Thursday, November 25, 2010

জিন এবং মিম

সতর্কবার্তাঃ লেখাটি নিজ দায়িত্বে পড়ুন। লেখাটি পড়ার পর আপনার মস্তিষ্ক একটি ভাল/খারাপ মিম দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। উক্ত মিম আপনার জীবনের গতিপথ বদলে দিতে পারে যেটা আপনার জন্য ভাল/খারাপ হতে পারে। যদি ভালো হয় তার কৃতিত্ব যেমন আপনার, কারণ মিমটি আপনি গ্রহন করেছেন, তেমনি খারাপ হলেও দায়িত্ব আপনার। লেখকের এখানে কোন দায় নেই।

অমরত্বের ইচ্ছে মানুষের সব সময়। মানুষ কোন না কোন ভাবে চায় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। এই সেদিন আমার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটি হু হু করে কাঁদছিলো মৃত্যু ভয়ে। সে মরতে চায় না। এই বয়সেই তার মাঝে মৃত্যু ভয় চলে এসেছে। আমি জানতে চাইলাম কেন তুমি এতো ভয় পাচ্ছো? ভয়টা কিসের? সে জবাব দিল, মারা গেল তার ঘুম আর ভাঙ্গবে না, সে আর কোন দিন খেলা করতে পারবে না, সে আর কোন বন্ধুর সাথে কথা বলতে পারবে না, এটা সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। একটু ভাল ভাবে খেয়াল করে দেখুন এখানে কিন্তু নরকের কোন ভয় নেই। তাহলে দেখতে পারছেন যে কোন প্রকার নরক নামক বস্তুর ভয় ব্যতীতও একজন স্বাভাবিক মানুষের মনে মৃত্যু ভয় চলে আসতে পারে। তারজন্য ধর্ম পর্যন্ত যেতে হয় না। এরকম মৃত্যু ভয়ই হতে পারে একজন দয়ালু ঈশ্বর নামক চিন্তার শুরু।

যা হোক, দু’ভাবে মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। একঃ তাঁর নিজের জিনের প্রতিলিপি তৈরীর মাধ্যমে, দুইঃ তার নিজের বিশ্বাস/আদর্শ/সংস্কৃতি/ভাষা/ ইত্যাদী মিমের প্রতিলিপ তৈরীর মাধ্যমে। জিনের প্রতিলিপ সম্ভব সেক্সের মাধ্যমে অথবা ক্লোনিং এর মাধ্যমে আর মিমের প্রতিলিপ সম্ভব মস্তিষ্কের মাধ্যমে। জিন এবং মিম এই দু’টোর প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যমেই কেবলমাত্র নিশ্চিত করা যায় যে একজন মানুষের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি তৈরী হয়েছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে কোন ভাবেই একজন মানুষ তার সম্পূর্ণ প্রতিলিপি রেখে যেতে পারে না। ক্লোনিং এর ফলে জিনের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি সম্ভব হলেও যে মিমের প্রতিলিপি একই হবে তার নিশ্চয়তা নেই। যে কারণে টুইন বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জেনেটিক বৈশিষ্ট একই থাকলেও তাঁদের চরিত্র ভিন্ন হতে পারে। আবার সেক্সের ফলে জিনের যে প্রতিলিপ তৈরী হয় সেখানে কখনই বাবা/মার একশত ভাগ প্রতিলিপি আসে না।

আমরা যদি ক্লোনিং এর প্রসঙ্গকে আপাতত বাহিরে রাখি, তবে সেক্সই কেমাত্র উপায় জিনের প্রতিলিপি জন্য। তেমনি মিমও কেবলমাত্র প্রতিলিপি তৈরী করতে পারে যদি সে কোন মস্তিষ্কের সংস্পর্শে আসে। যেমন আপনি যদি নির্দিষ্ট কোন সংস্কৃতি/ভাষা/বিশ্বাস এর কথা কোনদিন নাই শুনেন তবে সেই মিমটি সম্পর্কে কোন ধারনাই আপনার মস্তিষ্কে থাকবে না। একটি মিম মস্তিষ্কে তার প্রতিলিপ তৈরী করতে পারে আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। চোখ, কান, ত্বক, ঘ্রাণ, এগুলোর মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকেই তাহলে আমরা মিম হিসেবে সংঙায়িত করতে পারি। যিনি বর্ণান্ধ তার মস্তিষ্কে রঙের কোন ভিন্নতা নেই। তাই মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট কোন মিমের সংস্পর্শে না আসলে মস্তিষ্কে সেই মিমের প্রতিলিপি তৈরী হয় না। মিমের সংস্পর্শে আমরা প্রতিনিয়তই আসছি। এই যে লেখাটি পড়ছেন, আপনি একটি মিম পাচ্ছেন। একটি বই পড়ছেন, মুভি দেখছেন, টিভি/রেডিও দেখছেন/শুনছেন প্রতিনিয়ত মিমের সংস্পর্শে আসছেন। বাবা-মা সন্তাদের সব সময় কোন না কোন মিম দিচ্ছেন। আপনার বন্ধু/বান্ধব, স্কুল/কলেজ, অফিস/আদালত সব কিছু হতে আপনি মিম পাচ্ছেন।

এখন কে বেশি শক্তিশালী তাহলে? জিন নাকি মিম? প্রশ্নটির জবাব পেতে হলে আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে কার প্রতিলিপি তাহলে বেশি তৈরি হচ্ছে? কে বেশি ছড়িয়ে দিতে পারছে নিজেকে? সেক্সের দ্বারা আপনি আপনার নিজের জিনের কতগুলো প্রতিলিপি তৈরি করতে পারছেন? চেঙ্গিস খানের মত হলেও এক জীবন বেশি হলে একশত সন্তান রেখে যেতে পারলেন একাধিক স্ত্রীর ঘরে। তারপরেও কথা থাকে - জিনের প্রতিলিপি কখনই নিজের একশত ভাগ হয় না এবং জিনের প্রতিলিপি হলেই মিমের প্রতিলিপি তৈরি হয় না। অন্যদিকে মিমের প্রতিলিপি আপনি যে কারোর মাঝেই ছড়িয়ে দিতে পারেন, তার জন্য নিজের জেনেটিক প্রতিলিপির দরকার নেই। যে কারণে খুব সহজেই একটি মিম কোটি কোটি মানুষের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যেতে পারে।

তাহলে বুঝতেই পারছেন কেন মানুষ আজ এগিয়ে গিয়েছে অন্য জীবের তুলনায়। অন্যান্য প্রাণী গোষ্ঠী যেখানে কেবলমাত্র জিনের প্রতিলিপি তৈরি করে সেখানে মানুষ জিনের প্রতিলিপির সাথে মিমেরও প্রতিলিপি তৈরি করে। জিনের মিউটেশান যেখানে খুব ধীর গতির, মিমের মিউটেশান সেখানে দ্রুত গতির। যে কারণেই বিবর্তনের এক দম শেষ দিবসে এসে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হলেও খুব সহজেই মানুষ অন্যান্য জীব গোষ্ঠি্কে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে হুর হুর করে, এবং এ সম্ভব হয়েছে মস্তিষ্কের এই মিমের প্রতিলিপির ফলেই। মানুষ তার পূর্ব-অভিজ্ঞতায় অর্জিত জ্ঞান তার পরবর্তী জেনেরাশানে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, এবং ছড়িয়ে দিতে পেরেছে অন্যান্য মানুষের মাঝেও।

মিমের বিবর্তন দ্রুত গতির হলেও, সেটিও প্রাকৃতিক নির্বাচনের বাহিরে নয় মোটেই। যে মিমগুলো সময়ের প্রেক্ষিতে টিকে থাকায় সহায়তা করেছে তারাই নির্বাচিত হয়েছে এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছে। ধর্ম, নৈতিকতা, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ সহ যে কোন মিমকেই এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব। প্রতিটি মিমের কাজ হচ্ছে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া, নিজের প্রতিলিপি তৈরি করা। মানুষের মস্তিষ্কই এই মিমগুলো ধারণ করে আবার বর্জন করে। সময়ের প্রয়োজনেই ধর্মগুলো এসেছিলো, আবার তাঁদের কার্যকারিতা না থাকলে সময়ের প্রয়োজনেই সেগুলো বিবর্তিত হবে অথবা হারিয়ে যাবে।

জিনপুলে যেমন পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে যাওয়ার আগে ড়্যান্ডম মিউটেশান ঘটে তেমনি মিমের ক্ষেত্রেও ঘটে। এক বাংলা ভাষাই যদি দেখেন তবে দেখবেন যে আজকে আমরা যে ভাষায় কথা বলি সে ভাষাতেই কি আমাদের কয়েক পূর্বপুরুষ আগের মানুষেরা কথা বলতো। সামনের দিকে ভাষার মাঝে আরো পরিবর্তন আসবে, এবং সেটাই স্বাভাবিক। এখন যখন কোন মিম নিজেকে অবিকৃত রেখে ছড়াতে চায় তখনই কনফ্লিক্ট শুরু হয়। ধর্ম যদি নিজেকে বিবর্তিত করতে পারতো তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু ধর্ম যখন নিজেকে ঈশ্বরের বাণী বলে অবিকৃত থাকতে যায়, তখনই সে অন্যান্য মিউটেডেট মিমের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।

মিউটেশন অবশ্যই নন-মিউটেশানের তুলনায় উন্নত হবে। মিউটেশানের ফলে জিনপুলে, মিমপুলে অনেক বৈচিত্র থাকে। যার ফলে যে কোন প্রতিকূল পরিবেশে এই বৈচিত্রের মধ্য হতে কারোর না কারোর টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকবে এবং তারাই পরবর্তীতে বংশবৃদ্ধি করবে। কিন্তু সবাই একই রকমের হলে পুরো মানবকূল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে কারণে আমার ব্যক্তিগত অভিমত মানব ক্লোনিং যদি কোন দিন বৈধ হয়ও, সেক্সের ফলে সৃষ্ট মানব জাতিই টিকে থাকবে, ক্লোনিং মানব জাতি নয়। এ কারণেই আমি মনে করি ঐশ্বরিক ধর্মের মিমগুলো যদি সময়ের সাথে নিজেদেরকে বিবর্তিত না করে তবে তারা অন্যান্য প্রগতিশীল মিমগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এবং হারিয়ে যাবে মানুষের মস্তিষ্কে থেকে যেভাবে হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী হতে বহু ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি। ধর্মে বিশ্বাসীরা এই বাস্তবতা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততই সভ্যতার জন্য মঙ্গল হবে।

নোটঃ উপরের সতর্কবার্তাটির ধারণাটি “Virus of the mind : the new science of the meme / Richard Brodie ” বইয়ের সূচনা থেকে ধার করা। মিম নিয়ে নিজেও মাত্রই জানছি। তাই স্বতস্ফুর্ত আলোচনা হোক এটাই কামনা করি। আর আমি ঠিক করেছি এখন থেকে কোন বিষয় নিয়ে লিখলে লেখার সাথে চেষ্টা করবো একটি হলেও মূল বই সংযুক্ত করে দিতে যেন আগ্রহী পাঠকেরা চাইলে মূল বই থেকে আরো বেশি জানতে পারে। শুধু লেখার উদ্দেশ্য এবং নিজের আনন্দের জন্যই আমার কোন লেখা নয়। লিখি যেন নিজের চিন্তাগুলো অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি। তাই অনুরোধ থাকবে মূল বইগুলো পড়ুন। নিজেও জানুন এবং অন্যের মাঝেও ছড়িয়ে দিন। এভাবেই একমাত্র সম্ভব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর মিমগুলোকে আউট নাম্বার করা।

আজ মিম নিয়ে একটি বই দিচ্ছি যেটি আমার ইস্নিপ্স ফোল্ডার থেকে ডাউনলোড করতে পারবেন Darwinizing culture : the status of memetics as a science / edited by Robert Aunger ; with a foreword by Daniel Dennett. । বইটি্র সফট কপি জোগাড় করে দেওয়ার জন্য সচলায়তন সদস্য শুভাশীষকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।

Wednesday, November 17, 2010

এলোমেলো চিন্তাঃ “ডোপামিন” তার নাম

ডেনিয়েল ডেনেটের Breaking the spell বইটা পড়ে Lancet liver fluke পরজীবির কথা জানতে পারি যেটার কথা আমার এলোমেলো চিন্তাঃ বিবর্তনময় জীবন এই লেখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম। এই পরজীবি তার জৈবিক চক্রের একটি ধাপে যখন পিঁপড়ের মাঝে বংশবৃদ্ধি করে তখন এক পর্যায়ে পিঁপড়ের মস্তিষ্কের দখল নিয়ে ফেলে এবং পিঁপড়েটিকে এক প্রকার সুখানুভুতি প্রদানের মাধ্যমে বাধ্য করে পরজীবিটির নিজ উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করার জন্য। ডেনেট মানুষের বিশ্বাস ব্যবস্থাকে সেরকম কিছু পরজীবির সাথে তুলনা করেছেন। মানুষ নিজের বিশ্বাসকে রক্ষার্থে নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে পারে, টুইন টাওয়ারে বিমান নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পারে।

কিন্তু বিশ্বাস একটি এবস্ট্রাক্ট কিছু। তাহলে বিশ্বাস কিভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে আত্মহননের মত কাজে। নিশ্চয়ই মানুষের মস্তিষ্কেও সেরকম কোন একটি পোকার অবস্থান রয়েছে যেটি উক্ত কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। হয়তো সেই পোকাও আমাদেরকে এক প্রকার সুখানুভুতি প্রদান করে। যে কারণে কোন কাজ করলে ভাল লাগে, অথবা কোন কাজ করতে ইচ্ছে করে না। নিজের মাঝে এই পোকার অবস্থান সব সময় টের পাই। এই পোকাই বাধ্য করে নিজের আসল গবেষণা ফেলে বনের মোষ তাড়ানোর গবেষণা করতে, ব্লগে লেখা দিতে। এই পোকাই বাধ্য করে সমাজ, বিশ্ব জগৎ ইত্যাদী নিয়ে চিন্তা করতে। আমার বিশ্বাস এ রকম পোকার অস্তিত্ব কম বেশি সবার মাঝেই রয়েছে।

বহুদিন পোকাটির অস্তিত্বটি টের পেলেও, তার পরিচয় জানার সুযোগ হয়নি। সম্প্রতি পোকাটির নাম জানতে পারলাম। এর নাম নাকি ডোপামিন (উচ্চারণটি কি ডোপামাইন হবে?) মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে এই ডোপামিনের তারতম্যের ফলেই নাকি মানুষের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, চেতনা, অনুভূতি, কার্মদক্ষতা , কর্মস্পৃহা ইত্যাদীর তারতম্য দেখা যায়। এই ডোপামিনের অভাবেই পারকিনসসের মত রোগ হয় যার এক মাত্র চিকিৎসা হচ্ছে ডোপামিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া। আবার এর অত্যাধিকতার জন্য অটিজম, সিজ্রোফেনিয়া, হাইপার একটিভিটি, ম্যানিয়া এর মত মানসিক রোগগুলো দেখা যায়। এর প্রভাবেই নাকি মানুষের মাঝে অত্যাধিক বুদ্ধিমত্তা কিংবা ধর্ম/বিশ্ব নিয়ে বেশি চিন্তা করার প্রবনতা, তীব্র প্রতিযোগিতা মনোভাবাপন্নতা দেখা যায়। এর আধিক্যের ফলে অতিপ্রাকৃতিক অনুভূতি লাভ হয়, যার ফলে স্বর্গ/নরক কিংবা ঈশ্বরের দেখা পাওয়ার মত অনুভূতি হতে পারে। এরই ফলে মানুষের মাঝে দূর ভবিষ্যৎ কিংবা মহা বিশ্বের মত বৃহৎ আকার নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হয়। আজ পর্যন্ত যত সমর নায়ক, ধর্ম অবতার, কিংবা দার্শনিক, বিজ্ঞানী এসেছেন তাঁদের মাঝে এই ডোপামিনের আধিক্য ছিল বলে ধারনা করা হয়।

এটি মানুষের সকল কর্মস্পৃহার মূলে। এটি কাজ করে পূরষ্কারের ভিক্তিতে। অর্থাৎ কোন কাজ ভাল লাগলে পুরষ্কার হিসেবে মস্তিষ্কে এই বস্তু কিছুটা নিঃসৃত হলে আপনার মনে এক ধরণের ভাল লাগা অনুভুত হবে যার ফলে আপনি আবার সেই কাজটি করার জন্য উদ্বুদ্ধ হবেন। কোন ভাল খাবার খেলে বা সেক্সের ফলে, বা কোন ভাল কাজের ফলে এই বস্তুর নিঃসরণ ঘটে যার কারণে আমরা তৃপ্তিলাভ করি। একই রকমের অনুভুতি কোকেন বা উদ্দিপক নানান ড্রাগের মাধ্যমেও পাওয়া যায়। শুধু ভাল কাজেই যে তা নয়, আক্রমনাত্মক কাজেও এই বস্তুর নিঃসরণ যুক্ত। মোটকথা এই বস্তুই আমাদের মাথার সেই পোকা যে কিনা আমাদেরকে তার পথে চালায়।

মানুষের আজকের এই আধুনিক বুদ্ধিমত্তার মানুষ হয়ে উঠার পেছনেও নাকি মস্তিষ্কের আকারের তুলনায় এই ডোপামিনের প্রভাবই বেশি বলে এক পক্ষের ধারনা। আমি নিশ্চিত এই লেখাটি আমাদের সেই “নেচার ভার্সেস নেচার” বিতর্ককে আবার উসকে দিবে। এই পক্ষের ধারনা যে মানুষের মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি হলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তা সেভাবে বাড়েনি বরং ২ লক্ষ বছর আগে আধুনিক মানুষের উৎপত্তি হলেও তখনকার তুলনায় মানুষের মস্তিষ্কের আকার বেশি পরিবর্তন হয়নি, বরং কিছুটা কমেছে। কিন্তু আমরা দেখি যে জেনেটিকালি খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তার বেশ উন্নতি হয় এবং সেই উন্নতির পেছনে এই ডোপামিনের অবদানকেই ধরা হচ্ছে। আধুনিক মানুষের আগেও আমাদের যে পূর্বপুরুষেরা ছিল তাঁদের মাঝেও এই ডোপামিন ছিল কিন্তু তার পরিমান আজকের মানুষদের তুলনায় প্রায় অর্ধেক ছিল। এই পক্ষের ধারনা মানুষের আদি পূর্বপুরষদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের যাত্রা শুরু হয় মূলত মাংসাশী প্রাণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে এবং গায়ের লোম কমা শুরুর পর থেকে। ডোপামিন মানুষের দেহ হতে তাপ দ্রুত কমাতে সাহায্য করে। তাই গায়ের লোম কমার পাশাপাশি সে সময় ডোপামিনের পরিমানও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শুধু মাংসাশী প্রাণী এবং তাপ ঝরানোর কারণেই ডোপামিনের পরিমান অনেক বেশি হয়ে যায় না। তাই পরবর্তী ১০০,০০০ বছরে মানুষের বুদ্ধিমত্তায় তেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। সেই সময়কার তাঁদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সেই ধারনাই দেয়।

প্রায় ১৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ হাজার বছরের দিকে কিছু আধুনিক মানুষ পূর্ব আফ্রিকা হতে দক্ষিণের দিকে মাইগ্রেট করে এবং এই সময় সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি থাকার কারণে এবং বড় বড় মাংসাশী প্রাণীর অভাবের কারণে তাঁদের খাদ্যাভাসে সামুদ্রিক প্রাণী/মাছ নিয়ে আসে। সামুদ্রিক মাছ খাদ্য তালিকায় প্রবেশের কারণে তাঁদের শরীরে আয়োডিনের পরিমান বৃদ্ধি পায়। এই আয়োডিনের ফলে, থাইরয়েড প্রন্থির প্রভাবে সেই মানুষের মাঝে ডোপামিনের মাত্রা আরেক দফা বৃদ্ধি পায়। যার কারণে এই সময়কার মানুষের পাথরের যন্ত্রপাতিগুলো উন্নত হয়। যন্ত্রপাতিগুলো আগের চেয়ে ধারালো, এবং কার্যকর হয়। এই সময় মানুষের মাঝে বিভিন্ন সংস্কৃতি, আর্ট এগুলোও দেখা যায়। কিন্তু শুধু্মাত্র মাংসভোজ কিংবা আয়োডিনের প্রভাবেই আজকের এই ডোপামিনের সভ্যতা নয়।

এই সময়টাতেও মানুষ মূলত শিকারী এবং সংগ্রাহক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতো। মানুষ তখনো পুরোপুরি কৃষিনির্ভর হয়ে উঠেনি, যে কারণে তখনো জনসংখ্যার পরিমান বেশি হয়নি এবং এর ঘনত্ব অনেক কম ছিল। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সেভাবে প্রবল হয়ে দেখা দেয়নি। কিন্তু প্রায় ৮০০০ বছর আগে এই শিকারী গোত্রের বেশির ভাগ মানুষই পাকাপাকি ভাবে কৃষিকাজ শুরু করে এবং যার ফলে সমাজের চরিত্র দ্রুত বদলাতে থাকে। জনসংখ্যার বিষ্ফোরণ ঘটে, জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়, বৃহৎ আকারে সমাজ, রাষ্ট্রের মত সংস্থা তৈরী হয়। মানুষের মাঝে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এই চরম প্রতিযোগিতাই মানুষের মাঝে ডোপামিনের পরিমান বৃদ্ধি করে এবং যার ফলে আমরা আজকের এই ডোপামিনিক সভ্যতা দেখতে পাচ্ছি।

ডোপামিনের বৃদ্ধির ফলে মানুষের মাঝে চরম প্রতিযোগিতা মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। লেখকের মতে আমরা এখন হাইপার ডোপামিনিক সময়ের মাঝে আছি। এর শুরু হয়েছে ইন্ড্রাসটিয়াল রেভুলেশানর পর থেকে বা আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরুর পর থেকে। মানুষ এখন আগেরকার যে কোন সময়ের তুলনায় বেঁচে থাকার জন্য সর্বোচ্চ প্রতিযোগীতার মধ্যে দিয়ে যায়। লেখক এই পর্যায়ে এসে অনেকটা দার্শনিক হয়ে যান। তিনি কামনা করেন এই হাইপার ডোপামিনিক সভ্যতা হতে রিভার্স প্রক্রিয়ায় আমরা আরেকটু কম ডোপামিন মাত্রার সভ্যতায় যেতে পারি কিনা সেই প্রশ্ন রেখে। ডোপামিন নিয়ে গবেষণা এখনো শুরুর দিকে। আশা করা যায় ভবিষ্যতে এই বস্তুর প্রভাব আরো ভাল করে বুঝা যাবে। বুঝা যাচ্ছে এর মাধ্যমেই মস্তিষ্কের আচরণকে আরো ভাল করে জানা সম্ভব হবে।

নোটঃ এই লেখাটি Fred H. Previc এর The Dopaminergic Mind in Human Evolution and History বই অবলম্বনে লেখা হয়েছে। আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আগ্রহীদেরকে উক্ত বইটি পড়ে দেখতে বলবো। সময়ের অভাবে পুরো বইটি অনুবাদ করা অসম্ভব আমার পক্ষে। এই লেখাটিকে সারমর্ম হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। তারপরেও মনে করি লেখাটি আরো ভাল হতে পারতো। আরো কিছু বিষয়ে বিস্তারিত লেখা যেতে পারতো। কিছু ছবি যুক্ত করা যেতে পারতো। কিন্তু সেগুলো সব করতে গেলে হয়তো লেখাটিই আর আত্মপ্রকাশ করতো না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে অন্তত কিছু হলেও লেখা উচিৎ মুক্তমনার পাঠক/লেখকদের জন্য। আমি মনে করি মানব মস্তিষ্কের আচরণ সুনির্দিষ্ট ভাবে বুঝার মাঝেই নীহিত রয়েছে মানব সভ্যতার ভবিষ্যত। সবশেষে মুক্তমনা ও সচলায়তনের সদস্য সিরাতকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই বইটির খোঁজ দেওয়ার জন্য। সিরাতের এই লেখাটির মাধ্যমেই প্রথম বইটির কথা জানতে পারি।

Monday, November 1, 2010

এলোমেলো চিন্তাঃ জীবনের উদ্দেশ্য এবং Inception

জীবনের উদ্দেশ্য কি? - এই প্রশ্ন মানুষের মনে প্রথম কবে আসে বলা মুশকিল। মানুষ যখন মূলত শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো তখন, নাকি যখন প্রথম কৃষিজীবি হয়ে উঠে তখন থেকেই এই প্রশ্নের উৎপত্তি। প্রশ্নের শুরু যখন থেকেই হোক সেই প্রশ্ন যে বংশপরম্পরায় আজো আমরাও বহন করে চলছি তার প্রমান পাই আজো সবার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজা দেখে। এই প্রশ্নের পেছনে কোন একক নির্দিষ্ট জাতি শুধু সময় ব্যয় করেনি- বলা যায় ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সকলেই কোন না কোন জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এর সবচেয়ে সহজ যে জবাবটি আমরা দেখি তা হল দু’স্বত্বা, দু’জগত এবং এক বা বহু সৃষ্টিকর্তার চিন্তাতে। এই বিশ্বাস মূলত নির্ভর করছে দেহ এবং আত্মা এই দুটি বিষয়ের উপর। দেহের মৃত্যুর পর আত্মার অমরণশীলতা এবং সে সাথে নুতন একটি জগতে প্রবেশ করা, এই ধারণার উপর ভিক্তি করে এই জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা।

সকলেই যে এই মতবাদে বিশ্বাসী তা নয়। তারা কোন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী নয় বা মৃত্যুর পরের কোন জগতেও বিশ্বাসী নয়। তাছাড়া, আধুনিক বিজ্ঞানেও মন বা আত্মার আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া/প্রতিক্রিয়ার মাঝেই মনের অবস্থান। মস্তিষ্কের মৃত্যুর মাঝে মনেরও মৃত্যু ঘটে। আত্মা যদি নাও থাকে সমস্যা রয়েই যায়, তা হলো এই জীবনের উদ্দেশ্য কি? কেনই বা এই পৃথিবী আর কেনই বা এত দ্বন্দ্ব।

এই কিছুদিন আগেও মানুষের কাছে এর জবাব ছিলনা। কিন্তু অধুনা জেনেটিক বিজ্ঞান, ণৃ-বিজ্ঞান, এবং জীববিজ্ঞানের ফলে মানুষ আজ তার নিজের বিবর্তন সম্পর্কে অতীতের চেয়েও অনেক বেশি জানে। জীববিজ্ঞানের শাখায় বিবর্তন আজ একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়। এটি শুধু জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ না থেকে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, জেনেটিক্স এর মত শাখাগুলোতেও আজ প্রয়োগ হচ্ছে। AIDS ভাইরাস বা সুপারবাগ ব্যাক্টেরিয়ার মত প্রাণঘাতী জীবগুলোর প্রতিষেধক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিবর্তনের জ্ঞানকে কাজে লাগানো হচ্ছে। মানুষের আচার/ব্যবহার বিশ্লেষণের জন্য, মানুষের বিভিন্ন মানসিক রোগ অথবা অটিজমের মত রোগগুলোকে বিশ্লেষণের জন্য মনোবিদ্যায় বিবর্তনকে কাজ লাগানো হচ্ছে। এ ছাড়া মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ আচরনকে বোঝার জন্য কিংবা জাতিগত দ্বন্দ্ব নিরসনে, বা অর্থনীতির মত বিষয়গুলোকে বোঝার জন্যেও আজ বিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে বিবর্তনীয় সমাজবিজ্ঞান,বিবর্তনীয় অর্থনীতির মত বিষয়গুলোর চালু হয়েছে।

আজকের এই লেখায় বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার আলোকে জীবনের উদ্দেশ্য তুলে ধরার কিছুটা চেষ্টা করবো। বিবর্তনীয় মনোবিদ্যা অনুসারে মানুষের মস্তিষ্ক তার অন্যান্য অঙ্গের মতই দীর্ঘ বিবর্তনের একটি ফসল। অন্যান্য প্রাণীদের থেকে আমরা এগিয়ে গিয়েছি আমাদের এই বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মস্তিষ্কের জন্য। এ জন্য আমাদের মস্তিষ্কের আকার অন্যান্য প্রাণীদের থেকে বড়। বিবর্তনের উপর প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য মুক্তমনা ও সচলের লেখক বন্যা আহমেদের বিবর্তনের পথ ধরে বইটি পড়তে পারেন। এটি বাংলা ভাষায় বিবর্তনের উপর লেখা একটি অসাধারণ বই। খুব সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য বইটি লেখা হয়েছে। আমার নিজের প্রাথমিক জ্ঞানও লাভ করি এই বই থেকে।

আমাদের দেহকে যদি একটি যন্ত্র হিসেবে চিন্তা করেন এবং তাহলে মস্তিষ্ককে চিন্তা করতে পারেন একটি গণনা কেন্দ্র হিসেবে যেটি বিশ্বের আধুনিকতম কম্পিউটারের চেয়েও শক্তিশালী। শুধু এর ভেতর তারের জালের পরিবর্তে রয়েছে অসংখ্য সুক্ষ্ণ নার্ভ। মানুষকে চিন্তা করতে পারেন একটি রোবট হিসেবে, শু্ধু এর পার্টসগুলো তৈরী হচ্ছে মাংস দিয়ে। মস্তিষ্ক হচ্ছে আমাদের দেহের প্রসেসিং ইউনিট। যে কোন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য চলে যায় মস্তিষ্কে এবং মস্তিষ্ক সেটি প্রসেস করে, তার পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে করণীয় নির্ধারণ করে সেটা পাঠিয়ে দেয় যথাযথ প্রত্যঙ্গের কাছে।

মস্তিষ্ক আবার একই সাথে একটি প্রসেসিং যন্ত্র এবং তথ্য সংরক্ষনের স্থান। আমাদের যাবতীয় তথ্য এখানে সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু মস্তিষ্কের আকার যেহেতু সীমাবদ্ধ তাই সকল তথ্যই আমাদের পক্ষে ধারণ করা সম্ভব হয় না। কোন তথ্য সংরক্ষন করা হবে তার জন্য মস্তিষ্ক পূর্ব অভিজ্ঞতা, কতটা মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, তথ্যের প্রয়োজনীয়তা এসবের উপর ভিক্তি করে একটি রেটিং করে এবং সেভাবে সে সংগ্রহ করে। এ জন্য দেখা যায় যে অনেক কিছুই আমরা দেখি/শুনি/পড়ি কিন্তু সকল তথ্য আমাদের স্মরণ থাকে না। আবার সকল তথ্য একই গভীরতায় সংরক্ষিত হয় না। যে সব তথ্য আমরা দৈনন্দিন ব্যবহার করি সেগুলো প্রথম ধাপেই রাখা হয় যেন সহজেই চাইলে পাওয়া যায়। আর যেগুলো সচারচর ব্যবহার করা হয়না সেগুলো একটু গভীরে রাখা হয়। অনেকটা একটি দোকানের জিনিস সংরক্ষনের মত। চালু আইটেমগুলোকে হাতের নাগালেই রাখা হয়, আর একটু কম চালু বা দামী জিনিসগুলোকে গোডাউনে অথবা বিশেষ স্থানে রাখা হয়।

মানুষের নানান আচার/ব্যবহার মস্তিষ্কের গঠন/গড়ন এবং এর কার্যপদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত করা সম্ভব। অবশ্য এই বিষয়গুলো এখনো নুতন, প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে এই বিষয়ের উপর। বিশেষ করে মস্তিষ্কের স্ক্যানিং প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হবার পর বিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছে মস্তিষ্কের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে আরো বিষদভাবে জানার জন্য। আশা করা যায় একদিন মানুষ সেই লক্ষ্যে পৌছতে পারবে। তখন হয়তো মানুষের কছাকাছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরী করা সক্ষম হবে। মস্তিষ্কের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো বেশি জানার জন্য Evolutionary psychology বা শুধু psychology এর উপর যে কোন বই দেখতে পারেন আগ্রহী পাঠকগণ।

আমি এবার একটু লম্ফ দিব আরেকটি বইয়ের গল্পে। এই বইটির লেখক ডেনিয়েল ডেনেট, তিনি বর্তমান কালের একজন দার্শনিক। তিনি Tufts University এর একজন অধ্যাপক। কাজ করেন মূলত মনোবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, দর্শন নিয়ে। সম্প্রতি তার একটি বই পড়লাম- ব্রেকিং দ্যা স্পেলঃ রিলিজিয়ন এজ এ ন্যাচারাল ফেনেমেনন। তিনি বইটিতে মূলত দেখাতে চেষ্টা করেছেন কিভাবে আমাদের মস্তিষ্কের মাঝে বিদ্যমান কোন আইডিয়া/ধারণা আমাদেরকে চালিত করে। এই আইডিয়া মস্তিষ্কের মাঝে অবচেতন ভাবে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। যদি আইডিয়াই একজন মানুষের চালিকা শক্তি হয়ে যায় তবে সেটা অনেকটা ভাইরাসের মত প্রাণঘাতী হতে পারে। যেমনটি হয়ে থাকে Lancet liver fluke নামক পরজীবিতে আক্রান্ত পিঁপড়ে। এই পরজীবিটি তার জৈবিক চক্রের একটি ধাপে গিয়ে শামুকের লালা হতে চলে যায় পিঁপড়ের পাকস্থলীতে। তারপর সেখানে বংশ বৃদ্ধি করে এক পর্যায়ে পিঁপড়ের নার্ভ এর দখল নিয়ে ফেলে। পরজীবিটিকে তার বংশবৃদ্ধির লক্ষ্যে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে কোন গবাদীপশুর পাকস্থলীতে। এই অবস্থায় পরজীবিটি পিঁপড়েটিকে বাধ্য করে কোন লম্বা ঘাসের চুঁড়ায় উঠার জন্য। পিপড়েটি ঘাসের আগায় উঠে বসে থাকে যতক্ষন না সে কোন গবাদীপশুর পেটে যায়। এভাবেই চলতে থাকে। পিঁপড়েটি নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সে কোন প্রতিরোধ করতে পারে না। কথা হল পিঁপড়েটিকে কিভাবে চালিত করে সেই পরজীবিটি। পিঁপড়েটিকে একধরণের সুখানুভুতি প্রদান করে পরজীবিটি যদি সে সেই লম্বা ঘাসের চূড়ায় উঠে। সেই অনুভূতির লোভে পিঁপড়েটি এই কাজে বারংবার প্ররোচিত হয়।

এই বিষয়টিকেই আরেক বিবর্তনীয় বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার সেলফিশ জিন বইয়ে বলেছেন সেলফিশনেস অফ জিন। জিন তার নিজের বংশবৃদ্ধিতে তার হোস্টকে মরে যেতেও উদ্ধুদ্ধ করে। যে কারণেই প্রাণী জগতের মাঝে পরোপোকারীর মত ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। সে কারণেই একজন মা/বাবা তাঁদের নিজের জীবন দিয়ে হলেও নিজের সন্তানকে রক্ষা করে। এই বিষয়গুলোই প্রকাশ করে জিনের স্বার্থপরতার বিষয়টি। সুতরাং বিবর্তনীয় দৃষ্টিতে যদি দেখি তবে আমাদের জীবনের আসলে উদ্দেশ্য একটিই, তা হচ্ছে নিজের জিনকে রক্ষা করা এবং এর বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। প্রচন্ড হতাশার, কি বলেন?


তবে এটা হচ্ছে ম্যাক্রো লক্ষ্য। একজন ইন্ডিভিজুয়ালের কাছে সেই চালিকা শক্তি থাকে না। তাহলে জিন কিভাবে তার নিজের উদ্দেশ্যে পৌঁছে, সেটা একটি প্রশ্ন। এখানেই আসে আমাদের মস্তিষ্কের কাজ। যেহেতু মস্তিষ্ক হচ্ছে আমাদের মূল প্রসেসিং ইউনিট তাই আমাদের অবচেতন মন সেই লক্ষ্যে সেট করা রয়েছে। অন্যভাবে, সেই পিঁপড়েটির সাথে তুলনা করলে দেখবেন যে আমাদের মস্তিষ্কের এই অবচেতন অংশের কাজ হচ্ছে আমাদেরকে সেই সুখানুভুতি প্রদানের মাধ্যমে তার নিজের লক্ষ্য কাজ করা। এখন একজন মা/বাবা নিজের মৃত্যু হলেও যদি জানেন যে তার সন্তান রক্ষা পেয়েছে বা পাবে তিনি কোন কষ্ট অনুভব করেন না। আবার ধরুণ, সেক্স এর মাধ্যমে এক ধরণের সুখানুভুতি লাভ হবে, যার তাড়নায় আপনি সে কর্মে নিমজ্জিত হবেন আর জিন তার বংশবৃদ্ধি করবে। অবশ্য পরিবার পরিকল্পনার কথা জিন ভাবেনি। আপনি/আমি লেখালেখি করে আনন্দ পাই, কেউ আড্ডা মেরে আনন্দ পাই, কিংবা ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ হই, সবই আমাদের মস্তিষ্কের সেই ভাল লাগাকে ম্যাক্সিমাইজ করার জন্য। দিন শেষে একটি কাজ করে যদি দেখেন যে আপনি আসলে কোন সুখ পাচ্ছেন না, তখন পুরো সময়টাই অপচয় হয়েছে বলে ভাবি। তাহলে মাইক্রো লেভেল জীবনের উদ্দেশ্য ধরতে পারি এই ভাল লাগার অনুভুতিকে ম্যক্সিমাইজ করা। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তেই আমরা সব সময় হিসেব করতে থাকি সচেতনে বা অবচেতনে কতটুকু ভাল লাগা বা মন্দ লাগা অর্জন করেছি। আর তার পরিপ্রেক্ষিতেই ভাবি জীবনটি কি অর্থহীন না অর্থহীন নয়। আমার কাছে তাই জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিটি মুহুর্তকে উপভোগের মাধ্যমে ভাল লাগার অনুভুতিকে ম্যক্সিমাইজ করা, খারাপ অনুভুতিকে মিনিমাইজ করা, এবং তার মাধ্যমে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার প্রেরণা লাভ করা।

এখন আসুন আরেকটু জটিল ভাবনায়। মস্তিষ্কের মাঝে এই অবচেতন অংশে আমি/আপনি যদি একটি ধারণা পাই যেটি ধারণাটির জন্য ভাল কিন্তু আমার বা অন্যের জন্য ক্ষতিকর সে ক্ষেত্রে কি হবে? ধরুণ, জিহাদী ধারণা। এরকম একটি ধারণা আপনার নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে আত্মহত্যার মত কাজে, আবার সেই সাথে এটি ক্ষতিকর সমাজের জন্য কারণ এতে অনেক নিরীহ মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে। এবং এরকম একটি ধারণা কিন্তু সহজেই আপনার মাঝে প্রতিস্থাপিত হতে পারে আপনার চারিপাশ হতে, আপনার পরিবার হতে, বা আপনি নিজেও যে কোন ভাবে এই ধারণায় উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। এখানেই চলে আসে ইনসেপশান ছবিটির কথা। ছবিটিতে এই বিষয়টিই দেখানো হয়েছে যে কিভাবে একটি ক্ষুদ্র ধারণা আপনি অন্যজনের মাঝে প্রতিস্থাপন করতে পারেন। ছবিটির বানিজ্যকরণের লক্ষ্যে সেখানে নানান বিষয়, যেমন স্বপ্ন, স্বপ্নের মাঝে স্বপ্ন নিয়ে এসেছে, থ্রিল এসেছে। তবে মূল উদ্দেশ্য ছিল “একটি ক্ষুদ্র ধারণার প্রতিস্থাপন”, যেটা অন্য একজন মানুষের স্বপ্নের মাঝে করা হয়েছে এমন ভাবে যেন সেই ব্যক্তিটি বুঝতে না পারে যে তার মাঝে অন্য কেউ কোন ধারণা প্রতিস্থাপন করেছে।

এখন যদি আমরা আমাদের নিজস্ব জগতের কথা চিন্তা করি তবে এরকম ধারণার ইনসেপশান কিন্তু অহরহই হচ্ছে। এই যেমন আমার আজকের লেখা আপনার মাঝে একটি ক্ষুদ্র ধারণা প্রতিস্থাপিত করতে পারে। এভাবে অবচেতন মনে বিদ্যমান নানান ধারণা ছাড়াও শিশুকাল হতে এটা করা খারাপ/এটা করা যাবে না এরকম নানান ধারণার ইনসেপশান চলতেই থাকে, যেটা অনেক বড় হয়েও অনেকেই কাটাতে পারি না। আর সেই ধারণা যখন বদ্ধমূল হয়ে যায় সেটা পরিণত হয় একটি স্থির বিশ্বাসে এবং তখন বিশ্বাসই হয়ে যায় চালিকা শক্তি। তখন আরেকজনকে বিচার করি নিজের বিশ্বাসের আয়নায়, একজন মানুষ হিসেবে নয়। ডেনেট এই বিশ্বাস ব্যবস্থাকেই বলেছেন ভাইরাসের মত।

এ কারণে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা যে কোন বিশ্বাসকে সংরক্ষনের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে। আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দেই, আমরা দেশের জন্য প্রাণ দেই, আমরা মানবাধিকারের জন্য প্রাণ দেই, আমরা ধর্মের জন্য প্রাণ দেই। আমরা বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়ে বন্ধুর সাথে তর্কে লিপ্ত হই, বন্ধুত্ব ছিন্ন করি। আমরা সেই বিশ্বাসকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে আনন্দ পাই। কারণ বিশ্বাসই তখন চালিকা শক্তি। তাই সতর্ক থাকুন, নিজের বিশ্বাস সম্পর্কে। অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার আগে ভাবুন, আপনার ধারণাটি কি প্রাণঘাতী নাকি মানুষের কল্যাণমূখী। আপনার সন্তানের মাঝে কোন ধারণার ইনসেপশানের আগে একটি বার ভেবে, তারপর সিদ্ধান্ত নিন। কারণ একমাত্র কল্যাণমূখী ধারণাই দিতে পারে একটি সুন্দর ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং একটি সুন্দর পৃথিবী। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার চেষ্টাই, তাই, আমার লক্ষ্য।


কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

১। বিবর্তনের পথ ধরে লেখক বন্যা আহমেদ
২। Evolutionary psychology: an introduction by Lance Workman and Will Reader
৩। Breaking the spell: Religion as a natural phenomenon by Daniel Dennett
৪। The selfish gene by Richard Dawkins
৫। Inception (a movie released in 2010)
৬। Wikipedia