দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষলে কি হয় তা মনে হয় আমরা এখন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি। আমাদের লজ্জা যে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো করিইনি উল্টো তাঁদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। যে কারণে আজ তাঁরা বলতে সাহস করে যে স্বাধীনতায় তাঁদেরও অবদান আছে। আমরা জাতি হিসেবে কতটা খারাপ হয়ে যাচ্ছি সেটা আর কষ্ট করিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিতে হচ্ছে না। যে জাতিতে যুদ্ধাপরাধীরা, দুর্নীতিবাজরা গলা উচিয়ে চলে আর সৎ মানুষেরা হয় সমাজে অচল, সে জাতি কিভাবে পৃথিবীতে টিকে থাকবে আমি জানি না। এখনো সময় আছে, আমাদের জাতিকে গড়ে তোলবার। যার জন্য এই প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে, কাজ করতে হবে। ভুলে যেতে হবে আমাদের আগের প্রজন্মের ব্যার্থতার কথা। তাঁরা পারেননি, হয়তো তাঁদের সীমাবদ্ধতা ছিল। তাঁরা হয়তো স্বাধীনতা এনে দিয়েই তাঁদের দায়িত্ব শেষ মনে করেছে।
আজকে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল, মিডিয়া সকল ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলে আমরা যেটা সুবিধে পাচ্ছি তা হল সমমনাদের একত্রে পাওয়া- যা অতীত কালে এভাবে সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারতো না। আজ পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত হতে যে কেউ যে কোন প্রকল্প হাতে নিতে পারে এবং তার জন্য সকলে মিলে কাজ করতে পারি। যে কারণে দেশ হতে বাহিরে এসেও কেউই ভাবে না সে দেশের বাহিরে রয়েছে। আমি যেখানেই থাকি না কেন প্রিয় জন্মভূমির জন্য টান কখনো মলিন হবার নয়।
এই মুহুর্তে আমাদের যেটা করা দরকার ব্লগে ব্লগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিপুল জনমত তৈরী করা। আমি জানি জনমত তৈরী আছেই, কিন্তু সেটাই এখন আওয়াজ দিয়ে সরকারের কর্ণকুহরে পৌছানো। সরকার যেন কোনভাবেই না ভাবে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিডিয়ার হত্যা মামলা বা ২১ শে আগষ্ট গ্রেনেড হামলা বা ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। আর আওয়ামী লীগ যেন কোনভাবেই এই বিচারেকে তাঁদের আগামী নির্বাচনের ইস্তিহারের বিষয় ভেবে না রাখে। সরকারের বিভিন্ন কথাবার্তায় সে রকমই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমরা যত দেরী করবো তত এই যুদ্ধাপরাধীরা মানুষকে আরো বেশি বিভ্রান্ত করবে।
সরকারকে এই মুহুর্তে একটি ডেড লাইন দিয়ে দেওয়া জরুরী। এই ক্ষেত্রে আমি বলবো আমরা আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর্ব শুরু হয়েছে দেখতে চাই। এ জন্য আমরা সবাই প্রচারনা চালিয়ে যাই। ব্যানার হোক, পোস্টার হোক, শ্লোগান হোক, কবিতা হোক, গান হোক, ছবি হোক, গল্প হোক, লেখা হোক, মানব বন্ধন হোক। কিন্তু আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর্ব শুরু না হয়া পর্যন্ত আমাদের মুখ বন্ধ রাখবো না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংগঠন তাঁদের কার্যক্রম শুরু করেছে। সিসিবি যুদ্ধাপরাধীদের জন্য আলাদা আর্কাইভ খুলেছে। সচলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি/লেখা নিয়ে আলাদা আর্কাইভ এর চিন্তা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া WCSF (War Crime Strategy Forum) গঠন হয়েছে যেখানে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে গড়ে উঠছে যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত মিডিয়া আর্কাইভ এবং ই-লাইব্রেরী। মিডিয়া আর্কাইভে গত এক বছরের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে প্রকাশিত সকল পত্রিকার খবর ও ব্লগে প্রকাশিত লেখা, বিভিন্ন ভিডিও সংগ্রহ করা হয়েছে। ই-লাইব্রেরীতে বাংলা ও ইংরেজীতে প্রকাশিত যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত বই, জার্নাল সংগ্রহ করা হচ্ছে। এগুলো সকলের ব্যবহারে জন্য উম্মুক্ত রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে একেক জন যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে আলাদা আলাদা তথ্য সংগ্রহ করা হবে এবং সেখান থেকে তাঁদের কুকীর্তিগুলো নিয়ে প্রতিবেদন তৈরী করা হবে যা পরবর্তীতে উইকি এবং অন্যান্য সকল জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এই তথ্য ভাণ্ডার যেন বিচারের সময় ব্যবহৃত হয় সেটার জন্যও সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ করা হবে। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে আরো তথ্য পাওয়া যাবে জেনোসাইড আর্কাইভ, মুক্তধারা, নিউ-ইয়র্ক বাংলার ওয়েবসাইটে। এই তথ্যগুলো সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হোক।
আমাদের প্রজন্মের আক্ষেপ থাকতে পারে যে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের সুযোগ পাইনি। কিন্তু আমাদের এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে মুক্তির জন্য সে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়ে যায় নি। এখনো রাজাকার, দুর্নীতিবাজরা লাল সবুজের পতাকার গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ায়। তাই নিজেকে প্রশ্ন করি যে যার অবস্থানে থেকে কি করতে পারি দেশের জন্য। সবাইকে যে এর জন্য রাজনীতি করতে হবে তাও নয়। প্রথমতঃ নিজে যদি সচেতন হই, মুক্ত চিন্তার মানুষ হই তখনই দেশ গড়ার কাজে প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তারপর নিজের অবস্থান, নিজের ক্ষমতা বুঝে যে কোন একটি ক্ষেত্রে অবদান রাখা। এই মুহুর্তে সবচেয়ে উপযোগী ক্ষেত্র হচ্ছে বাংলা উইকিকে সমৃদ্ধ করা। আমার মতে আমাদের দেশের মত অনুন্নত দেশগুলোর জন্য উইকি একটি বিশাল সুযোগ এনে দিয়েছে। একটি শক্তিশালী নুতন প্রজন্ম গঠনের জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। মানুষ যে সব শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়েই পায় তা নয়। তাঁর পরিবার, বন্ধু বান্ধব, সহকর্মী, মিডিয়া সকল ক্ষেত্রে থেকেই সে জ্ঞান লাভ করে। আর সেই জ্ঞানের জন্যই প্রয়োজন একটি তথ্য ভাণ্ডার। চিন্তা করে দেখুন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভবপর নয় সকল স্কুলে বা সকল গ্রামে একটি করে লাইব্রেরী দেওয়া। কিন্তু আমাদের পক্ষে সম্ভব সকল জায়গায় একটি করে কম্পিউটারর ও ইন্টারেন্ট দেওয়া। স্বল্প খরচে সকলের কাছে আমরা জ্ঞানের দড়জা খুলে দিতে পারি যদি আমদের সেই জ্ঞানের ভান্ডার থাকে। উইকিকে আমি সেই জ্ঞানের ভান্ডার হিসেবেই দেখি। সকলের প্রচেষ্টায় আমরা এই ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে পারি। বাংলার ইতিহাস, পৃথিবীর ইতিহাস, সমাজ, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি কোন বিষয় নেই যা আপনি আজ উইকির মাধ্যমে জানতে না পারছেন।
আমি জানি রাগিব সব সময় এই কথাগুলো বলার চেষ্টা করছে। আমিও আজ থেকে তাঁর সাথে এই কথাগুলো বলে যাবো। আমরা ফেইসবুকে বা ব্লগে যে পরিমান সময় ব্যয় করি তার থেকে কিছু সময় দিতে পারি উইকিকে, অন্তত পক্ষে বাংলা উইকিকে। উইকিতে লিখা আর ব্লগে লেখার মাঝে তেমন বিশেষ পার্থক্য নেই। তারপরেও রাগিবের টিউটোরিয়াল দেখে নিলে তেমন কোন সমস্যাই হবে না। আরকেটি কথাঃ অনেকেই ভাবি যে উইকিতে লিখতে হলে হয়তো অনেক কিছু জানতে হয়। সেটা ঠিক নয়। আপনি যা জানেন সেটাই লিখুন। কোন বইয়ে কিছু পড়েছেন, এবং যদি আপনার মনে হয় সেই তথ্যটি মানুষ জানলে উপকৃত হবে তবে তা দিয়ে দিন। শুধু বইয়ের সুত্রটি দিয়ে দিবেন। অথবা ইংরেজী উইকি থেকে কিছু পড়েছেন এবং যদি মনে করেন আপনি চান মানুষ সেটা জানুক তবে সেটাকে অনুবাদ করে নিজের ভাষায় কিছু লিখে দিন। ব্লগে যদি এত কিছু লিখতে পারেন তবে অবশ্যই সেখানেও দু'এক লাইন লিখতে পারবেন। আসুন গা ঝাড়া দিয়ে উঠুন, কিছু কাজ করুন। শুধু বিচারের দাবী জানিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। আর কখনো যেন বিচারের জন্য অপেক্ষা না করতে হয় সেটার জন্যও কাজ করতে হবে। এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেন সমাজে আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা হয়। কেউই যেন নিজেকে আইনের উর্ধ্বে মনে না করে। দুর্নীতিবাজ, যুদ্ধাপরাধীদের স্থান যেন হয় শুধু চার দেওয়ালের ভেতরে।
Wednesday, December 16, 2009
Friday, November 13, 2009
আইন কি শুধু আরিফের জন্যই, ওদের জন্য নয়?
পর পর দু'দুটো ঘটনা প্রমান করে যে দেশ আমাদের কোন দিকে চলছে। কার্টুনিস্ট আরিফের পুরোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে যশোরের বিচারক রায় দিয়েছেন তাঁকে আরো দু'মাসের জেলে যেতে হবে, যা নিয়ে আমাদের আরেক আরিফ জেবতিক ভাই লিখেছেন । আর সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি দুর্নীতি মামালায় সাজা প্রাপ্ত জাতীয় সংসদের উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবর এর সকল দন্ড ও অর্থ জরিমানা মওকুফ করে দিয়েছেন। খবরটি পাবেন এখানে। কিন্তু রাষ্ট্রের পতি, আরিফের প্রতি এই উদারতা দেখাতে সাহস পান না। সত্যি কি বিচিত্র এই দেশ।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন তাঁর সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু তিনি নিজেও জবাবদিহিতার উর্ধ্বে নন। এই ক্ষেত্রে আমি একজন প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হিসেবে জানতে চাই ঠিক কোন কারণে তিনি এই সাজা মওকুফ করেছেন। এভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অপব্যবহার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ বলেই মনে করি। তাতে দেশে দুর্নীতিকে আরো প্রশ্রয় দেওয়া হল। এতে এটি প্রমানিত হল যে আইন শুধু আমাদের মত সাধারণ জনগণের জন্য, ক্ষমতাধরদের জন্য নয়।
আমাদের দেশের অনেক সমস্য। দেশের অধিকাংশ মানুষ অর্ধ-শিক্ষিত। দেশের জনসংখ্যা অত্যাধিক, সম্পদ সে তুলনায় অপ্রতুল। কিন্তু সব চেয়ে বড় সমস্যা আমাদের এই দুর্নীতি। দুর্নীতি আমাদের আজ ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। শুধু মাত্র যদি আমরা এই দুর্নীতিকে রোধ করতে পারি, প্রতিরোধ করতে পারি তবে আমরা আবার মাথা তুলে দাড়াতে পারবো। আজ পর্যন্ত আমরা একজন দুর্নীতিবাজকেও শাস্তি দিতে পারিনি। আদালত যে দু'একটিকে সাজা দেয় রাষ্ট্র তাকে ভিনদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে আর নয়তো এভাবে শাস্তি মওকুফ করে দেয়।
এই ক্ষেত্রে আরো একটি ব্যাপার চলে আসে। আমার মতে আমাদের রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়া উচিৎ। প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ আইন প্রণয়ন করুক, কিন্তু রাষ্ট্রের পিতা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হলে সংসদের জবাবদিহিতা নিশ্চিৎ করা যায়। গণতন্ত্র নিয়ে আমার আগের লেখায় আমি বলেছিলাম যে শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য ক্ষমতার ভারসাম্য অনস্বীকার্য। তাই সংসদ, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রপতি, দুর্নীতি দমন কমিশন এদের মঝে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। একটি শক্তিশালী দুর্নীতি দমন ও স্বাধীন বিচার বিভাগ ছাড়া আমাদের শক্তিশালী গণতন্ত্র সম্ভব নয়।
বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বড় সমস্যা হল, জনগণের শুধু ভোটাধিকার আছে। শাসন ব্যবস্থা বা আইন প্রণয়নে সরাসরি অংশগ্রহনের কোন সুযোগ নেই। তাই যখন আইন প্রণয়নকারি নিজেই দুর্নীতি করেন তখন আমাদের হাত বাধা থাকে। বর্তমান পদ্ধতিতে যদিও আমরা ভিন্ন ভিন্ন লোককে ক্ষমতায় নিয়ে আসি, কিন্তু আড়ালে একটি শক্তিশালী গ্রুপ বিদ্যমান যারা মূলত নীতি নির্ধারণে ভুমিকা রাখে। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিবিদ এরা সকলে মিলে একটি সিন্ডিকেট তৈরী করেছে। শুধু মাত্র তাঁদের অনাগ্রহের কারণেই তাঁরা বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেয় না। প্রতি পাঁচ বছর পর পর আমরা একবার খালেদা, একবার হাসিনা, এদেরকেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফিরে আনতে বাধ্য হই, আর দিন বদলের স্বপ্ন দেখি।
এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিত। আমাদের এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো সোচ্চার হওয়া উচিত। এই দুর্নীতিবাজদের জনগণের সামনে তাঁদের রূপকে উম্মোচন করা উচিত, যেমনটি আমরা সোচ্চার যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে। আমরা অতীত পাপীদের যেমন বিচার করবো, এই নতুন পাপীদেরও তেমনি বিচার চাই। আমরা তরুন সমাজই পারি এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। আসুন আমরা শুরু করি এই আন্দোলন। আমরা একটি কাগুজে বাঘ দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বিচার বিভাগ চাই না। সত্যিকার অর্থে একটি শক্তিশালী স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগ এখন সময়ের দাবী। এই দাবীর প্রতি সকলে সোচ্চার হই, দুর্নীতিবাজদের প্রতিরোধ করি।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন তাঁর সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু তিনি নিজেও জবাবদিহিতার উর্ধ্বে নন। এই ক্ষেত্রে আমি একজন প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হিসেবে জানতে চাই ঠিক কোন কারণে তিনি এই সাজা মওকুফ করেছেন। এভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অপব্যবহার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ বলেই মনে করি। তাতে দেশে দুর্নীতিকে আরো প্রশ্রয় দেওয়া হল। এতে এটি প্রমানিত হল যে আইন শুধু আমাদের মত সাধারণ জনগণের জন্য, ক্ষমতাধরদের জন্য নয়।
আমাদের দেশের অনেক সমস্য। দেশের অধিকাংশ মানুষ অর্ধ-শিক্ষিত। দেশের জনসংখ্যা অত্যাধিক, সম্পদ সে তুলনায় অপ্রতুল। কিন্তু সব চেয়ে বড় সমস্যা আমাদের এই দুর্নীতি। দুর্নীতি আমাদের আজ ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। শুধু মাত্র যদি আমরা এই দুর্নীতিকে রোধ করতে পারি, প্রতিরোধ করতে পারি তবে আমরা আবার মাথা তুলে দাড়াতে পারবো। আজ পর্যন্ত আমরা একজন দুর্নীতিবাজকেও শাস্তি দিতে পারিনি। আদালত যে দু'একটিকে সাজা দেয় রাষ্ট্র তাকে ভিনদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে আর নয়তো এভাবে শাস্তি মওকুফ করে দেয়।
এই ক্ষেত্রে আরো একটি ব্যাপার চলে আসে। আমার মতে আমাদের রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়া উচিৎ। প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ আইন প্রণয়ন করুক, কিন্তু রাষ্ট্রের পিতা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হলে সংসদের জবাবদিহিতা নিশ্চিৎ করা যায়। গণতন্ত্র নিয়ে আমার আগের লেখায় আমি বলেছিলাম যে শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য ক্ষমতার ভারসাম্য অনস্বীকার্য। তাই সংসদ, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রপতি, দুর্নীতি দমন কমিশন এদের মঝে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। একটি শক্তিশালী দুর্নীতি দমন ও স্বাধীন বিচার বিভাগ ছাড়া আমাদের শক্তিশালী গণতন্ত্র সম্ভব নয়।
বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বড় সমস্যা হল, জনগণের শুধু ভোটাধিকার আছে। শাসন ব্যবস্থা বা আইন প্রণয়নে সরাসরি অংশগ্রহনের কোন সুযোগ নেই। তাই যখন আইন প্রণয়নকারি নিজেই দুর্নীতি করেন তখন আমাদের হাত বাধা থাকে। বর্তমান পদ্ধতিতে যদিও আমরা ভিন্ন ভিন্ন লোককে ক্ষমতায় নিয়ে আসি, কিন্তু আড়ালে একটি শক্তিশালী গ্রুপ বিদ্যমান যারা মূলত নীতি নির্ধারণে ভুমিকা রাখে। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিবিদ এরা সকলে মিলে একটি সিন্ডিকেট তৈরী করেছে। শুধু মাত্র তাঁদের অনাগ্রহের কারণেই তাঁরা বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেয় না। প্রতি পাঁচ বছর পর পর আমরা একবার খালেদা, একবার হাসিনা, এদেরকেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফিরে আনতে বাধ্য হই, আর দিন বদলের স্বপ্ন দেখি।
এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিত। আমাদের এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো সোচ্চার হওয়া উচিত। এই দুর্নীতিবাজদের জনগণের সামনে তাঁদের রূপকে উম্মোচন করা উচিত, যেমনটি আমরা সোচ্চার যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে। আমরা অতীত পাপীদের যেমন বিচার করবো, এই নতুন পাপীদেরও তেমনি বিচার চাই। আমরা তরুন সমাজই পারি এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। আসুন আমরা শুরু করি এই আন্দোলন। আমরা একটি কাগুজে বাঘ দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বিচার বিভাগ চাই না। সত্যিকার অর্থে একটি শক্তিশালী স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগ এখন সময়ের দাবী। এই দাবীর প্রতি সকলে সোচ্চার হই, দুর্নীতিবাজদের প্রতিরোধ করি।
Friday, October 16, 2009
দেশ উন্নয়ন ভাবনা
ভুমিকাঃ
কোন নির্দিষ্ট নিয়ম বা নীতিমালা পালনের জন্য মানুষের সৃষ্টি হয়নি। মানুষের পালনের জন্য কিছু নীতিমালার সৃষ্টি হয়ে থাকে। তাই সকল নীতিকে আতসী কাচের নীচে রেখে যাচাই করতে হয় তা আদৌ মানুষের কল্যাণে কাজ করছে কিনা। পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ যে কোন নীতির পরিবর্তন তাই বাঞ্ছনীয়। নীতিকে অলঙ্ঘনীয় ধরে মানুষের পরিবর্তন কখনই কাম্য হতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে ব্যক্তি মানুষের, গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের আচরণ, সংস্কৃতি, ভাষার পরিবর্তন ঘটে থাকে। এই পরিবর্তন হলো অলঙ্ঘনীয়। তাই এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে চলার জন্য বাকী সকল কিছুকে পরিবর্তিত হতে হবে। কোন রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ যদি তাদের নীতিকে সময়ের সাথে উপযোগী না করে তুলে তবে তারা সময়ের তুলনায় পিছিয়ে থাকবে। যেটার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।
কোন দেশ কতটা উন্নত তার একটি নিয়ামক হচ্ছে সেই দেশের নীতি বা সংবিধান কতটা সময়োপযোগী সেটা দেখা। তারা সময়ের সাথে সাথে তাদের সংবিধানকে পরিবর্তন করছে কিনা, জনগণকে উন্নত সেবা প্রদানের জন্য। আমাদের দেশের সংবিধানকে, শাসন ব্যবস্থাকে একুশ শতকের উপযোগী করা এখন সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনামলের শাসন পদ্ধতি আমরা এখনো বহন করে চলছি যার ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রের প্রশাসকদের মাঝে এখনো পুরোনো জমিদারী আচরণ লক্ষ্য করা যায়, দেশকে পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে চিন্তা করার একটি মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়, যা কিনা কোন প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে হওয়া উচিত নয়।
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা/কর্মচারীকে হত হবে জনগণের সেবক, শাসক নয়। আমাদের দেশে কোন পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের জবাবদিহিতার কোন ব্যবস্থা নেই। সময় এসেছে সেই নীতিমালার, যেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সরকারী/আধা-সরকারী/বেসরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। প্রতিটি সেবা প্রদানের জন্য সর্বোচ্চ সময় উল্লেখ থাকবে। প্রতিটি বিভাগে ভোক্তার অধিকার রক্ষার্থে আলাদা বিভাগ থাকবে যেখানে ভোক্তা তার সেবাটি উক্ত সময়ের মাঝে না পেলে নালিশ করতে পারবে।প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি নাগরিককে জানাতে হবে তার কতটুকু প্রাপ্য, যা না পেলে সে আইনি সাহায্য নিতে পারবে। রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে সেই ধরনের নীতিমালা প্রণয়নের জন্য। এভাবে রাষ্ট্র এবং জনগণের পরস্পরের মিথষ্ক্রিয়ার ফলে একটি দেশ এগিয়ে যাবে।
বলাই বাহুল্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোন শাসক গোষ্ঠীই জনগণের সেবা প্রদানের কোন প্রকার চিন্তা করেনি বরং সর্বক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। রাজনীতিবিদগণ বিশাল জনগোষ্ঠীর শিক্ষা-স্বল্পতার সুযোগ নিয়ে, ধর্ম-ভীরুতার সুযোগ নিয়ে, দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে ভোটের আগে ছলনার আশ্রয় নেয়। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজস্ব গোষ্ঠী এবং নিজের উন্নয়নে, আর জনগণ নিরুপায় হয়ে বারংবার ধর্ষিত হয়।
সময় এসেছে সমস্ত নীতিমালা পর্যালোচনা করে একুশ শতাব্দীর সমাজ গড়ে তোলবার। একটি অসাম্প্রদায়িক, মিশ্র অর্থনীতির, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার। দেশকে নিম্ন আয় হতে মধ্য আয়ের এবং সেখান হতে উন্নত আয়ের দেশে পরিণত করার। আপামর জনগণের মাথাপিছু আয় না বাড়াতে পারলে কোন লক্ষ্যেই আমরা পৌঁছতে পারবো না। এই দারিদ্রতার সাথেই কুশিক্ষা, মৌলবাদ, দুর্নীতি সকল কিছু সম্পর্কিত। একটি জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থাই কেবল পারে একটি দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তাই জনগণকেই সোচ্চার হতে হবে তাদের নিজেদের অধিকারের জন্য নীতিমালা প্রণয়নে রাষ্ট্রের শাসকদের বাধ্য করাতে।
সংবিধান ও গণতন্ত্র
রাষ্ট্র হিসেবে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রই সর্বাপেক্ষা উত্তম যেখানে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস হয়ে থাকে এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সকল প্রজাই সমান হয়ে থাকে। আর রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা বা সরকার পদ্ধতির জন্য গণতন্ত্রই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভাল পন্থা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মূলত দু’ধরণের। প্রথমটি হল - ডিরেক্ট বা সরাসরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যেখানে সকল প্রজা রাষ্ট্রের সকল স্বিদ্ধান্তে নিজের মতামত প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করবে। আর দ্বিতীয়টি হল- জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের সকল স্বিদ্ধান্ত গ্রহন ও প্রয়োগ করবে যা রিপ্রজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধিমুলক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। দু’পদ্ধতিরই ভাল এবং খারাপ দিক রয়েছে।
সরাসরি পদ্ধতির সবচেয়ে ভাল সুবিধে হল এর মাধ্যমে জনগণের সরাসরি চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অনেক সময় নির্বাচিত হয়ে জনগণকে উপেক্ষা করে সে ধরণের প্রতারনার সুযোগ থাকে না। আরো একটি বড় সুবিধে হল যেহেতু এই পদ্ধতিতে জনগণের সরাসরি মিথষ্ক্রি য়া থাকে তাই এতে বিপুল সংখ্যক জনগণের অংশগ্রহন হয়ে থাকে যা একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য খুবই প্রয়োজনীয় অংশ।
এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় অসুবিধে হল একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি স্বিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই মিথষ্ক্রি য়ার আয়োজন সময় ও অর্থ সাপেক্ষ ব্যাপার। এ কারণে এই ধরণের পদ্ধতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী – যেমন সচলায়তন – এর ক্ষেত্রে উপযোগী। বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তাই নির্বাচিত প্রতিনিধিমুলক পদ্ধতিই উপযোগী হয়ে থাকে। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে সরাসরি পদ্ধতির বা গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত সর্বোত্তম পদ্ধতি হলেও এই পদ্ধতিও ত্রুটিমুক্ত নয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ত্রুটিগুলো প্রকান্তরে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিরও ত্রুটি। সরাসরি বা নির্বাচিত যে পদ্ধতিই হোক না কেন গণতন্ত্রের একটি প্রধান সমস্যা হল “বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শাসন”। যদিও গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মতামত জানা, কিন্তু ক্ষুদ্র অংশের মতামতকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। যদি সেই মতামতকে উপেক্ষা করা হয় তবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীটি সর্ব সময় শোষিত হয়ে চলবে যা কোন সমাজের জন্যও ভাল ফল বয়ে আনবে না। এখানেই মানবতার প্রশ্নটি চলে আসে এবং এ কারণেই আসে সংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা। সংবিধান এমন একটি ব্যবস্থা যা ব্যক্তি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিৎ করার জন্য চেষ্টা করে। অন্য ভাবে বলা যায় ক্ষুদ্র অংশকে রক্ষা করে বৃহতৎ অংশের শোষন হতে। রক্ষা করে দুর্বলকে সবলের হাত হতে। রক্ষা করে নারী ও শিশুকে, রক্ষা করে লঘু সম্প্রদায়কে, রক্ষা করে মুক্ত চিন্তাকে, রক্ষা করে দরিদ্রকে।
নির্বাচিত প্রতিনিধিমুলক পদ্ধতির একটি অসুবিধে হচ্ছে সব সময় সঠিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না। অনেক সময় সঠিক জনপ্রতিনিধি পাওয়া যায় না বা অনেক সময় জনগণ সঠিক প্রতিনিধি খুঁজে পেতে ভুল করে। তাই সংবিধানের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাকে সীমিত করে রাখা যেন তাঁর কখনই নিজেদেরকে জনগণের চেয়ে ক্ষমতাশালী বলে ভাবতে না পারে। সুতরাং বলা যায় সংবিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল ব্যক্তির মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণের ক্ষমতাকেও নিশ্চিত করা। যদি আমরা সংবিধানের এই উদ্দেশ্যগুলো পরিষ্কার করে বুঝতে পারি তবেই বুঝবো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কেমনতর সংবিধান প্রয়োজন।
সংবিধান ও সরকার পদ্ধতি
সংবিধানের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের জবাবদিহীতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিতকরণ। একটি গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতির মূল ক্ষমতার উৎস তিনটিঃ নির্বাহী বিভাগ, আইন প্রণয়ন বিভাগ বা সংসদ ও বিচার বিভাগ। এই তিন বিভাগের স্বাধীনতা, পরষ্পরের মিথষ্ক্রি য়ায় তাদের মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্যের উপরই নির্ভর করে প্রকৃত গণতন্ত্রের ভবিষ্যত। অধুনা আরো কয়েকটি বিভাগের স্বাধীনতাও সুষ্ঠ গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় বলে ধরা হয়। এগুলো হলঃ দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন এবং প্রচার মাধ্যম।
সরকার পদ্ধতির মধ্যে বহুল প্রচলিত পদ্ধতিটি হচ্ছে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি যেখানে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের প্রধান হয়ে থাকেন একই ব্যক্তি, যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে থাকেন যারা সরকারের নির্বাহী কাজ পরিচালনা করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীরা কেবল মাত্র সংসদের কাছে জবাবদিহী হয়ে থাকেন। সংসদ চাইলে যেকোন সময় অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে সরকার ভেঙ্গে দিতে পারেন। এই পদ্ধতির প্রধান সুবিধে হল একই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ নির্বাহী এবং সংসদের সদস্য হওয়ায় সরকার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন সহজেই প্রণয়ন করতে পারেন, যা প্রকান্তরে প্রশাসনে গতিশীলতা আনে। কিন্তু একই ব্যক্তি আইন প্রণয়নকারী এবং প্রয়োগকারী হওয়ায় আইনের অপব্যবহার বা কাল-আইনের প্রণয়নের সম্ভাবনা থেকে যায়। এই সরকার পদ্ধতির দ্বিতীয় অসুবিধেটি হল,সরকারের অনিশ্চিত স্থায়ীত্ব বা মেয়াদকাল। যেহেতু যেকোন মুহুর্তে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে সরকারের পতন সম্ভব তাই সরকার প্রধানকে সব সময় নিজ দলের এবং বিরোধী দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সন্তুষ্ট রেখেই সরকার চালাতে হয়। সরকার প্রধানের নিজ দলের মতের বিরুদ্ধে যেয়ে নিজ চিন্তার প্রতিফলন অনেক সময় সম্ভব হয় না। যদিও এর মাধ্যমে সরকারের নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়, তারপরেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারের মাঝে দলীয় আনুগত্য প্রকাশ পেয়ে যায়। ঠিক সেরকম ভাবে দলীয়ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও দলের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের চিন্তার প্রতফলন ঘটান না বেশিরভাগ সময়ই। এটি আরো খারাপ আকার ধারন করে যখন দলীয় পর্যায়েও গণতন্ত্রের অভাব থাকে তখন সরকার পরিচালনায় ব্যক্তিকেন্দ্রীকতা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে এই কথাটি বিশেষভাবে পরীক্ষিত।
দ্বিতীয় সরকার পদ্ধতিটি হল প্রেসিডেন্সিয়াল বা রাষ্ট্রপ্রধান সরকার পদ্ধতি, যেখানে সরকার প্রধান সরাসরি জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধে হলো রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ আইন প্রনয়ন বিভাগ বা সংসদ হতে পৃথক থাকে। নির্বাহী বিভাগ সরকার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের জন্য সংসদে পাঠান এবং সংসদ সেই আইন পর্যালোচনা করে তা আইন হিসেবে পাশ করেন। রাষ্ট্রপ্রধানেরও সংসদের পাশ করা কোন আইনের উপর ভেটো দেওয়ার অধিকার থাকে যা আবার সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে রহিত করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে গতিশীলতা কিছুটা বাধাগ্রস্থ হলেও গণতন্ত্রের জন্য তা ভাল। এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ এক অপরের উপর নির্ভরশীল এবং এর মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা যায়। আরো একটি সুবিধে পাওয়া যায় তা হল সরকারের নিশ্চিত স্থায়ীত্ব। যেহেতু রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের ভোটে নির্বাচিত তাই সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে। আবার নির্বাচিত হবার পর দলীয় আনুগত্য প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা না থাকায় রাষ্ট্রপ্রধান নিজের চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারেন। সরকারের মেয়াদ শেষে জনগণের কাছে ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপ্রধানের মূল্যায়ন হয় বিধায় জনগণের জন্য কাজ করার চেষ্টা থাকবে বেশি।
আগেই বলেছি যে সরকারের মাঝে যত বেশি জবাবদিহীতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে জনগণের অধিকারও তত বেশি নিশ্চিত হবে। সেই জন্যই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা গনতান্ত্রিক সরকারের কাঠামো তিনটির অন্যতম একটি অংশ। বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের সমান্তরাল একটি স্বাধীন বিভাগ। একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করে আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান ভাবে হচ্ছে কিনা এবং সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়ন হচ্ছে কিনা। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যদি দেখি তবে দেখতে পাই যে আমরা এখনো গণতন্ত্রের এই মৌলিক অংশটিই নিশ্চিত করতে পারিনি। যেখানে স্বাধীন বিচার বিভাগই নেই সেখানে গণতন্ত্রের কোন সুফল আশা করা বৃথা। স্বাধীন বিচার বিভাগের পর পরই আসবে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। বেশিরভাগ দেশেই এই পাঁচটি স্বাধীন বিভাগকে ধরা হয় গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো হিসেবে। আরো উন্নত দেশে প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতার উপরও জোর দেওয়া হয় কারণ সেখানে জনগণের সরাসরি মতামত প্রতিফলিত হয়। আর আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে আমি পুলিশ বিভাগকেও স্বাধীন হিসেবে প্রয়োজন বলে মনে করি। অন্তত স্বাধীন না হলেও নির্বাহী বিভাগ হতে পৃথক করে স্বাধীন বিচার বিভাগে দেওয়া যেতে পারে।
সরকারের বাড়তি কিছু জবাবদিহীতার জন্য সংসদকে দু’কক্ষ বিশিষ্ট করা যাতে পারে। নিম্ন কক্ষ বর্তমান সংসদের মতই থাকতে পারে। অর্থ সংশ্লিষ্ট যেকোন কিছুর ব্যাপারে নিম্ন কক্ষের স্বিদ্ধান্তই চুড়ান্ত হতে পারে। তবে উচ্চ কক্ষ মনে করলে সেটা রহিত করতে পারে। উচ্চকক্ষ আইন প্রণয়ন এবং সংবিধানের সংশোধন এর ব্যাপারে স্বিদ্ধান্ত নিবেন। উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিদের জন্য স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। নিম্ন কক্ষে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারে। তবে উচ্চ কক্ষের প্রতিনিধি বাছাই এর ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা অবলম্বন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন জেলা, বিভিন্ন গোত্র, বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন পেশাজীবি, বিভিন্ন শ্রেনী ও লিঙ্গ ভেদে প্রতিনিধি বাছাই করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে সকল গোষ্ঠীর মতামত প্রতিফলিত হবে যা একটি প্রজাতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয়। সর্বশেষ কাঠামোটি হচ্ছে, সরকার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ। রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করে প্রতিটি প্রদেশে দু’কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ এবং নির্বাচিত প্রদেশিক প্রধান এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগকে আলাদা করা হলে সরকারের মাঝে গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে।
এই সমস্ত কিছু আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে এক ধাপেই অর্জন করা সম্ভবপর নয়। তাই আমাদের দেশের জন্য সর্ব প্রথম প্রয়োজন বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী বিভাগ হতে মূক্ত করা। এর মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার হ্রাস সম্ভবপর হবে এবং আইনের প্রয়োগ সমানভাবে সম্ভবপর হবে। শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন পারে দলীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে, যেন একই ব্যক্তি আজীবন দলীয় প্রধানের পদ অলংকৃত করে না রাখতে পারেন। সর্বোপরি প্রয়োজন একটি নুতন গণতান্ত্রিক দল, যারা জনগণের কাছে তুলে ধরবে সরকার পদ্ধতির পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা।
সংবিধান ও ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি
একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল প্রজা রাষ্ট্রের চোখে সমান। সেখানে কোন ধর্ম বিভেদ, ভাষা বিভেদ, অঞ্চল বিভেদ বা জাতি বিভেদ থাকতে পারে না। এটাই প্রজাতন্ত্রের মূল মন্ত্র। মুসলিম, হিন্দু, খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের যেমন রয়েছে ধর্ম পালনের অধিকার, তেমনি রয়েছে অধার্মিকদের কোন ধর্ম না পালনের। একজন মানুষের যেমন শুদ্ধ বাংলা বলার অধিকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে আরেকজনের আঞ্চলিক ভাষা বা আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের। প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতি, রীতি নীতি পালনের অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের যেমন ব্যক্তি পর্যায়ের মানুষের ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রনের অধিকার নেই তেমনি রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতি থাকাও উচিত নয়।
রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ, ভাষা নিরপেক্ষ এবং সংস্কৃতি নিরপেক্ষ। সংবিধানে সেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্যে সচেষ্ট হতে হবে। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে সকল ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা জ্ঞাপন নয় এবং রাষ্ট্রের পক্ষে সকল ধর্মের সমান মর্যাদা প্রদানও সম্ভব নয়। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে বুঝায় রাষ্ট্রের ধর্মহীনতা। রাষ্ট্রের কোন নিজস্ব ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্র যেমন নাস্তিকতায় মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করবে না তেমনি রাষ্ট্র অন্য ধর্ম পালনেও বিরত থাকবে। ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষ যেকোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশেষ কোন ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে নিতে পারে না।
ধর্মের মত সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রকে বিরত থাকা উচিত। নজরুল না রবীন্দ্রনাথ – কে হবেন আমাদের দেশের কবি এই জাতীয় তর্কের রাষ্ট্রের যাওয়া উচিত নয়। এখানেও ব্যক্তি পর্যায়ে বা বেসরকারী পর্যায়ে যে যার মত নজরুল, রবীন্দ্র, লালন জয়ন্তী করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাইকে সমান ভাবে মর্যাদা দেওয়া সম্ভবপর নয়। এবং এইসব কারণেই জাতিতে বিভক্তি আসে। ইংরেজী, না আরবী, না বাংলা নববর্ষ উৎযাপন করা হবে এই ধরণের বিষয়ে রাষ্ট্রের নাক না গলিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। একই কথা প্রযোজ্য খেলাধুলার উপর। ফুটবল না ক্রিকেট না হাডুডু- কোন খেলায় রাষ্ট্র অগ্রাধিকার দিবে, না সকল খেলায় সমান ভাবে বা আনুপাতিক হারে সাহায্য করবে এই সব রাষ্ট্রের চিন্তা হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্র যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকারই নিশ্চিত করতে পারছে না সেখানে এই সব ব্যপারে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। এর ফলে সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়, ধর্ম মন্ত্রনালয়, ক্রীড়া মন্ত্রনালয় এর মত মন্ত্রনালয়গুলোতে জনগণের ট্যাক্সের টাকা নষ্ট হবার হাত হতে রক্ষা পাবে।
ভাষার ব্যাপারটি কিছুটা ভিন্ন , ধর্ম বা সংস্কৃতির তুলনায়। রাষ্টের ধর্ম বা সংস্কৃতির প্রয়োজন না থাকলেও যোগাযোগের মাধ্যমের জন্য কোন না কোন একটি ভাষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বাংলাদেশের সৃষ্টিতে ভাষা এবং ভাষাশহীদদের অবদানের কথা বিবেচনা করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রের ব্যবহারের জন্য প্রথম পছন্দ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে সকল ভাষার সমান অধিকার নিশ্চিত হয় না। এ কারণে অঞ্চলভেদে যারা যার আঞ্চলিক ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। সবশেষে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজী ভাষাকে তৃতীয় পছন্দ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। এভাবে জনগণের সামনে তিনটি বিকল্পের যেকোন একটি বেছে নেবার সুযোগ থাকে।
অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন তা নয়, বিশেষ করে সংস্কৃতির ব্যাপারে। কারণ এতে দেশীয় সংস্কৃতি বা দেশীয় খেলাধুলা বা আমাদের ভাষা ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তবে আমার মতে পরিবর্তন বা বিবর্তন যদি হয়ই , তা সময়ের প্রয়োজনেই হয় এবং সেই পরিবর্তন আমি বা আপনি অস্বীকার করতে পারি কিন্তু ঠেকাতে পারবো না।
সংবিধান ও শিক্ষা
মানুষ পুরোপুরি ব্লাঙ্ক স্লেট হয়ে জন্ম না নিলেও, সুন্দর পরিবেশ এবং সঠিক শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে একটি শিশুকে মুক্ত চিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ কারণে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম একটি উন্নত জাতি গঠনের জন্য। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মাঝে শিক্ষা অন্যতম এবং প্রতিটি মানুষের শিক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। জাতির এক অংশকে শিক্ষার আলো হতে বঞ্চিত রেখে কোন জাতির পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। জনগণের করের অর্থ যদি সর্বপ্রথম কোথাও ব্যবহৃত হতে হয় তবে আমি শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিব। আমাদের সংবিধানেও সকলের জন্য শিক্ষার কথা বলা হয়েছে এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ এ, সকলের জন্য শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
বৈষম্যহীন শিক্ষার জন্য প্রথমত যেটা প্রয়োজন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত অভিন্ন পাঠ্যসুচি প্রণয়ন করা। শিশুর জন্মলগ্ন থেকেই যদি তাকে বাংলা, ইংরেজী, ও আরবী মাধ্যমে বিভক্ত করে ফেলি তাহলে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি কি করে? তারপর যেটা প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারী এবং শহর ও গ্রাম ভিক্তিক শিক্ষার বিভাজন দূর করা। উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক হওয়া উচিত। তবে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশুনা নিখরচার হওয়ার প্রয়োজন নেই এবং প্রয়োজনে সরকার বিনা সুদে বা অল্প সুদে ঋন দিতে পারে। কারিগরী শিক্ষার জন্য সরকার অর্ধেক ঋন এবং অর্ধেক বৃত্তি হিসেবে দিতে পারে। বিদেশ গমন কারীদের জন্য মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিকের পরে ছয়মাস বা এক বছরের কারিগরী ও ভাষার প্রশিক্ষন দেওয়া যেতে পারে। যে কোন চাকুরীর ক্ষেত্রেই মাধ্যমিকের নীচে চাইতে পারবে না এমন নিয়ম করা উচিত। প্রতিবন্দ্বী শিশুদের জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে বা প্রতিটি জেলায় তাঁদের জন্য আলাদা বিভাগ বা বিদ্যালয় রাখা উচিত। এবং দরিদ্র শিশুদের পরিবারের জন্য বৃত্তি প্রদান করা উচিত।
স্নাতক পর্যায় নিয়ে খুব বেশি না বলে স্নাতকোত্তর পর্যায় নিয়ে বলছি। একটি দেশের উন্নতির জন্য খুব প্রয়োজন নিজ দেশের উপযোগী প্রযুক্তি এবং যার জন্য প্রয়োজন গবেষনা। গবেষনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য এই খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বাড়ানো উচিত এবং স্নাতকোত্তর কোন ছাত্র যেন গবেষনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারে তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সকলের স্নাতকোত্তর শিক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধু মাত্র যারা শিক্ষকতা এবং গবেষনায় আগ্রহী হবে তাদেরকেই স্নাতকোত্তর শিক্ষায় ভর্তির সুযোগ দেওয়া উচিত।
সবশেষে ভাল শিক্ষার প্রথম শর্ত হচ্ছে ভাল শিক্ষক। দেশের মেধাবীদের শিক্ষকতার পেশায় আনার জন্য শিক্ষকদের প্রতিটি স্তরে ভাল বেতন প্রদান প্রয়োজনীয়। একজন শিক্ষক যদি জীবন সংগ্রামে নিজেই নৈতিকতার পথ পরিহার করেন, তবে তিনি কি করে অন্যকে শিক্ষা দিবেন। আমরা যতদিন পর্যন্ত শিক্ষককে সম্মানিত না করবো, ততদিন আসলে কোন সংস্কার বা শিক্ষানীতিই কাজে আসবে না। উন্নত শিক্ষক তৈরীর জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষন ব্যবস্থার প্রয়োজন। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটিকে আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা খুব সহজেই ডিজিটাল পাঠ্য পুস্তক, মাল্টিমিডিয়া লেকচার, অনলাইন গ্রন্থাগার তৈরী করতে পারি। নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির সাহায্যে দূর-শিক্ষন পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে দূর-শিক্ষন পদ্ধতি আমি শুধু মাত্র উচ্চ শিক্ষা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করবো। আমাদের দেশের বিপুল জনসংখ্যার বিচারে চাইবো যত বেশি মানুষকে কাজে লাগানো যায়। তবে অবকাঠামো তৈরী করে রাখা যায়, যেন প্রয়োজনে দূর-শিক্ষনের সাহায্য নিতে পারে যে কেউ।
এ ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক নীতির প্রশ্ন চলে আসেঃ
প্রথমত - শিক্ষা দান পদ্ধতি। মূলত আমাদের দেশের শিক্ষা প্রদান পদ্ধতি এবং পরীক্ষন পদ্ধতি যেটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে সেটা মধ্যযুগীয় পদ্ধতি। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষককেরাই শিক্ষা দেওয়া বলতে বুঝায় একটি নির্দিষ্ট বই শুধু পড়ে যাওয়া। যদি শুধু বই এর একটি অংশ পড়তেই হয় তবে তার জন্য শিক্ষকের কি প্রয়োজন, সেটা একজন ছাত্র নিজেই তা করতে পারে। আর পরীক্ষন পদ্ধতিতে এখনো বিচার হয় কে কত বেশি মুখস্থ করতে পারে তা। প্রয়োজন একজন ছাত্র/ছাত্রী বিষয়টুকু কতটুকু বুঝতে পেরেছে সেটি। তার জন্য শিক্ষা প্রদান ও পরীক্ষণ পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজন। তবে এটি সর্বাগ্রে বুঝতে হবে একজন শিক্ষককে।
এই শিক্ষা পদ্ধতির জন্য আমি প্রতিটি বিষয়কে তাত্বিক ও ব্যবহারিক ক্লাসে ভাগ করতে চাই। প্রতিটি বিষয়ে ৩০ মিনিট লেকচারের জন্য থাকবে আর এক ঘন্টা থাকবে ব্যবহারিকের জন্য। লেকচার ও ব্যবহারিক ক্লাস এমন ভাবে সমন্নয় করতে হবে যেন শিক্ষক বুঝতে পারেন তিনি যা দিতে চেয়েছেন তা ছাত্ররা বুঝতে পেরেছে কিনা আর ছাত্র/ছাত্রীরাও বুঝতে পারে শিক্ষক যা বুঝিয়েছেন তা তাঁরা বুঝেছে কিনা। ব্যবহারিক ক্লাসের শেষ দশ বা পনের মিনিটে শিক্ষক ছোট্ট কুইজ নিতে পারেন, যার মাধ্যমে ছাত্ররা কতটুকু বুঝতে পারলো তার একটি পরিমাপও হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে ছাত্রটির ক্লাসেই পড়া হয়ে গেল এবং তাঁর বাসায় গিয়ে আরো বেশি পড়ার প্রয়োজন পড়বে না। সমাপনী পরীক্ষায় শতকরা ৩০ বা ৪০ ভাগের বেশি নম্বর রাখা উচিত নয়।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল পাঠ্যসূচি। কি কি বিষয় পড়ানো উচিত? মৌলিক বিষয় হিসেবে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর নিম্ন বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। উচ্চ-মাধ্যমিক শেষে একজন ছাত্র/ছাত্রী যেন এই মূল বিষয়গুলোর প্রাথমিক পর্যায়ের জ্ঞানগুলো অল্প বিস্তর জানে সেটা আমাদের নিশ্চিত করা উচিত।
ভাষাঃ বাংলা, ইংরেজী, ঐচ্ছিক বিষয়ঃ আঞ্চলিক বাংলা ভাষা, আদিবাসী ভাষা, আরবী ভাষা।
বিজ্ঞানঃ পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, চিকিতসা বিজ্ঞান, জ্যোতির বিজ্ঞান।
গণিতঃ পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতিসহ সকল ধরনের প্রাথমিক গণিত।
সমাজঃ সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, আইন।
ইতিহাসঃ বাংলাদেশের ইতিহাস, উপমহাদেশের ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, সাধারণ জ্ঞান, সম-সাময়িক ঘটনা।
প্রযুক্তিঃ কম্পিউটার প্রযুক্তি, অন্তর্জাল।
সাংস্কৃতিকঃ চিত্র কলা, সঙ্গীত, নাটক, লেখালেখি, বিতর্ক ইত্যাদি।
শারীরিকঃ ড্রিল, খেলাধুলা, সাতার, ভ্রমণ, স্কাউট।
নৈতিকতাঃ সেইফটি জ্ঞান, ধর্ম, দর্শন ।
সবশেষে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯:
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ এর খসড়াতে বেশ কিছু ভাল প্রস্তাব উঠে এসেছে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়েছে এবং সকলের ক্ষেত্রে অভিন্ন পাঠ্য সূচি রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং তা অবৈতনিক রাখা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তর ধরা হয়েছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত। বাস্তবতার বিবেচনায় আমি বলব প্রাথমিক শিক্ষাকে বর্ধিত করা এবং সে পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক রাখা ঠিক আছে। তারপরেও আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে সবাই যেন মাধ্যমিক স্তর শেষ করে। ২০১১-১২ এর মাঝে ১০০ ভাগ শিশুকে শিক্ষার তলে আনার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবন্দ্বী শিশুদের জন্য বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দরিদ্র শিশুদের জন্য উপবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। মুখস্থ বিদ্যা থেকে সরে এসে সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সার্বিকভাবে যেসব প্রস্তাব এসেছে সেগুলো বাস্তাবয়ন করা গেলে শিক্ষার মান অনেকাংশে বাড়বে বলে আমার ধারণা। তবে একটি বিষয় না বললেই নয় তা হল -বলা হয়েছে সাংবিধানিক সেকুলার নীতির কথা। কিন্তু আমাদের বর্তমান সংবিধান সেকুলার নয়। সে ক্ষেত্রে এই নীতি প্রনয়নের আগে সংবিধানের পরিবর্তন বাঞ্চনীয়। আবার সেকুলারের কথা বলেও নৈতিক শিক্ষার জন্য যার যার ধর্মের মাঝেই ফিরে যাই। এখানে একজন ছাত্র/ছাত্রী শুধু তাঁর নিজের ধর্ম পড়বে নাকি যে মূল চারটি ধর্মের কথা বলা হয়েছে সব গুলোই পড়বে তা পরিষ্কার করা হয়নি। যদিও সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদান মানেই সেকুলার নয়, তারপরেও নিদেন পক্ষে সকল ধর্ম সম্পর্কে জানলেও একজন মানুষ ধর্মের মূল সুরটি ধরতে পারবে বলে মনে হয়। তাই বৈষম্যহীন শিক্ষা দিতে হলে সকল ধর্মই প্রতিটি ছাত্র/ছাত্রীর পড়া উচিত।
সবশেষে নীতি কি করা হল সেটার চেয়ে মুখ্য বিষয় হল নীতির কতটুকু গ্রহন করার জন্য আমরা আন্তরিক। আমরা যদি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি নাই করতে পারি তবে আমাদের সকল সংস্কারই ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই মুক্ত চিন্তার জাতি গঠনের জন্য সবার আগে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করতে হবে।
সংবিধান ও স্বাস্থ্যসেবা
শিক্ষার পর মৌলিক যে চাহিদাটি মানুষের প্রয়োজন তা হল স্বাস্থ্যসেবা। আমি সুস্থ আছি সেটা যে কত বড় নিয়ামক সেটা আমরা অসুস্থ হবার আগ পর্যন্ত বুঝিনা। বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতির পরও এখনো অনেক রোগই রয়ে গেছে আমাদের চিকিৎসার বাহিরে। তাই মৃত্যুকে আমরা জয় করতে পারিনি এখনো। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পরিবারের যখন কেউ অসুস্থ হয়ে পরে তখন সেই মানুষটির সুস্থতার জন্য পরিবারের সদস্যরা সর্বপ্রকার চেষ্টাই করে। এটাই মানবের স্বাভাবিক ধর্ম।
একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল মানুষের সমান চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। শুধু মাত্র অর্থের অভাবে কোন প্রাণ বিনা চিকিৎসায় ধীরে ধীরে মৃত্যুকে বরণ করবে সেটা হতে পারে না। তাই সকলের সমান স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দায়ভার রাষ্ট্রের। এমন একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিতে হবে যেন সকল চিকিৎসা কেন্দ্র গুলোতে, তা রাষ্ট্র পরিচালিত হোক বা ব্যক্তিগত ভাবে পরিচালিত হোক, জনগণ সমান স্বাস্থ্যসেবা পায়। তার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।
একটি কেন্দ্রীয় ভাবে পরিচালিত বীমা এই কাজে সাহায্য করতে পারে। ব্যবস্থাটি এমন হবে যে সকল জনগণ তার স্বাস্থ্য সেবার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রকে প্রতি মাসে প্রদান করবে। যদি কোন মাসে সে অসুস্থ হয় তবে তিনি সরাসরি যেকোন ডাক্তার এর কাছে যাবেন এবং চিকিৎসার জন্য যা যা প্রয়োজনীয় তা তিনি করবেন। এর সকল খরচ রাষ্ট্র সরাসরি উক্ত চিকিৎসা কেন্দ্রকে প্রদান করবে। এই বীমা ব্যবস্থা পরিসংখ্যানের কিছু নিয়ম মেনে চলে। ধরা হয় যে, প্রতি মাসে দেশের সকল জনগণ একত্রে অসুস্থ হয়ে পড়বে না। কিন্তু যেহেতু সবাই প্রতি মাসে তাঁদের কিস্তি প্রদান করে থাকে, তাই যারা অসুস্থ হয়নি তাঁদের টাকা দিয়ে অসুস্থদের চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব। এখন, আপনি নিজেও যদি কোন এক সময় কঠিন অসুস্থ হোন, আপনিও চিকিৎসা পাবেন। ব্যাপারটি অনেকটা নিজের ভবিষ্যতের অসুস্থতার কথা চিন্তা করে সব সময় অল্প অল্প করে অর্থ সঞ্চয় করে রাখা।
তবে এরকম একটি ব্যবস্থা রাতারাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও নীতিমালার প্রয়োজন। একটি সমন্বিত তথ্যকেন্দ্র থাকতে হবে যেখানে প্রতিটি নাগরিকের তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। পুরো স্বাস্থ্যসেবাকে একটি কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কের মাঝে নিয়ে আসতে হবে। দূর-চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শুরুতে আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য কিছু বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোকই দরিদ্র, যাদের প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেওয়া সম্ভব হবে না আবার বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে সবসময় ভর্তুকি দিয়েও রাষ্ট্র চলতে পারবে না। এই সমস্যা আমাদের সর্ব ক্ষেত্রেই থাকবে। এ কারণে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় না বাড়িয়ে সত্যিকার অর্থে কিছু করা কষ্টকর হবে। তাই অর্থনীতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
সংবিধান ও অর্থনীতি
মানুষের বাকী মৌলিক চাহিদা গুলো হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান। এই সবগুলো সরাসরি জীবিকার সাথে সম্পর্কিত। এক কথায় বলা যায় একজন মানুষ চায় তাঁর একটি জীবিকা অর্জনের পথ থাকবে যা দিয়ে সে তাঁর এই মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে। মানুষ আসলে কি খুব বেশি কামনা করে? সে চায় সমাজে তাঁর জন্য একটি কাজ থাকবে, যে কাজ দিয়ে সে তাঁর সংসারটিকে সুন্দর ভাবে চালাতে পারবে। পরিবারের সকল সদস্যের মাঝে খাবার তুলে দিতে পারবে। সন্তানদের শিক্ষার আলো দিতে পারবে। পরিবারের কোন সদস্য অসুস্থ হলে তাকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবে। পরিশেষে নিজে যখন কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে, তখন তাঁর সন্তান বা রাষ্ট্র তাঁর দেখাশুনা করবে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি একটি জটিল ব্যবস্থা। আমরা আজ একটি জটিল ধাঁধার মাঝে আছি। সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী একজোট হয়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় মানুষকে শোষণ করে। আবার সম্পূর্ণ সমবায় ব্যবস্থায় কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজের শ্রম ব্যয় না করে সমবায় ব্যবস্থার সুবিধে নিয়ে অর্থনীতির চাকাকে স্থবির করে দেয়। এখন এই দুই দ্বন্দের মুক্তি হল মিশ্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কিন্তু ঠিক কতটুকু সমবায় আর কতটুকু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা একটি গতিশীল অর্থনীতির জন্য প্রযোজ্য সেটা বের করাই আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য।
সমাজে বিভাজন নেই সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। সমাজে অধিক কর্মক্ষম ব্যক্তি আছে আবার কম কর্মক্ষম ব্যক্তি আছে, অধিক মেধাবী আছে আবার কম মেধাবী আছে, অধিক বয়সী বা অভিজ্ঞ ব্যক্তি আছে আবার কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি আছে, কারিগরী ও প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি আছে আবার নন-ঢেঁকি ব্যক্তি আছে। সুতরাং বিভাজন কিছুটা থাকবেই। তবে বিভিন্ন পেশাবিদদের বেতন স্কেল ভিন্ন না করে অভিন্ন করার পক্ষপাতিত্বে আমি। বেতন স্কেলের বিভাজন কেবল মাত্র হবে কর্মক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও মেধার ভিত্তিতে।
অর্থনীতিকে সবল করতে হলে দেশের আমদানি ও রপ্তানীর মাঝে ভারসাম্য থাকতে হবে। আমদানীকে কমিয়ে রপ্তানী যত বাড়ানো যাবে তত অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। এখন আমদানী কমানোর অনন্য উপায় হচ্ছে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো। সর্বক্ষেত্রে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করা। তার জন্য প্রয়োজন দেশীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো যা বিশ্ববদ্যালয়গুলোতে গবেষনার মাধ্যমে হতে পারে। দেশীয় প্রয়োজন মেটানোর পর, উদ্বৃত্ত দেশের বাহিরে রপ্তানী করা। আমরা যদি কোন পণ্য রপ্তানী নাও করতে পারে, শুধু জনসম্পদ রপ্তানী করেই প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।
রাষ্ট্রের যদি কোন খাতে বিনিয়োগ করতে হয় তবে বিনিয়োগ করা উচিত দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য। মানুষকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া উচিত দেশীয় কল-কারখানা গড়ার জন্য। বিনিয়োগ করা উচিত জনসম্পদ রপ্তানী খাতে। মানুষকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া উচিত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের জন্য এবং বিদেশ গমণের ব্যয়ভার বহনের জন্য। বিনিয়োগ করা উচিত তথ্য প্রযুক্তিতে। দেশের সকল জনগণের জন্য একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা উচিত। দেশের সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে একটি নেটওয়ার্কের মাঝে নিয়ে আসা উচিত। সকল সরকারী/বেসরকারি কর্মকাণ্ড অন্তর্জাল ও মোবাইল এর আওয়তায় নিয়ে আসা উচিত। বিনিয়োগ যদি করতে হয় তবে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা উচিত। গবেষণায় করা উচিত। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় করা উচিত।
শেষ কিছু কথাঃ
অনেকেই লেখাটি পড়ে ভাবতে পারেন পুরোটাই ইউটোপিয় চিন্তাভাবনা। আবার অনেকেই এর মাঝে সোস্যালিষ্ট চিন্তাধারণার ছায়াও পেতে পারেন। হ্যাঁ, অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিন্তাগুলো স্বপ্নের মতই। দেশের যে কোন উন্নতি সম্ভব, এমন ধারণা পোষণকারী খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। কিন্তু আমি বলবো অসম্ভব কোন কিছুই নয়। আমি যে সমাজ ব্যবস্থার কথা বলেছি, তা পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশগুলোতে বিদ্যমান। তাঁরা উন্নত এজন্য নয় যে তাঁদের সমাজ ব্যবস্থা উন্নত। তাঁরা উন্নত কারণ, তাঁরা নিজেদের দেশের অর্থনীতিকে উন্নত করেছে। এ কারণে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করাই হবে আমাদের মৌলিক লক্ষ্য। আবার অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, শাসন ব্যবস্থা সব এক অপরের উপর নির্ভরশীল এবং সম্পর্কিত। একটি ব্যতীত অন্যটিকে উন্নত করা সম্ভব নয়। তাই আসলে প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। প্রয়োজন গণমানুষের মৌলিক চাহিদার লক্ষ্যে একটি নীতিমালা এবং একটি স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা, যেন একটি গতিশীল অর্থনীতি পাওয়া যায় এবং সেই সাথে সকলের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।
সোস্যালিজমের ছায়া পেতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে উন্নত দেশগুলো কিন্তু সোস্যালিষ্ট দেশ নয়। বরং বলা যেতে পারে মিশ্র অর্থনীতির দেশ। ধীরে ধীরে সকল রাষ্ট্রই এই সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবে। আবার এই সমাজ ব্যবস্থাও যে ত্রুটিমুক্ত তা নয় কিন্তু। এখনো উন্নত দেশগুলোর মাঝে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব বিরাজমান, কারণ আমাদের প্রকৃত গনতন্ত্রের অভাব। বর্তমানে যে গণতন্ত্র বিরাজমান তা কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের হাতে জিম্মি। এই কথাটি উন্নত, উন্নয়নশীল সকল দেশের জন্যই প্রযোজ্য। এই অসাধু চক্রটি জনগণের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মুখোশ নিয়ে আসে, কিন্তু আদতে তারা শোষনের যন্ত্রটি ঠিকই চালু রাখে। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য একটিই - জনগণের করের টাকায় জীবন ভোগ (বিভিন্ন রাজনীতিবিদগণ ও ঋনখেলাপীদের হাজার কোটি টাকার সম্পদ দ্রষ্টব্য)। এরা তাই ঋণ খেলাপী হয়েও বড় বড় দলের অর্থের জোগানদার, এরাই দেশের অর্থনীতির নীতি নির্ধারক। এরা তাই দেশের কোন মৌলিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী নয়। এ কারণেই যে সরকারই ক্ষমতা আসুক, শাসন ব্যবস্থা একই ভাবেই চলে।
রাজনীতিবিদগণ ধীরে ধীরে এই অসাধু চক্রটির শোষনের যন্ত্র হয়ে উঠে, কখনোবা নিজেই চক্রটির অংশ হয়ে যায়। এই অসাধু চক্রটিকে চিহ্নিত করতে হবে এবং এদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। বিদ্যমান শাসন যন্ত্রে সেটি কখনই সম্ভব হবে না। আমাদের প্রয়োজন একবিংশ শতাব্দীর জন্য নতুন একটি দল গঠন করা যারা জনগণের সামনে বিকল্প হয়ে আসবে। এটি হতে হবে সম্পূর্ণ এই প্রজন্মের হাতে তৈরি। এদের কাজ হবে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এই অসাধু চক্রটিকে চিহ্নিত করা এবং জনগণের কাছে এদের মুখোশ খুলে দেওয়া। এভাবে আগামী দশ বা পনের বছরে যদি এই দলটি জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে পারে তবেই কাঙ্খিত পরিবর্তন সম্ভব। অন্যথায় এক শ্রেনীর মানুষ শুধু সম্পদের পাহাড় গড়বে আর অধিকাংশ মানুষ শুধু বেঁচে থাকার জন্যই প্রাণান্তকর সংগ্রাম করে চলবে এবং ঈশ্বরের দোষারোপ করে চলবে।
কোন নির্দিষ্ট নিয়ম বা নীতিমালা পালনের জন্য মানুষের সৃষ্টি হয়নি। মানুষের পালনের জন্য কিছু নীতিমালার সৃষ্টি হয়ে থাকে। তাই সকল নীতিকে আতসী কাচের নীচে রেখে যাচাই করতে হয় তা আদৌ মানুষের কল্যাণে কাজ করছে কিনা। পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ যে কোন নীতির পরিবর্তন তাই বাঞ্ছনীয়। নীতিকে অলঙ্ঘনীয় ধরে মানুষের পরিবর্তন কখনই কাম্য হতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে ব্যক্তি মানুষের, গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের আচরণ, সংস্কৃতি, ভাষার পরিবর্তন ঘটে থাকে। এই পরিবর্তন হলো অলঙ্ঘনীয়। তাই এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে চলার জন্য বাকী সকল কিছুকে পরিবর্তিত হতে হবে। কোন রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ যদি তাদের নীতিকে সময়ের সাথে উপযোগী না করে তুলে তবে তারা সময়ের তুলনায় পিছিয়ে থাকবে। যেটার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।
কোন দেশ কতটা উন্নত তার একটি নিয়ামক হচ্ছে সেই দেশের নীতি বা সংবিধান কতটা সময়োপযোগী সেটা দেখা। তারা সময়ের সাথে সাথে তাদের সংবিধানকে পরিবর্তন করছে কিনা, জনগণকে উন্নত সেবা প্রদানের জন্য। আমাদের দেশের সংবিধানকে, শাসন ব্যবস্থাকে একুশ শতকের উপযোগী করা এখন সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনামলের শাসন পদ্ধতি আমরা এখনো বহন করে চলছি যার ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রের প্রশাসকদের মাঝে এখনো পুরোনো জমিদারী আচরণ লক্ষ্য করা যায়, দেশকে পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে চিন্তা করার একটি মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়, যা কিনা কোন প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে হওয়া উচিত নয়।
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা/কর্মচারীকে হত হবে জনগণের সেবক, শাসক নয়। আমাদের দেশে কোন পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের জবাবদিহিতার কোন ব্যবস্থা নেই। সময় এসেছে সেই নীতিমালার, যেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সরকারী/আধা-সরকারী/বেসরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। প্রতিটি সেবা প্রদানের জন্য সর্বোচ্চ সময় উল্লেখ থাকবে। প্রতিটি বিভাগে ভোক্তার অধিকার রক্ষার্থে আলাদা বিভাগ থাকবে যেখানে ভোক্তা তার সেবাটি উক্ত সময়ের মাঝে না পেলে নালিশ করতে পারবে।প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি নাগরিককে জানাতে হবে তার কতটুকু প্রাপ্য, যা না পেলে সে আইনি সাহায্য নিতে পারবে। রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে সেই ধরনের নীতিমালা প্রণয়নের জন্য। এভাবে রাষ্ট্র এবং জনগণের পরস্পরের মিথষ্ক্রিয়ার ফলে একটি দেশ এগিয়ে যাবে।
বলাই বাহুল্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোন শাসক গোষ্ঠীই জনগণের সেবা প্রদানের কোন প্রকার চিন্তা করেনি বরং সর্বক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। রাজনীতিবিদগণ বিশাল জনগোষ্ঠীর শিক্ষা-স্বল্পতার সুযোগ নিয়ে, ধর্ম-ভীরুতার সুযোগ নিয়ে, দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে ভোটের আগে ছলনার আশ্রয় নেয়। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজস্ব গোষ্ঠী এবং নিজের উন্নয়নে, আর জনগণ নিরুপায় হয়ে বারংবার ধর্ষিত হয়।
সময় এসেছে সমস্ত নীতিমালা পর্যালোচনা করে একুশ শতাব্দীর সমাজ গড়ে তোলবার। একটি অসাম্প্রদায়িক, মিশ্র অর্থনীতির, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার। দেশকে নিম্ন আয় হতে মধ্য আয়ের এবং সেখান হতে উন্নত আয়ের দেশে পরিণত করার। আপামর জনগণের মাথাপিছু আয় না বাড়াতে পারলে কোন লক্ষ্যেই আমরা পৌঁছতে পারবো না। এই দারিদ্রতার সাথেই কুশিক্ষা, মৌলবাদ, দুর্নীতি সকল কিছু সম্পর্কিত। একটি জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থাই কেবল পারে একটি দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তাই জনগণকেই সোচ্চার হতে হবে তাদের নিজেদের অধিকারের জন্য নীতিমালা প্রণয়নে রাষ্ট্রের শাসকদের বাধ্য করাতে।
সংবিধান ও গণতন্ত্র
রাষ্ট্র হিসেবে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রই সর্বাপেক্ষা উত্তম যেখানে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস হয়ে থাকে এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সকল প্রজাই সমান হয়ে থাকে। আর রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা বা সরকার পদ্ধতির জন্য গণতন্ত্রই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভাল পন্থা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মূলত দু’ধরণের। প্রথমটি হল - ডিরেক্ট বা সরাসরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যেখানে সকল প্রজা রাষ্ট্রের সকল স্বিদ্ধান্তে নিজের মতামত প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করবে। আর দ্বিতীয়টি হল- জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের সকল স্বিদ্ধান্ত গ্রহন ও প্রয়োগ করবে যা রিপ্রজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধিমুলক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। দু’পদ্ধতিরই ভাল এবং খারাপ দিক রয়েছে।
সরাসরি পদ্ধতির সবচেয়ে ভাল সুবিধে হল এর মাধ্যমে জনগণের সরাসরি চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অনেক সময় নির্বাচিত হয়ে জনগণকে উপেক্ষা করে সে ধরণের প্রতারনার সুযোগ থাকে না। আরো একটি বড় সুবিধে হল যেহেতু এই পদ্ধতিতে জনগণের সরাসরি মিথষ্ক্রি য়া থাকে তাই এতে বিপুল সংখ্যক জনগণের অংশগ্রহন হয়ে থাকে যা একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য খুবই প্রয়োজনীয় অংশ।
এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় অসুবিধে হল একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি স্বিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই মিথষ্ক্রি য়ার আয়োজন সময় ও অর্থ সাপেক্ষ ব্যাপার। এ কারণে এই ধরণের পদ্ধতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী – যেমন সচলায়তন – এর ক্ষেত্রে উপযোগী। বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তাই নির্বাচিত প্রতিনিধিমুলক পদ্ধতিই উপযোগী হয়ে থাকে। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে সরাসরি পদ্ধতির বা গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত সর্বোত্তম পদ্ধতি হলেও এই পদ্ধতিও ত্রুটিমুক্ত নয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ত্রুটিগুলো প্রকান্তরে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিরও ত্রুটি। সরাসরি বা নির্বাচিত যে পদ্ধতিই হোক না কেন গণতন্ত্রের একটি প্রধান সমস্যা হল “বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শাসন”। যদিও গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মতামত জানা, কিন্তু ক্ষুদ্র অংশের মতামতকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। যদি সেই মতামতকে উপেক্ষা করা হয় তবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীটি সর্ব সময় শোষিত হয়ে চলবে যা কোন সমাজের জন্যও ভাল ফল বয়ে আনবে না। এখানেই মানবতার প্রশ্নটি চলে আসে এবং এ কারণেই আসে সংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা। সংবিধান এমন একটি ব্যবস্থা যা ব্যক্তি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিৎ করার জন্য চেষ্টা করে। অন্য ভাবে বলা যায় ক্ষুদ্র অংশকে রক্ষা করে বৃহতৎ অংশের শোষন হতে। রক্ষা করে দুর্বলকে সবলের হাত হতে। রক্ষা করে নারী ও শিশুকে, রক্ষা করে লঘু সম্প্রদায়কে, রক্ষা করে মুক্ত চিন্তাকে, রক্ষা করে দরিদ্রকে।
নির্বাচিত প্রতিনিধিমুলক পদ্ধতির একটি অসুবিধে হচ্ছে সব সময় সঠিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না। অনেক সময় সঠিক জনপ্রতিনিধি পাওয়া যায় না বা অনেক সময় জনগণ সঠিক প্রতিনিধি খুঁজে পেতে ভুল করে। তাই সংবিধানের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাকে সীমিত করে রাখা যেন তাঁর কখনই নিজেদেরকে জনগণের চেয়ে ক্ষমতাশালী বলে ভাবতে না পারে। সুতরাং বলা যায় সংবিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল ব্যক্তির মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণের ক্ষমতাকেও নিশ্চিত করা। যদি আমরা সংবিধানের এই উদ্দেশ্যগুলো পরিষ্কার করে বুঝতে পারি তবেই বুঝবো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কেমনতর সংবিধান প্রয়োজন।
সংবিধান ও সরকার পদ্ধতি
সংবিধানের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের জবাবদিহীতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিতকরণ। একটি গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতির মূল ক্ষমতার উৎস তিনটিঃ নির্বাহী বিভাগ, আইন প্রণয়ন বিভাগ বা সংসদ ও বিচার বিভাগ। এই তিন বিভাগের স্বাধীনতা, পরষ্পরের মিথষ্ক্রি য়ায় তাদের মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্যের উপরই নির্ভর করে প্রকৃত গণতন্ত্রের ভবিষ্যত। অধুনা আরো কয়েকটি বিভাগের স্বাধীনতাও সুষ্ঠ গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় বলে ধরা হয়। এগুলো হলঃ দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন এবং প্রচার মাধ্যম।
সরকার পদ্ধতির মধ্যে বহুল প্রচলিত পদ্ধতিটি হচ্ছে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি যেখানে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের প্রধান হয়ে থাকেন একই ব্যক্তি, যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে থাকেন যারা সরকারের নির্বাহী কাজ পরিচালনা করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীরা কেবল মাত্র সংসদের কাছে জবাবদিহী হয়ে থাকেন। সংসদ চাইলে যেকোন সময় অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে সরকার ভেঙ্গে দিতে পারেন। এই পদ্ধতির প্রধান সুবিধে হল একই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ নির্বাহী এবং সংসদের সদস্য হওয়ায় সরকার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন সহজেই প্রণয়ন করতে পারেন, যা প্রকান্তরে প্রশাসনে গতিশীলতা আনে। কিন্তু একই ব্যক্তি আইন প্রণয়নকারী এবং প্রয়োগকারী হওয়ায় আইনের অপব্যবহার বা কাল-আইনের প্রণয়নের সম্ভাবনা থেকে যায়। এই সরকার পদ্ধতির দ্বিতীয় অসুবিধেটি হল,সরকারের অনিশ্চিত স্থায়ীত্ব বা মেয়াদকাল। যেহেতু যেকোন মুহুর্তে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে সরকারের পতন সম্ভব তাই সরকার প্রধানকে সব সময় নিজ দলের এবং বিরোধী দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সন্তুষ্ট রেখেই সরকার চালাতে হয়। সরকার প্রধানের নিজ দলের মতের বিরুদ্ধে যেয়ে নিজ চিন্তার প্রতিফলন অনেক সময় সম্ভব হয় না। যদিও এর মাধ্যমে সরকারের নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়, তারপরেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারের মাঝে দলীয় আনুগত্য প্রকাশ পেয়ে যায়। ঠিক সেরকম ভাবে দলীয়ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও দলের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের চিন্তার প্রতফলন ঘটান না বেশিরভাগ সময়ই। এটি আরো খারাপ আকার ধারন করে যখন দলীয় পর্যায়েও গণতন্ত্রের অভাব থাকে তখন সরকার পরিচালনায় ব্যক্তিকেন্দ্রীকতা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে এই কথাটি বিশেষভাবে পরীক্ষিত।
দ্বিতীয় সরকার পদ্ধতিটি হল প্রেসিডেন্সিয়াল বা রাষ্ট্রপ্রধান সরকার পদ্ধতি, যেখানে সরকার প্রধান সরাসরি জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধে হলো রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ আইন প্রনয়ন বিভাগ বা সংসদ হতে পৃথক থাকে। নির্বাহী বিভাগ সরকার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের জন্য সংসদে পাঠান এবং সংসদ সেই আইন পর্যালোচনা করে তা আইন হিসেবে পাশ করেন। রাষ্ট্রপ্রধানেরও সংসদের পাশ করা কোন আইনের উপর ভেটো দেওয়ার অধিকার থাকে যা আবার সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে রহিত করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে গতিশীলতা কিছুটা বাধাগ্রস্থ হলেও গণতন্ত্রের জন্য তা ভাল। এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ এক অপরের উপর নির্ভরশীল এবং এর মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা যায়। আরো একটি সুবিধে পাওয়া যায় তা হল সরকারের নিশ্চিত স্থায়ীত্ব। যেহেতু রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের ভোটে নির্বাচিত তাই সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে। আবার নির্বাচিত হবার পর দলীয় আনুগত্য প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা না থাকায় রাষ্ট্রপ্রধান নিজের চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারেন। সরকারের মেয়াদ শেষে জনগণের কাছে ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপ্রধানের মূল্যায়ন হয় বিধায় জনগণের জন্য কাজ করার চেষ্টা থাকবে বেশি।
আগেই বলেছি যে সরকারের মাঝে যত বেশি জবাবদিহীতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে জনগণের অধিকারও তত বেশি নিশ্চিত হবে। সেই জন্যই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা গনতান্ত্রিক সরকারের কাঠামো তিনটির অন্যতম একটি অংশ। বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের সমান্তরাল একটি স্বাধীন বিভাগ। একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করে আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান ভাবে হচ্ছে কিনা এবং সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়ন হচ্ছে কিনা। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যদি দেখি তবে দেখতে পাই যে আমরা এখনো গণতন্ত্রের এই মৌলিক অংশটিই নিশ্চিত করতে পারিনি। যেখানে স্বাধীন বিচার বিভাগই নেই সেখানে গণতন্ত্রের কোন সুফল আশা করা বৃথা। স্বাধীন বিচার বিভাগের পর পরই আসবে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। বেশিরভাগ দেশেই এই পাঁচটি স্বাধীন বিভাগকে ধরা হয় গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো হিসেবে। আরো উন্নত দেশে প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতার উপরও জোর দেওয়া হয় কারণ সেখানে জনগণের সরাসরি মতামত প্রতিফলিত হয়। আর আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে আমি পুলিশ বিভাগকেও স্বাধীন হিসেবে প্রয়োজন বলে মনে করি। অন্তত স্বাধীন না হলেও নির্বাহী বিভাগ হতে পৃথক করে স্বাধীন বিচার বিভাগে দেওয়া যেতে পারে।
সরকারের বাড়তি কিছু জবাবদিহীতার জন্য সংসদকে দু’কক্ষ বিশিষ্ট করা যাতে পারে। নিম্ন কক্ষ বর্তমান সংসদের মতই থাকতে পারে। অর্থ সংশ্লিষ্ট যেকোন কিছুর ব্যাপারে নিম্ন কক্ষের স্বিদ্ধান্তই চুড়ান্ত হতে পারে। তবে উচ্চ কক্ষ মনে করলে সেটা রহিত করতে পারে। উচ্চকক্ষ আইন প্রণয়ন এবং সংবিধানের সংশোধন এর ব্যাপারে স্বিদ্ধান্ত নিবেন। উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিদের জন্য স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। নিম্ন কক্ষে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারে। তবে উচ্চ কক্ষের প্রতিনিধি বাছাই এর ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা অবলম্বন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন জেলা, বিভিন্ন গোত্র, বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন পেশাজীবি, বিভিন্ন শ্রেনী ও লিঙ্গ ভেদে প্রতিনিধি বাছাই করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে সকল গোষ্ঠীর মতামত প্রতিফলিত হবে যা একটি প্রজাতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয়। সর্বশেষ কাঠামোটি হচ্ছে, সরকার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ। রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করে প্রতিটি প্রদেশে দু’কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ এবং নির্বাচিত প্রদেশিক প্রধান এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগকে আলাদা করা হলে সরকারের মাঝে গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে।
এই সমস্ত কিছু আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে এক ধাপেই অর্জন করা সম্ভবপর নয়। তাই আমাদের দেশের জন্য সর্ব প্রথম প্রয়োজন বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী বিভাগ হতে মূক্ত করা। এর মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার হ্রাস সম্ভবপর হবে এবং আইনের প্রয়োগ সমানভাবে সম্ভবপর হবে। শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন পারে দলীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে, যেন একই ব্যক্তি আজীবন দলীয় প্রধানের পদ অলংকৃত করে না রাখতে পারেন। সর্বোপরি প্রয়োজন একটি নুতন গণতান্ত্রিক দল, যারা জনগণের কাছে তুলে ধরবে সরকার পদ্ধতির পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা।
সংবিধান ও ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি
একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল প্রজা রাষ্ট্রের চোখে সমান। সেখানে কোন ধর্ম বিভেদ, ভাষা বিভেদ, অঞ্চল বিভেদ বা জাতি বিভেদ থাকতে পারে না। এটাই প্রজাতন্ত্রের মূল মন্ত্র। মুসলিম, হিন্দু, খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের যেমন রয়েছে ধর্ম পালনের অধিকার, তেমনি রয়েছে অধার্মিকদের কোন ধর্ম না পালনের। একজন মানুষের যেমন শুদ্ধ বাংলা বলার অধিকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে আরেকজনের আঞ্চলিক ভাষা বা আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের। প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতি, রীতি নীতি পালনের অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের যেমন ব্যক্তি পর্যায়ের মানুষের ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রনের অধিকার নেই তেমনি রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতি থাকাও উচিত নয়।
রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ, ভাষা নিরপেক্ষ এবং সংস্কৃতি নিরপেক্ষ। সংবিধানে সেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্যে সচেষ্ট হতে হবে। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে সকল ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা জ্ঞাপন নয় এবং রাষ্ট্রের পক্ষে সকল ধর্মের সমান মর্যাদা প্রদানও সম্ভব নয়। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে বুঝায় রাষ্ট্রের ধর্মহীনতা। রাষ্ট্রের কোন নিজস্ব ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্র যেমন নাস্তিকতায় মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করবে না তেমনি রাষ্ট্র অন্য ধর্ম পালনেও বিরত থাকবে। ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষ যেকোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশেষ কোন ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে নিতে পারে না।
ধর্মের মত সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রকে বিরত থাকা উচিত। নজরুল না রবীন্দ্রনাথ – কে হবেন আমাদের দেশের কবি এই জাতীয় তর্কের রাষ্ট্রের যাওয়া উচিত নয়। এখানেও ব্যক্তি পর্যায়ে বা বেসরকারী পর্যায়ে যে যার মত নজরুল, রবীন্দ্র, লালন জয়ন্তী করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাইকে সমান ভাবে মর্যাদা দেওয়া সম্ভবপর নয়। এবং এইসব কারণেই জাতিতে বিভক্তি আসে। ইংরেজী, না আরবী, না বাংলা নববর্ষ উৎযাপন করা হবে এই ধরণের বিষয়ে রাষ্ট্রের নাক না গলিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। একই কথা প্রযোজ্য খেলাধুলার উপর। ফুটবল না ক্রিকেট না হাডুডু- কোন খেলায় রাষ্ট্র অগ্রাধিকার দিবে, না সকল খেলায় সমান ভাবে বা আনুপাতিক হারে সাহায্য করবে এই সব রাষ্ট্রের চিন্তা হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্র যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকারই নিশ্চিত করতে পারছে না সেখানে এই সব ব্যপারে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। এর ফলে সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়, ধর্ম মন্ত্রনালয়, ক্রীড়া মন্ত্রনালয় এর মত মন্ত্রনালয়গুলোতে জনগণের ট্যাক্সের টাকা নষ্ট হবার হাত হতে রক্ষা পাবে।
ভাষার ব্যাপারটি কিছুটা ভিন্ন , ধর্ম বা সংস্কৃতির তুলনায়। রাষ্টের ধর্ম বা সংস্কৃতির প্রয়োজন না থাকলেও যোগাযোগের মাধ্যমের জন্য কোন না কোন একটি ভাষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বাংলাদেশের সৃষ্টিতে ভাষা এবং ভাষাশহীদদের অবদানের কথা বিবেচনা করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রের ব্যবহারের জন্য প্রথম পছন্দ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে সকল ভাষার সমান অধিকার নিশ্চিত হয় না। এ কারণে অঞ্চলভেদে যারা যার আঞ্চলিক ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। সবশেষে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজী ভাষাকে তৃতীয় পছন্দ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। এভাবে জনগণের সামনে তিনটি বিকল্পের যেকোন একটি বেছে নেবার সুযোগ থাকে।
অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন তা নয়, বিশেষ করে সংস্কৃতির ব্যাপারে। কারণ এতে দেশীয় সংস্কৃতি বা দেশীয় খেলাধুলা বা আমাদের ভাষা ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তবে আমার মতে পরিবর্তন বা বিবর্তন যদি হয়ই , তা সময়ের প্রয়োজনেই হয় এবং সেই পরিবর্তন আমি বা আপনি অস্বীকার করতে পারি কিন্তু ঠেকাতে পারবো না।
সংবিধান ও শিক্ষা
মানুষ পুরোপুরি ব্লাঙ্ক স্লেট হয়ে জন্ম না নিলেও, সুন্দর পরিবেশ এবং সঠিক শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে একটি শিশুকে মুক্ত চিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ কারণে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম একটি উন্নত জাতি গঠনের জন্য। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মাঝে শিক্ষা অন্যতম এবং প্রতিটি মানুষের শিক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। জাতির এক অংশকে শিক্ষার আলো হতে বঞ্চিত রেখে কোন জাতির পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। জনগণের করের অর্থ যদি সর্বপ্রথম কোথাও ব্যবহৃত হতে হয় তবে আমি শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিব। আমাদের সংবিধানেও সকলের জন্য শিক্ষার কথা বলা হয়েছে এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ এ, সকলের জন্য শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
বৈষম্যহীন শিক্ষার জন্য প্রথমত যেটা প্রয়োজন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত অভিন্ন পাঠ্যসুচি প্রণয়ন করা। শিশুর জন্মলগ্ন থেকেই যদি তাকে বাংলা, ইংরেজী, ও আরবী মাধ্যমে বিভক্ত করে ফেলি তাহলে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি কি করে? তারপর যেটা প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারী এবং শহর ও গ্রাম ভিক্তিক শিক্ষার বিভাজন দূর করা। উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক হওয়া উচিত। তবে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশুনা নিখরচার হওয়ার প্রয়োজন নেই এবং প্রয়োজনে সরকার বিনা সুদে বা অল্প সুদে ঋন দিতে পারে। কারিগরী শিক্ষার জন্য সরকার অর্ধেক ঋন এবং অর্ধেক বৃত্তি হিসেবে দিতে পারে। বিদেশ গমন কারীদের জন্য মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিকের পরে ছয়মাস বা এক বছরের কারিগরী ও ভাষার প্রশিক্ষন দেওয়া যেতে পারে। যে কোন চাকুরীর ক্ষেত্রেই মাধ্যমিকের নীচে চাইতে পারবে না এমন নিয়ম করা উচিত। প্রতিবন্দ্বী শিশুদের জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে বা প্রতিটি জেলায় তাঁদের জন্য আলাদা বিভাগ বা বিদ্যালয় রাখা উচিত। এবং দরিদ্র শিশুদের পরিবারের জন্য বৃত্তি প্রদান করা উচিত।
স্নাতক পর্যায় নিয়ে খুব বেশি না বলে স্নাতকোত্তর পর্যায় নিয়ে বলছি। একটি দেশের উন্নতির জন্য খুব প্রয়োজন নিজ দেশের উপযোগী প্রযুক্তি এবং যার জন্য প্রয়োজন গবেষনা। গবেষনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য এই খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বাড়ানো উচিত এবং স্নাতকোত্তর কোন ছাত্র যেন গবেষনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারে তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সকলের স্নাতকোত্তর শিক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধু মাত্র যারা শিক্ষকতা এবং গবেষনায় আগ্রহী হবে তাদেরকেই স্নাতকোত্তর শিক্ষায় ভর্তির সুযোগ দেওয়া উচিত।
সবশেষে ভাল শিক্ষার প্রথম শর্ত হচ্ছে ভাল শিক্ষক। দেশের মেধাবীদের শিক্ষকতার পেশায় আনার জন্য শিক্ষকদের প্রতিটি স্তরে ভাল বেতন প্রদান প্রয়োজনীয়। একজন শিক্ষক যদি জীবন সংগ্রামে নিজেই নৈতিকতার পথ পরিহার করেন, তবে তিনি কি করে অন্যকে শিক্ষা দিবেন। আমরা যতদিন পর্যন্ত শিক্ষককে সম্মানিত না করবো, ততদিন আসলে কোন সংস্কার বা শিক্ষানীতিই কাজে আসবে না। উন্নত শিক্ষক তৈরীর জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষন ব্যবস্থার প্রয়োজন। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটিকে আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা খুব সহজেই ডিজিটাল পাঠ্য পুস্তক, মাল্টিমিডিয়া লেকচার, অনলাইন গ্রন্থাগার তৈরী করতে পারি। নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির সাহায্যে দূর-শিক্ষন পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে দূর-শিক্ষন পদ্ধতি আমি শুধু মাত্র উচ্চ শিক্ষা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করবো। আমাদের দেশের বিপুল জনসংখ্যার বিচারে চাইবো যত বেশি মানুষকে কাজে লাগানো যায়। তবে অবকাঠামো তৈরী করে রাখা যায়, যেন প্রয়োজনে দূর-শিক্ষনের সাহায্য নিতে পারে যে কেউ।
এ ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক নীতির প্রশ্ন চলে আসেঃ
প্রথমত - শিক্ষা দান পদ্ধতি। মূলত আমাদের দেশের শিক্ষা প্রদান পদ্ধতি এবং পরীক্ষন পদ্ধতি যেটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে সেটা মধ্যযুগীয় পদ্ধতি। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষককেরাই শিক্ষা দেওয়া বলতে বুঝায় একটি নির্দিষ্ট বই শুধু পড়ে যাওয়া। যদি শুধু বই এর একটি অংশ পড়তেই হয় তবে তার জন্য শিক্ষকের কি প্রয়োজন, সেটা একজন ছাত্র নিজেই তা করতে পারে। আর পরীক্ষন পদ্ধতিতে এখনো বিচার হয় কে কত বেশি মুখস্থ করতে পারে তা। প্রয়োজন একজন ছাত্র/ছাত্রী বিষয়টুকু কতটুকু বুঝতে পেরেছে সেটি। তার জন্য শিক্ষা প্রদান ও পরীক্ষণ পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজন। তবে এটি সর্বাগ্রে বুঝতে হবে একজন শিক্ষককে।
এই শিক্ষা পদ্ধতির জন্য আমি প্রতিটি বিষয়কে তাত্বিক ও ব্যবহারিক ক্লাসে ভাগ করতে চাই। প্রতিটি বিষয়ে ৩০ মিনিট লেকচারের জন্য থাকবে আর এক ঘন্টা থাকবে ব্যবহারিকের জন্য। লেকচার ও ব্যবহারিক ক্লাস এমন ভাবে সমন্নয় করতে হবে যেন শিক্ষক বুঝতে পারেন তিনি যা দিতে চেয়েছেন তা ছাত্ররা বুঝতে পেরেছে কিনা আর ছাত্র/ছাত্রীরাও বুঝতে পারে শিক্ষক যা বুঝিয়েছেন তা তাঁরা বুঝেছে কিনা। ব্যবহারিক ক্লাসের শেষ দশ বা পনের মিনিটে শিক্ষক ছোট্ট কুইজ নিতে পারেন, যার মাধ্যমে ছাত্ররা কতটুকু বুঝতে পারলো তার একটি পরিমাপও হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে ছাত্রটির ক্লাসেই পড়া হয়ে গেল এবং তাঁর বাসায় গিয়ে আরো বেশি পড়ার প্রয়োজন পড়বে না। সমাপনী পরীক্ষায় শতকরা ৩০ বা ৪০ ভাগের বেশি নম্বর রাখা উচিত নয়।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল পাঠ্যসূচি। কি কি বিষয় পড়ানো উচিত? মৌলিক বিষয় হিসেবে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর নিম্ন বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। উচ্চ-মাধ্যমিক শেষে একজন ছাত্র/ছাত্রী যেন এই মূল বিষয়গুলোর প্রাথমিক পর্যায়ের জ্ঞানগুলো অল্প বিস্তর জানে সেটা আমাদের নিশ্চিত করা উচিত।
ভাষাঃ বাংলা, ইংরেজী, ঐচ্ছিক বিষয়ঃ আঞ্চলিক বাংলা ভাষা, আদিবাসী ভাষা, আরবী ভাষা।
বিজ্ঞানঃ পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, চিকিতসা বিজ্ঞান, জ্যোতির বিজ্ঞান।
গণিতঃ পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতিসহ সকল ধরনের প্রাথমিক গণিত।
সমাজঃ সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, আইন।
ইতিহাসঃ বাংলাদেশের ইতিহাস, উপমহাদেশের ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, সাধারণ জ্ঞান, সম-সাময়িক ঘটনা।
প্রযুক্তিঃ কম্পিউটার প্রযুক্তি, অন্তর্জাল।
সাংস্কৃতিকঃ চিত্র কলা, সঙ্গীত, নাটক, লেখালেখি, বিতর্ক ইত্যাদি।
শারীরিকঃ ড্রিল, খেলাধুলা, সাতার, ভ্রমণ, স্কাউট।
নৈতিকতাঃ সেইফটি জ্ঞান, ধর্ম, দর্শন ।
সবশেষে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯:
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ এর খসড়াতে বেশ কিছু ভাল প্রস্তাব উঠে এসেছে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়েছে এবং সকলের ক্ষেত্রে অভিন্ন পাঠ্য সূচি রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং তা অবৈতনিক রাখা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তর ধরা হয়েছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত। বাস্তবতার বিবেচনায় আমি বলব প্রাথমিক শিক্ষাকে বর্ধিত করা এবং সে পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক রাখা ঠিক আছে। তারপরেও আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে সবাই যেন মাধ্যমিক স্তর শেষ করে। ২০১১-১২ এর মাঝে ১০০ ভাগ শিশুকে শিক্ষার তলে আনার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবন্দ্বী শিশুদের জন্য বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দরিদ্র শিশুদের জন্য উপবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। মুখস্থ বিদ্যা থেকে সরে এসে সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সার্বিকভাবে যেসব প্রস্তাব এসেছে সেগুলো বাস্তাবয়ন করা গেলে শিক্ষার মান অনেকাংশে বাড়বে বলে আমার ধারণা। তবে একটি বিষয় না বললেই নয় তা হল -বলা হয়েছে সাংবিধানিক সেকুলার নীতির কথা। কিন্তু আমাদের বর্তমান সংবিধান সেকুলার নয়। সে ক্ষেত্রে এই নীতি প্রনয়নের আগে সংবিধানের পরিবর্তন বাঞ্চনীয়। আবার সেকুলারের কথা বলেও নৈতিক শিক্ষার জন্য যার যার ধর্মের মাঝেই ফিরে যাই। এখানে একজন ছাত্র/ছাত্রী শুধু তাঁর নিজের ধর্ম পড়বে নাকি যে মূল চারটি ধর্মের কথা বলা হয়েছে সব গুলোই পড়বে তা পরিষ্কার করা হয়নি। যদিও সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদান মানেই সেকুলার নয়, তারপরেও নিদেন পক্ষে সকল ধর্ম সম্পর্কে জানলেও একজন মানুষ ধর্মের মূল সুরটি ধরতে পারবে বলে মনে হয়। তাই বৈষম্যহীন শিক্ষা দিতে হলে সকল ধর্মই প্রতিটি ছাত্র/ছাত্রীর পড়া উচিত।
সবশেষে নীতি কি করা হল সেটার চেয়ে মুখ্য বিষয় হল নীতির কতটুকু গ্রহন করার জন্য আমরা আন্তরিক। আমরা যদি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি নাই করতে পারি তবে আমাদের সকল সংস্কারই ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই মুক্ত চিন্তার জাতি গঠনের জন্য সবার আগে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করতে হবে।
সংবিধান ও স্বাস্থ্যসেবা
শিক্ষার পর মৌলিক যে চাহিদাটি মানুষের প্রয়োজন তা হল স্বাস্থ্যসেবা। আমি সুস্থ আছি সেটা যে কত বড় নিয়ামক সেটা আমরা অসুস্থ হবার আগ পর্যন্ত বুঝিনা। বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতির পরও এখনো অনেক রোগই রয়ে গেছে আমাদের চিকিৎসার বাহিরে। তাই মৃত্যুকে আমরা জয় করতে পারিনি এখনো। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পরিবারের যখন কেউ অসুস্থ হয়ে পরে তখন সেই মানুষটির সুস্থতার জন্য পরিবারের সদস্যরা সর্বপ্রকার চেষ্টাই করে। এটাই মানবের স্বাভাবিক ধর্ম।
একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল মানুষের সমান চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। শুধু মাত্র অর্থের অভাবে কোন প্রাণ বিনা চিকিৎসায় ধীরে ধীরে মৃত্যুকে বরণ করবে সেটা হতে পারে না। তাই সকলের সমান স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দায়ভার রাষ্ট্রের। এমন একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিতে হবে যেন সকল চিকিৎসা কেন্দ্র গুলোতে, তা রাষ্ট্র পরিচালিত হোক বা ব্যক্তিগত ভাবে পরিচালিত হোক, জনগণ সমান স্বাস্থ্যসেবা পায়। তার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।
একটি কেন্দ্রীয় ভাবে পরিচালিত বীমা এই কাজে সাহায্য করতে পারে। ব্যবস্থাটি এমন হবে যে সকল জনগণ তার স্বাস্থ্য সেবার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রকে প্রতি মাসে প্রদান করবে। যদি কোন মাসে সে অসুস্থ হয় তবে তিনি সরাসরি যেকোন ডাক্তার এর কাছে যাবেন এবং চিকিৎসার জন্য যা যা প্রয়োজনীয় তা তিনি করবেন। এর সকল খরচ রাষ্ট্র সরাসরি উক্ত চিকিৎসা কেন্দ্রকে প্রদান করবে। এই বীমা ব্যবস্থা পরিসংখ্যানের কিছু নিয়ম মেনে চলে। ধরা হয় যে, প্রতি মাসে দেশের সকল জনগণ একত্রে অসুস্থ হয়ে পড়বে না। কিন্তু যেহেতু সবাই প্রতি মাসে তাঁদের কিস্তি প্রদান করে থাকে, তাই যারা অসুস্থ হয়নি তাঁদের টাকা দিয়ে অসুস্থদের চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব। এখন, আপনি নিজেও যদি কোন এক সময় কঠিন অসুস্থ হোন, আপনিও চিকিৎসা পাবেন। ব্যাপারটি অনেকটা নিজের ভবিষ্যতের অসুস্থতার কথা চিন্তা করে সব সময় অল্প অল্প করে অর্থ সঞ্চয় করে রাখা।
তবে এরকম একটি ব্যবস্থা রাতারাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও নীতিমালার প্রয়োজন। একটি সমন্বিত তথ্যকেন্দ্র থাকতে হবে যেখানে প্রতিটি নাগরিকের তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। পুরো স্বাস্থ্যসেবাকে একটি কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কের মাঝে নিয়ে আসতে হবে। দূর-চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শুরুতে আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য কিছু বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোকই দরিদ্র, যাদের প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেওয়া সম্ভব হবে না আবার বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে সবসময় ভর্তুকি দিয়েও রাষ্ট্র চলতে পারবে না। এই সমস্যা আমাদের সর্ব ক্ষেত্রেই থাকবে। এ কারণে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় না বাড়িয়ে সত্যিকার অর্থে কিছু করা কষ্টকর হবে। তাই অর্থনীতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
সংবিধান ও অর্থনীতি
মানুষের বাকী মৌলিক চাহিদা গুলো হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান। এই সবগুলো সরাসরি জীবিকার সাথে সম্পর্কিত। এক কথায় বলা যায় একজন মানুষ চায় তাঁর একটি জীবিকা অর্জনের পথ থাকবে যা দিয়ে সে তাঁর এই মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে। মানুষ আসলে কি খুব বেশি কামনা করে? সে চায় সমাজে তাঁর জন্য একটি কাজ থাকবে, যে কাজ দিয়ে সে তাঁর সংসারটিকে সুন্দর ভাবে চালাতে পারবে। পরিবারের সকল সদস্যের মাঝে খাবার তুলে দিতে পারবে। সন্তানদের শিক্ষার আলো দিতে পারবে। পরিবারের কোন সদস্য অসুস্থ হলে তাকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবে। পরিশেষে নিজে যখন কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে, তখন তাঁর সন্তান বা রাষ্ট্র তাঁর দেখাশুনা করবে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি একটি জটিল ব্যবস্থা। আমরা আজ একটি জটিল ধাঁধার মাঝে আছি। সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী একজোট হয়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় মানুষকে শোষণ করে। আবার সম্পূর্ণ সমবায় ব্যবস্থায় কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজের শ্রম ব্যয় না করে সমবায় ব্যবস্থার সুবিধে নিয়ে অর্থনীতির চাকাকে স্থবির করে দেয়। এখন এই দুই দ্বন্দের মুক্তি হল মিশ্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কিন্তু ঠিক কতটুকু সমবায় আর কতটুকু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা একটি গতিশীল অর্থনীতির জন্য প্রযোজ্য সেটা বের করাই আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য।
সমাজে বিভাজন নেই সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। সমাজে অধিক কর্মক্ষম ব্যক্তি আছে আবার কম কর্মক্ষম ব্যক্তি আছে, অধিক মেধাবী আছে আবার কম মেধাবী আছে, অধিক বয়সী বা অভিজ্ঞ ব্যক্তি আছে আবার কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি আছে, কারিগরী ও প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি আছে আবার নন-ঢেঁকি ব্যক্তি আছে। সুতরাং বিভাজন কিছুটা থাকবেই। তবে বিভিন্ন পেশাবিদদের বেতন স্কেল ভিন্ন না করে অভিন্ন করার পক্ষপাতিত্বে আমি। বেতন স্কেলের বিভাজন কেবল মাত্র হবে কর্মক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও মেধার ভিত্তিতে।
অর্থনীতিকে সবল করতে হলে দেশের আমদানি ও রপ্তানীর মাঝে ভারসাম্য থাকতে হবে। আমদানীকে কমিয়ে রপ্তানী যত বাড়ানো যাবে তত অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। এখন আমদানী কমানোর অনন্য উপায় হচ্ছে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো। সর্বক্ষেত্রে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করা। তার জন্য প্রয়োজন দেশীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো যা বিশ্ববদ্যালয়গুলোতে গবেষনার মাধ্যমে হতে পারে। দেশীয় প্রয়োজন মেটানোর পর, উদ্বৃত্ত দেশের বাহিরে রপ্তানী করা। আমরা যদি কোন পণ্য রপ্তানী নাও করতে পারে, শুধু জনসম্পদ রপ্তানী করেই প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।
রাষ্ট্রের যদি কোন খাতে বিনিয়োগ করতে হয় তবে বিনিয়োগ করা উচিত দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য। মানুষকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া উচিত দেশীয় কল-কারখানা গড়ার জন্য। বিনিয়োগ করা উচিত জনসম্পদ রপ্তানী খাতে। মানুষকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া উচিত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের জন্য এবং বিদেশ গমণের ব্যয়ভার বহনের জন্য। বিনিয়োগ করা উচিত তথ্য প্রযুক্তিতে। দেশের সকল জনগণের জন্য একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা উচিত। দেশের সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে একটি নেটওয়ার্কের মাঝে নিয়ে আসা উচিত। সকল সরকারী/বেসরকারি কর্মকাণ্ড অন্তর্জাল ও মোবাইল এর আওয়তায় নিয়ে আসা উচিত। বিনিয়োগ যদি করতে হয় তবে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা উচিত। গবেষণায় করা উচিত। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় করা উচিত।
শেষ কিছু কথাঃ
অনেকেই লেখাটি পড়ে ভাবতে পারেন পুরোটাই ইউটোপিয় চিন্তাভাবনা। আবার অনেকেই এর মাঝে সোস্যালিষ্ট চিন্তাধারণার ছায়াও পেতে পারেন। হ্যাঁ, অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিন্তাগুলো স্বপ্নের মতই। দেশের যে কোন উন্নতি সম্ভব, এমন ধারণা পোষণকারী খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। কিন্তু আমি বলবো অসম্ভব কোন কিছুই নয়। আমি যে সমাজ ব্যবস্থার কথা বলেছি, তা পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশগুলোতে বিদ্যমান। তাঁরা উন্নত এজন্য নয় যে তাঁদের সমাজ ব্যবস্থা উন্নত। তাঁরা উন্নত কারণ, তাঁরা নিজেদের দেশের অর্থনীতিকে উন্নত করেছে। এ কারণে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করাই হবে আমাদের মৌলিক লক্ষ্য। আবার অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, শাসন ব্যবস্থা সব এক অপরের উপর নির্ভরশীল এবং সম্পর্কিত। একটি ব্যতীত অন্যটিকে উন্নত করা সম্ভব নয়। তাই আসলে প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। প্রয়োজন গণমানুষের মৌলিক চাহিদার লক্ষ্যে একটি নীতিমালা এবং একটি স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা, যেন একটি গতিশীল অর্থনীতি পাওয়া যায় এবং সেই সাথে সকলের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।
সোস্যালিজমের ছায়া পেতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে উন্নত দেশগুলো কিন্তু সোস্যালিষ্ট দেশ নয়। বরং বলা যেতে পারে মিশ্র অর্থনীতির দেশ। ধীরে ধীরে সকল রাষ্ট্রই এই সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবে। আবার এই সমাজ ব্যবস্থাও যে ত্রুটিমুক্ত তা নয় কিন্তু। এখনো উন্নত দেশগুলোর মাঝে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব বিরাজমান, কারণ আমাদের প্রকৃত গনতন্ত্রের অভাব। বর্তমানে যে গণতন্ত্র বিরাজমান তা কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের হাতে জিম্মি। এই কথাটি উন্নত, উন্নয়নশীল সকল দেশের জন্যই প্রযোজ্য। এই অসাধু চক্রটি জনগণের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মুখোশ নিয়ে আসে, কিন্তু আদতে তারা শোষনের যন্ত্রটি ঠিকই চালু রাখে। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য একটিই - জনগণের করের টাকায় জীবন ভোগ (বিভিন্ন রাজনীতিবিদগণ ও ঋনখেলাপীদের হাজার কোটি টাকার সম্পদ দ্রষ্টব্য)। এরা তাই ঋণ খেলাপী হয়েও বড় বড় দলের অর্থের জোগানদার, এরাই দেশের অর্থনীতির নীতি নির্ধারক। এরা তাই দেশের কোন মৌলিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী নয়। এ কারণেই যে সরকারই ক্ষমতা আসুক, শাসন ব্যবস্থা একই ভাবেই চলে।
রাজনীতিবিদগণ ধীরে ধীরে এই অসাধু চক্রটির শোষনের যন্ত্র হয়ে উঠে, কখনোবা নিজেই চক্রটির অংশ হয়ে যায়। এই অসাধু চক্রটিকে চিহ্নিত করতে হবে এবং এদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। বিদ্যমান শাসন যন্ত্রে সেটি কখনই সম্ভব হবে না। আমাদের প্রয়োজন একবিংশ শতাব্দীর জন্য নতুন একটি দল গঠন করা যারা জনগণের সামনে বিকল্প হয়ে আসবে। এটি হতে হবে সম্পূর্ণ এই প্রজন্মের হাতে তৈরি। এদের কাজ হবে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এই অসাধু চক্রটিকে চিহ্নিত করা এবং জনগণের কাছে এদের মুখোশ খুলে দেওয়া। এভাবে আগামী দশ বা পনের বছরে যদি এই দলটি জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে পারে তবেই কাঙ্খিত পরিবর্তন সম্ভব। অন্যথায় এক শ্রেনীর মানুষ শুধু সম্পদের পাহাড় গড়বে আর অধিকাংশ মানুষ শুধু বেঁচে থাকার জন্যই প্রাণান্তকর সংগ্রাম করে চলবে এবং ঈশ্বরের দোষারোপ করে চলবে।
Wednesday, October 7, 2009
রেসিজম
রেসিজম, মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে আদি শত্রু এবং মানুষের সবচেয়ে পুরোন সাথী। মানুষ যেদিন হতে ঈশ্বর আর শয়তান নামের দু’জনকে চিন্তা করতে শুরু করলো এবং ভাল ও খারাপ কাজের জন্য যথাক্রমে দু’জনকে দায়ী করতে থাকলো, সেদিন হতে রেসিজম মানুষের চিন্তার সঙ্গী। ছোটবেলায় পড়েছি, “পাপকে ঘৃনা কর, পাপীকে নয়’- এই কথাটি আজো অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়ে রয়ে আছে। যেদিন হতে আমরা ভেবেছি ভাল কাজ হচ্ছে ঈশ্বরের আর খারাপ কাজ হচ্ছে শয়তানের, তখনই আমরা খারাপ কাজের মানুষগুলোকে আলাদা করে ফেলেছি - কারণ তারা শয়তানের উপাসনা করে, ভালোর নয়।
যুগে যুগে রেসিজমের চিন্তা ধারণা নানান ভাবে আমাদের মধ্য দিয়ে বংশ পরম্পরায় বয়ে চলেছে। একদম আদিম সমাজের মানুষ শুধু মাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে প্রকৃতির সাথে বা প্রকৃতির অন্য জীবের সাথে বা এক অন্যের সাথে লড়াই করতো। সেখানে গোত্রবিশেষের বা মানুষের নিজেদের মাঝে বিদ্ধেষের বিশেষ সুযোগ ছিল না। কিন্তু যখন গোত্র গোত্র বিশেষ মিলে সমাজ হল, সমাজ হতে রাষ্ট্র হল, সমাজে আচরণ বিধি হল, সমাজ ও রাষ্ট্রে শাসক এবং শাসিত গোষ্ঠি হল, এরই কোন পর্যায়ে মানুষে মানুষে বিভেদের সৃষ্টি হল।
ধর্মগুলো মানবতার কথা বললেও রেসিজম থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত হতে পারলো না। ইহুদী ধর্মগ্রন্থে বলা হয় ইহুদীরা ঈশ্বরের পছন্দের জাতি। গ্রীক পূরাণেও গ্রীক জাতি নিজেদের ঈশ্বরের সন্তান মনে করে। এভাবে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে যে ধরণের হিংসার বীজ রয়েছে, তাতে মনে হয়েছে যে ধর্মগ্রন্থগুলো ঈশ্বরের বাণী হতে পারে না। একজন ঈশ্বরের কাছে তার সৃষ্টির মাঝে কোন পার্থক্য থাকতে পারে না। শুধু ধর্মগ্রন্থই নয়, দর্শনগুলোও নিজেদের সম্পুর্ণ মুক্ত করতে পারেনি রেসিজম হতে। একারণেই আমরা দেখি এরিষ্টটল, কান্ট, হেগেলের মত বিখ্যাত দার্শনিকদেরকেও রেসিজমের বীজ অন্তরে ধারণ করতে। এরিষ্টটল মনে করতেন যে গ্রীক জাতি প্রকৃতগত ভাবে মুক্ত এবং বর্বর (প্যাগান বা নন-গ্রীক) জাতি প্রকৃতগত ভাবেই দাস। কান্ট এবং হেগেল উভয়েই মনে করতেন যে, কালো মানুষদের বুদ্ধি কম এবং তারা সাদা মানুষের তুলনায় নীচু জাতের।
আমার মতে, রেসিজমের মূলে রয়েছে অন্ধ-বিশ্বাস এবং অহংকার। আমার বিশ্বাস, বা ধর্ম, বা জাত অন্যদের তুলনায় ভিন্ন এবং উৎকৃষ্ট - এই ধরণের চিন্তার প্রতফলনই হল রেসিজম। তাই আমরা দেখি ধর্মযুদ্ধগুলো থেকে শুরু করে বিশ্বযুদ্ধ এবং আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে বা হচ্ছে তার সবকয়টির সাথেই এই রেসিজম ওতপ্রেতভাবে জড়িত। মানবতা হয়েছে লুন্ঠিত। অন্ধ-বিশ্বাসের প্রকৃতিটি বুঝা খুব জরুরী যদি আমরা রেসিজমকে চিহ্নিত করতে চাই। নিজের বিশ্বাসকে অন্ধ ভাবে পালন করে যদি মানবতাকে উপেক্ষা করি এবং মানুষের মাঝে বিভেদের দেয়াল তুলে দেই তবে, নিজের অজান্তেই রেসিজমের বীজ বপণ করে চলবো। এক জন ধর্মপ্রাণ মানুষ, যিনি কোনদিন হয়তো মিথ্য বলেননি বা অন্যায় করেননি, তিনিও হয়তো একজন নাস্তিককে ঘৃনা করতে পারেন, কিংবা একজন নাস্তিক, নিজেকে মুক্তচিন্তার অধিকারী দাবী করেও, যদি এই ধারণা পোষন করেন যে ধর্মপ্রাণ মানুষই সমাজকে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে, তাহলে তিনিও রেসিজম অন্তরে ধারণ করছেন। ধর্ম নয়, ধর্মের মাঝে বিদ্যমান রেসিজমই দায়ি সভ্যতাকে পেছনে নেওয়ার জন্য।
অন্ধ-বিশ্বাস শুধু মাত্র ধর্ম বা বর্ণেই বিদ্যমান তা নয়। যদি নিজের মতবাদকেই সেরা হিসেবে গন্য করি, , বা সিনিয়র কলিগ হয়ে জুনিয়র কলিগদের তাচ্ছিল্য করি, বা একজন ব্লগার হয়ে সহব্লগারের মতামতকে হেয় প্রতিপন্য করি, বা দেশের সমস্ত রাজনীতিবিদদের চোর মনে করি, বা প্রবাসী সব ভাইয়দের স্বার্থপর মনে করি, বা গরীবলোক মানেই চুরি করে মনে করি, বা কাজের লোকদের যথাযথ সম্মান না দিই, বা বুয়েটের ছাত্র বা ইডেনের ছাত্রী বলে নিজেকে একটু ভিন্ন মনে করি, বা আমার ছেলে কোন অপরাধ করতে পারে না এমন ধারণা মা হিসেবে পোষন করি, বা সকল তরুণদের উচ্ছৃঙ্ঘল মনে করি, বা সকল বুইড়াদের ফালতু মনে করি – এই সবই অন্ধ-বিশ্বাসের প্রতিফলন। আর যখন এই অন্ধ-বিশ্বাষটুকু প্রকট হয়, তখন ভিন্ন মতালম্বী মানুষটিকে আর মানুষ হিসেবে দেখা হয় না – যাহাই রেসিজমের সৃষ্টি করে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নিজেকে মুক্তচিন্তার মানুষ বলে দাবী করলেও, প্রকৃত রেসিজম থেকে মুক্ত থাকা কতটা কষ্টকর। নিজেও যে এর উর্ধ্বে ছিলাম দাবী করি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় কালে অমনোযোগী ছাত্রদের হেয় করেছি, দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেছি সেটা তাদের ভালোর জন্যই করেছি, কিন্তু আজ উক্ত কাজ ভুল ছিল স্বীকার করি। মানবতা এবং অহিংসাকে জীবনের পাথেয় করেছি। সকল মানুষ সমান এবং সকলের সমান ভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে এই পৃথিবীতে, এটা বিশ্বাস করি। শুধু সকল মানুষ নয়, সকল জীবেরই বাঁচার সমান অধিকার রয়েছে বলেই মনে করি। একে অন্যের বিশ্বাস এবং মতামতের উপর সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাশীলতার মাধ্যমেই আমরা পারি রেসিজমকে পেছনে ফেলে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
যুগে যুগে রেসিজমের চিন্তা ধারণা নানান ভাবে আমাদের মধ্য দিয়ে বংশ পরম্পরায় বয়ে চলেছে। একদম আদিম সমাজের মানুষ শুধু মাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে প্রকৃতির সাথে বা প্রকৃতির অন্য জীবের সাথে বা এক অন্যের সাথে লড়াই করতো। সেখানে গোত্রবিশেষের বা মানুষের নিজেদের মাঝে বিদ্ধেষের বিশেষ সুযোগ ছিল না। কিন্তু যখন গোত্র গোত্র বিশেষ মিলে সমাজ হল, সমাজ হতে রাষ্ট্র হল, সমাজে আচরণ বিধি হল, সমাজ ও রাষ্ট্রে শাসক এবং শাসিত গোষ্ঠি হল, এরই কোন পর্যায়ে মানুষে মানুষে বিভেদের সৃষ্টি হল।
ধর্মগুলো মানবতার কথা বললেও রেসিজম থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত হতে পারলো না। ইহুদী ধর্মগ্রন্থে বলা হয় ইহুদীরা ঈশ্বরের পছন্দের জাতি। গ্রীক পূরাণেও গ্রীক জাতি নিজেদের ঈশ্বরের সন্তান মনে করে। এভাবে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে যে ধরণের হিংসার বীজ রয়েছে, তাতে মনে হয়েছে যে ধর্মগ্রন্থগুলো ঈশ্বরের বাণী হতে পারে না। একজন ঈশ্বরের কাছে তার সৃষ্টির মাঝে কোন পার্থক্য থাকতে পারে না। শুধু ধর্মগ্রন্থই নয়, দর্শনগুলোও নিজেদের সম্পুর্ণ মুক্ত করতে পারেনি রেসিজম হতে। একারণেই আমরা দেখি এরিষ্টটল, কান্ট, হেগেলের মত বিখ্যাত দার্শনিকদেরকেও রেসিজমের বীজ অন্তরে ধারণ করতে। এরিষ্টটল মনে করতেন যে গ্রীক জাতি প্রকৃতগত ভাবে মুক্ত এবং বর্বর (প্যাগান বা নন-গ্রীক) জাতি প্রকৃতগত ভাবেই দাস। কান্ট এবং হেগেল উভয়েই মনে করতেন যে, কালো মানুষদের বুদ্ধি কম এবং তারা সাদা মানুষের তুলনায় নীচু জাতের।
আমার মতে, রেসিজমের মূলে রয়েছে অন্ধ-বিশ্বাস এবং অহংকার। আমার বিশ্বাস, বা ধর্ম, বা জাত অন্যদের তুলনায় ভিন্ন এবং উৎকৃষ্ট - এই ধরণের চিন্তার প্রতফলনই হল রেসিজম। তাই আমরা দেখি ধর্মযুদ্ধগুলো থেকে শুরু করে বিশ্বযুদ্ধ এবং আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে বা হচ্ছে তার সবকয়টির সাথেই এই রেসিজম ওতপ্রেতভাবে জড়িত। মানবতা হয়েছে লুন্ঠিত। অন্ধ-বিশ্বাসের প্রকৃতিটি বুঝা খুব জরুরী যদি আমরা রেসিজমকে চিহ্নিত করতে চাই। নিজের বিশ্বাসকে অন্ধ ভাবে পালন করে যদি মানবতাকে উপেক্ষা করি এবং মানুষের মাঝে বিভেদের দেয়াল তুলে দেই তবে, নিজের অজান্তেই রেসিজমের বীজ বপণ করে চলবো। এক জন ধর্মপ্রাণ মানুষ, যিনি কোনদিন হয়তো মিথ্য বলেননি বা অন্যায় করেননি, তিনিও হয়তো একজন নাস্তিককে ঘৃনা করতে পারেন, কিংবা একজন নাস্তিক, নিজেকে মুক্তচিন্তার অধিকারী দাবী করেও, যদি এই ধারণা পোষন করেন যে ধর্মপ্রাণ মানুষই সমাজকে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে, তাহলে তিনিও রেসিজম অন্তরে ধারণ করছেন। ধর্ম নয়, ধর্মের মাঝে বিদ্যমান রেসিজমই দায়ি সভ্যতাকে পেছনে নেওয়ার জন্য।
অন্ধ-বিশ্বাস শুধু মাত্র ধর্ম বা বর্ণেই বিদ্যমান তা নয়। যদি নিজের মতবাদকেই সেরা হিসেবে গন্য করি, , বা সিনিয়র কলিগ হয়ে জুনিয়র কলিগদের তাচ্ছিল্য করি, বা একজন ব্লগার হয়ে সহব্লগারের মতামতকে হেয় প্রতিপন্য করি, বা দেশের সমস্ত রাজনীতিবিদদের চোর মনে করি, বা প্রবাসী সব ভাইয়দের স্বার্থপর মনে করি, বা গরীবলোক মানেই চুরি করে মনে করি, বা কাজের লোকদের যথাযথ সম্মান না দিই, বা বুয়েটের ছাত্র বা ইডেনের ছাত্রী বলে নিজেকে একটু ভিন্ন মনে করি, বা আমার ছেলে কোন অপরাধ করতে পারে না এমন ধারণা মা হিসেবে পোষন করি, বা সকল তরুণদের উচ্ছৃঙ্ঘল মনে করি, বা সকল বুইড়াদের ফালতু মনে করি – এই সবই অন্ধ-বিশ্বাসের প্রতিফলন। আর যখন এই অন্ধ-বিশ্বাষটুকু প্রকট হয়, তখন ভিন্ন মতালম্বী মানুষটিকে আর মানুষ হিসেবে দেখা হয় না – যাহাই রেসিজমের সৃষ্টি করে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নিজেকে মুক্তচিন্তার মানুষ বলে দাবী করলেও, প্রকৃত রেসিজম থেকে মুক্ত থাকা কতটা কষ্টকর। নিজেও যে এর উর্ধ্বে ছিলাম দাবী করি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় কালে অমনোযোগী ছাত্রদের হেয় করেছি, দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেছি সেটা তাদের ভালোর জন্যই করেছি, কিন্তু আজ উক্ত কাজ ভুল ছিল স্বীকার করি। মানবতা এবং অহিংসাকে জীবনের পাথেয় করেছি। সকল মানুষ সমান এবং সকলের সমান ভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে এই পৃথিবীতে, এটা বিশ্বাস করি। শুধু সকল মানুষ নয়, সকল জীবেরই বাঁচার সমান অধিকার রয়েছে বলেই মনে করি। একে অন্যের বিশ্বাস এবং মতামতের উপর সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাশীলতার মাধ্যমেই আমরা পারি রেসিজমকে পেছনে ফেলে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
Thursday, August 13, 2009
টিপাইমুখ বাঁধ ও আমাদের করণীয়
বাঁধ বা ব্যারাজ এর ফলে কি হবে তা আমাদের সংসদীয় কমিটি অল্প বিস্তর জানেন বলেই আমার বিশ্বাস। IWM এর অপ্রকাশিত রিপোর্ট করা হয়েছে সরকারের নির্দেশে এবং সেটার রিপোর্ট একমাত্র সরকারের কাছেই আছে। তাছাড়া সংসদীয় কমিটিতে মনোয়ার স্যার আছেন যিনি নিজে একজন morphology বিশেষজ্ঞ। এ ছাড়া আরো অনেক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য এর মাঝেই বেশ কিছু পত্রিকায় এসেছে। সুতরাং বাঁধের প্রভাব আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কি হবে তা তাঁরা জানেন। কথা হল সমাধাণ বিশেষজ্ঞদের হাতে খুব বেশি নয়। সমাধাণ রাজনীতিবিদ বা দেশের নেতৃত্বের হাতে। তাঁরা যদি দেশের পরিণাম জেনেও কিছু না করতে চায় তবে আমাদের বিকল্প পথ চিন্তা করতে হবে। আমরা বরং বিকল্প গুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।
আমি যদি ধাঁপে ধাঁপে চিন্তা করি –
প্রথমতঃ ইন্ডিয়ার কাছে বিদ্যুতের জন্য বা বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ বিকল্প কোন পথ আছে কিনা সেটা বের করা।
দ্বিতীয়তঃ বিদ্যুতের জন্য আমাদের কোন বিকল্প আছে কিনা সেটা জানা। বা বাঁধ যদি দেওয়াই হয় তবে আমাদের বিকল্প বা করণীয় কি হতে পারে?
তৃতীয়তঃ আন্ত নদী গুলো সম্পর্কে দু'দেশের অবস্থান। তাঁরা সেঁচ করবেই কিনা বা ব্রম্মপুত্র হতেও পানি সরাবে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। মোট কথা এক সাথে সকল আন্ত নদী সম্পর্কে একটি চুক্তিতে আসা। সেই চুক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে তা ঠিক করা। আমরা একবার বরাক নিয়ে তারপর ব্রম্মপুত্র নিয়ে আন্দোলন করবো, এভাবে বারবার সময় নষ্ট করতে পারি না।
চতুর্থতঃ ইন্ডিয়া আমাদের কথা কেন শুনবে? ইন্ডিয়াকে কিভাবে আমাদের মতামত গ্রহন করানো / বা শুনানো যায় তার জন্য সম্ভাব্য পথ গুলো চিন্তা করা। তারপর ইন্ডিয়া যদি আমাদের কথা একদমই না মানতে চায় তবে আমাদের শেষ বিকল্প কি হতে পারে তা চিন্তা করা।
পঞ্চমতঃ আমাদের দেশের সরকার বা বিরোধী দল কি দেশের স্বার্থ দেখছে? যদি না দেখে তবে আমাদের কি করণীয়। এটা দুঃখজনক যে আমাদেরকেই আমাদের দেশের রাজনীতিবিদের বুঝানোর কথা চিন্তা করতে হচ্ছে।
আর কোন পয়েন্ট প্রয়োজন মনে করলে দয়া করে জানাবেন।
প্রথম পয়েন্টের জবাবে বলতে পারি ইন্ডিয়া আমেরিকার সাথে নিউক্লিয়ার এনার্জির চুক্তি করেছে বলে পেপারে দেখেছি, যেটা জাহিদের লেখায়ও এসেছে। যদি বিদ্যুতের সমাধাণ অন্যখাত হতে পাওয়া যায় তবে শুধু বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। জাহিদের লেখায় যেটা এসেছে বাঁধ সাময়িক ভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও, লং টার্মে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কারণ বাঁধের ফলে যে অতিরিক্ত ক্ষয় হবে তা আবার ভাটিতে জমে নদীর ভূমির তলদেশের উচ্চতা বাড়িয়ে দিবে। তখন আগে যে প্রবাহতে বন্যা হতো না, তাতেই এখন বন্যা হবে। মনে রাখতে হবে যে বন্যা অতিরিক্ত পানি প্রবাহের কারণে হয় না, হয় পানির উচ্চতার জন্য। নদীর তলদেশ উচ্চে উঠে আসার কারণে এখন অল্প প্রবাহেই পানির উচ্চতা আগের মতই হতে পারে এবং বন্যা হতে পারে। এ কারণেই এখন বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধের কথা না বলে বলা হয় বন্যার সাথে বসবাস উপযোগী ব্যবস্থা নেওয়াই হল সবচেয়ে উত্তম। যেমন উচ্চস্থানে বাড়ি করা বা বেশি পানি উপযোগী ধান বা উচু রাস্তা এবং রাস্তার মাঝে মাঝে কালভার্ট করা যেন বন্যার পানির প্রবাহ ঠিক থাকে, নদীর তলদেশ খনন করে নদীর প্রবাহশক্তি বাড়ানো, হাওর, বিল বা পুকুর খনন করে বন্যার পানি সংরক্ষন ইত্যাদি। যেটাকে আমরা বলি non-structural measure। তবে পরিবেশের ক্ষতি কম করে বাঁধ বানানো সম্ভব বলে আমার জানা নেই। যে কারণে আজ উন্নত বিশ্বে আর কোন নতুন বাঁধ তৈরির প্রকল্প হাতে নেয় না। ইউরোপ বা আমেরিকায় যত বাঁধ হয়েছে তা হয়েছে তখন যখন জলবিদ্যুত ভিন্ন অন্য কোন বিকল্প ছিল না।
দ্বিতীয় পয়েন্টের জবাবে বলতে পারি বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য বিকল্প হিসেবে সচলে বেশ কিছু লেখা এসেছে। নিউক্লিয়ার এনার্জির কথা আমরাও চিন্তা করতে পারি। নিউক্লিয়ার এনার্জির প্রধান সমস্যা প্রাথমিক বিনোয়গের অর্থ এবং নিউক্লিয়ার বর্জ্য। প্রয়োজন মনে করলে আমেরিকার সাথে আমরাও চুক্তি করতে পারি নিউক্লিয়ার এনার্জির জন্য। আমাদের দেশে বিদ্যুতের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে আমাদেরকে বিকপ্ল কিছু চিন্তা করতেই হবে। সবচেয়ে খারাপ যদি হয় যে আমরা কোনভাবেই ইন্ডিয়াকে বাঁধ করা থেকে বিরত রাখতে পারছি না তবে যেন মন্দের ভাল হিসেবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমরা স্বল্প দামে বিদ্যুত কিনতে পারি তার জন্য নেগোসিয়েশন করা যেতে পারে। আমি বলেছি এটা হতে পারে একদম শেষ বিকল্প, এখানে ভারত প্রেম কিংবা আমেরিকা প্রেম আবিষ্কারের চিন্তা আমাদের আলোচনাকে শুধু ভিন্ন পথেই প্রবাহিত করবে। বাঁধ যদি দেওয়াই হয় তবে বাঁধের প্রভাব কি হবে তার জন্য পর্যাপ্ত ও নির্দিষ্ট ডাটা নিয়ে two-dimensional hydrodynamic and morphological model দিয়ে দেখতে হবে আমাদের হাওড় গুলো এবং নদী গুলোর কি হবে। IWM যে স্টাডি করেছিল তা শুধু হাইড্রোলজিকাল এবং হাইড্রোডাইনামিকাল মডেল এবং তারও তথ্য কল্পনা করে। কোন মর্ফোলজিকাল এন্যালাইসিস করা হয়নি। কিন্ত মর্ফোলজিকাল মডেল চালানো খুবই জরুরী। মর্ফোলজিকাল মডেল এর মাধ্যমে জানা যাবে নদীর কোথায় কোথায় ভাংগতে পারে আর কোথায় পলি পড়তে পারে। যদি শহরের আশে পাশে ভাঙ্গনের প্রেডিকশন থাকে তবে শহর রক্ষা বাঁধের জন্য চিন্তা করতে হবে। যেখানে পলি জমবে সেখানে ড্রেজিং করতে হবে। দরকার হলে হাওর এর পানি প্রবাহের জন্য কৃত্রিম খাল খনন করা যেতে পারে। মোট কথা যদি বাঁধ দেওয়াই হয় সেটাকে মোকাবেলা করার জন্য এ ধরণের স্টাডি করতেই হবে। এবং সেটা প্রতি বছর করতে হবে যতদিন না নদী তার নতুন প্রবাহের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। এ ধরণের স্টাডি সরকার লুকিয়ে না করে IWM এবং বুয়েটের পানি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে করতে পারেন। এবং স্টাডি থেকে আমাদের ক্ষয় ক্ষতির একটি আনুমানিক আর্থিক হিসেব করা প্রয়োজনীয়। যদি ইন্ডিয়াকে বাঁধ বানানো থেকে বিরত না রাখা যায় তবে সে ক্ষেত্রে এসব ক্ষতি পূরণ আদায়ের জন্য নেগোসোশিয়েন করা যেতে পারে। এই সব করণীয়র প্রশ্ন আসবে তখনই যদি ইন্ডিয়া বাঁধ বানায়ই তবে।
তৃতীয় পয়েন্টের জবাবে আন্তনদী সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অবস্থান হচ্ছে আন্তঅর্জাতিক আইনে যা বলা আছে সে আলোকে দু’দেশের মধ্য সকল আন্তনদী নিয়ে চুক্তি করা বিশেষ প্রয়োজন। এবং সেটা এখন করাই সবচেয়ে উত্তম। এটা করার জন্য দু’দেশের সকল রাজনীতিবিদ দের নিয়ে করতে হবে কারণ চুক্তির মূল বিষয় থাকে সকল সরকারের সময় চুক্তির ধারাবাহিকতা। চুক্তি যেন অবশ্যই পাঁচ বা দশ বছর পর পর পর্যালোচনা করা হয় এবং তা নবায়ণ করা হয়।
চতুর্থ পয়েন্ট হল সবচেয়ে কঠিন আমার মতে। এ ব্যাপারে সকলের বাস্তব সম্মত মতামত কামনা করছি। এ ব্যাপারে আমার মতামত হল সময় এসেছে ইন্ডিয়াকে মেসেজ দেওয়া যে দেশের স্বার্থ বিরোধী কোন কিছু মেনে নেওয়ার দিন ফুঁরিয়ে গেছে। প্রথমত করণীয় সকল রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, পেশাজীবি, সুর্ব সাধারণের বিরোধ ভুলে দেখানো যে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছুতে জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকে। আমাদের মাঝের হাসিনা বা খালেদা, বাম বা ডান এই সব বিরোধের ফায়দা লুটে বহিরাশক্তিরা। একদিকে পাকি মারে অন্যদিকে ভারত মারে। মাঝখানে নিরীহ মানুষ মরে। আমি মনে করি বহিরাশক্তি যদি দেখে যে দেশ স্বার্থ বিরোধী যে কোন কিছুতে আমরা ঐক্যবদ্ধ তখন যে কোন কিছু করার আগে দু’বার ভাববে। সমস্যা হল রাজনীতিবিদদের সকলকে এক সুঁরে কথা বলাতে বাধ্য করা। এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেটার জন্যই আমার পঞ্চম পয়েন্টের অবতারণা। আশা করি আরো কিছু মতামত আসবে সকলের মন্তব্য হতে। আমরা কি হার্ড লাইনে যেতে পারি কিনা সেটাও আলোচনায় আসতে পারে। মনে রাখতে হবে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। সুতরাং আমরা আসলে কতটুকু করতে পারি সেটা আলোচনায় আসতে পারে। হার্ড লাইন সম্পর্কে আমার নিজের বক্তব্য হল ভাটির পনের কোটি মানুষকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলার কোন যুক্তি ইন্ডীয়ার থাকতে পারে না। এটা মানবিধাকারের চরম লঙ্ঘন। ফারাক্কার কারনে আজ দেশের একাংশ মরুভুমিতে পরিণত। এখন এই বাঁধ ও ফুলরতলের ব্যারাজের কারণে বাকি অংশও মরুভুমিতে পরিণত হবে। তারপর ব্রম্মপুত্র থেকে পানি সরালে এই পনের কোটি মানুষ এমনিতেই না খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরবে। আমাদেরকে যদি দেয়ালে পিঠ ঠেকাতে তারা বাধ্য করেই তবে আমাদেরও যুদ্ধ বিনা কোন গতি নেই। আমি বলছি না আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি, কিন্তু ইন্ডিয়াকে মেসেজ দেওয়া যে আমরা দেশের স্বার্থে সেটি চিন্তা করতে পিছপা হব না। এখন ইন্ডিয়ার ডিসিশন নেবার পালা তারা প্রতিবেশি দু’ই দেশের সাথে যুদ্ধে যাবার ঝুকি নিবে কি নিবে না। অনেকটা বল তাঁদের কোর্টে ঠেলে দিয়ে দেখা তারা কি করে। এই ব্যাপারে সকলের আরো সুচিন্তিত মতামত কামণা করছি। তবে হার্ড লাইনে যাবার আগে আর্ন্তজাতিক আদালতে যাবার বিকল্প আমাদের হাতে আছে, যদিও সেটা কতটুকু ফলপ্রসু হবে আমার ধারণা নেই।
সবশেষে, কিভাবে সরকারকে এবং বিরোধী দলকে এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদ বা সুশীল সমাজকে বাধ্য করা যায় জনগণের কথা শুনতে। জনগণের মেসেজটা কিভাবে সরকারের কানে প্রবেশ করা যায়। আমার মতে মিডিয়া চেষ্ট কছে, প্রতিটী ব্লগ মাধ্যম চেষ্টা করছে । বাম দল গুলো ও চেষ্টা করছে। সবাই বিচ্ছিন্ন ভাবে চিন্তা করছে এবং চেষ্টা করছে তাদের কথাগুলো বলার জন্য।
একবারেই সফলতা চলে আসবে এমন ভাবনা করিনা। কিন্তু নিজেকে তো বুঝাতে পারবো চেষ্টাতো করেছি। প্রথমত যেটা করতে পারি, এই আলোচনায় অংশগ্রহন করে নিজেদের মতামত দিতে পারি। আগামী এক মাসের বা দু’সপ্তাহের মাঝে আমরা সকলের মতামতের উপর ভিক্তি করে আমাদের দেশের কি কি করণীয় তার উপর একটি রিপোর্ট তৈরী করতে পারি। দ্বিতীয়ত যেটা করতে পারি আমরা একটি দিন ঠিক করতে পারি, যে দিন বিশ্বের প্রতিটি শহরে বাজ্ঞালীরা গ্রিনিচ সময়ে এক সাথে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পারি এবং সে দিন আমাদের রিপোর্টটি সংসদীয় কমিটি বা সরকারের কাছে ও সকল পত্রিকায় পৌঁছে দিতে পারি। সেটা দশ জনের হোক বা একশত জনের হোক। আমরা সবাই যার যার পক্ষ থেকে জনসংযোগ শুরু করতে পারি। আমরা সকল মিডিয়ার কাছে যেতে পারি সাহায্যের জন্য, সকল ব্লগের সাহায্য নিতে পারি। আমরা সকল রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, পেশাজীবি, সর্ব সাধারণ এর কাছে আমাদের বার্তা পৌছে দিতে পারি। দিনটি আজ থেকে এক মাস পর হলে ভাল হয়। এর মাঝে আমরা জনসংযোগ করতে পারি এবং আমাদের রিপোর্টটি প্রস্তুত করতে পারি। প্রবাসীদের কথা চিন্তা করে শনি বা রোববার করতে পারি। বাংলাদেশের সকল বিভাগে বা জেলায় করতে পারি।
আমার উদ্দেশ্য সকলের আলোচনা হতে একটি করণীয় ঠিক করা, যেটাকে আমরা সামনে রেখে এগোতে পারি। যে কোন কিছুতে নামার আগে সর্বপ্রথম লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। আসুন আমরা সকলে আগে সেই লক্ষ্যটি ঠিক করি, ঠিক করি আমরা আসলে কি চাই। দ্বিতীয়টি যদি আমাদের পক্ষে আয়োজন করা সম্ভব নাও হয় ক্ষতি নেই। আমরা রিপোর্টটি তৈরি করি এবং সেই রিপোর্ট আমরা সকল পত্রিকায় ও সরকারে কাছে এক সাথে তুলে দিব। তারপর দেশের জনগণ নিজেদের ভাগ্য বেছে নিক।
আমি যদি ধাঁপে ধাঁপে চিন্তা করি –
প্রথমতঃ ইন্ডিয়ার কাছে বিদ্যুতের জন্য বা বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ বিকল্প কোন পথ আছে কিনা সেটা বের করা।
দ্বিতীয়তঃ বিদ্যুতের জন্য আমাদের কোন বিকল্প আছে কিনা সেটা জানা। বা বাঁধ যদি দেওয়াই হয় তবে আমাদের বিকল্প বা করণীয় কি হতে পারে?
তৃতীয়তঃ আন্ত নদী গুলো সম্পর্কে দু'দেশের অবস্থান। তাঁরা সেঁচ করবেই কিনা বা ব্রম্মপুত্র হতেও পানি সরাবে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। মোট কথা এক সাথে সকল আন্ত নদী সম্পর্কে একটি চুক্তিতে আসা। সেই চুক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে তা ঠিক করা। আমরা একবার বরাক নিয়ে তারপর ব্রম্মপুত্র নিয়ে আন্দোলন করবো, এভাবে বারবার সময় নষ্ট করতে পারি না।
চতুর্থতঃ ইন্ডিয়া আমাদের কথা কেন শুনবে? ইন্ডিয়াকে কিভাবে আমাদের মতামত গ্রহন করানো / বা শুনানো যায় তার জন্য সম্ভাব্য পথ গুলো চিন্তা করা। তারপর ইন্ডিয়া যদি আমাদের কথা একদমই না মানতে চায় তবে আমাদের শেষ বিকল্প কি হতে পারে তা চিন্তা করা।
পঞ্চমতঃ আমাদের দেশের সরকার বা বিরোধী দল কি দেশের স্বার্থ দেখছে? যদি না দেখে তবে আমাদের কি করণীয়। এটা দুঃখজনক যে আমাদেরকেই আমাদের দেশের রাজনীতিবিদের বুঝানোর কথা চিন্তা করতে হচ্ছে।
আর কোন পয়েন্ট প্রয়োজন মনে করলে দয়া করে জানাবেন।
প্রথম পয়েন্টের জবাবে বলতে পারি ইন্ডিয়া আমেরিকার সাথে নিউক্লিয়ার এনার্জির চুক্তি করেছে বলে পেপারে দেখেছি, যেটা জাহিদের লেখায়ও এসেছে। যদি বিদ্যুতের সমাধাণ অন্যখাত হতে পাওয়া যায় তবে শুধু বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। জাহিদের লেখায় যেটা এসেছে বাঁধ সাময়িক ভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও, লং টার্মে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কারণ বাঁধের ফলে যে অতিরিক্ত ক্ষয় হবে তা আবার ভাটিতে জমে নদীর ভূমির তলদেশের উচ্চতা বাড়িয়ে দিবে। তখন আগে যে প্রবাহতে বন্যা হতো না, তাতেই এখন বন্যা হবে। মনে রাখতে হবে যে বন্যা অতিরিক্ত পানি প্রবাহের কারণে হয় না, হয় পানির উচ্চতার জন্য। নদীর তলদেশ উচ্চে উঠে আসার কারণে এখন অল্প প্রবাহেই পানির উচ্চতা আগের মতই হতে পারে এবং বন্যা হতে পারে। এ কারণেই এখন বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধের কথা না বলে বলা হয় বন্যার সাথে বসবাস উপযোগী ব্যবস্থা নেওয়াই হল সবচেয়ে উত্তম। যেমন উচ্চস্থানে বাড়ি করা বা বেশি পানি উপযোগী ধান বা উচু রাস্তা এবং রাস্তার মাঝে মাঝে কালভার্ট করা যেন বন্যার পানির প্রবাহ ঠিক থাকে, নদীর তলদেশ খনন করে নদীর প্রবাহশক্তি বাড়ানো, হাওর, বিল বা পুকুর খনন করে বন্যার পানি সংরক্ষন ইত্যাদি। যেটাকে আমরা বলি non-structural measure। তবে পরিবেশের ক্ষতি কম করে বাঁধ বানানো সম্ভব বলে আমার জানা নেই। যে কারণে আজ উন্নত বিশ্বে আর কোন নতুন বাঁধ তৈরির প্রকল্প হাতে নেয় না। ইউরোপ বা আমেরিকায় যত বাঁধ হয়েছে তা হয়েছে তখন যখন জলবিদ্যুত ভিন্ন অন্য কোন বিকল্প ছিল না।
দ্বিতীয় পয়েন্টের জবাবে বলতে পারি বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য বিকল্প হিসেবে সচলে বেশ কিছু লেখা এসেছে। নিউক্লিয়ার এনার্জির কথা আমরাও চিন্তা করতে পারি। নিউক্লিয়ার এনার্জির প্রধান সমস্যা প্রাথমিক বিনোয়গের অর্থ এবং নিউক্লিয়ার বর্জ্য। প্রয়োজন মনে করলে আমেরিকার সাথে আমরাও চুক্তি করতে পারি নিউক্লিয়ার এনার্জির জন্য। আমাদের দেশে বিদ্যুতের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে আমাদেরকে বিকপ্ল কিছু চিন্তা করতেই হবে। সবচেয়ে খারাপ যদি হয় যে আমরা কোনভাবেই ইন্ডিয়াকে বাঁধ করা থেকে বিরত রাখতে পারছি না তবে যেন মন্দের ভাল হিসেবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমরা স্বল্প দামে বিদ্যুত কিনতে পারি তার জন্য নেগোসিয়েশন করা যেতে পারে। আমি বলেছি এটা হতে পারে একদম শেষ বিকল্প, এখানে ভারত প্রেম কিংবা আমেরিকা প্রেম আবিষ্কারের চিন্তা আমাদের আলোচনাকে শুধু ভিন্ন পথেই প্রবাহিত করবে। বাঁধ যদি দেওয়াই হয় তবে বাঁধের প্রভাব কি হবে তার জন্য পর্যাপ্ত ও নির্দিষ্ট ডাটা নিয়ে two-dimensional hydrodynamic and morphological model দিয়ে দেখতে হবে আমাদের হাওড় গুলো এবং নদী গুলোর কি হবে। IWM যে স্টাডি করেছিল তা শুধু হাইড্রোলজিকাল এবং হাইড্রোডাইনামিকাল মডেল এবং তারও তথ্য কল্পনা করে। কোন মর্ফোলজিকাল এন্যালাইসিস করা হয়নি। কিন্ত মর্ফোলজিকাল মডেল চালানো খুবই জরুরী। মর্ফোলজিকাল মডেল এর মাধ্যমে জানা যাবে নদীর কোথায় কোথায় ভাংগতে পারে আর কোথায় পলি পড়তে পারে। যদি শহরের আশে পাশে ভাঙ্গনের প্রেডিকশন থাকে তবে শহর রক্ষা বাঁধের জন্য চিন্তা করতে হবে। যেখানে পলি জমবে সেখানে ড্রেজিং করতে হবে। দরকার হলে হাওর এর পানি প্রবাহের জন্য কৃত্রিম খাল খনন করা যেতে পারে। মোট কথা যদি বাঁধ দেওয়াই হয় সেটাকে মোকাবেলা করার জন্য এ ধরণের স্টাডি করতেই হবে। এবং সেটা প্রতি বছর করতে হবে যতদিন না নদী তার নতুন প্রবাহের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। এ ধরণের স্টাডি সরকার লুকিয়ে না করে IWM এবং বুয়েটের পানি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে করতে পারেন। এবং স্টাডি থেকে আমাদের ক্ষয় ক্ষতির একটি আনুমানিক আর্থিক হিসেব করা প্রয়োজনীয়। যদি ইন্ডিয়াকে বাঁধ বানানো থেকে বিরত না রাখা যায় তবে সে ক্ষেত্রে এসব ক্ষতি পূরণ আদায়ের জন্য নেগোসোশিয়েন করা যেতে পারে। এই সব করণীয়র প্রশ্ন আসবে তখনই যদি ইন্ডিয়া বাঁধ বানায়ই তবে।
তৃতীয় পয়েন্টের জবাবে আন্তনদী সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অবস্থান হচ্ছে আন্তঅর্জাতিক আইনে যা বলা আছে সে আলোকে দু’দেশের মধ্য সকল আন্তনদী নিয়ে চুক্তি করা বিশেষ প্রয়োজন। এবং সেটা এখন করাই সবচেয়ে উত্তম। এটা করার জন্য দু’দেশের সকল রাজনীতিবিদ দের নিয়ে করতে হবে কারণ চুক্তির মূল বিষয় থাকে সকল সরকারের সময় চুক্তির ধারাবাহিকতা। চুক্তি যেন অবশ্যই পাঁচ বা দশ বছর পর পর পর্যালোচনা করা হয় এবং তা নবায়ণ করা হয়।
চতুর্থ পয়েন্ট হল সবচেয়ে কঠিন আমার মতে। এ ব্যাপারে সকলের বাস্তব সম্মত মতামত কামনা করছি। এ ব্যাপারে আমার মতামত হল সময় এসেছে ইন্ডিয়াকে মেসেজ দেওয়া যে দেশের স্বার্থ বিরোধী কোন কিছু মেনে নেওয়ার দিন ফুঁরিয়ে গেছে। প্রথমত করণীয় সকল রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, পেশাজীবি, সুর্ব সাধারণের বিরোধ ভুলে দেখানো যে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছুতে জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকে। আমাদের মাঝের হাসিনা বা খালেদা, বাম বা ডান এই সব বিরোধের ফায়দা লুটে বহিরাশক্তিরা। একদিকে পাকি মারে অন্যদিকে ভারত মারে। মাঝখানে নিরীহ মানুষ মরে। আমি মনে করি বহিরাশক্তি যদি দেখে যে দেশ স্বার্থ বিরোধী যে কোন কিছুতে আমরা ঐক্যবদ্ধ তখন যে কোন কিছু করার আগে দু’বার ভাববে। সমস্যা হল রাজনীতিবিদদের সকলকে এক সুঁরে কথা বলাতে বাধ্য করা। এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেটার জন্যই আমার পঞ্চম পয়েন্টের অবতারণা। আশা করি আরো কিছু মতামত আসবে সকলের মন্তব্য হতে। আমরা কি হার্ড লাইনে যেতে পারি কিনা সেটাও আলোচনায় আসতে পারে। মনে রাখতে হবে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। সুতরাং আমরা আসলে কতটুকু করতে পারি সেটা আলোচনায় আসতে পারে। হার্ড লাইন সম্পর্কে আমার নিজের বক্তব্য হল ভাটির পনের কোটি মানুষকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলার কোন যুক্তি ইন্ডীয়ার থাকতে পারে না। এটা মানবিধাকারের চরম লঙ্ঘন। ফারাক্কার কারনে আজ দেশের একাংশ মরুভুমিতে পরিণত। এখন এই বাঁধ ও ফুলরতলের ব্যারাজের কারণে বাকি অংশও মরুভুমিতে পরিণত হবে। তারপর ব্রম্মপুত্র থেকে পানি সরালে এই পনের কোটি মানুষ এমনিতেই না খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরবে। আমাদেরকে যদি দেয়ালে পিঠ ঠেকাতে তারা বাধ্য করেই তবে আমাদেরও যুদ্ধ বিনা কোন গতি নেই। আমি বলছি না আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি, কিন্তু ইন্ডিয়াকে মেসেজ দেওয়া যে আমরা দেশের স্বার্থে সেটি চিন্তা করতে পিছপা হব না। এখন ইন্ডিয়ার ডিসিশন নেবার পালা তারা প্রতিবেশি দু’ই দেশের সাথে যুদ্ধে যাবার ঝুকি নিবে কি নিবে না। অনেকটা বল তাঁদের কোর্টে ঠেলে দিয়ে দেখা তারা কি করে। এই ব্যাপারে সকলের আরো সুচিন্তিত মতামত কামণা করছি। তবে হার্ড লাইনে যাবার আগে আর্ন্তজাতিক আদালতে যাবার বিকল্প আমাদের হাতে আছে, যদিও সেটা কতটুকু ফলপ্রসু হবে আমার ধারণা নেই।
সবশেষে, কিভাবে সরকারকে এবং বিরোধী দলকে এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদ বা সুশীল সমাজকে বাধ্য করা যায় জনগণের কথা শুনতে। জনগণের মেসেজটা কিভাবে সরকারের কানে প্রবেশ করা যায়। আমার মতে মিডিয়া চেষ্ট কছে, প্রতিটী ব্লগ মাধ্যম চেষ্টা করছে । বাম দল গুলো ও চেষ্টা করছে। সবাই বিচ্ছিন্ন ভাবে চিন্তা করছে এবং চেষ্টা করছে তাদের কথাগুলো বলার জন্য।
একবারেই সফলতা চলে আসবে এমন ভাবনা করিনা। কিন্তু নিজেকে তো বুঝাতে পারবো চেষ্টাতো করেছি। প্রথমত যেটা করতে পারি, এই আলোচনায় অংশগ্রহন করে নিজেদের মতামত দিতে পারি। আগামী এক মাসের বা দু’সপ্তাহের মাঝে আমরা সকলের মতামতের উপর ভিক্তি করে আমাদের দেশের কি কি করণীয় তার উপর একটি রিপোর্ট তৈরী করতে পারি। দ্বিতীয়ত যেটা করতে পারি আমরা একটি দিন ঠিক করতে পারি, যে দিন বিশ্বের প্রতিটি শহরে বাজ্ঞালীরা গ্রিনিচ সময়ে এক সাথে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পারি এবং সে দিন আমাদের রিপোর্টটি সংসদীয় কমিটি বা সরকারের কাছে ও সকল পত্রিকায় পৌঁছে দিতে পারি। সেটা দশ জনের হোক বা একশত জনের হোক। আমরা সবাই যার যার পক্ষ থেকে জনসংযোগ শুরু করতে পারি। আমরা সকল মিডিয়ার কাছে যেতে পারি সাহায্যের জন্য, সকল ব্লগের সাহায্য নিতে পারি। আমরা সকল রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, পেশাজীবি, সর্ব সাধারণ এর কাছে আমাদের বার্তা পৌছে দিতে পারি। দিনটি আজ থেকে এক মাস পর হলে ভাল হয়। এর মাঝে আমরা জনসংযোগ করতে পারি এবং আমাদের রিপোর্টটি প্রস্তুত করতে পারি। প্রবাসীদের কথা চিন্তা করে শনি বা রোববার করতে পারি। বাংলাদেশের সকল বিভাগে বা জেলায় করতে পারি।
আমার উদ্দেশ্য সকলের আলোচনা হতে একটি করণীয় ঠিক করা, যেটাকে আমরা সামনে রেখে এগোতে পারি। যে কোন কিছুতে নামার আগে সর্বপ্রথম লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। আসুন আমরা সকলে আগে সেই লক্ষ্যটি ঠিক করি, ঠিক করি আমরা আসলে কি চাই। দ্বিতীয়টি যদি আমাদের পক্ষে আয়োজন করা সম্ভব নাও হয় ক্ষতি নেই। আমরা রিপোর্টটি তৈরি করি এবং সেই রিপোর্ট আমরা সকল পত্রিকায় ও সরকারে কাছে এক সাথে তুলে দিব। তারপর দেশের জনগণ নিজেদের ভাগ্য বেছে নিক।
Thursday, July 23, 2009
কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮২৩) ও তাঁর দর্শন
একঃ দর্শন ও বিজ্ঞান
দেশ নিয়ে চিন্তার কোন এক প্রাক্কালে সমাজতন্ত্রের চিন্তা প্রথম মাথায় চলে আসে। আমার মত এমন অনেকেই মনে হয় আছেন যারা জীবনের কোন না কোন সময়ে সমাজতন্ত্রের প্রেমে পড়েছেন, আবার সেই প্রেম ছুটে যেতেও বেশি সময় নেয়নি। আপনি যদি মানবতাবাদী হোন তবে সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদ স্বাভাবিকভাবে চলে আসবে। কোন যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে শ্রেনীবিভেদ, লিংগবিভেদ, কিংবা ধর্মবিভেদ- এগুলোর কারণে সৃষ্ট শোষন মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করি। এ রকম একটি অবস্থায় আমি মার্ক্সের এর দর্শন নিয়ে আগ্রহবোধ করলাম। তবে মার্ক্সের দর্শন নিয়ে লেখার আগে আমি একটু বিস্তারিত বলার চেষ্টা করবো দর্শন কিভাবে কাজ করে। আমার মতে সেটা না জানা থাকলে যে কারো দর্শন নিয়ে আলোচনার চেষ্টা বৃথা।
আমি যেভাবে দর্শনকে দেখি তা হলো যুক্তির মাধ্যমে, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষন পদ্ধতিতে, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোকে কোন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। প্রতিটি দার্শনিক যেটা করে থাকেন – তিনি প্রথমে তাঁর পূর্ববর্তী সকল দার্শনিকদের চিন্তাভাবনা গুলো পর্যবেক্ষন করেন তাঁদের প্রকাশিত লেখার মাধ্যমে। যে কারনে প্রত্যেক দার্শনিক তাঁর সময়ের সর্বোচ্চ তত্বটিই প্রদান করেন তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের ভুলগুলো শুধরে দিয়ে। তারপরও প্রতিটি দর্শনের ক্ষেত্রে একটি কথা এখানে প্রযোজ্য যে যেকোন দর্শনই তাঁর কালকে অতিক্রম করতে পারে না। সকল দার্শনিক তাঁর সময়কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ। কথাগুলো সমভাবে প্রযোজ্য প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ গুলোর জন্য। প্রতিটি শেষ ধর্ম আগের ধর্মগুলোর ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই তৈরী হয় বলে শেষের ধর্মটি হয়ে থাকে সর্বোত্তম। ধর্মগ্রন্থ গুলোকে আমি দর্শনের ইতিহাসের একটি অংশবিশেষ হিসেবে দেখি। শুধু পার্থক্য এই যে দাবী করা হয়ে থাকে যে ধর্মের কথাগুলো সরাসরি ঈশ্বরের, আর দর্শনের গুলো মানুষের।যদি কেউ বলে থাকেন যে কারোর দর্শন সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য তবে তিঁনি ইতিহাসকেই অস্বীকার করেন।
এখন কথা হল দর্শন আর বিজ্ঞানের মাঝে পার্থক্য কি? বিজ্ঞানের যে কোন আবিষ্কার তাঁর পূর্ববরর্তী জ্ঞান বা তত্বকে পর্যালোচনা করেই সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যে কোন তত্ব হয় কালের উর্ধ্বে। যদি একটি তত্ব তাঁর পর্যবেক্ষনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তা যেমন তাঁর পূর্ব ও বর্তমান কালে সত্য তেমনি তা হতে হবে ভবিষ্যতেও সত্য। যদি ভবিষ্যতের কোন একটিও পর্যবেক্ষন দ্বারা সেই তত্ব অসত্য প্রমানিত হয় তবে তা আর বৈজ্ঞানিক তত্ব থাকে না। দর্শনগুলো যেহেতু তাদের কালকে অতিক্রম করতে পারে না তাই দর্শনের মাঝে বিজ্ঞান খোঁজা অবান্তর। সম কারনে ধর্মের মাঝেও বিজ্ঞান খোঁজাও অবান্তর।
তবে প্রত্যেক দার্শনিকই বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষন প্রনালী ব্যবহার করে থাকেন – জেনে বা না জেনেই। যে কোন কিছু জানার চেষ্টা করা-পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রশ্ন এবং তার উত্তরের মাধ্যমে – তাহাই বৈজ্ঞানিক প্রনালী। যেমন আদিম সমাজে মানূষ জানার চেষ্টা করতো কেন তাঁরা অসুস্থ হয়। তাঁদের যেহেতু জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছিল তাই তাঁরা বের করলো দেবতাদের খুশী রাখলে, পূঁজা করলে তাঁরা সুস্থ হয়ে যাবে। তাঁরা বের করলো জটিল মন্ত্র, যার হয়তো কোন ব্যাখ্যা নেই কিন্তু তারপরেও তা আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্বের তুলনায় কোন অংশে কম ছিল না তাঁদের কাছে। তবে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষন প্রনালী ব্যবহার করলেই সেটি বৈজ্ঞানিক তত্ব হয়ে যায় না, যেমনটি হল আদিম সমাজের মন্ত্রতত্ব। আজ আমরা যে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষনা করতে গেলে আমরা কি করি? প্রথমে আমরা ঠিক করি আমি কি নিয়ে কাজ করতে চাই এবং কেন করতে চাই। তারপর লিটেরেচার রিভিউ করি। আমার আগে যারা একই বিষয় নিয়ে কাজ করেছে তাঁরা কি কি করেছেন দেখি। তাঁদের সীমাবদ্ধতা কোথায় ছিল বোঝার চেষ্টা করি। এটা যখন ধরা যায় তখনি কেবল নিজের পক্ষে কতটুকু কাজের সুযোগ আছে এই বিষয়ে সে সম্পর্কে একটা ধারণা হয়। এই ধারণাটি যখন হয়ে যায় তারপরের কাজ বেশ সহজ। কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা করা হয় যা আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে সাহায্য করে। এভবে পরীক্ষা আর প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চলতে থাকে যতক্ষন না আমি সন্তুষ্ট হই।
দর্শনের ক্ষেত্রেও দার্শনিকরা কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজে চলেছেন। তবে এক্ষেত্রে তাঁরা পর্যবেক্ষন করে থাকে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস। যিনি যত পরে এসেছেন তাঁর কাছে পূর্ববর্তী ইতিহাসের তথ্য বেশী ছিল, তাই তাঁর পর্যবেক্ষন তত ভাল হয়েছে। সক্রেটিস, এরিষ্টটল, কান্ট, হেগেল, মার্ক্স– তাঁরা সবাই অনেক প্রতিভাবান ছিলেন কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁরা সকলেই তাঁদের সময়কাল দ্বারা আবদ্ধ ছিলেন। তাঁরা যেটুকু ইতিহাস দেখেছেন তাই শেষ নয়, তাই তাঁদের কথাই শেষ নয়। তবে তাঁরা যে কথাগুলো বলেছেন তা বুঝতে হলে আপনাকে তাঁরা যে ইতিহাস দেখে উনাদের সিদ্ধান্তে এসেছেন আপনাকেও পৃথকভাবে তাঁর কাছাকাছি যেতে হবে। যখন আপনি সেটা করতে পারছেন তখনি কেবল সম্ভব হবে চিন্তা করতে যে তাঁরা আজ বেঁচে থাকলে কি বলতেন।
নিছক মার্ক্সবাদের সমালোচনা করা, বা কারো ব্যাক্তিগত বিশ্বাসে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মার্ক্স এর দর্শন যা বুঝেছি তাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি কেবল। চেষ্টা করেছি মার্ক্স এর দূর্বলতা গুলোকে চিহ্নিত করে তাঁর প্রকৃত দর্শনকে তুলে ধরতে। আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষন একশত ভাগ সত্য হবে তা মনে করি না, তবে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে দ্বিমত পোষন করলে যুক্তি খন্ডন করে মতামত দিলে খুশি হবো। লেখার সময় চেষ্টা করেছি প্রতিটি রেফারেন্স উল্লেখ করতে এবং সমস্ত রেফারেন্সই অন্তর্জালে আছে। তাই আমার বক্তব্য খতিয়ে দেখা খুব বেশী কঠিন নয় বলেই মনে করি।
দুইঃ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
মার্ক্স (karl Marx, 1818-1883) এর দর্শনের প্রধানত দু’টি দিক- একটি বস্তুবাদ এবং অন্যটি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। এই দু’য়ের সংমিশ্রনে সৃষ্ট তাঁর দর্শন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। বস্তুবাদ কিংবা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি, মার্ক্সই প্রথম বলেন তা নয়। বস্তুবাদ দর্শন আমরা দেখতে পাই গ্রীক দার্শনিক থেল্স্(Thales, 624 BC-546 BC), ডেমোক্রিটাস্(Democritus, 460 BC-370 BC ), ইপিকিউরাস্ (Epicurus, 341 BC-270 BC) এর মাঝে [১]। তারপরে দেখা যায় হব্স্(Thomas Hobbes, 1588-1679), ফুয়েরবার্খ (Feuerbach, 1804-1872), মার্ক্স (Marx, 1818-1883), এংগেল্স্(Engels, 1820-1895), বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russel, 1872-1970) এর মাঝে [১]। বর্তমান সমসাময়িকে দেখা যায় ডেনেট (Dennett, 1942-), কুইন (Quin, 1908-2000), ডেভিডসন (Davidson, 1917-2003) প্রমুখ দার্শনিকের মাঝে [১]।
বস্তুবাদ দর্শনের মূল কথা হল, বস্তুই সব। পৃথিবীর সমস্তই বস্তু দ্বারা গঠিত এবং তা সর্বদা গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। বস্তুবাদ দর্শনে মন বা আত্মার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া/প্রতিক্রিয়াই হল মন। মার্ক্স এর পিএইচডির বিষয়বস্তু ছিল “The difference between the Democritean and Epicurean philosophy of nature”. উক্ত কাজের সময় এবং পরবর্তীতে জার্মান দার্শনিক হেগেল ও ফুয়েরবার্খ নিয়ে কাজ করার সময় তিনি বস্তুবাদী দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছিলেন বলে মনে হয়।
দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিও মার্ক্স সর্বপ্রথম বলেননি। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস্(Socrates, 469 BC-399 BC), প্লেটো (Plato, 428/427 BC-348/347 BC), এরিষ্টটল্(384 BC-322 BC) এর মাঝে দ্বান্দ্বিক কথোপকথন লক্ষ্য করা যায় [২]। তবে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন জার্মান দার্শনিক হেগেল (Hegel, 1770-1831), যার ধারনা তিনি পেয়েছিলেন আরেক জার্মান দার্শনিক কান্ট (Kant, 1724-1804) থেকে [২]। এই পর্যায়ে হেগেল এর কথা কিছুটা না বললেই নয়। হেগেলকে বলা হয় ভাববাদী দার্শনিকদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। প্রাচীন গ্রীক দর্শনের যুগের পর বিশাল মধ্যযুগে (রোমান সভ্যতার পতনের পর, পঞ্চম শতাব্দি, থেকে রেনেসাঁস্, ষোড়শ শতাব্দি, এর আগ পর্যন্ত) দর্শনের বিষয়বস্তু মূলত সীমাবদ্ধ থাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানে এবং তার ভাল গুণাবলীর আবিষ্কারে [৩]। মধ্যযুগের পর আধুনিক দর্শনকালে গ্যালিলিও (Galileo, 1564-1642), ডেস্কার্টেস (Descartes, 1596-1650), স্পিনোজা (Spinoza, 1632-1677), লিব্নিজ (Leibniz, 1646-1716) কান্ট, হেগেল অন্যতম [৩]। এই সময়কার দর্শনের মূল বিষয়বস্তু ছিল যুক্তির ব্যবহার। আর হেগেল এই যুক্তির ব্যাবহার কে এক অনন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে। তাঁর Lectures on the History of philosophy [৪] পড়লে দর্শনের ইতিহাস সম্পর্কে পুরো ধারণা লাভ করা যায়। সেখানে তিনি প্রাচীন কাল হতে তাঁর সময়কাল পর্যন্ত সকল পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দার্শনিকদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর লেখা হচ্ছে দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বোধ্য।
তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মূল বিষয় হল thesis (তত্ব) এবং antithesis (প্রতিতত্ব) এর দ্বন্দ্ব এবং এই দু’য়ের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে একটি synthesis এ পৌঁছা। synthesis কে অবশ্যই antithesis কে যুক্তি দিয়ে জয় করে আসতে হবে। হেগেল যেটি দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির মাঝে সবসময় একপ্রকার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের কারনে প্রতিটি বস্তু প্রতি নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালেও মানব জাতির মাঝে একই রকমের দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। হেগেল এবং মার্ক্স দু’জনেই মানব সভ্যতার ইতিহাসকে ভালভাবে পর্যবেক্ষন করেছেন। শুধু পার্থক্য এই যে হেগেল সবকিছুতে ছিলেন ভাববাদী আর মার্ক্স ছিলেন বস্তুবাদী। মার্ক্স এর নিজের ভাষায় তিনি হেগেল এর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে মস্তিষ্ক (ভাব) থেকে পাঁয়ে (বস্তু) নামালেন, বলা যায় একেবারে উল্টিয়ে দিলেন [৫]।
হেগেল সব কিছু পর্যবেক্ষন করে যেটা শেষমেশ দাঁড় করালেন তা হল, বস্তু হচ্ছে ‘absolute idea’ এর দ্বান্দ্বিক প্রকাশ। তিনি যেটা ধরে নিয়েছেন তা হচ্ছে আইডিয়া হল ‘অরিজিনাল আইডিয়া’। কিন্তু তার মধ্যে স্ববিরোধী দ্বন্দ্ব আছে, এবং সেই দ্বন্দ্বের ফলেই বাস্তব জগতের সৃষ্টি। তাঁর কথার মানে দাঁড়ায়, বাস্তব জগৎটা হচ্ছে একটা ছবি এবং সেই অর্থে সেটা হল ‘absolute idea’ এর প্রকাশ [৫]। অর্থাৎ দুনিয়াতে যা কিছু ঘটছে তা সেই absolute idea এরই বহিঃপ্রকাশ। এই কারনে হেগেলরই কিছু ছাত্র যাদের বলা হত বাম-ঘেঁষা (Left Hegelian), তাঁরা তাঁদের শিক্ষকের ‘অরিজিনাল আইডিয়া’ কে মানতে রাজী হল না। এর মাঝে ফুয়েরবার্খ, মার্ক্স অন্যতম। তাঁরা যেটা বললেন, ভাব থেকে বস্তু সৃষ্ট নয়, বরং ভাবই বস্তু থেকে সৃষ্ট। মন বা আত্মার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়ার ফলেই মন বা ভাবের সৃষ্টি। মানুষের মস্তিষ্কেই ঈশ্বরের অবস্থান। ঈশ্বরের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। তাঁরা বললেন হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সব ঠিকই আছে শুধু তাকে ভাববাদ থেকে মুক্ত করতে হবে। এভাবেই সৃষ্ট দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথা হল সমস্ত বস্তুই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের মধ্যেই সম্পর্কযুক্ত [৫]। এই দ্বন্দ্ব আবার দুই প্রকারঃ অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্ব। কোন বস্তু নিজের অভ্যন্তরে যে দ্বন্দ্ব তা হল অন্তর্দ্বন্দ্ব আর একটি বস্তুর সাথে অন্য বস্তুর যে দ্বন্দ্ব তা হল বহির্দ্বন্দ্ব। তবে মার্ক্স এর ভাষায় এই দুই দ্বন্দ্বের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্বই হল পরিবর্তনের ভিক্তি। বহির্দ্বন্দ্ব কোন কোন ক্ষেত্রে অন্তর্দ্বন্দ্বকে প্রভাবিত করতে পারে কিন্তু যতক্ষন পর্যন্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব পরিপক্কতা লাভ না করে ততক্ষন পর্যন্ত বহির্দ্বন্দ্ব কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এটার উদাহরন হিসেবে বলা যায় যখন কোন সমাজ বা গোষ্ঠী নিজেরা বিপ্লব বা পরিবর্তনের জন্য তৈরি না হয় তখন বাহির হতে কেউ তাদের কোন সাহায্য করলে বিশেষ লাভ নেই।
মানব সভতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে সমাজের অভ্যন্তরেও প্রতি নিয়ত বহুধরনের শক্তির দ্বন্দ্ব চলছে। শ্রেনী, বর্ণ, লিংগ, ধর্ম, জাত, রাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থ এরকম আরো অনেক বিভাজনের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চলছে। তবে মার্ক্স এর মতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সকল দ্বন্দ্বের মূল হল শ্রম ও পুঁজির মধ্যে দ্বন্দ্ব, যা নিয়ে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করবো। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তিনটি মূলনীতি বলে আজ শেষ করবো। প্রথমটি হলঃ বিরোধী শক্তির ঐক্য (unity of opposites)[৫]। একটি মানুষের মাঝে যেমন ভাল-খারাপ দুই গুণই বর্তমান, তেমনি সকল বস্তুতে এবং সমাজেও স্ববিরোধী শক্তির সহবস্থান আছে। ধনাত্মক ও ঋনাত্মক চার্জ, ইলেক্ট্রন ও প্রোটন, কিংবা সৌরজগতের আকর্ষন ও বিকর্ষন শক্তি এর উদাহরন। এই পরস্পরবিরোধী শক্তির সাম্যবস্থার কারনে সব স্বাভাবিক ভাবে চলছে। যখন কোন একটি শক্তি অন্যটি অপেক্ষা বেশী শক্তিশালী হয়ে যায় তখন দ্বিতীয় নীতিটি আসে, তা হলঃ বিকাশের পথে অবলুপ্তি, অবলুপ্তির পথে বিকাশ (Negation of the negation)[৫]। এই নীতির অর্থ হচ্ছে নিছক সৃষ্টি বা ধ্বংস বলে কিছু নেই। সৃষ্টি মানেই হচ্ছে ধ্বংস আবার ধ্বংসের মাঝেই হচ্ছে নুতনের সৃষ্টি। মানব শরীরে যেমন শৈশবের ধ্বংসের মাঝে একজন মানুষ কৈশোরে পদার্পণ করে, আবার সে কৈশোরকে ধ্বংস করেই যৌবনে পদার্পন করে। মার্ক্সের মতে সমাজেও সে রকম এক সমাজ ধ্বংস হয়ে নুতন সমাজ গড়ে উঠে। সবশেষ তৃতীয় নীতিটি হলঃ পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন (From quantitative change to qualitative change)[৫]। এই নীতির কথা হল যে সকল পরিবর্তনই গুণগত পরিবর্তন আনে না। যেমন পানিকে তাপ দিলে তা বাষ্প হয় না যতক্ষন না তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হচ্ছে। তেমনি সমাজে হয়তো প্রতিনিয়ত অল্প অল্প পরিমাণগত পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু তা যখন বিশাল আকারে হয় তখনই একে গুণগত বা বৈপ্লবিক বা মৌলিক পরিবর্তন বলা হয়।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। দর্শন নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আর আমি তেমন জানিওনে। দর্শন আমার বিষয়ও নয়। শুধু আমার মূল বক্তব্য ভালভাবে প্রকাশের জন্য একটি হালকা ধারনা দিচ্ছি। শুধু হেগেল কিংবা মার্ক্স এর দর্শন পুরোপুরি বুঝতে, যে কারো সারাজীবন চলে যাবে। আমার মূল উদ্দেশ্য মার্ক্সবাদ আর সমাজতন্ত্রের মাঝে কি পার্থক্য আছে তা খুঁজে বের করা। সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদ এর দ্বন্দ্ব থেকে কিছু সমাধান পাওয়া যায় কিনা তার চেষ্টা করা। আজ আমরা দেখলাম যে বস্তুবাদ এবং দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি কিভাবে আসলো। পরবর্তীতে দেখবো সমাজতন্ত্রের এবং সাম্যবাদের ধারনা কিভাবে আসলো।
তিনঃ সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ
সমাজতন্ত্রের ধারণাও মার্ক্সই প্রথম বলেননি। ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯-১৭৯৯) আগে দার্শনিক রুঁসো (Rousseau, ১৭১২-১৭৭৮) রচনা করেছিলেন ‘সামাজিক চুক্তি (social contract)’। যেখানে তিনি বলেন- মানুষ জন্ম নেয় মুক্ত হয়ে, কিন্তু জন্মের পর দেখে চারিদিকে শুধু বাঁধার শেঁকল [৬]। এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বলেছেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা, যে আইন হবে সকল মানুষের নিজেদের তৈরী আইন- এক ধরণের সামাজিক চুক্তি [৬]। রুঁসো সমাজতন্ত্রের কথা সরাসরি না বললেও তাঁর লেখায় ছিল নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির কথা। যে কারনে ফরাসী বিপ্লব যদিও রুঁসোর মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পর সংঘঠিত হয়, তারপরও ফরাসী বিপ্লবে রুঁসোর দর্শনের অবদান ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির চিন্তা মনে হয় মার্ক্স পেঁয়েছেন এই ফরাসী বিপ্লব থেকেই।
সেইণ্ট সিমন (Saint Simon, ১৭৬০-১৮২৫) ছিলেন ফরাসী বিপ্লবের সন্তান। তাঁর মতে ভবিষ্যত সমাজে সকলকে অবশ্যই কাজ করতে হবে, এবং সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির স্থান নির্ধারিত হবে তার শ্রমের কৃতিত্বগুলো দিয়ে[৭]। তবে রাজনীতিক সংগ্রাম ও বিপ্লব সম্পর্কে তিনি নেতিবাচক অবস্থান গ্রহন করেছিলেন। ফরাসী বিপ্লবে সর্বহারাদের শাসন কে আখ্যায়িত করেছেন ‘সন্ত্রাসের শাসন’ হিসেবে [৮]। তিঁনি চেয়েছিলেন সরকারি সংস্কারকর্ম আর এক নুতন ধর্মের চেতনায় সমাজের নৈতিক প্রশিক্ষনের ফলেই শ্রেনী-বিরোধের বিলুপ্তি ঘটবে [৭], যা মার্ক্স এবং এংগেলস এর মতে ইউটোপিয়।
পরবর্তীতে ফুঁরিয়ে (Charles Fourier, ১৭৭২-১৮৩৭), তাঁর লেখায় বুর্জ়োয়া সমাজের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তবে তিনিও হিংসাশ্রয়ী বিপ্লবের ধারণার বিরোধিতা করতেন এবং মনে করতেন যে ভবিষ্যত সমাজতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণ ঘটানো যেতে পারে শান্তিপূর্ণ প্রচারনের মধ্য দিয়ে-যেখানে লোকে কাজ করবে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে [৭]। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন, যে কোন একটি সমাজের সাধারণ মুক্তির মাপকাঠি হল সে সমাজের নারী মুক্তির মান [৮]।
ইংলেন্ডে যখন শিল্প বিপ্লবের শুরু হয়, সে সময় ওয়েন (Robert Owen, ১৭৭১-১৮৫৮) একটি সুতাকলের সুপারেন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। তিনি মনে করতেন যে সামাজিক অসাম্যের প্রধান কারণ যথেষ্ট জ্ঞানালোকের অভাব যা শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের দ্বারা দূর করা যায় [৭]। তাই যেখানে অন্য কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করতো দৈনিক তেরো-চৌদ্দ ঘন্টা সেখানে তাঁর শ্রমিকরা কাজ করতো সাড়ে দশ ঘন্টা [৮]। তিনি শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য কিন্ডারগার্ডেন এর ব্যাবস্থা করেন। যখন কারখানা বন্ধ থাকে তখনো তাঁর শ্রমিকরা পুরো মজুরি পেয়েছে। এ সব সত্ত্বেও তাঁর কারখানার মুনাফা কম হয় না।
সেইণ্ট সিমন, ফুঁরিয়ে কিংবা ওয়েন এরা সবাই সামজিক অসাম্য দূর করতে চেয়েছেন সমাজকে সংস্কারের মাধ্যমে। শিল্প বিপ্লব ইংলেন্ডে সবে মাত্র শুরু হয়েছে, এমন সময় পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার স্বরূপ তাঁদের পক্ষে ধরা অসম্ভব ছিল আর তাই তাঁদের সমাজ সংস্কারের ধারণা ইউটোপিয় হতে বাধ্য বলেই মার্ক্স ও এংগেলস মনে করতেন [৮]।
মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) এর সময়কালে আরো বেশ কয়েকজন সমাজতন্ত্রী ছিলেন। যাদের মধ্যে প্রুধুন (Prudhon, ১৮০৯-১৮৬৫), বুকিনিন (Bukinin, ১৮১৪-১৮৭৬), এবং ব্লাঙ্কুই (Blanqui, ১৮০৫-১৮৮১) অন্যতম। প্রুধুন এবং বুকিনিন ছিলেন ণৈরাজ্যবাদী (Anarchism) সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিতা। তাঁরা মার্ক্স এর শ্রমিক শ্রেনীর একনায়কতন্ত্রিক শাসনের বিরোধী ছিলেন। আর ব্লাঙ্কুই ছিলেন মুলত বিল্পবী চিন্তা ধারণার।
এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি তাতে দেখা যায় যে মার্ক্স এর সাম্যবাদ এর ধারণার পেছনে যে সমস্ত মানুষের অনুপ্রেরণা আছে তাঁরা হলঃ১। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির দর্শনঃ জার্মান দার্শনিক হেগেল।২। বস্তুবাদ দর্শনঃ আরেক জার্মান দার্শনিক ফুয়েরবাখ।২। সমাজতন্ত্র অথবা সাম্যবাদ এর প্রাথমিক ধারণাঃ রুঁসো, সেইন্ট সিমন, ফুরিয়ে, ওয়েন।
এর বাহিরে আরো কয়েকজনের কথা উল্লেখ করতে হয়। মার্ক্স এর বস্তুবাদী হবার পেছনে ডারউইন (Darwin, ১৮০৯-১৮৮২) এর বিখ্যাত ‘অন দা ওরিজিন অফ স্পিসিস’ এর অবদানও ছিল [৮]। মার্ক্স এর কাজকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একটি মুলত দর্শন নিয়ে এবং আরেকটি হল অর্থনীতি নিয়ে। রাজনৈতিক অর্থনীতি (Political Economy) এর উপর মার্ক্সের বেশ কয়েকটি লেখা আছে যেখানে তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপর আলোচনা করেছেন। অর্থনীতি একটু কম বুঝি বিধায় সে গুলো নিয়ে আলোচনায় গেলাম না। রাজনৈতিক অর্থনীতির মুল ধারণা তিনি নিয়েছেন এডাম স্মিথ (Adam smith, ১৭২৩-১৭৯০) এবং রিকার্ডো (David Ricardo, ১৭৭২-১৮২৩) থেকে। এর মাঝে স্মিথ কে বলা হয়ে থাকে আধুনিক অর্থনীতির জনক হিসেবে। স্মিথ তার লেখায় প্রথম পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা এবং মুনাফার জন্য শোষন এর ব্যাপারটি তুলে এনেছিলেন, যা পরপর্তীতে মার্ক্সকে অনুপ্রানিত করেছে।
সর্বশেষ ব্যক্তিটি হল তাঁর বন্ধু এবং সহলেখক এঙ্গেলস (Engels, ১৮২০-১৮৯৫)। মার্ক্স এর লেখায় আমি একধরণের অস্থিরতা লক্ষ্য করেছি, যা তাঁদের সম্মিলিত লেখায় নেই। আমার মতে তাঁর কারন এঙ্গেলস এর লেখার ধরণ অনেক গোঁছানো। তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনা অনেক পরিষ্কার। এঙ্গেলস অবশ্য নিজে স্বীকার করেন যে সাম্যবাদের মূল ধারণা মার্ক্সেরই [৭], তথাপী এটাও অনস্বীকার্য যে শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির স্বপ্ন এঙ্গেলস নিজেও দেখতেন। মার্ক্স এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এর মাধ্যমে এঙ্গেলস দেখলেন যে পুঁজি এবং শ্রেনীর দ্বন্দ্বটি প্রমান করা সম্ভব। যে কারনে সাম্যবাদের বা মার্ক্সের দ্বন্দ্বমূল্ক বস্তুবাদের উপর বিজ্ঞানের তঁকমা লাগানোর কাজটিও তিনিই করেছেন তাঁর ‘ইউটোপিয় ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ লেখায় [৮]।
চারঃ সাম্যবাদ
তাহলে ইউটোপিয় সমাজতন্ত্র আর কমিউনিজম বা সাম্যবাদের মাঝে পার্থক্য কি? মার্ক্স এর মতেই ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রীরা চান সমাজের প্রত্যেক সদস্যের, এমনকি সবচেয়ে সুবিধাভোগীর অবস্থার উন্নতি করতে [৭]। আর মার্ক্সবাদীরা চান কেবল শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তি, যা কিনা হবে বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে [৭]। মার্ক্স মনে করতেন না যে সমাজের সকল সদস্যের মুক্তি সম্ভব, তাই এই ধরণের যে কোন চিন্তা ইউটোপিয় হতে বাধ্য। এটা পরিষ্কার যে মার্ক্স নিজেকে মানবতাবাদী বলে মনে করতেন না, বরং মানবতাবাদীদের তিনি আখ্যা দেন রক্ষনশীল বলে যারা আসলে বুর্জ়োয়া সমাজ ব্যবস্থাকেই রক্ষা করতে চায় মানবতার আড়ালে [৭]।
এবার দেখা যাক মার্ক্সবাদের মূল ধারণা কি এবং তা কিভাবে আসলো। মার্ক্স হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিকে বস্তুবাদের উপর দাঁড় করিয়ে দেখলেন যে আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলেরই ইতিহাস শ্রেনী সংগ্রামের ইতিহাস [৭]। ডারউইন তার বিবর্তনবাদে যেমন দেখালেন যে প্রকৃতিতে সব সময় বিবর্তন হচ্ছে এবং যোগ্যতমরাই টিকে থাকছে, সে রকম মার্ক্সও দেখলেন যে মানব সমাজে সর্বত্র অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম চলছে, এবং একটি সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে তার উপর আরেকটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। প্রাচীন রোমান যুগে ছিল দাসভিত্তিক সমাজ। পরে মধ্যযুগে সেটা ভেঙ্গে হয় সামন্তপ্রথা সমাজ। সামন্তপ্রথা হচ্ছে আমাদের উপমহাদেশের জমিদারী প্রথার মত একটি ব্যবস্থা। ইউরোপে মধ্যযুগে এই সামন্তপ্রথার সমাজই ছিল। আধুনিক যুগে সেই সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে হল বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থা যা মার্ক্স এর মতে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা। মার্ক্স এর মতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে মধ্যবিত্ত শ্রেনী পুরোনো সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে তৈরী করে আজকের এই সমাজ, যার সুচনা হয় ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে [৭]।
আধুনিক এই বুর্জোয়া সমাজের বৈশিষ্ট কি? ব্যক্তি স্বাধীনতা, অবাধ বানিজ্য, ব্যক্তি মালিকানা, পুঁজিবাদ। এ সবই হল বৈশিষ্ট, কিন্তু বুর্জ়োয়া বা পুঁজিবাদী সমাজের মুল দ্বন্দ্ব কি – তা হল পুঁজি এবং শ্রমের দ্বন্দ্ব। এখন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির নিয়ম অনুসারে এই পুঁজি এবং শ্রম তারা বিরোধাত্বক, অর্থাৎ তারা একত্রে অবস্থান করতে পারেনা। তারা একে অপরকে উচ্ছেদ করতে চায়। পুঁজির কাজ হল শ্রমকে শোষন করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। শ্রমিক শ্রেনী যতদিন পর্যন্ত না পুঁজিকে উচ্ছেদের মত শক্তি অর্জন করছে, ততদিন তারা সহবস্থান করবে। যখনি সেই শক্তি অর্জন করবে তখন পুঁজির পতন অনিবার্য। এই হল স্বল্প কথায় মার্ক্স এর মুল তত্ব।
এখন মার্ক্স এই তত্ব কিভাবে পেলেন? মার্ক্স(১৮১৮-১৮৮৩) এর সময়টা এমনই যে তখন ইউরোপের চারিদিকে শিল্পের ব্যাপক প্রসার। স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কারের ফলে সর্বত্রই কলকারখানা গড়ে উঠেছে। এই সব কারখানায় কাজ করে প্রচুর শ্রমিক। ১৮২৫ সালে ইংলেন্ডে প্রথম একটি অর্থনৈতিক মন্দা আসে [৮], যার কারনে প্রচুর শ্রমিক চাকুরী হারায়। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা তখন অঙ্কুরে বিধায় মন্দা প্রায় দশ বছর পর পর দেখা দিত [৮], আজ যেটা অনেক বছর পর দেখা দেয়। ১৮২৫ সাল থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত এরকম মন্দা আসে পাঁচবার এবং ১৮৭৭ সালে আসে ষষ্ঠবার [৮]। বলাই বাহুল্য যে মার্ক্স এই সব মন্দা এবং এর ফলাফল খুব কাছ থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং একই কথা প্রযোজ্য এঙ্গেলস এর জন্য। এ কথা অনস্বীকার্য যে মার্ক্স পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে বেশ ভাল ভাবে ধরেছিলেন। কিভাবে এই মন্দা আসে এবং এই মন্দার চিত্র তিনি বেশ ভাল ভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। একের পর এক কারখানা গড়ে উঠার ফলে, উৎপাদন হয়ে যায় প্রচুর। এক পর্যায়ে অতিপ্রাচুর্যের ফলে অনেক উৎপন্ন পন্য অবিক্রিত থেকে যায়, কারখানা লোকসান দেয়। কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, শ্রমিকেরা চাকুরী হারায়। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আরো কমে যায়, পন্য বিক্রি আরো কমে যায়। এভাবেই চলতে থাকে যা ঠিক হতে কয়েক বছর লেগে যায়- ঠিক যেন আমাদের এখনকার (২০০৯ সালের) মন্দারই চিত্র।
এরকম একটি চিত্র থেকে মার্ক্স তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রয়োগে স্বিদ্ধান্তে আসলেন যে, বুর্জোয়া সমাজ ব্যাবস্থা যেমন সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে উৎপত্তি, তেমনি বুর্জোয়া সমাজ ভেঙ্গে তৈরি হবে নুতন একটি সমাজ ব্যাবস্থা। এটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দ্বিতীয় সুত্র ‘বিকাশের পথে অবলুপ্তি (Negation of the Negation)’ থেকে পাই। সেই নুতন সমাজ হবে প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেনীর সমাজ। তিনি ভাবলেন যেভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংকট দেখা দিচ্ছে, অচিরেই শ্রমিক শ্রেনী হবে সংখ্যায় গরিষ্ঠ। আর সেই শ্রেনী একদিন এই বুর্জ়োয়া সমাজ ভেঙ্গে তৈরী করবে কমিউনিষ্ট সমাজ। কমিউনিষ্ট পার্টির কাজ হচ্ছে সেই শ্রমিক শ্রেনীকে সংঘবদ্ধ করা, তাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে সাহায্য করা।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল। মার্ক্সবাদ এর সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক কিভাবে আসলো। বিজ্ঞান যেভাবে তত্ব প্রদান করে যা সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য, সে রকম মার্ক্সও সমাজের ক্ষেত্রে তার তত্বটি দিয়েছিলেন। মার্ক্স যেমন বলেন নি যে শ্রমিক শ্রেনীর সংঘবদ্ধ হওয়া উচিৎ বা তাদের ক্ষমতায় যাওয়া উচিৎ তাদের মুক্তির জন্য। তিনি বলেছেন শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তি আর বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংস দুইই অনিবার্য [৭]। অর্থাৎ এটি বস্তুবাদের ইতিহাসের নিয়মে বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সুত্র অনুসারে হবেই, এক ধরণের প্রেডিকশন (ভবিষ্যতবানী)। বলাই বাহুল্য সে রকম কিছু হয়নি আজো। বব্রং আধুনিক সমাজ এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বেশ ভাল ভাবেই আছে এবং থাকবে।
তাহলে মার্ক্স এর তত্বের ভুল কোথায়? কোথায় মার্ক্স ভুল বুঝেছেন? আমি বলবো প্রতিটি দার্শনিক বা গবেষক যেমন তাঁর সময়কাল দ্বারা আবর্তিত, তেমনি মার্ক্স পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বা আধুনিক অর্থনীতি ব্যবস্থাকে পুরোপুরি দেখতে পারেননি। পুঁজিব্যবস্থা তখন সবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছে আমি বলবো। এটা অনস্বীকার্য যে মার্ক্স এর পর প্রায় দেড়শত বছর পার হয়ে গেলেও বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অনেক ভুল আছে, যার কারনে এখনও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। কিন্তু সেটা কেটে যায়, তা থেকে মানুষ নুতন কিছু শিখে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরো সুসংহত হয়।
আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খুবই জটিল একটি ব্যাপার। একক ভাবে মানুষ নিজে একটি জটিল প্রানী। তার মাস্তিষ্কের ব্যবহার অন্য যে কোন প্রানী থেকে অনেক বেশী বিধায় তাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন সম্ভব নয়। এমন কোন তত্ব নেই যা দিয়ে বলা সম্ভব মানুষ একটি অবস্থায় কিভাবে নিজেকে বদলে নিবে বা কাজ করবে। অতীত ইতিহাস দেখে আমরা একটি ধারণা করতে পারি, কিন্তু সেটা ঘটবেই বলতে পারি না। আর এই মানুষ যখন গোষ্ঠিবদ্ধ ভাবে চলে, যখন একটি সমাজ গঠন করে, সেই সমাজে উক্ত মানুষগুলো কিভাবে চলবে সেটা কোন তত্ব দিয়ে প্রকাশ করা আরো অসম্ভব। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর সমাজ ব্যবস্থা দুইই সরাসরি ব্যক্তি ও গোষ্ঠিবদ্ধ মানুষের কাজের সাথে জড়িত। এই দুই ব্যবস্থা এতই নন-লিনিয়র (Non-linear) এবং নন-ডিটারমিনিষ্টিক (Non-Deterministic) যে সমাজ বিজ্ঞানে বা অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে সে রকম কোন নির্দিষ্ট তত্ব নেই। যা আছে তা কোন নির্দিষ্ট পারিপার্শ্বিকতার ক্ষেত্রে কিছু ইম্পিরিকাল (empirical) সুত্র।
একটি নন-লিনিয়র চিত্রের উদাহরণ যদি দেই তাহলে আরো পরিষ্কার হবে। সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিচলণ প্রক্রিয়া। আমাদের জলবায়ুর মডেল আছে, তাত্বিক সুত্র আছে- তথাপি এই প্রক্রিয়া নিজেই এত নন-লিনিয়র যে সে প্রক্রিয়াটিকে সঠিকভাবে প্রেডিক্ট করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমরা সর্বোচ্চ পাঁচদিন পর্যন্ত প্রেডিকশন করতে পারি, তারপরেও বলা হয়ে থাকে ৩০% বা ৬০% বৃষ্টি হবার সম্ভবাবনার কথা। কোন ভাবে হয়তো এই মুহুর্তের কথা বলতে পারবো, যদি পর্যাপ্ত তথ্য থাকে, বা পরবর্তী এক ঘন্টার কথা বলতে পারবো কিন্তু এক মাস পর কি হবে তা বলা অবাস্তব বা ইউটোপিয়। যে কারণে আজকের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরাও নিশ্চিত করে বলতে পারেন না ঠিক কোন পদ্ধতিতে বা কবে বর্তমান মন্দা দূর হবে।
নন-লিনিয়র প্রক্রিয়ার এর আরেকটি মজার দিক রয়েছে, যা তার প্রেডিকশনকে আরো কঠিন করে তুলে। তা হল এক কথায় ‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’। বলা হয়ে থাকে আজ যদি বাংলাদেশে কোন একটি প্রজাপতি তার পাখা নাঁড়ায় আর সেই সঞ্চালণ, নন-লিনিয়র এফেক্ট এর কারণে বাড়তে বাড়তে নিউইয়র্কে বৃষ্টি ঘটাতে পারে। যেমন ঘটতে পারে – কোন এক পথচারীর আকষ্মিক মৃত্যু, যা রূপ নিতে পারে বিশাল ভাংচু্রে। সেখানে কিছু হলে সেটা আরো বড় আকার হয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।
এরকম একটি জটিল সামাজিক এবং অর্থৈতিক ব্যবস্থাকে অঙ্কুরে দেখে যে তত্বই দেওয়া হোক না কেন তা কাজ না করাটাই স্বাভাবিক, বরং যদি কাজ করে আমি বলবো সেটাই কাকতলীয়। তা হলে মার্ক্স এর দর্শনের সব কিছু কি ভুল? না তা নয়।
পাঁচঃ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র
আমি মার্ক্স এর কমিউনিষ্ট পার্টির ইস্তেহারের প্রথম কথা দিয়েই শুরু করছি। তিনি বলছেন যে আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলেরই ইতিহাস শ্রেনী সংগ্রামের ইতিহাস [৭]। কথাটি আমি বলবো আংশিক সত্য। এ কথা ঠিক যে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে আমরা বেঁচে থাঁকার জন্য সংগ্রাম করি। সেই সংগ্রাম হয় প্রকৃতির সাথে আমাদের, প্রকৃতির অন্য প্রানীদের সাথে আমাদের এবং আমাদের নিজেদের সাথে নিজেদের। যখনই উৎপাদন এর তুলনায় চাহিদা বেশি থাকবে তখনই দ্বন্দ্ব থাকবে। আজ পর্যন্ত যত সংগ্রাম হচ্ছে তা হচ্ছে সেই চাহিদা আর উৎপাদনের মাঝে ব্যবধান এর জন্য। সেই সংগ্রাম ভিন্ন শ্রেনীর মধ্যে হতে পারে আবার নিজস্ব শ্রেনীর মাঝেও হতে পারে। পৃথিবীতে যদি কোন সাদা-কালো না থেকে শুধু সাদারাই থাকতো তবে কি রক্ত ঝরতো না? যদি কোন বুর্জোয়া শ্রেনী না থেকে শুধু শ্রমিক শ্রেনী হয় তবে কি কোন দ্বন্দ্ব থাকবে না? বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম চলবে যতদিন পৃথিবীতে সম্পদের উৎপাদন তার চাহিদার তুলনায় কম থাকবে। যদি সমাধান খুঁজতেই হয় তবে চাহিদা আর উৎপাদন এর ব্যাবধান কমাতে হবে। তা জনসংখ্যা সীমিত করে বা উৎপাদন এর পরিমাণ বাড়িয়ে।
তবে হ্যাঁ একটি সুষ্ঠ সামাজিক ব্যবস্থা দরকার যা চাহিদা আর উৎপাদন এর ব্যবধানকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করবে। মার্ক্স তাঁর দর্শনে যেটা বলার চেষ্টা করেছেন তা হল বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আমরা সেটা করছি না। যার কারনে অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছেকৃত ভাবে চাহিদার পরিমাণকে বাড়িয়ে রাখা হয় শুধু মাত্র পন্যের মান ধরে রাখার জন্য। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নিয়ম বানানো হয় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা, সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেনীর তাঁদের সুবিধার্তে। জনগণের করের টাকায় সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেনী বা নিম্ন বিত্তের জন্য করা হয় কম। রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিৎ করে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হয়ে উঠে শোষনের যন্ত্র। এ ধরণের সমাজ ব্যবস্থায় ধনী-গরিবের ব্যবধান শুধু বৃদ্ধি পায়। মার্ক্স এটাকেই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফল (Output) হিসেবে বলেছেন। কিন্তু আমি একে পুঁজিবাদ এর দোষ বলবো না। আমি বলবো এটা মানুষের মানসিকতার সমস্যা, নৈতিকতার দৈন্যতার প্রকাশ। এবং এই সমস্যা যে কোন সাম্যবাদী দলের শাসনের ক্ষেত্রেও হতে পারে যদি মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটায়। যেমনটি আমরা দেখতে পাই বর্তমান কমিউনিষ্ট শাসিত দেশ গুলোর ক্ষেত্রেও।
মার্ক্স সমাজ ব্যবস্থার এই ত্রুটিকে ভালভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং খুব ভাল ভাবে বুঝেছেন যে শুধু শাসক গোষ্ঠির পরিবর্তন বা শাসন ক্ষমতা থেকে বুর্জোয়াদের দূর করালেই সমাজে পরিবর্তন হবে না, করতে হবে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন। যে কথাটি আমার মতে আজো প্রযোজ্য। শুধু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েতের সজ্ঞাটিকে একটু বদলাতে হবে। শিল্প বিপ্লবের সময়কালে মার্ক্স দেখেছিলেন শুধু দু’টি শ্রেনী- বুর্জ়োয়া আর প্রলেতারিয়েত। সেই সময়কার সমাজ ব্যবস্থায় এই দু’টি শ্রেনীই প্রধান ছিল। মার্ক্স এর ভাষায় নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেনীরাও স্বল্প পুঁজির কারণে এক সময় প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতে পরিণত হবে [৭] এবং পুঁজি আরে শ্রমের দ্বন্দ্বে প্রলেতারিয়েতের সংখা বৃদ্ধি পাবে [৭]। কিন্তু আজ যদি আমরা দেখি তাহলে দেখবো সমাজে এখন স্পষ্টতই তিনটি শ্রেনী। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত। মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে আমরা আরো কিছুটা ভাগ করতে পারি, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত হিসেবে। আজকের সমাজে যদি বুর্জোয়া বলতে হয় তবে আমি বলবো উচ্চবিত্ত আর উচ্চ-মধ্যবিত্তদের। আর যদি প্রলেতারিয়েত বলতে হয় তবে বলবো নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর নিম্ন বিত্তদের। আজকের যুগের বিশাল এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর অবস্থান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অঙ্কুরকালে তেমন প্রকট ছিল না, এবং এই শ্রেনীটি মার্ক্স এর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি শুধু বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে ধরে নিয়ে এগিয়েছেন এবং আমার মতে মার্ক্স এর প্রধান ভুলটি এখানেই। আজ যদি কেউ এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে বুর্জোয়া শ্রেনীর মাঝে ফেলে চিন্তা করে তবে তিনি আরো বড় ভুল করবেন। কারণ আজ এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীই সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেনী।
সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন আর শাসক গোষ্ঠির পরিবর্তন এর মধ্যকার পার্থক্যটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেই যদি উদাহরণ দিয়ে বলি-আগে শাসক গোষ্ঠি ছিল মোঘলরা, তারপর এল ইংরেজরা, তারপর -পাকিরা, তারপর আওয়ামী লিগ, বিএনপি, এরশাদ। কিন্তু মানুষের প্রকৃত মুক্তি কখনই আসেনি। এর কারন সেই সমাজ ব্যবস্থাটির কখনো পরিবর্তন হয়নি। শাসকদের মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়নি আমাদের রাষ্ট্রের মানসিকতা। যারাই শাসন করেছে তারা সাধারন জনগণকেই শোষন করেছে। সেই সমাজ ব্যবস্থাটির পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রের সুবিধে বঞ্চিত মানুষের কথা চিন্তা করতে হবে। ঋণখেলাপী ব্যবসায়ী, দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিগ্রস্থ আমলা, এদের সুবিধার্তে রচিত শাসন ব্যাবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। আজকের যুগে এরাই প্রকৃত বুর্জোয়া। তাদেরকেই শাসনের ক্ষমতা থেকে উতখাত করতে হবে। সৎ ও যোগ্য রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায় আনতে হবে। তারপর সংবিধান সংশোধন করে সকল দূর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, পেশাবিদদের হাত হতে দেশকে মুক্ত করতে হবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সকল নাগরিককে সমান সুযোগ দিতে হবে। সমাজতন্ত্র মানে সকল মানুষ সমান তাই নয়। মানে হল সকল মানুষের সমান সুযোগ সুবিধে প্রদান। সকলের জন্য মৌলিক চাহিদার সমান সুযোগ। সকলের জন্য আইনের সমান প্রয়োগ। তারপর যার যার যোগ্যতার ভিক্তিতে যে যার মত অবস্থানে যাবে।
মার্ক্স গোলমাল করে ফেলেছেন সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের পথ খুঁজতে গিয়ে। সকল সমস্যার সমাধান তিনি দেখেছেন প্রলেতারিয়েতের শাসনে। কিন্তু বর্তমানে বা উত্তর আধুনিক যুগে প্রলেতারিয়েত শ্রেনী সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেনী নয়। সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেনী হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেনী। তাই প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর শাসন কখনই মার্ক্সের সংখ্যা গরিষ্ঠের শাসন হতে পারে না, অন্তত আজকের যুগে। তাছাড়া মার্ক্স এর এই প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর শাসনের প্রক্রিয়ায় কিছু স্ববিরোধিতা আছে বলে আমি মনে করি। যেমন তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বুর্জোয়া শ্রেনীর মধ্য থেকে কোন ভাল দল এসে শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তি ঘটাতে পারবে না। আমার মত প্রকৌশলীরা, অর্থনীতিবিদরা, সমাজসেবীরা সবাই বুর্জোয়া, তাই আমাদের প্রদত্ত সমাজতন্ত্রও বুর্জ়োয়া বা রক্ষনশীল সমাজতন্ত্র [৭]। এমন কি পেটি-বুর্জোয়া (নিম্ন মধ্য বিত্ত) শ্রেনীও সেটা করতে পারবে না। পারবে শুধু প্রলেতারিয়েত শ্রেনী যদি বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়াদের উৎখাত করে। কিন্তু প্রলেতারিয়েত শ্রেনী কিভাবে সংঘঠিত করবে এই বিপ্লব? মার্ক্স এর মতে সেটা হবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনের মাধ্যম্যে যা একদিন রূপ নিবে বিশাল পরিবর্তনে (দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তৃতীয় সুত্র (পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন (From quantitative change to qualitative change)))। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্রমিক আন্দোলন গুলো হতে শ্রমিক শ্রেনী আস্তে আস্তে তার অবস্থান সম্পর্কে সচেতণ হবে এবং একদিন এই সমাজ ব্যবস্থা বদলের জন্য, কমিউনিষ্ট সমাজ গঠণের জন্য বিপ্লবের পতাকাতলে একত্রিত হবে।
কিন্তু বিপ্লব এক জিনিস আর একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করা ভিন্ন জিনিস। শোষনে অতিষ্ঠ হয়ে যে কোন সমাজ, জাতি বা দেশ নিজেদের মুক্তির জন্য বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতেই পারে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সমাজ ব্যবস্থা থেকে অন্য আরেকটি সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তর কিভাবে সম্ভব তা শ্রমিক শ্রেনী কিভাবে শিখবে তা তিনি বলেননি। এই দ্বান্দিক বস্তুবাদ, ইতিহাসের শ্রেনীর সংগ্রাম এ সব কিভাবে প্রলেতারিয়েতরা জানবে তা তিনি বলেননি। আমি যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখি লেনিন, মাও, ফিডেল ক্রাষ্টো এরা কেউই প্রলেতারিয়েত শ্রেনী থেকে আসেননি। তাঁরা সবাই রীতিমত বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন, সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক ধারণাগুলো লাভ করেছেন, তার পর তাঁরা বিপ্লব সংঘঠিত করছেন। আর মার্ক্স কিংবা এঙ্গেলস তাঁরা নিজেরাও কি প্রলেতারিয়েত শ্রেনী থেকে এসেছেন? এক জনকে আমি বলতে পারি যিনি প্রলেতারিয়েত শ্রেনী থেকে উঠে এসেছেন তিনি হল – স্টালিন। তাই তাঁর শাসনের সহিংসতা ছাড়িয়ে যায় সকলকে, যা ‘The Soviet Story ’ ডকুমেন্ট্রিটিতে উঠে এসেছে।
তাই শ্রমিক শ্রেনী যে শুধু তৈরী শাসন ব্যবস্থাটিকে পেলেই যে সমাজের পরিবর্তন হবে না সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন প্যারিস কমিউনে (১৮৭১) কমিনিউষ্টদের দুই মাসের শাসন কালে। ১৮৭২ সালের ইস্তেহারের মুখপত্রেই যা তিনি স্বীকার করেছেন [৭]। মার্ক্স তরুণ বয়সে বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে তিনি সে পথ থেকে সরে এসেছিলেন, যার নমূণা পাই ১৮৭২ সালে আমর্স্টাডাম এ দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে, যেটা আমি পাই কার্ল কাউটস্কি এর ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসি ভার্সাস কমিউনিজম’ লেখায় [৯]। যেখানে তিনি বলেছেন- “ শ্রমিকদের অবশ্যই কোন একদিন রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে হবে, নুতন সামাজিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে। তাদের অবশ্যই পুরাতন রাজনৈতিক যন্ত্রটিকে উতখাত করতে হবে যা কিনা ক্রিষ্টিয়ানদেরর জীর্ণ কাঠামোর উপর গঠিত। কিন্তু এই অর্জনের পন্থা সর্বত্র একই রকমের হতে পারে না। আমাদের অবশ্যই বিভিন্ন দেশের বর্তমান কাঠামো, সংস্কৃতি, রীতিণীতি এই সমস্ত বিষয়কে চিন্তায় রাখতে হবে। আমরা এটা অস্বীকার করতে পারিনা যে-কিছু দেশ যেমন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কিংবা হলান্ড- সেখানে শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ ভাবে তাদের লক্ষে পৌছতে পারে যা অন্য সব দেশে সম্ভবপর নয়।” এখানে তিনি স্পষ্টতই সে সব দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শ্রমিক শ্রেনীর লক্ষ্যে পৌছার কথা বুঝিয়েছেন।
মার্ক্স শ্রমিক শ্রেনীর শাসনের মাঝ দিয়ে সমগ্র সমাজের মুক্তির পথ দেখেছেন। তাতে যদি বুর্জোয়া সমাজ ধ্বংস হয়, মানুষের মনে সহিংসতা আসে তাতে তিনি বিচলিত নন। যে কারনে মার্ক্স এর এই পন্থা অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ। যারা মানবতাবাদী, সমগ্র মানব জাতির মুক্তি চায়-নির্দিষ্ট কোন শ্রেনীর মুক্তি চায় না- তাদের পক্ষে জেনে শুনে মার্ক্সবাদ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। আমিও নিজেকে মানবতাবাদী হিসেবেই দেখতে চাই। সমগ্র মানবের মুক্তি কামনা করি, একটি সুষ্ঠ সমাজের স্বপ্ন দেখি। বোমা মেরে, নিরীহ মানুষ মেরে যেমন ধর্মের প্রচার করা অসম্ভব বলে মনে করি তেমনি বিপ্লব করে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিও অসম্ভব বলে মনে করি। যে পন্থাই অবলম্বন করতে আপনি চান তা সর্বপ্রথম সেই সমস্ত মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হতে হবে যাদের মুক্তি আপনি চান। এ রকম একটি অবস্থা থেকেই আমি মনে করি যে গণতান্ত্রিক উপায়েই সম্ভব একটি নুতন সমাজ ব্যবস্থা চালু করা। যদি প্রতিটি মানুষের কাছে পৌছে দিতে পারেন আপনার দলের আদর্শ কি, কিভাবে আপনার দল ক্ষমতায় গেলে সমাজ ব্যস্থায় কি ধরণের পরিবর্তন আনবে ও কেন, তা হলে আমার বিশ্বাস তারা তা গ্রহন করবে। আর যদি তারা আপনার আদর্শ গ্রহন না করে, তবে সহিংস পদ্ধতিতে যদিও আপনি সাময়িক ক্ষমতা লাভ করেন, একদিন তা ইতিহাস হয়েই যাবে।
সমাজতন্ত্র মানেই যে ব্যক্তিমালিকানার উচ্ছেদ, বা সকল কিছু রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হতে হবে তা নয়। আজ অনেক দেশে মিশ্র অর্থনীতি বিরাজমান। রাষ্ট্রীয় তদাকরীতে বেসরকারীভাবে সব কিছু চলছে। কিন্তু রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করছে। আমেরিকার কথা বিস্তারিত বলতে পারবো না, কিন্ত কানাডায় পাঁচ বছর ধরে আছি দেখছি- এখানে বিনামূল্যে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পাবেন, বাচ্চাদের পড়াশুনা পাবেন। আঁয় ভাল না হলে স্বল্প ভাড়ায় সরকারী বাসা পাবেন, বেকার ভাতা পাবেন। কোন কিছু জানতে চাইলে সমস্ত তথ্য ইন্টারনেট এ দেওয়া আছে, ফোন লাইন দেওয়া আছে, জানতে পারবেন। এরা সমাজতান্ত্রিক দেশ না হয়েও মানুষের মৌলিক অধিকার গুলো বাস্তাবায়নের চেষ্টা করছে। উন্নত দেশেও যে সমস্যা নেই তা নয়। ধনী-গরিবের ব্যবধান নেই, বেকারত্ব নেই, অপরাধ নেই তা নয়। যেখানেই সমাজ আছে তা থাকবেই এবং সে গুলো দূর করার চেষ্টাই হল আদর্শ রষ্ট্রের কাজ।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এখন যেটা সব থেকে বেশি প্রয়োজনঃ
১। একটি আদর্শ নির্ভর তৃতীয় শক্তির দল। একটি যোগ্য নেতৃত্ব দেবার মত একটি দল। যাদের প্রধান উদ্দেশ্য হবে রাষ্ট্রীয় তত্বাবধানে (পরিচালিত নয়) দেশীয় শিল্পকে প্রতিষ্ঠিত করা। দেশের অর্থনীতিকে সবল করা। দেশকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে একটি মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত করা। রপ্তানী নির্ভর শিল্প গড়ে তুলা।
২। দেশের সকল বিভাগ হতে দুর্নীতি দূর করা। বিচার ব্যবস্থা, পুলিশি ব্যবস্থা, এবং সচিবালয় বা সরকারী ব্যবস্থাকে স্বাধীন ভাবে নিজ নিজ বিভাগের রুলস অনুসারে চলতে দেওয়া। প্রয়োজন হলে দেশের সকল সরকারী/বেসরকারী বিভাগের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন করে দেওয়া, যার বাহিরে কেউই চলতে পারবে না।
৩। দেশের জনসংখ্যার বিষ্ফোরন রোধ করা। বিশাল জনসংখ্যাকে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। প্রতিটি মানুষকে একটি জাতীয় নম্বর দেওয়া যেতে পারে, যার বিপরীতে তার যাবতীয় (জন্ম, আয়, চাকুরী, সম্পত্তি, বিবাহ, সন্তান, বিদেশ গমন, যা যা সম্ভব) তথ্য থাকবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই নম্বর প্রদান করতে হবে, তাতে করে একই নামে অঢেল সমপত্তি বা কর ফাঁকি, বা বহু বিবাহ সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রন করা সহজ হয়ে যাবে।
আমাদের দেশের শাসকেরা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা বিবেচনা করে দেশ পরিচালনা করে থাকে, কখনো বা দলীয় স্বার্থে। দেশের স্বার্থ বিবেচনা বা সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থের চিন্তা তাঁরা কখনই করে না। অথচ শুধু মাত্র পাঁচ বছরই যদি দেশের স্বার্থের কথা বিবচনা করে দেশ পরিচালনা করতো তবে আজ আমাদের দেশ প্রভুত উন্নতি করতে পারতো। এটা আমরা সবাই জানি। সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ ও জানে এটা। গত দশ বছরে দেশের মোবাইল, বেসরকারী টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা, ইন্টারনেট এর বদৌলতে এখনকার মানুষ আগের তুলনায় অনেক সচেতন। মানুষ পরিবর্তন চায়, কিন্তু পরিবর্তনের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজে পায় না। তাই হতাশ হয়ে মইন বা ইউনুস বা ফখরউদ্দিন যাকে পায় তাকেই ধরার চেষ্টা করে। আমি আমাদের প্রজন্মকে অনুরোধ করবো রাজনীতিতে আসুন। নুতন দল গঠন করুন। সেই আদর্শের বানী নিয়ে প্রতিটি জনগণের কাছে যান। ভুলে যান অতীতের ব্যর্থতা। ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন প্রতিটি সমাজে, জাতিতে, এ রকম ক্রান্তিকালে তাদের নব জাগরন হয়েছে। আমাদের দেশেও সেই নব জাগরনের সূচনা হোক আমাদের হাত ধরে।
আমার এই লেখার মুল উদ্দেশ্য বিশেবিদ্যালয়ে পড়ুয়া সেই সব মেধাবী ছাত্রদের প্রতি যারা মানুষের জন্য একটি নুতন সমাজ গড়ার উদ্দেশ্যে নিজের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়গুলো ব্যয় করে চলে আর জাতিকে উপহার দেয় পরবর্তিতে কিছু হতাশাগ্রস্থ যুবক। এটা যতটা না তাদের ব্যর্থতা তার চেয়ে বেশী হল আমাদের তথাকথিত বাম রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা। আমার কথা হল- ইস্তেহারটি নিজে পড়, সাথে মার্ক্স এর আরো কিছু বই পড়, এংগেলস এর কিছু লেখা পড়। সব লেখাই http://www.marxists.org/ এই ঠিকানায় পাওয়া যায়। তারপর নিজের বিবেচনা বুদ্ধি কাজে লাগাও। অন্ধের মত যে কোন কিছু বিশ্বাস করাকে আর যাই বলুক প্রগতিশীল বলা যায় না। একটি নুতন সমাজ গড়ার আগে নিজেকে গড়তে হবে। তার জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হবে, পড়তে হবে, জানতে হবে। প্রতিটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। সর্বোপরি মানব সভ্যতার ইতিহাসটুকু জানতে হবে।
১. http://en.wikipedia.org/wiki/Materialism২. http://en.wikipedia.org/wiki/Dialectic৩. http://en.wikipedia.org/wiki/History_of_philosophy৪. http://www.marxists.org/reference/archive/hegel/index.htm৫. মার্ক্সবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের কয়েকটি দিক- শিবদাস ঘোষ http://www.ganadabi.in/works1/marxism_b.pdf
৬. http://www.marxists.org/reference/subject/economics/rousseau/social-contract/ch01.htm৭. http://www.marxists.org/bangla/archive/marx-engels/1848/communist-manifesto/istahar.pdf৮. http://www.marxists.org/bangla/archive/marx-engels/1880/utopia/Socialism,%20Utopian%20and%20Scientific.pdf
৯. http://www.marxists.org/archive/kautsky/1930s/demvscom/index.htm
পরিশিষ্টঃ আজকের যুগে প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া কারা
[লেখাটি লিখার পর অনেকেই নানান মন্তব্য করেছেন। তবে একজন মার্ক্সবাদী, তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমি প্রলেতারিয়েত বা বুর্জোয়ার সজ্ঞা সঠিক বুঝতে পেরেছিলাম কিনা। সাধারনত আমি মুল বইয়ের কোন উদ্ধৃতি সরাসরি দিই না। আমি মনে করি একটি নির্দিষ্ট লাইন তুলে দিয়ে কখনই একজন লেখকের পুরো বক্তব্য বুঝানো যায় না, তার জন্য মুল বই পুরো পড়তে হয়। উক্ত মন্তব্যের জবাবে আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি মার্ক্স এর ভাষায় কাদের তিনি প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া বলেছেন এবং সেই সজ্ঞা মেনে আমি আজ উত্তর আধুনিক যুগে কাদের প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া বলবো]
যা হোক - কমিউনিজমের মূলনীতি [১] থেকে প্রলেতারিয়েতের যে সজ্ঞাটি পাইঃ
"The proletariat is that class in society which lives entirely from the sale of its labor and does not draw profit from any kind of capital; whose weal and woe, whose life and death, whose sole existence depends on the demand for labor – hence, on the changing state of business, on the vagaries of unbridled competition. The proletariat, or the class of proletarians, is, in a word, the working class of the 19th century. "
একই বইয়ের [১] আরো এক স্থানে তিনি বলেছেনঃ
"The class of the wholly propertyless, who are obliged to sell their labor to the bourgeoisie in order to get, in exchange, the means of subsistence for their support. This is called the class of proletarians, or the proletariat. "
সুতরাং এই দুই সজ্ঞা থেকে এবং মার্ক্স ও এংগেলস আর অন্যান্য লেখা থেকে আমি যা বুঝেছি - প্রলেতারিয়েত হল তারাই যারা জীবন ধারণের জন্য তাদের শ্রম বিক্রি করে এবং যারা কোন লভ্যাংশ পায়না তাঁদের সে শ্রম দ্বারা তৈরী পূঁজি বা মুনাফা হতে। প্রলেতারিয়েতের কোন নিজস্ব সম্পত্তি নেই, যার কারনে তাঁদের শ্রম বিক্রি ব্যাতীত অন্য কোন উপায় নেই বেঁচে থাকার জন্য। সেই শ্রমের বিনিময়ে যেটুকু মুজুরী পায় তা দিয়ে তাঁরা কোনমতে বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু কোন সম্পত্তি গড়তে পারে না। শিল্প বিপ্লব এর সময়কালের ইংল্যান্ডে তাই মার্ক্স প্রলেতারিয়েত বলতে বুঝিয়েছেন তখনকার কারখানার কর্মজীবি শ্রমিক শ্রেনীদের।
ঠিক এ কারনেই আমি বুঝি আজকের যুগে প্রলেতারিয়েত হল আমাদের দেশের খেঁটে খাওয়া মানুষেরা, যারা শুধু শ্রম বিক্রি করে জীবন ধারণ করে থাকে। যারা দিন আনে দিন খায়। কোন বেলা কাজ না থাকলে তাদের সংসারে খাবার থাকে না। তাঁদের আয় এতই কম যে তা মৌলিক চাহিদা পূরোনেও যথেষ্ট নয়। এ কারনেই আমি আমাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বা নিম্ন বিত্ত শ্রেনীকে বলেছি প্রলেতারিয়েত হিসেবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় – গার্মেন্টস কর্মী, বর্গা চাষী, দৈনিক মুজুর, রিক্সাচালক, সরকারী/বেসরকারী চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী ইত্যাদিদের। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই শ্রেনী সংখ্যা গরিষ্ঠ কিনা তা আমি জানি না, তবে তাদের সংখ্যা যে অনেক তাতে কোন সন্দেহ নেই। একই কারনে আমি মনে করি না আমার বা আপনার মত পেশাবিদ শ্রমিকেরা প্রলেতারিয়েতের শ্রেনীতে পরি। কারন আমরা যে মুজুরী পাই তা থেকে উদ্ধৃত থাকে এবং তা দিয়ে আমরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানাতে পারি, যদিও আমরাও শ্রম বিক্রি করেই জীবিকা অর্জন করে থাকি।
উন্নত পুঁজিবাদী দেশে কোন প্রলেতারিয়েত শ্রেনী পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কারণ সেখানে শুধু শ্রম বিক্রির আয় ছাড়াও সরকার থেকে অনেক ধরণের সুবিধে পাওয়া যায়, যেমন বিনামুল্যে চিকিৎসা, সাবসিডাইজড বাসা, বিনামুল্যে পড়াশুনা ইত্যাদি। এগুলো আসে জনগণের ট্যাক্স এর টাকা থেকে। এবং ট্যাক্স আসে উচ্চ আয়ের লোকদের কাছ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের থেকে। সুতরাং সেখানে নিম্নবিত্তের লোকেরাও ঘুরিয়ে রাষ্ট্রে মাধ্যমে এক ধরণের লভ্যাংশ/সেবা পায়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে দেখবেন যে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা বছর শেষে বেতনের বাহিরেও প্রতিষ্ঠানের মূল লভ্যাংশের ভাগ পায়। সে ক্ষেত্রেও এদেরকে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতে ফেলতে পারবেন না।
এবার আসি বুর্জোয়া প্রসংগে। একই বইয়ে [১] তিনি বলেছেন-
"The class of big capitalists, who, in all civilized countries, are already in almost exclusive possession of all the means of subsistance and of the instruments (machines, factories) and materials necessary for the production of the means of subsistence. This is the bourgeois class, or the bourgeoisie. "
বৃহত পূঁজিপতি শ্রেনী, যারা উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সকল উপাদান (কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, কারখানা) এর একচেটিয়া অধিকার সংরক্ষণ করে। এখানে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের কোন প্রশ্ন নেই। যারাই পূঁজি খাঁটিয়ে লাভ করে তারাই বুর্জোয়া শ্রেনী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- কারখানার মালিক শ্রেনী, বাড়িওয়ালা, বড় দোকানি, বড় ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের।
মার্ক্স এর সময়কালে হয়তো ইংল্যান্ডে মধ্যবিত্তেরাই বেশী ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিল। উচ্চবিত্তের প্রচুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকার কারনে তাঁরা সেই সব সম্পত্তির থেকে প্রাপ্ত খাঁজনা থেকেই জীবিকা অর্জন করতো। এ কারনেই হয়তো মার্ক্স সে সময়কার মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলেছিলেন, এবং যাদের ধ্বংসের মাঝে দিয়ে নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আমি সকল ব্যবাসায়ী বা পূজিঁপতিদের কে বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলতে রাজী নই। সে কারনেই রাজী নই আজকের যুগের মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে বুর্জোয়ার সজ্ঞায় ফেলতে। আমি যা বুঝেছি তা হল বুর্জোয়া তারাই যারা সমাজকে শোষণ করে অন্যায়ের মাধ্যমে, অসৎ পথে, দূর্ণীতির মাধ্যমে। তাঁরাই দেশের শত্রু হতে পারে, সমাজের শত্রু হতে পারে, সকল ব্যবসায়ী বা পূঁজিপতি নয়। তাই বলেছিলাম আজকের যুগে আমার চোঁখে বুর্জোয়া হতে পারে – দূর্ণীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ, দূর্ণীতিগ্রস্থ আমলা, দূর্ণীতিগ্রস্থ পেশাবিদ, অসৎ ব্যবসায়ী, ঋণখেলাপী ব্যবসায়ী, কালোবাজারি ব্যবসায়ী ইত্যাদি।
আমি খুব চিন্তিত ছিলাম আমি নিজে কোন শ্রেনীতে পড়ি তা নিয়ে। সেটার জবাব পেলাম ইস্তেহারে [২]।
"A part of the bourgeoisie is desirous of redressing social grievances in order to secure the continued existence of bourgeois society. To this section belong economists, philanthropists, humanitarians, improvers of the condition of the working class, organisers of charity, members of societies for the prevention of cruelty to animals, temperance fanatics, hole-and-corner reformers of every imaginable kind. This form of socialism has, moreover, been worked out into complete systems."
আমার মনে হয় আমার মত পেশাবিদরা – ডাক্তার, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, আইনবিদ ইত্যাদিরা – সরাসরি বুর্জোয়া না হলেও আমাদের সহানুভুতি থাকবে সমাজের উচ্চশ্রেনীর প্রতিই। সেটা মনে করেই মার্ক্স হয়তো আমাদেরকে রক্ষনশীল বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলেছেন। প্রশ্নদাতার কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল যে তিনি নিজে পেশাবিদ হয়েও কোন কারনে নিজেকে মার্ক্সবাদী বলছেন অথচ যেখানে কমিউনিজম হচ্ছে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর শাসন। অথবা নিজেকে তিনি প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতেই ভাবছেন কিভাবে? আমি উনাকে আরো প্রশ্ন রেখেছিলাম, আজকের যুগে কাদেরকে আপনি বুর্জোয়া বা প্রলেতারিয়েত বলে মনে করেন তা আমার মত উদাহরণ সহকারে তুলে ধরলে আমার নিজেই বুঝতে পারতাম কোথায় আমাদের মতবিরোধ।
উনার মন্তব্যের একটি বক্তব্যের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করছিলাম। উনি বলেছেন আমার লেখা সম্পর্কে যে ঃ
“আমি মধ্য আয়ের বেতন ভোগী ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিতদেরকে মধ্যবিত্ত বা পেটিবুর্জোয়া বলেছি”
কিন্তু আমি পেশাবিদদের মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে ফেলিনি আর পেটি-বুর্জোয়াতেতো নয়ই। আমি তাঁদের ফেলেছি উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে বা বুর্জোয়া সমাজের যন্ত্রবিশেষ হিসেবে। পেটি-বুর্জোয়া বলতে আমি বুঝেছি মধ্যবিত্তের নিম্ন শ্রেনী বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেনী কে, যারা স্বল্পপূঁজির ব্যবসায়ী, কিন্তু বৃহৎ পুঁজির শোষণে একদিন প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতেই রূপান্তরিত হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আমাদের দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (হস্তশিল্পী, ফুটপাতের ব্যবসায়ী) সরকারী/বেসরকারী দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারী ইত্যাদিদের। যাদের আয় খুব সামান্য এবং যে কোন বড় বিপদে সর্বসান্ত হয়ে পথের ভিকিরি হয়ে যায়।
পেটি বুর্জোয়া সম্পর্কে ইস্তেহারে [২] যা মার্ক্স বলেছেনঃ
"The lower strata of the middle class — the small tradespeople, shopkeepers, and retired tradesmen generally, the handicraftsmen and peasants — all these sink gradually into the proletariat, partly because their diminutive capital does not suffice for the scale on which Modern Industry is carried on, and is swamped in the competition with the large capitalists, partly because their specialised skill is rendered worthless by new methods of production. Thus the proletariat is recruited from all classes of the population. "
ইস্তেহারের [২] অন্য এক স্থানে বলেছেন -
"In countries where modern civilisation has become fully developed, a new class of petty bourgeois has been formed, fluctuating between proletariat and bourgeoisie, and ever renewing itself as a supplementary part of bourgeois society. The individual members of this class, however, are being constantly hurled down into the proletariat by the action of competition, and, as modern industry develops, they even see the moment approaching when they will completely disappear as an independent section of modern society, to be replaced in manufactures, agriculture and commerce, by overlookers, bailiffs and shopmen. "
আমি আমার অবস্থান পরিষ্কার করেছি। কোন্কারণে এবং কাদের কে আমি কোন্শ্রেনীতে ফেলেছি। আমার স্বল্প জ্ঞানের অভাবে বুঝার ভুল হতে পারে। তবে নিশ্চিত থাকবেন ভুল বুঝে থাকলে তা শুধরে নেওয়ার সুযোগ আমার কাছে সব সময় আছে। আপনার মত সমাজের পরিবর্তন আমিও চাই। তবে কিভাবে চাই সেটাই এখনো খুঁজছি। আমি মার্ক্স বা এঙ্গেলস এর লেখা দিয়ে তাঁদের বুঝতে চাই, লেনিন বা মাও বা অন্য কারোর চোখ দিয়ে নয়। তাই নিজের মত করেই তাঁদের বুঝতে চাই।
১. http://www.marxists.org/archive/marx/works/1847/11/prin-com.htm
২. http://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/communist-manifesto/index.htm
আমার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মার্ক্সবাদী ভাইয়ের জবাবঃ
স্বাধীন, আপনাকে নতুন করে আলোচনা করার জন্য ধন্যবাদ। আপনার আলোচনার ধরনটা বেশ ভালো লাগলো কেননা গ্রহন বর্জন করার একটা মানসিকতার ছাপ রয়েছে সেখানে। আর আদর্শগত অর্থে আপনিও আমার মত এই বুর্জোয়া সমাজ ব্যাবস্থার আমুল পরিবর্তনই বোধহয় চাইছেন। যাই হোক, আমার মনে হয় আমার আগের মন্তব্যে আমি আজকের যুগে কারা প্রলেটারিয়াত আর কারা বুর্জোয়া সে বিষয়ে আমার বক্তব্য পরিস্কার করার চেষ্টা করেছিলাম। তারপরও এখানে একটি উদাহরণ দিয়ে আমার আগের বক্তব্যটি পরিস্কার করার চেষ্টা করি। ধরা যাক এক জন প্রকৌশলী একটি রিয়েল এস্টেট কম্পানি খুলেছেন যেখানে তিনি আরও ১০ জন প্রকৌশলী, ২০ জন টেকনিশিয়ান, ১০০ জন নির্মান শ্রমিককে বেতন দিয়ে পোষেন। কোম্পানীর মালিক প্রকৌশলী পুজি বিনিয়োগ করে বিভিন্ন প্লটে ফ্লাট বানানোর কাজ শুরু করেন। প্রকৌশলী এবং টেকনিশিয়ানরা তাদের দক্ষ/আধা দক্ষ শ্রম দিয়ে নকশা এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার কাজ করেন। নির্মান শ্রমিকেরা সেই নকশা অনুযায়ী তাদের অদক্ষ/আধা দক্ষ শ্রম দিয়ে সেই কাজটিকে বাস্তবায়ন করেন। এখন এখানে কার কি শ্রেণী অবস্থান?
# নিয়োগ কারী প্রকৌশলী যেহেতু পুজি বিনিয়োগ করে উদ্বৃত্ত আত্মসাত করেন এবং সেই উদ্বৃত্ত পুনরায় বিনিয়োগ করেন আরও বেশী মুনাফার জন্য, সেহেতু মার্ক্সবাদ অনুসারে তিনি হলেন একজন বুর্জোয়া। এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। তিনি ব্যাক্তি হিসেবে অত্যন্ত ভালো মানুষ হতে পারেন কিন্তু যেহেতু পুজিবাদী উতপাদন পদ্ধতিতে তার নিয়োগকৃত শ্রমিক, প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের উতপাদিত উদ্বৃত্তে তিনি ভাগ বসাচ্ছেন, সেই কারণে তিনি শোষণকারী বুর্জোয়া।
# বেতন ভোগী প্রকৌশলী/টেকনিশিয়ান আর মজুরী ভোগী নির্মান শ্রমিক প্রত্যেকেই শ্রমিকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত যেহেতু তারা তাদের শ্রম বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করছেন। বেতনভোগী প্রকৌশলী টেকনিশিয়ানরা হলো হোয়াট কালার শ্রমিক যেহেতু এদের শ্রমের মূল্য অপেক্ষাকৃত বেশী দেয়া হয়, যেহেতু এরা মূলত মানসিক শ্রম বিক্রী করে এবং এদের শ্রমকে দক্ষ শ্রম বলা হয় যেটাকে অর্জন করতে নির্দিষ্ট ধরনের ট্রেনিং বা শিক্ষার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। আর নির্মান শ্রমিকরা হলো ব্ল-কলার শ্রমিক যেহেতু এদের শ্রমের মূল্য কম দেয়া হয়, যেহেতু এদের শ্রম অদক্ষ বা আধা দক্ষ এবং শারীরিক শ্রম নির্ভর। এরা শ্রম বিক্রিয়কারী হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত বা Class in itself হলেও চেতনাগত অর্থে প্রলেতারীয় শ্রমিক শ্রেণীর চেতনা ধারণ নাও করতে পারে অর্থাত Class for itself হলো রাজনৈতিক চেতনার ব্যাপার যা অর্জন করার বিষয়।
উচ্চ বেতন ও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কারণে বেতনভোগী প্রকৌশলীরা নিজেকে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ইত্যাদি অনেক কিছুই ভাবতে পারে কিংবা নিজেদের সুবিধা জনক অবস্থান বজায় রাখা এবং মূল্যবান চাকুরীটি হারানোর ভয়ে মালিক প্রকৌশলীর একান্তঅনুগত হিসেবে সেই বুর্জোয়া মালিকের শোষণের যন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে—অর্থাত সাংস্কৃতিক বিবেচনা, লাইফস্টাইল মূল্যবোধ ইত্যাদি অর্থে সে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত বিভিন্ন ধরণের মানসিকতা ধারণ করতে পারে কিন্তু অর্থনেতিক হিসেবে উতপাদনের উপকরণের সাথে মালিকানা সম্পর্ক বিচারে তার অবস্থান কিন্তু শ্রমিকতার অবস্থান। একইভাবে একজন টেকনিশিয়ান এমনকি কোন কোন উচ্চমজুরী প্রাপ্ত দক্ষ নির্মান শ্রমিকও পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিচারে নিজেকে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ভাবতে পারে, চাকুরী হারানো বা অন্যান্য বিবেচনায় মালিক শ্রেণীর স্বার্থবাহক শোষনের যন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে কিন্তু তাই বলে সে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিচারে কখনও বুর্জোয়া বা পেটিবুর্জোয়া মধ্যবিত্ত হয়ে যায় না। উচ্চ বেতন পাওয়ার জন্য হোয়াট কলার শ্রমিকদের কারও কারও হাতে উদ্বৃত্ত থাকলেও যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সেই অর্থকে পুজিতে রুপান্তর না করছে অর্থ মুনাফা অর্জনের জন্য শ্রমিক নিয়োগ করে কারখানা বা কোম্পানী না খুলছে ততক্ষণ পর্যন্ত উতপাদন সম্পর্ক বিচারে তারা শ্রমিক শ্রেণীরই অংশ, যাদের কে লেনিনের ভাষায় বলা যায় লেবার এরোস্টেক্রেট। লেনিন উন্নত ধনবাদী দেশে ক্রমশ এই লেবার এরোস্প্রোক্রেটদের বৃদ্ধি দেখে বলেছিলেন কার্যকর শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই লেবার এরোস্ট্রোক্রেসি একাটা বিরাট বাধা, কাজেই এটাকে ভাঙা খুবই জরুরী।
এভাবে হোয়াইট কলার শ্রমিকেরা স্বাভাবিক সময়ে তাদের সুবিধাজনক অবস্থা হারানোর ভয়ে পুজি ও শ্রমের দ্বন্দ্বে পুজির পক্ষাবলম্বন করলেও সংকটের সময় যখন ব্ল-কলার শ্রমিকদের মতই তাদেরকে ছাটাই হতে হয় তখন কিন্ত দেখা যায় এরা শ্রমিকদের মতই ট্রেড ইউনিয়ন জাতীয় সংগঠন করে মালিক বুর্জোয়ার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। আপনি আপনি আপনার আলোচনায় যেসব স্যোসাল ওয়েল ফেয়ারের উদাহরণ দিয়েছেন এগুলো কিন্তু এই হোয়াট কলার আর ব্লু কলার শ্রমিকদের মিলিত আন্দোলনের ফল। এখন তারা তাদের সেই শ্রেণী চেতনা কতটুকু ধরে রাখবে এটা পুরোপুরি নির্ভর করে সেই সময়ের রাজনৈতিক অর্থনেতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সর্বপরি শ্রমিক শ্রেণীর চেতনাগত মান ও তার প্রয়োগ সক্ষমতার উপর।
আর আমি নিজে একজন প্রকৌশলী হয়েও কেন সর্বহারা শ্রেণীর শাসন কমিউনিজমে বিশ্বাস করি তার উত্তরে বলবো মার্কস/এঙ্গেলস নিজেরাও কিন্তু সেই অর্থে কারখানায় কাজ করা সর্বহারা শ্রমিক ছিলেন না কিন্তু চেতনাগত অর্থে তারা সর্বহারার সাথে একাত্মতা বোধ করেছেন অর্থাত ডি-ক্লাসড হয়েছিলেন। আর আমি তো নিজে একজন হোয়াট কলার শ্রমিক- আমার কেবল দরকার নিজেকে মধ্যবিত্তের মানসিকতা থেকে বের করে নিজের শ্রেণী অবস্থানটাকে বুঝে নেয়া এবং সে অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করা।
যার প্রেক্ষিতে আমার জবাব ও উপসংহারঃ
ধন্যবাদ আপনাকে আপনার মন্তব্যের জন্য। আপনার বক্তব্যের পর এটা বুঝতে পারলাম আপনার সাথে আমার চিন্তার পার্থক্য খুবই সামান্য, তবে তা মৌলিক পার্থক্য। শুধু এইটুকু পার্থক্যের জন্যই আপনি নিজেকে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতে একাত্মতাবোধ করেন এবং মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী হয়ে সমাজ পরিবর্তণের স্বপ্ন দেখেন। পার্থক্যটি হল যত না প্রলেতারিয়েতের সজ্ঞায় তার চেয়েও বেশী বুর্জোয়ার সজ্ঞায়। প্রলেতারিয়েত এখানে মূল বিষয় নয়, শোষিত শ্রেনী মানেই প্রলেতারিয়েত। কিন্তু বুর্জোয়া কারা।
আপনারই ভাষায় -নিয়োগ কারী প্রকৌশলী যেহেতু পুজি বিনিয়োগ করে উদ্বৃত্ত আত্মসাত করেন এবং সেই উদ্বৃত্ত পুনরায় বিনিয়োগ করেন আরও বেশী মুনাফার জন্য, সেহেতু মার্ক্সবাদ অনুসারে তিনি হলেন একজন বুর্জোয়া। এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। তিনি ব্যাক্তি হিসেবে অত্যন্ত ভালো মানুষ হতে পারেন কিন্তু যেহেতু পুজিবাদী উতপাদন পদ্ধতিতে তার নিয়োগকৃত শ্রমিক, প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের উতপাদিত উদ্বৃত্তে তিনি ভাগ বসাচ্ছেন, সেই কারণে তিনি শোষণকারী বুর্জোয়া।
আমিও ঠিক এটাই বুঝেছি যে মার্ক্স তাই বুঝিয়েছেন। আমি বলেছি- বৃহত পূঁজিপতি শ্রেনী, যারা উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সকল উপাদান (কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, কারখানা) এর একচেটিয়া অধিকার সংরক্ষণ করে। এখানে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের কোন প্রশ্ন নেই। যারাই পূঁজি খাঁটিয়ে লাভ করে তারাই বুর্জোয়া শ্রেনী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- কারখানার মালিক শ্রেনী, বাড়িওয়ালা, বড় দোকানি, বড় ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের।
সুতরাং দেখতেই পারছেন আমার মার্ক্স এর সজ্ঞা বুঝায় আর আপনার সজ্ঞায় তেমন বেশী পার্থক্য নেই। পার্থক্য হল আমি মার্ক্স এর এই সজ্ঞাকে মনে করি খুবই সরলিকৃত একটি সজ্ঞা হিসেবে। সকল পুঁজিপতিদেরই তিনি শত্রুর কাঁতারে ফেলেছেন। তিনি যেটা দেখেছেন যে সকলে মিলে লাভ করা হয়, কিন্তু সে লভ্যাংশ শুধু পায় পুঁজিপতি। সেই বাড়তি মুনাফা আবার বিনিয়োগ হয়, তা থেকে আরো মুনাফা হয়, সেটাও যায় পুঁজিপতির ঘরেই। সুতরাং যে কারোরই সেই পুঁজিপতির উপর ক্ষোভ হতেই পারে।
কিন্তু পুঁজিপতি যে বিনিয়োগটি করছে তার যে রিস্ক আছে সেটাও তো পুঁজিপতির, তাই না। সে কিছু লাভের আশায় ব্যবসায় এসেছে। আপনার সেই প্রকৌশলী তো নিজে ব্যবসায় না এসে সারাজীবন শ্রম বিক্রি করেই চলতে পারতো। কিন্তু সে ব্যবসায় এসেছে কারণ ব্যবসায় লাভ আছে আবার লোকসানের ভয়ও আছে। এখানে আপনি যে সিস্টেম এর কথা বলছেন সেটাই ক্লাসিকাল অর্থনীতি। সেই একই অর্থনীতি মেনেই কমিউনিষ্ট সমাজেও রাষ্ট্রকে ব্যবসা করতে হবে। পুঁজি খাটাতে হবে, সেখান হতে মুনাফা করতে হবে, সেই বাড়তি মুনাফা দিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরী করতে হবে। যদি এটা না করে তবে সে দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়বে। তবে এটাও মনে রাখা উচিৎ রাষ্ট্রের পক্ষে ব্যবসা করে মুনাফা করা এত সহজ কথা নয়, যার প্রমান আমাদের দেশের সকল রাষ্ট্রীয় শিল্প বা প্রতিষ্ঠান গুলো। যে কারনেই ব্যক্তি মালিকানায় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হয়। রাষ্ট্র সেখান হতে কর আদায় করে, অর্থ্যাৎঘুরিয়ে বললে রাষ্ট্র একটু কম মুনাফা করলো। রাষ্ট্রের বাকি মুনাফা ব্যক্তিকে দেওয়া হল কারণ সেই ব্যক্তি নিজে রিস্ক নিয়ে একটি কর্মক্ষেত্র তৈরী করলো এবং রাষ্ট্রকে মুনাফা দিল। রাষ্ট্র শুধু পুঁজি ধার দিয়ে মুনাফা করলো, আর ব্যক্তি তার শ্রম ও মেধা খাটিয়ে নিজে ও রাষ্ট্রকে মুনাফা দিল। এমন ব্যক্তিকে আমি কিভাবে শত্রু শ্রেনী হিসেবে চিহ্নিত করবো। আমার সাথে আপনার বা মার্ক্স এর মূল পার্থক্য এখানেই।
আরেকটি ক্ষুদ্র পার্থক্য হল, মানবতাবোধ বা নীতিবোধ। আপনি যেভাবে খুব সহজ করে বলে দিতে পারেন এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। আমি তা পারিনা। কারণ নীতি এবং মানবতা আমার কাছে অনেক বড়। একজন মানুষকে আমি শ্রেনী শত্রু আখ্যা দিয়ে মেরে ফেলে আর যাই করি কারোর ভাল করতে পারবো এ ধরণের বিশ্বাস আমার পক্ষে অসম্ভব। সে কারনেই বোমা মেরে মানুষকে ধর্মের বাণী পৌছে দেওয়া সম্ভব বলেও আমি মনে করি না।
মুনাফা, সে ব্যক্তিই করুক বা রাষ্ট্রই করুক, রাষ্ট্রের উচিৎ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তাবায়ন হচ্ছে কিনা তার তদারকি করা। অর্থাৎ সেই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা পর্যাপ্ত মুজুরি পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিৎ করা রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্র সেটা না করলে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে পারে, তার জন্য আন্দোলন হতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পরিবর্তন সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। কারন মার্ক্স যাকে পুঁজিবাদ বলেন তাকে আমি বলি আধুনিক অর্থনীতি ব্যবস্থা। মার্ক্স যাকে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা বলেন আমি তাকে বলি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই অর্থনৈতিক বা সমাজ ব্যবস্থা এসেছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের অংশ হিসেবেই। সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করা মানে হল সভ্যতার চাকাকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া ।
এটা ঠিক যে আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। গণতন্ত্রের চেয়ে উত্তম শাসন ব্যবস্থা এখনো পাওয়া যায়নি। তাই বলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। যদি সমাজে পরিবর্তন আনতেই হয় তবে আমি বর্তমান ব্যবস্থাকেই ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করবো। আমি সভ্যতার চাকাটিকে সামনের দিকেই নিয়ে যাবার চেষ্টা করবো, পেছনের দিকে নয়।
দেশ নিয়ে চিন্তার কোন এক প্রাক্কালে সমাজতন্ত্রের চিন্তা প্রথম মাথায় চলে আসে। আমার মত এমন অনেকেই মনে হয় আছেন যারা জীবনের কোন না কোন সময়ে সমাজতন্ত্রের প্রেমে পড়েছেন, আবার সেই প্রেম ছুটে যেতেও বেশি সময় নেয়নি। আপনি যদি মানবতাবাদী হোন তবে সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদ স্বাভাবিকভাবে চলে আসবে। কোন যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে শ্রেনীবিভেদ, লিংগবিভেদ, কিংবা ধর্মবিভেদ- এগুলোর কারণে সৃষ্ট শোষন মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করি। এ রকম একটি অবস্থায় আমি মার্ক্সের এর দর্শন নিয়ে আগ্রহবোধ করলাম। তবে মার্ক্সের দর্শন নিয়ে লেখার আগে আমি একটু বিস্তারিত বলার চেষ্টা করবো দর্শন কিভাবে কাজ করে। আমার মতে সেটা না জানা থাকলে যে কারো দর্শন নিয়ে আলোচনার চেষ্টা বৃথা।
আমি যেভাবে দর্শনকে দেখি তা হলো যুক্তির মাধ্যমে, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষন পদ্ধতিতে, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোকে কোন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। প্রতিটি দার্শনিক যেটা করে থাকেন – তিনি প্রথমে তাঁর পূর্ববর্তী সকল দার্শনিকদের চিন্তাভাবনা গুলো পর্যবেক্ষন করেন তাঁদের প্রকাশিত লেখার মাধ্যমে। যে কারনে প্রত্যেক দার্শনিক তাঁর সময়ের সর্বোচ্চ তত্বটিই প্রদান করেন তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের ভুলগুলো শুধরে দিয়ে। তারপরও প্রতিটি দর্শনের ক্ষেত্রে একটি কথা এখানে প্রযোজ্য যে যেকোন দর্শনই তাঁর কালকে অতিক্রম করতে পারে না। সকল দার্শনিক তাঁর সময়কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ। কথাগুলো সমভাবে প্রযোজ্য প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ গুলোর জন্য। প্রতিটি শেষ ধর্ম আগের ধর্মগুলোর ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই তৈরী হয় বলে শেষের ধর্মটি হয়ে থাকে সর্বোত্তম। ধর্মগ্রন্থ গুলোকে আমি দর্শনের ইতিহাসের একটি অংশবিশেষ হিসেবে দেখি। শুধু পার্থক্য এই যে দাবী করা হয়ে থাকে যে ধর্মের কথাগুলো সরাসরি ঈশ্বরের, আর দর্শনের গুলো মানুষের।যদি কেউ বলে থাকেন যে কারোর দর্শন সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য তবে তিঁনি ইতিহাসকেই অস্বীকার করেন।
এখন কথা হল দর্শন আর বিজ্ঞানের মাঝে পার্থক্য কি? বিজ্ঞানের যে কোন আবিষ্কার তাঁর পূর্ববরর্তী জ্ঞান বা তত্বকে পর্যালোচনা করেই সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যে কোন তত্ব হয় কালের উর্ধ্বে। যদি একটি তত্ব তাঁর পর্যবেক্ষনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তা যেমন তাঁর পূর্ব ও বর্তমান কালে সত্য তেমনি তা হতে হবে ভবিষ্যতেও সত্য। যদি ভবিষ্যতের কোন একটিও পর্যবেক্ষন দ্বারা সেই তত্ব অসত্য প্রমানিত হয় তবে তা আর বৈজ্ঞানিক তত্ব থাকে না। দর্শনগুলো যেহেতু তাদের কালকে অতিক্রম করতে পারে না তাই দর্শনের মাঝে বিজ্ঞান খোঁজা অবান্তর। সম কারনে ধর্মের মাঝেও বিজ্ঞান খোঁজাও অবান্তর।
তবে প্রত্যেক দার্শনিকই বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষন প্রনালী ব্যবহার করে থাকেন – জেনে বা না জেনেই। যে কোন কিছু জানার চেষ্টা করা-পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রশ্ন এবং তার উত্তরের মাধ্যমে – তাহাই বৈজ্ঞানিক প্রনালী। যেমন আদিম সমাজে মানূষ জানার চেষ্টা করতো কেন তাঁরা অসুস্থ হয়। তাঁদের যেহেতু জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছিল তাই তাঁরা বের করলো দেবতাদের খুশী রাখলে, পূঁজা করলে তাঁরা সুস্থ হয়ে যাবে। তাঁরা বের করলো জটিল মন্ত্র, যার হয়তো কোন ব্যাখ্যা নেই কিন্তু তারপরেও তা আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্বের তুলনায় কোন অংশে কম ছিল না তাঁদের কাছে। তবে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষন প্রনালী ব্যবহার করলেই সেটি বৈজ্ঞানিক তত্ব হয়ে যায় না, যেমনটি হল আদিম সমাজের মন্ত্রতত্ব। আজ আমরা যে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষনা করতে গেলে আমরা কি করি? প্রথমে আমরা ঠিক করি আমি কি নিয়ে কাজ করতে চাই এবং কেন করতে চাই। তারপর লিটেরেচার রিভিউ করি। আমার আগে যারা একই বিষয় নিয়ে কাজ করেছে তাঁরা কি কি করেছেন দেখি। তাঁদের সীমাবদ্ধতা কোথায় ছিল বোঝার চেষ্টা করি। এটা যখন ধরা যায় তখনি কেবল নিজের পক্ষে কতটুকু কাজের সুযোগ আছে এই বিষয়ে সে সম্পর্কে একটা ধারণা হয়। এই ধারণাটি যখন হয়ে যায় তারপরের কাজ বেশ সহজ। কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা করা হয় যা আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে সাহায্য করে। এভবে পরীক্ষা আর প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চলতে থাকে যতক্ষন না আমি সন্তুষ্ট হই।
দর্শনের ক্ষেত্রেও দার্শনিকরা কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজে চলেছেন। তবে এক্ষেত্রে তাঁরা পর্যবেক্ষন করে থাকে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস। যিনি যত পরে এসেছেন তাঁর কাছে পূর্ববর্তী ইতিহাসের তথ্য বেশী ছিল, তাই তাঁর পর্যবেক্ষন তত ভাল হয়েছে। সক্রেটিস, এরিষ্টটল, কান্ট, হেগেল, মার্ক্স– তাঁরা সবাই অনেক প্রতিভাবান ছিলেন কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁরা সকলেই তাঁদের সময়কাল দ্বারা আবদ্ধ ছিলেন। তাঁরা যেটুকু ইতিহাস দেখেছেন তাই শেষ নয়, তাই তাঁদের কথাই শেষ নয়। তবে তাঁরা যে কথাগুলো বলেছেন তা বুঝতে হলে আপনাকে তাঁরা যে ইতিহাস দেখে উনাদের সিদ্ধান্তে এসেছেন আপনাকেও পৃথকভাবে তাঁর কাছাকাছি যেতে হবে। যখন আপনি সেটা করতে পারছেন তখনি কেবল সম্ভব হবে চিন্তা করতে যে তাঁরা আজ বেঁচে থাকলে কি বলতেন।
নিছক মার্ক্সবাদের সমালোচনা করা, বা কারো ব্যাক্তিগত বিশ্বাসে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মার্ক্স এর দর্শন যা বুঝেছি তাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি কেবল। চেষ্টা করেছি মার্ক্স এর দূর্বলতা গুলোকে চিহ্নিত করে তাঁর প্রকৃত দর্শনকে তুলে ধরতে। আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষন একশত ভাগ সত্য হবে তা মনে করি না, তবে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে দ্বিমত পোষন করলে যুক্তি খন্ডন করে মতামত দিলে খুশি হবো। লেখার সময় চেষ্টা করেছি প্রতিটি রেফারেন্স উল্লেখ করতে এবং সমস্ত রেফারেন্সই অন্তর্জালে আছে। তাই আমার বক্তব্য খতিয়ে দেখা খুব বেশী কঠিন নয় বলেই মনে করি।
দুইঃ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
মার্ক্স (karl Marx, 1818-1883) এর দর্শনের প্রধানত দু’টি দিক- একটি বস্তুবাদ এবং অন্যটি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। এই দু’য়ের সংমিশ্রনে সৃষ্ট তাঁর দর্শন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। বস্তুবাদ কিংবা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি, মার্ক্সই প্রথম বলেন তা নয়। বস্তুবাদ দর্শন আমরা দেখতে পাই গ্রীক দার্শনিক থেল্স্(Thales, 624 BC-546 BC), ডেমোক্রিটাস্(Democritus, 460 BC-370 BC ), ইপিকিউরাস্ (Epicurus, 341 BC-270 BC) এর মাঝে [১]। তারপরে দেখা যায় হব্স্(Thomas Hobbes, 1588-1679), ফুয়েরবার্খ (Feuerbach, 1804-1872), মার্ক্স (Marx, 1818-1883), এংগেল্স্(Engels, 1820-1895), বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russel, 1872-1970) এর মাঝে [১]। বর্তমান সমসাময়িকে দেখা যায় ডেনেট (Dennett, 1942-), কুইন (Quin, 1908-2000), ডেভিডসন (Davidson, 1917-2003) প্রমুখ দার্শনিকের মাঝে [১]।
বস্তুবাদ দর্শনের মূল কথা হল, বস্তুই সব। পৃথিবীর সমস্তই বস্তু দ্বারা গঠিত এবং তা সর্বদা গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। বস্তুবাদ দর্শনে মন বা আত্মার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া/প্রতিক্রিয়াই হল মন। মার্ক্স এর পিএইচডির বিষয়বস্তু ছিল “The difference between the Democritean and Epicurean philosophy of nature”. উক্ত কাজের সময় এবং পরবর্তীতে জার্মান দার্শনিক হেগেল ও ফুয়েরবার্খ নিয়ে কাজ করার সময় তিনি বস্তুবাদী দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছিলেন বলে মনে হয়।
দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিও মার্ক্স সর্বপ্রথম বলেননি। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস্(Socrates, 469 BC-399 BC), প্লেটো (Plato, 428/427 BC-348/347 BC), এরিষ্টটল্(384 BC-322 BC) এর মাঝে দ্বান্দ্বিক কথোপকথন লক্ষ্য করা যায় [২]। তবে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন জার্মান দার্শনিক হেগেল (Hegel, 1770-1831), যার ধারনা তিনি পেয়েছিলেন আরেক জার্মান দার্শনিক কান্ট (Kant, 1724-1804) থেকে [২]। এই পর্যায়ে হেগেল এর কথা কিছুটা না বললেই নয়। হেগেলকে বলা হয় ভাববাদী দার্শনিকদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। প্রাচীন গ্রীক দর্শনের যুগের পর বিশাল মধ্যযুগে (রোমান সভ্যতার পতনের পর, পঞ্চম শতাব্দি, থেকে রেনেসাঁস্, ষোড়শ শতাব্দি, এর আগ পর্যন্ত) দর্শনের বিষয়বস্তু মূলত সীমাবদ্ধ থাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানে এবং তার ভাল গুণাবলীর আবিষ্কারে [৩]। মধ্যযুগের পর আধুনিক দর্শনকালে গ্যালিলিও (Galileo, 1564-1642), ডেস্কার্টেস (Descartes, 1596-1650), স্পিনোজা (Spinoza, 1632-1677), লিব্নিজ (Leibniz, 1646-1716) কান্ট, হেগেল অন্যতম [৩]। এই সময়কার দর্শনের মূল বিষয়বস্তু ছিল যুক্তির ব্যবহার। আর হেগেল এই যুক্তির ব্যাবহার কে এক অনন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে। তাঁর Lectures on the History of philosophy [৪] পড়লে দর্শনের ইতিহাস সম্পর্কে পুরো ধারণা লাভ করা যায়। সেখানে তিনি প্রাচীন কাল হতে তাঁর সময়কাল পর্যন্ত সকল পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দার্শনিকদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর লেখা হচ্ছে দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বোধ্য।
তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মূল বিষয় হল thesis (তত্ব) এবং antithesis (প্রতিতত্ব) এর দ্বন্দ্ব এবং এই দু’য়ের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে একটি synthesis এ পৌঁছা। synthesis কে অবশ্যই antithesis কে যুক্তি দিয়ে জয় করে আসতে হবে। হেগেল যেটি দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির মাঝে সবসময় একপ্রকার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের কারনে প্রতিটি বস্তু প্রতি নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালেও মানব জাতির মাঝে একই রকমের দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। হেগেল এবং মার্ক্স দু’জনেই মানব সভ্যতার ইতিহাসকে ভালভাবে পর্যবেক্ষন করেছেন। শুধু পার্থক্য এই যে হেগেল সবকিছুতে ছিলেন ভাববাদী আর মার্ক্স ছিলেন বস্তুবাদী। মার্ক্স এর নিজের ভাষায় তিনি হেগেল এর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে মস্তিষ্ক (ভাব) থেকে পাঁয়ে (বস্তু) নামালেন, বলা যায় একেবারে উল্টিয়ে দিলেন [৫]।
হেগেল সব কিছু পর্যবেক্ষন করে যেটা শেষমেশ দাঁড় করালেন তা হল, বস্তু হচ্ছে ‘absolute idea’ এর দ্বান্দ্বিক প্রকাশ। তিনি যেটা ধরে নিয়েছেন তা হচ্ছে আইডিয়া হল ‘অরিজিনাল আইডিয়া’। কিন্তু তার মধ্যে স্ববিরোধী দ্বন্দ্ব আছে, এবং সেই দ্বন্দ্বের ফলেই বাস্তব জগতের সৃষ্টি। তাঁর কথার মানে দাঁড়ায়, বাস্তব জগৎটা হচ্ছে একটা ছবি এবং সেই অর্থে সেটা হল ‘absolute idea’ এর প্রকাশ [৫]। অর্থাৎ দুনিয়াতে যা কিছু ঘটছে তা সেই absolute idea এরই বহিঃপ্রকাশ। এই কারনে হেগেলরই কিছু ছাত্র যাদের বলা হত বাম-ঘেঁষা (Left Hegelian), তাঁরা তাঁদের শিক্ষকের ‘অরিজিনাল আইডিয়া’ কে মানতে রাজী হল না। এর মাঝে ফুয়েরবার্খ, মার্ক্স অন্যতম। তাঁরা যেটা বললেন, ভাব থেকে বস্তু সৃষ্ট নয়, বরং ভাবই বস্তু থেকে সৃষ্ট। মন বা আত্মার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়ার ফলেই মন বা ভাবের সৃষ্টি। মানুষের মস্তিষ্কেই ঈশ্বরের অবস্থান। ঈশ্বরের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। তাঁরা বললেন হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সব ঠিকই আছে শুধু তাকে ভাববাদ থেকে মুক্ত করতে হবে। এভাবেই সৃষ্ট দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথা হল সমস্ত বস্তুই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের মধ্যেই সম্পর্কযুক্ত [৫]। এই দ্বন্দ্ব আবার দুই প্রকারঃ অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্ব। কোন বস্তু নিজের অভ্যন্তরে যে দ্বন্দ্ব তা হল অন্তর্দ্বন্দ্ব আর একটি বস্তুর সাথে অন্য বস্তুর যে দ্বন্দ্ব তা হল বহির্দ্বন্দ্ব। তবে মার্ক্স এর ভাষায় এই দুই দ্বন্দ্বের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্বই হল পরিবর্তনের ভিক্তি। বহির্দ্বন্দ্ব কোন কোন ক্ষেত্রে অন্তর্দ্বন্দ্বকে প্রভাবিত করতে পারে কিন্তু যতক্ষন পর্যন্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব পরিপক্কতা লাভ না করে ততক্ষন পর্যন্ত বহির্দ্বন্দ্ব কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এটার উদাহরন হিসেবে বলা যায় যখন কোন সমাজ বা গোষ্ঠী নিজেরা বিপ্লব বা পরিবর্তনের জন্য তৈরি না হয় তখন বাহির হতে কেউ তাদের কোন সাহায্য করলে বিশেষ লাভ নেই।
মানব সভতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে সমাজের অভ্যন্তরেও প্রতি নিয়ত বহুধরনের শক্তির দ্বন্দ্ব চলছে। শ্রেনী, বর্ণ, লিংগ, ধর্ম, জাত, রাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থ এরকম আরো অনেক বিভাজনের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চলছে। তবে মার্ক্স এর মতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সকল দ্বন্দ্বের মূল হল শ্রম ও পুঁজির মধ্যে দ্বন্দ্ব, যা নিয়ে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করবো। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তিনটি মূলনীতি বলে আজ শেষ করবো। প্রথমটি হলঃ বিরোধী শক্তির ঐক্য (unity of opposites)[৫]। একটি মানুষের মাঝে যেমন ভাল-খারাপ দুই গুণই বর্তমান, তেমনি সকল বস্তুতে এবং সমাজেও স্ববিরোধী শক্তির সহবস্থান আছে। ধনাত্মক ও ঋনাত্মক চার্জ, ইলেক্ট্রন ও প্রোটন, কিংবা সৌরজগতের আকর্ষন ও বিকর্ষন শক্তি এর উদাহরন। এই পরস্পরবিরোধী শক্তির সাম্যবস্থার কারনে সব স্বাভাবিক ভাবে চলছে। যখন কোন একটি শক্তি অন্যটি অপেক্ষা বেশী শক্তিশালী হয়ে যায় তখন দ্বিতীয় নীতিটি আসে, তা হলঃ বিকাশের পথে অবলুপ্তি, অবলুপ্তির পথে বিকাশ (Negation of the negation)[৫]। এই নীতির অর্থ হচ্ছে নিছক সৃষ্টি বা ধ্বংস বলে কিছু নেই। সৃষ্টি মানেই হচ্ছে ধ্বংস আবার ধ্বংসের মাঝেই হচ্ছে নুতনের সৃষ্টি। মানব শরীরে যেমন শৈশবের ধ্বংসের মাঝে একজন মানুষ কৈশোরে পদার্পণ করে, আবার সে কৈশোরকে ধ্বংস করেই যৌবনে পদার্পন করে। মার্ক্সের মতে সমাজেও সে রকম এক সমাজ ধ্বংস হয়ে নুতন সমাজ গড়ে উঠে। সবশেষ তৃতীয় নীতিটি হলঃ পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন (From quantitative change to qualitative change)[৫]। এই নীতির কথা হল যে সকল পরিবর্তনই গুণগত পরিবর্তন আনে না। যেমন পানিকে তাপ দিলে তা বাষ্প হয় না যতক্ষন না তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হচ্ছে। তেমনি সমাজে হয়তো প্রতিনিয়ত অল্প অল্প পরিমাণগত পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু তা যখন বিশাল আকারে হয় তখনই একে গুণগত বা বৈপ্লবিক বা মৌলিক পরিবর্তন বলা হয়।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। দর্শন নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আর আমি তেমন জানিওনে। দর্শন আমার বিষয়ও নয়। শুধু আমার মূল বক্তব্য ভালভাবে প্রকাশের জন্য একটি হালকা ধারনা দিচ্ছি। শুধু হেগেল কিংবা মার্ক্স এর দর্শন পুরোপুরি বুঝতে, যে কারো সারাজীবন চলে যাবে। আমার মূল উদ্দেশ্য মার্ক্সবাদ আর সমাজতন্ত্রের মাঝে কি পার্থক্য আছে তা খুঁজে বের করা। সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদ এর দ্বন্দ্ব থেকে কিছু সমাধান পাওয়া যায় কিনা তার চেষ্টা করা। আজ আমরা দেখলাম যে বস্তুবাদ এবং দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি কিভাবে আসলো। পরবর্তীতে দেখবো সমাজতন্ত্রের এবং সাম্যবাদের ধারনা কিভাবে আসলো।
তিনঃ সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ
সমাজতন্ত্রের ধারণাও মার্ক্সই প্রথম বলেননি। ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯-১৭৯৯) আগে দার্শনিক রুঁসো (Rousseau, ১৭১২-১৭৭৮) রচনা করেছিলেন ‘সামাজিক চুক্তি (social contract)’। যেখানে তিনি বলেন- মানুষ জন্ম নেয় মুক্ত হয়ে, কিন্তু জন্মের পর দেখে চারিদিকে শুধু বাঁধার শেঁকল [৬]। এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বলেছেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা, যে আইন হবে সকল মানুষের নিজেদের তৈরী আইন- এক ধরণের সামাজিক চুক্তি [৬]। রুঁসো সমাজতন্ত্রের কথা সরাসরি না বললেও তাঁর লেখায় ছিল নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির কথা। যে কারনে ফরাসী বিপ্লব যদিও রুঁসোর মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পর সংঘঠিত হয়, তারপরও ফরাসী বিপ্লবে রুঁসোর দর্শনের অবদান ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির চিন্তা মনে হয় মার্ক্স পেঁয়েছেন এই ফরাসী বিপ্লব থেকেই।
সেইণ্ট সিমন (Saint Simon, ১৭৬০-১৮২৫) ছিলেন ফরাসী বিপ্লবের সন্তান। তাঁর মতে ভবিষ্যত সমাজে সকলকে অবশ্যই কাজ করতে হবে, এবং সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির স্থান নির্ধারিত হবে তার শ্রমের কৃতিত্বগুলো দিয়ে[৭]। তবে রাজনীতিক সংগ্রাম ও বিপ্লব সম্পর্কে তিনি নেতিবাচক অবস্থান গ্রহন করেছিলেন। ফরাসী বিপ্লবে সর্বহারাদের শাসন কে আখ্যায়িত করেছেন ‘সন্ত্রাসের শাসন’ হিসেবে [৮]। তিঁনি চেয়েছিলেন সরকারি সংস্কারকর্ম আর এক নুতন ধর্মের চেতনায় সমাজের নৈতিক প্রশিক্ষনের ফলেই শ্রেনী-বিরোধের বিলুপ্তি ঘটবে [৭], যা মার্ক্স এবং এংগেলস এর মতে ইউটোপিয়।
পরবর্তীতে ফুঁরিয়ে (Charles Fourier, ১৭৭২-১৮৩৭), তাঁর লেখায় বুর্জ়োয়া সমাজের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তবে তিনিও হিংসাশ্রয়ী বিপ্লবের ধারণার বিরোধিতা করতেন এবং মনে করতেন যে ভবিষ্যত সমাজতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণ ঘটানো যেতে পারে শান্তিপূর্ণ প্রচারনের মধ্য দিয়ে-যেখানে লোকে কাজ করবে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে [৭]। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন, যে কোন একটি সমাজের সাধারণ মুক্তির মাপকাঠি হল সে সমাজের নারী মুক্তির মান [৮]।
ইংলেন্ডে যখন শিল্প বিপ্লবের শুরু হয়, সে সময় ওয়েন (Robert Owen, ১৭৭১-১৮৫৮) একটি সুতাকলের সুপারেন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। তিনি মনে করতেন যে সামাজিক অসাম্যের প্রধান কারণ যথেষ্ট জ্ঞানালোকের অভাব যা শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের দ্বারা দূর করা যায় [৭]। তাই যেখানে অন্য কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করতো দৈনিক তেরো-চৌদ্দ ঘন্টা সেখানে তাঁর শ্রমিকরা কাজ করতো সাড়ে দশ ঘন্টা [৮]। তিনি শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য কিন্ডারগার্ডেন এর ব্যাবস্থা করেন। যখন কারখানা বন্ধ থাকে তখনো তাঁর শ্রমিকরা পুরো মজুরি পেয়েছে। এ সব সত্ত্বেও তাঁর কারখানার মুনাফা কম হয় না।
সেইণ্ট সিমন, ফুঁরিয়ে কিংবা ওয়েন এরা সবাই সামজিক অসাম্য দূর করতে চেয়েছেন সমাজকে সংস্কারের মাধ্যমে। শিল্প বিপ্লব ইংলেন্ডে সবে মাত্র শুরু হয়েছে, এমন সময় পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার স্বরূপ তাঁদের পক্ষে ধরা অসম্ভব ছিল আর তাই তাঁদের সমাজ সংস্কারের ধারণা ইউটোপিয় হতে বাধ্য বলেই মার্ক্স ও এংগেলস মনে করতেন [৮]।
মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) এর সময়কালে আরো বেশ কয়েকজন সমাজতন্ত্রী ছিলেন। যাদের মধ্যে প্রুধুন (Prudhon, ১৮০৯-১৮৬৫), বুকিনিন (Bukinin, ১৮১৪-১৮৭৬), এবং ব্লাঙ্কুই (Blanqui, ১৮০৫-১৮৮১) অন্যতম। প্রুধুন এবং বুকিনিন ছিলেন ণৈরাজ্যবাদী (Anarchism) সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিতা। তাঁরা মার্ক্স এর শ্রমিক শ্রেনীর একনায়কতন্ত্রিক শাসনের বিরোধী ছিলেন। আর ব্লাঙ্কুই ছিলেন মুলত বিল্পবী চিন্তা ধারণার।
এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি তাতে দেখা যায় যে মার্ক্স এর সাম্যবাদ এর ধারণার পেছনে যে সমস্ত মানুষের অনুপ্রেরণা আছে তাঁরা হলঃ১। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির দর্শনঃ জার্মান দার্শনিক হেগেল।২। বস্তুবাদ দর্শনঃ আরেক জার্মান দার্শনিক ফুয়েরবাখ।২। সমাজতন্ত্র অথবা সাম্যবাদ এর প্রাথমিক ধারণাঃ রুঁসো, সেইন্ট সিমন, ফুরিয়ে, ওয়েন।
এর বাহিরে আরো কয়েকজনের কথা উল্লেখ করতে হয়। মার্ক্স এর বস্তুবাদী হবার পেছনে ডারউইন (Darwin, ১৮০৯-১৮৮২) এর বিখ্যাত ‘অন দা ওরিজিন অফ স্পিসিস’ এর অবদানও ছিল [৮]। মার্ক্স এর কাজকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একটি মুলত দর্শন নিয়ে এবং আরেকটি হল অর্থনীতি নিয়ে। রাজনৈতিক অর্থনীতি (Political Economy) এর উপর মার্ক্সের বেশ কয়েকটি লেখা আছে যেখানে তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপর আলোচনা করেছেন। অর্থনীতি একটু কম বুঝি বিধায় সে গুলো নিয়ে আলোচনায় গেলাম না। রাজনৈতিক অর্থনীতির মুল ধারণা তিনি নিয়েছেন এডাম স্মিথ (Adam smith, ১৭২৩-১৭৯০) এবং রিকার্ডো (David Ricardo, ১৭৭২-১৮২৩) থেকে। এর মাঝে স্মিথ কে বলা হয়ে থাকে আধুনিক অর্থনীতির জনক হিসেবে। স্মিথ তার লেখায় প্রথম পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা এবং মুনাফার জন্য শোষন এর ব্যাপারটি তুলে এনেছিলেন, যা পরপর্তীতে মার্ক্সকে অনুপ্রানিত করেছে।
সর্বশেষ ব্যক্তিটি হল তাঁর বন্ধু এবং সহলেখক এঙ্গেলস (Engels, ১৮২০-১৮৯৫)। মার্ক্স এর লেখায় আমি একধরণের অস্থিরতা লক্ষ্য করেছি, যা তাঁদের সম্মিলিত লেখায় নেই। আমার মতে তাঁর কারন এঙ্গেলস এর লেখার ধরণ অনেক গোঁছানো। তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনা অনেক পরিষ্কার। এঙ্গেলস অবশ্য নিজে স্বীকার করেন যে সাম্যবাদের মূল ধারণা মার্ক্সেরই [৭], তথাপী এটাও অনস্বীকার্য যে শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তির স্বপ্ন এঙ্গেলস নিজেও দেখতেন। মার্ক্স এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এর মাধ্যমে এঙ্গেলস দেখলেন যে পুঁজি এবং শ্রেনীর দ্বন্দ্বটি প্রমান করা সম্ভব। যে কারনে সাম্যবাদের বা মার্ক্সের দ্বন্দ্বমূল্ক বস্তুবাদের উপর বিজ্ঞানের তঁকমা লাগানোর কাজটিও তিনিই করেছেন তাঁর ‘ইউটোপিয় ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ লেখায় [৮]।
চারঃ সাম্যবাদ
তাহলে ইউটোপিয় সমাজতন্ত্র আর কমিউনিজম বা সাম্যবাদের মাঝে পার্থক্য কি? মার্ক্স এর মতেই ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রীরা চান সমাজের প্রত্যেক সদস্যের, এমনকি সবচেয়ে সুবিধাভোগীর অবস্থার উন্নতি করতে [৭]। আর মার্ক্সবাদীরা চান কেবল শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তি, যা কিনা হবে বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে [৭]। মার্ক্স মনে করতেন না যে সমাজের সকল সদস্যের মুক্তি সম্ভব, তাই এই ধরণের যে কোন চিন্তা ইউটোপিয় হতে বাধ্য। এটা পরিষ্কার যে মার্ক্স নিজেকে মানবতাবাদী বলে মনে করতেন না, বরং মানবতাবাদীদের তিনি আখ্যা দেন রক্ষনশীল বলে যারা আসলে বুর্জ়োয়া সমাজ ব্যবস্থাকেই রক্ষা করতে চায় মানবতার আড়ালে [৭]।
এবার দেখা যাক মার্ক্সবাদের মূল ধারণা কি এবং তা কিভাবে আসলো। মার্ক্স হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিকে বস্তুবাদের উপর দাঁড় করিয়ে দেখলেন যে আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলেরই ইতিহাস শ্রেনী সংগ্রামের ইতিহাস [৭]। ডারউইন তার বিবর্তনবাদে যেমন দেখালেন যে প্রকৃতিতে সব সময় বিবর্তন হচ্ছে এবং যোগ্যতমরাই টিকে থাকছে, সে রকম মার্ক্সও দেখলেন যে মানব সমাজে সর্বত্র অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম চলছে, এবং একটি সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে তার উপর আরেকটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। প্রাচীন রোমান যুগে ছিল দাসভিত্তিক সমাজ। পরে মধ্যযুগে সেটা ভেঙ্গে হয় সামন্তপ্রথা সমাজ। সামন্তপ্রথা হচ্ছে আমাদের উপমহাদেশের জমিদারী প্রথার মত একটি ব্যবস্থা। ইউরোপে মধ্যযুগে এই সামন্তপ্রথার সমাজই ছিল। আধুনিক যুগে সেই সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে হল বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থা যা মার্ক্স এর মতে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা। মার্ক্স এর মতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে মধ্যবিত্ত শ্রেনী পুরোনো সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে তৈরী করে আজকের এই সমাজ, যার সুচনা হয় ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে [৭]।
আধুনিক এই বুর্জোয়া সমাজের বৈশিষ্ট কি? ব্যক্তি স্বাধীনতা, অবাধ বানিজ্য, ব্যক্তি মালিকানা, পুঁজিবাদ। এ সবই হল বৈশিষ্ট, কিন্তু বুর্জ়োয়া বা পুঁজিবাদী সমাজের মুল দ্বন্দ্ব কি – তা হল পুঁজি এবং শ্রমের দ্বন্দ্ব। এখন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির নিয়ম অনুসারে এই পুঁজি এবং শ্রম তারা বিরোধাত্বক, অর্থাৎ তারা একত্রে অবস্থান করতে পারেনা। তারা একে অপরকে উচ্ছেদ করতে চায়। পুঁজির কাজ হল শ্রমকে শোষন করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। শ্রমিক শ্রেনী যতদিন পর্যন্ত না পুঁজিকে উচ্ছেদের মত শক্তি অর্জন করছে, ততদিন তারা সহবস্থান করবে। যখনি সেই শক্তি অর্জন করবে তখন পুঁজির পতন অনিবার্য। এই হল স্বল্প কথায় মার্ক্স এর মুল তত্ব।
এখন মার্ক্স এই তত্ব কিভাবে পেলেন? মার্ক্স(১৮১৮-১৮৮৩) এর সময়টা এমনই যে তখন ইউরোপের চারিদিকে শিল্পের ব্যাপক প্রসার। স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কারের ফলে সর্বত্রই কলকারখানা গড়ে উঠেছে। এই সব কারখানায় কাজ করে প্রচুর শ্রমিক। ১৮২৫ সালে ইংলেন্ডে প্রথম একটি অর্থনৈতিক মন্দা আসে [৮], যার কারনে প্রচুর শ্রমিক চাকুরী হারায়। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা তখন অঙ্কুরে বিধায় মন্দা প্রায় দশ বছর পর পর দেখা দিত [৮], আজ যেটা অনেক বছর পর দেখা দেয়। ১৮২৫ সাল থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত এরকম মন্দা আসে পাঁচবার এবং ১৮৭৭ সালে আসে ষষ্ঠবার [৮]। বলাই বাহুল্য যে মার্ক্স এই সব মন্দা এবং এর ফলাফল খুব কাছ থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং একই কথা প্রযোজ্য এঙ্গেলস এর জন্য। এ কথা অনস্বীকার্য যে মার্ক্স পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে বেশ ভাল ভাবে ধরেছিলেন। কিভাবে এই মন্দা আসে এবং এই মন্দার চিত্র তিনি বেশ ভাল ভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। একের পর এক কারখানা গড়ে উঠার ফলে, উৎপাদন হয়ে যায় প্রচুর। এক পর্যায়ে অতিপ্রাচুর্যের ফলে অনেক উৎপন্ন পন্য অবিক্রিত থেকে যায়, কারখানা লোকসান দেয়। কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, শ্রমিকেরা চাকুরী হারায়। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আরো কমে যায়, পন্য বিক্রি আরো কমে যায়। এভাবেই চলতে থাকে যা ঠিক হতে কয়েক বছর লেগে যায়- ঠিক যেন আমাদের এখনকার (২০০৯ সালের) মন্দারই চিত্র।
এরকম একটি চিত্র থেকে মার্ক্স তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রয়োগে স্বিদ্ধান্তে আসলেন যে, বুর্জোয়া সমাজ ব্যাবস্থা যেমন সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে উৎপত্তি, তেমনি বুর্জোয়া সমাজ ভেঙ্গে তৈরি হবে নুতন একটি সমাজ ব্যাবস্থা। এটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দ্বিতীয় সুত্র ‘বিকাশের পথে অবলুপ্তি (Negation of the Negation)’ থেকে পাই। সেই নুতন সমাজ হবে প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেনীর সমাজ। তিনি ভাবলেন যেভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংকট দেখা দিচ্ছে, অচিরেই শ্রমিক শ্রেনী হবে সংখ্যায় গরিষ্ঠ। আর সেই শ্রেনী একদিন এই বুর্জ়োয়া সমাজ ভেঙ্গে তৈরী করবে কমিউনিষ্ট সমাজ। কমিউনিষ্ট পার্টির কাজ হচ্ছে সেই শ্রমিক শ্রেনীকে সংঘবদ্ধ করা, তাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে সাহায্য করা।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল। মার্ক্সবাদ এর সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক কিভাবে আসলো। বিজ্ঞান যেভাবে তত্ব প্রদান করে যা সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য, সে রকম মার্ক্সও সমাজের ক্ষেত্রে তার তত্বটি দিয়েছিলেন। মার্ক্স যেমন বলেন নি যে শ্রমিক শ্রেনীর সংঘবদ্ধ হওয়া উচিৎ বা তাদের ক্ষমতায় যাওয়া উচিৎ তাদের মুক্তির জন্য। তিনি বলেছেন শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তি আর বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংস দুইই অনিবার্য [৭]। অর্থাৎ এটি বস্তুবাদের ইতিহাসের নিয়মে বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সুত্র অনুসারে হবেই, এক ধরণের প্রেডিকশন (ভবিষ্যতবানী)। বলাই বাহুল্য সে রকম কিছু হয়নি আজো। বব্রং আধুনিক সমাজ এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বেশ ভাল ভাবেই আছে এবং থাকবে।
তাহলে মার্ক্স এর তত্বের ভুল কোথায়? কোথায় মার্ক্স ভুল বুঝেছেন? আমি বলবো প্রতিটি দার্শনিক বা গবেষক যেমন তাঁর সময়কাল দ্বারা আবর্তিত, তেমনি মার্ক্স পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বা আধুনিক অর্থনীতি ব্যবস্থাকে পুরোপুরি দেখতে পারেননি। পুঁজিব্যবস্থা তখন সবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছে আমি বলবো। এটা অনস্বীকার্য যে মার্ক্স এর পর প্রায় দেড়শত বছর পার হয়ে গেলেও বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অনেক ভুল আছে, যার কারনে এখনও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। কিন্তু সেটা কেটে যায়, তা থেকে মানুষ নুতন কিছু শিখে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরো সুসংহত হয়।
আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খুবই জটিল একটি ব্যাপার। একক ভাবে মানুষ নিজে একটি জটিল প্রানী। তার মাস্তিষ্কের ব্যবহার অন্য যে কোন প্রানী থেকে অনেক বেশী বিধায় তাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন সম্ভব নয়। এমন কোন তত্ব নেই যা দিয়ে বলা সম্ভব মানুষ একটি অবস্থায় কিভাবে নিজেকে বদলে নিবে বা কাজ করবে। অতীত ইতিহাস দেখে আমরা একটি ধারণা করতে পারি, কিন্তু সেটা ঘটবেই বলতে পারি না। আর এই মানুষ যখন গোষ্ঠিবদ্ধ ভাবে চলে, যখন একটি সমাজ গঠন করে, সেই সমাজে উক্ত মানুষগুলো কিভাবে চলবে সেটা কোন তত্ব দিয়ে প্রকাশ করা আরো অসম্ভব। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর সমাজ ব্যবস্থা দুইই সরাসরি ব্যক্তি ও গোষ্ঠিবদ্ধ মানুষের কাজের সাথে জড়িত। এই দুই ব্যবস্থা এতই নন-লিনিয়র (Non-linear) এবং নন-ডিটারমিনিষ্টিক (Non-Deterministic) যে সমাজ বিজ্ঞানে বা অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে সে রকম কোন নির্দিষ্ট তত্ব নেই। যা আছে তা কোন নির্দিষ্ট পারিপার্শ্বিকতার ক্ষেত্রে কিছু ইম্পিরিকাল (empirical) সুত্র।
একটি নন-লিনিয়র চিত্রের উদাহরণ যদি দেই তাহলে আরো পরিষ্কার হবে। সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিচলণ প্রক্রিয়া। আমাদের জলবায়ুর মডেল আছে, তাত্বিক সুত্র আছে- তথাপি এই প্রক্রিয়া নিজেই এত নন-লিনিয়র যে সে প্রক্রিয়াটিকে সঠিকভাবে প্রেডিক্ট করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমরা সর্বোচ্চ পাঁচদিন পর্যন্ত প্রেডিকশন করতে পারি, তারপরেও বলা হয়ে থাকে ৩০% বা ৬০% বৃষ্টি হবার সম্ভবাবনার কথা। কোন ভাবে হয়তো এই মুহুর্তের কথা বলতে পারবো, যদি পর্যাপ্ত তথ্য থাকে, বা পরবর্তী এক ঘন্টার কথা বলতে পারবো কিন্তু এক মাস পর কি হবে তা বলা অবাস্তব বা ইউটোপিয়। যে কারণে আজকের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরাও নিশ্চিত করে বলতে পারেন না ঠিক কোন পদ্ধতিতে বা কবে বর্তমান মন্দা দূর হবে।
নন-লিনিয়র প্রক্রিয়ার এর আরেকটি মজার দিক রয়েছে, যা তার প্রেডিকশনকে আরো কঠিন করে তুলে। তা হল এক কথায় ‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’। বলা হয়ে থাকে আজ যদি বাংলাদেশে কোন একটি প্রজাপতি তার পাখা নাঁড়ায় আর সেই সঞ্চালণ, নন-লিনিয়র এফেক্ট এর কারণে বাড়তে বাড়তে নিউইয়র্কে বৃষ্টি ঘটাতে পারে। যেমন ঘটতে পারে – কোন এক পথচারীর আকষ্মিক মৃত্যু, যা রূপ নিতে পারে বিশাল ভাংচু্রে। সেখানে কিছু হলে সেটা আরো বড় আকার হয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।
এরকম একটি জটিল সামাজিক এবং অর্থৈতিক ব্যবস্থাকে অঙ্কুরে দেখে যে তত্বই দেওয়া হোক না কেন তা কাজ না করাটাই স্বাভাবিক, বরং যদি কাজ করে আমি বলবো সেটাই কাকতলীয়। তা হলে মার্ক্স এর দর্শনের সব কিছু কি ভুল? না তা নয়।
পাঁচঃ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র
আমি মার্ক্স এর কমিউনিষ্ট পার্টির ইস্তেহারের প্রথম কথা দিয়েই শুরু করছি। তিনি বলছেন যে আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলেরই ইতিহাস শ্রেনী সংগ্রামের ইতিহাস [৭]। কথাটি আমি বলবো আংশিক সত্য। এ কথা ঠিক যে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে আমরা বেঁচে থাঁকার জন্য সংগ্রাম করি। সেই সংগ্রাম হয় প্রকৃতির সাথে আমাদের, প্রকৃতির অন্য প্রানীদের সাথে আমাদের এবং আমাদের নিজেদের সাথে নিজেদের। যখনই উৎপাদন এর তুলনায় চাহিদা বেশি থাকবে তখনই দ্বন্দ্ব থাকবে। আজ পর্যন্ত যত সংগ্রাম হচ্ছে তা হচ্ছে সেই চাহিদা আর উৎপাদনের মাঝে ব্যবধান এর জন্য। সেই সংগ্রাম ভিন্ন শ্রেনীর মধ্যে হতে পারে আবার নিজস্ব শ্রেনীর মাঝেও হতে পারে। পৃথিবীতে যদি কোন সাদা-কালো না থেকে শুধু সাদারাই থাকতো তবে কি রক্ত ঝরতো না? যদি কোন বুর্জোয়া শ্রেনী না থেকে শুধু শ্রমিক শ্রেনী হয় তবে কি কোন দ্বন্দ্ব থাকবে না? বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম চলবে যতদিন পৃথিবীতে সম্পদের উৎপাদন তার চাহিদার তুলনায় কম থাকবে। যদি সমাধান খুঁজতেই হয় তবে চাহিদা আর উৎপাদন এর ব্যাবধান কমাতে হবে। তা জনসংখ্যা সীমিত করে বা উৎপাদন এর পরিমাণ বাড়িয়ে।
তবে হ্যাঁ একটি সুষ্ঠ সামাজিক ব্যবস্থা দরকার যা চাহিদা আর উৎপাদন এর ব্যবধানকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করবে। মার্ক্স তাঁর দর্শনে যেটা বলার চেষ্টা করেছেন তা হল বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আমরা সেটা করছি না। যার কারনে অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছেকৃত ভাবে চাহিদার পরিমাণকে বাড়িয়ে রাখা হয় শুধু মাত্র পন্যের মান ধরে রাখার জন্য। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নিয়ম বানানো হয় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা, সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেনীর তাঁদের সুবিধার্তে। জনগণের করের টাকায় সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেনী বা নিম্ন বিত্তের জন্য করা হয় কম। রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিৎ করে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হয়ে উঠে শোষনের যন্ত্র। এ ধরণের সমাজ ব্যবস্থায় ধনী-গরিবের ব্যবধান শুধু বৃদ্ধি পায়। মার্ক্স এটাকেই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফল (Output) হিসেবে বলেছেন। কিন্তু আমি একে পুঁজিবাদ এর দোষ বলবো না। আমি বলবো এটা মানুষের মানসিকতার সমস্যা, নৈতিকতার দৈন্যতার প্রকাশ। এবং এই সমস্যা যে কোন সাম্যবাদী দলের শাসনের ক্ষেত্রেও হতে পারে যদি মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটায়। যেমনটি আমরা দেখতে পাই বর্তমান কমিউনিষ্ট শাসিত দেশ গুলোর ক্ষেত্রেও।
মার্ক্স সমাজ ব্যবস্থার এই ত্রুটিকে ভালভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং খুব ভাল ভাবে বুঝেছেন যে শুধু শাসক গোষ্ঠির পরিবর্তন বা শাসন ক্ষমতা থেকে বুর্জোয়াদের দূর করালেই সমাজে পরিবর্তন হবে না, করতে হবে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন। যে কথাটি আমার মতে আজো প্রযোজ্য। শুধু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েতের সজ্ঞাটিকে একটু বদলাতে হবে। শিল্প বিপ্লবের সময়কালে মার্ক্স দেখেছিলেন শুধু দু’টি শ্রেনী- বুর্জ়োয়া আর প্রলেতারিয়েত। সেই সময়কার সমাজ ব্যবস্থায় এই দু’টি শ্রেনীই প্রধান ছিল। মার্ক্স এর ভাষায় নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেনীরাও স্বল্প পুঁজির কারণে এক সময় প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতে পরিণত হবে [৭] এবং পুঁজি আরে শ্রমের দ্বন্দ্বে প্রলেতারিয়েতের সংখা বৃদ্ধি পাবে [৭]। কিন্তু আজ যদি আমরা দেখি তাহলে দেখবো সমাজে এখন স্পষ্টতই তিনটি শ্রেনী। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত। মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে আমরা আরো কিছুটা ভাগ করতে পারি, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত হিসেবে। আজকের সমাজে যদি বুর্জোয়া বলতে হয় তবে আমি বলবো উচ্চবিত্ত আর উচ্চ-মধ্যবিত্তদের। আর যদি প্রলেতারিয়েত বলতে হয় তবে বলবো নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর নিম্ন বিত্তদের। আজকের যুগের বিশাল এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর অবস্থান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অঙ্কুরকালে তেমন প্রকট ছিল না, এবং এই শ্রেনীটি মার্ক্স এর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি শুধু বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে ধরে নিয়ে এগিয়েছেন এবং আমার মতে মার্ক্স এর প্রধান ভুলটি এখানেই। আজ যদি কেউ এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে বুর্জোয়া শ্রেনীর মাঝে ফেলে চিন্তা করে তবে তিনি আরো বড় ভুল করবেন। কারণ আজ এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীই সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেনী।
সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন আর শাসক গোষ্ঠির পরিবর্তন এর মধ্যকার পার্থক্যটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেই যদি উদাহরণ দিয়ে বলি-আগে শাসক গোষ্ঠি ছিল মোঘলরা, তারপর এল ইংরেজরা, তারপর -পাকিরা, তারপর আওয়ামী লিগ, বিএনপি, এরশাদ। কিন্তু মানুষের প্রকৃত মুক্তি কখনই আসেনি। এর কারন সেই সমাজ ব্যবস্থাটির কখনো পরিবর্তন হয়নি। শাসকদের মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়নি আমাদের রাষ্ট্রের মানসিকতা। যারাই শাসন করেছে তারা সাধারন জনগণকেই শোষন করেছে। সেই সমাজ ব্যবস্থাটির পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রের সুবিধে বঞ্চিত মানুষের কথা চিন্তা করতে হবে। ঋণখেলাপী ব্যবসায়ী, দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিগ্রস্থ আমলা, এদের সুবিধার্তে রচিত শাসন ব্যাবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। আজকের যুগে এরাই প্রকৃত বুর্জোয়া। তাদেরকেই শাসনের ক্ষমতা থেকে উতখাত করতে হবে। সৎ ও যোগ্য রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায় আনতে হবে। তারপর সংবিধান সংশোধন করে সকল দূর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, পেশাবিদদের হাত হতে দেশকে মুক্ত করতে হবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সকল নাগরিককে সমান সুযোগ দিতে হবে। সমাজতন্ত্র মানে সকল মানুষ সমান তাই নয়। মানে হল সকল মানুষের সমান সুযোগ সুবিধে প্রদান। সকলের জন্য মৌলিক চাহিদার সমান সুযোগ। সকলের জন্য আইনের সমান প্রয়োগ। তারপর যার যার যোগ্যতার ভিক্তিতে যে যার মত অবস্থানে যাবে।
মার্ক্স গোলমাল করে ফেলেছেন সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের পথ খুঁজতে গিয়ে। সকল সমস্যার সমাধান তিনি দেখেছেন প্রলেতারিয়েতের শাসনে। কিন্তু বর্তমানে বা উত্তর আধুনিক যুগে প্রলেতারিয়েত শ্রেনী সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেনী নয়। সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেনী হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেনী। তাই প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর শাসন কখনই মার্ক্সের সংখ্যা গরিষ্ঠের শাসন হতে পারে না, অন্তত আজকের যুগে। তাছাড়া মার্ক্স এর এই প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর শাসনের প্রক্রিয়ায় কিছু স্ববিরোধিতা আছে বলে আমি মনে করি। যেমন তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বুর্জোয়া শ্রেনীর মধ্য থেকে কোন ভাল দল এসে শ্রমিক শ্রেনীর মুক্তি ঘটাতে পারবে না। আমার মত প্রকৌশলীরা, অর্থনীতিবিদরা, সমাজসেবীরা সবাই বুর্জোয়া, তাই আমাদের প্রদত্ত সমাজতন্ত্রও বুর্জ়োয়া বা রক্ষনশীল সমাজতন্ত্র [৭]। এমন কি পেটি-বুর্জোয়া (নিম্ন মধ্য বিত্ত) শ্রেনীও সেটা করতে পারবে না। পারবে শুধু প্রলেতারিয়েত শ্রেনী যদি বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়াদের উৎখাত করে। কিন্তু প্রলেতারিয়েত শ্রেনী কিভাবে সংঘঠিত করবে এই বিপ্লব? মার্ক্স এর মতে সেটা হবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনের মাধ্যম্যে যা একদিন রূপ নিবে বিশাল পরিবর্তনে (দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তৃতীয় সুত্র (পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন (From quantitative change to qualitative change)))। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্রমিক আন্দোলন গুলো হতে শ্রমিক শ্রেনী আস্তে আস্তে তার অবস্থান সম্পর্কে সচেতণ হবে এবং একদিন এই সমাজ ব্যবস্থা বদলের জন্য, কমিউনিষ্ট সমাজ গঠণের জন্য বিপ্লবের পতাকাতলে একত্রিত হবে।
কিন্তু বিপ্লব এক জিনিস আর একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করা ভিন্ন জিনিস। শোষনে অতিষ্ঠ হয়ে যে কোন সমাজ, জাতি বা দেশ নিজেদের মুক্তির জন্য বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতেই পারে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সমাজ ব্যবস্থা থেকে অন্য আরেকটি সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তর কিভাবে সম্ভব তা শ্রমিক শ্রেনী কিভাবে শিখবে তা তিনি বলেননি। এই দ্বান্দিক বস্তুবাদ, ইতিহাসের শ্রেনীর সংগ্রাম এ সব কিভাবে প্রলেতারিয়েতরা জানবে তা তিনি বলেননি। আমি যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখি লেনিন, মাও, ফিডেল ক্রাষ্টো এরা কেউই প্রলেতারিয়েত শ্রেনী থেকে আসেননি। তাঁরা সবাই রীতিমত বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন, সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক ধারণাগুলো লাভ করেছেন, তার পর তাঁরা বিপ্লব সংঘঠিত করছেন। আর মার্ক্স কিংবা এঙ্গেলস তাঁরা নিজেরাও কি প্রলেতারিয়েত শ্রেনী থেকে এসেছেন? এক জনকে আমি বলতে পারি যিনি প্রলেতারিয়েত শ্রেনী থেকে উঠে এসেছেন তিনি হল – স্টালিন। তাই তাঁর শাসনের সহিংসতা ছাড়িয়ে যায় সকলকে, যা ‘The Soviet Story ’ ডকুমেন্ট্রিটিতে উঠে এসেছে।
তাই শ্রমিক শ্রেনী যে শুধু তৈরী শাসন ব্যবস্থাটিকে পেলেই যে সমাজের পরিবর্তন হবে না সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন প্যারিস কমিউনে (১৮৭১) কমিনিউষ্টদের দুই মাসের শাসন কালে। ১৮৭২ সালের ইস্তেহারের মুখপত্রেই যা তিনি স্বীকার করেছেন [৭]। মার্ক্স তরুণ বয়সে বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে তিনি সে পথ থেকে সরে এসেছিলেন, যার নমূণা পাই ১৮৭২ সালে আমর্স্টাডাম এ দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে, যেটা আমি পাই কার্ল কাউটস্কি এর ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসি ভার্সাস কমিউনিজম’ লেখায় [৯]। যেখানে তিনি বলেছেন- “ শ্রমিকদের অবশ্যই কোন একদিন রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে হবে, নুতন সামাজিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে। তাদের অবশ্যই পুরাতন রাজনৈতিক যন্ত্রটিকে উতখাত করতে হবে যা কিনা ক্রিষ্টিয়ানদেরর জীর্ণ কাঠামোর উপর গঠিত। কিন্তু এই অর্জনের পন্থা সর্বত্র একই রকমের হতে পারে না। আমাদের অবশ্যই বিভিন্ন দেশের বর্তমান কাঠামো, সংস্কৃতি, রীতিণীতি এই সমস্ত বিষয়কে চিন্তায় রাখতে হবে। আমরা এটা অস্বীকার করতে পারিনা যে-কিছু দেশ যেমন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কিংবা হলান্ড- সেখানে শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ ভাবে তাদের লক্ষে পৌছতে পারে যা অন্য সব দেশে সম্ভবপর নয়।” এখানে তিনি স্পষ্টতই সে সব দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শ্রমিক শ্রেনীর লক্ষ্যে পৌছার কথা বুঝিয়েছেন।
মার্ক্স শ্রমিক শ্রেনীর শাসনের মাঝ দিয়ে সমগ্র সমাজের মুক্তির পথ দেখেছেন। তাতে যদি বুর্জোয়া সমাজ ধ্বংস হয়, মানুষের মনে সহিংসতা আসে তাতে তিনি বিচলিত নন। যে কারনে মার্ক্স এর এই পন্থা অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ। যারা মানবতাবাদী, সমগ্র মানব জাতির মুক্তি চায়-নির্দিষ্ট কোন শ্রেনীর মুক্তি চায় না- তাদের পক্ষে জেনে শুনে মার্ক্সবাদ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। আমিও নিজেকে মানবতাবাদী হিসেবেই দেখতে চাই। সমগ্র মানবের মুক্তি কামনা করি, একটি সুষ্ঠ সমাজের স্বপ্ন দেখি। বোমা মেরে, নিরীহ মানুষ মেরে যেমন ধর্মের প্রচার করা অসম্ভব বলে মনে করি তেমনি বিপ্লব করে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিও অসম্ভব বলে মনে করি। যে পন্থাই অবলম্বন করতে আপনি চান তা সর্বপ্রথম সেই সমস্ত মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হতে হবে যাদের মুক্তি আপনি চান। এ রকম একটি অবস্থা থেকেই আমি মনে করি যে গণতান্ত্রিক উপায়েই সম্ভব একটি নুতন সমাজ ব্যবস্থা চালু করা। যদি প্রতিটি মানুষের কাছে পৌছে দিতে পারেন আপনার দলের আদর্শ কি, কিভাবে আপনার দল ক্ষমতায় গেলে সমাজ ব্যস্থায় কি ধরণের পরিবর্তন আনবে ও কেন, তা হলে আমার বিশ্বাস তারা তা গ্রহন করবে। আর যদি তারা আপনার আদর্শ গ্রহন না করে, তবে সহিংস পদ্ধতিতে যদিও আপনি সাময়িক ক্ষমতা লাভ করেন, একদিন তা ইতিহাস হয়েই যাবে।
সমাজতন্ত্র মানেই যে ব্যক্তিমালিকানার উচ্ছেদ, বা সকল কিছু রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হতে হবে তা নয়। আজ অনেক দেশে মিশ্র অর্থনীতি বিরাজমান। রাষ্ট্রীয় তদাকরীতে বেসরকারীভাবে সব কিছু চলছে। কিন্তু রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করছে। আমেরিকার কথা বিস্তারিত বলতে পারবো না, কিন্ত কানাডায় পাঁচ বছর ধরে আছি দেখছি- এখানে বিনামূল্যে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পাবেন, বাচ্চাদের পড়াশুনা পাবেন। আঁয় ভাল না হলে স্বল্প ভাড়ায় সরকারী বাসা পাবেন, বেকার ভাতা পাবেন। কোন কিছু জানতে চাইলে সমস্ত তথ্য ইন্টারনেট এ দেওয়া আছে, ফোন লাইন দেওয়া আছে, জানতে পারবেন। এরা সমাজতান্ত্রিক দেশ না হয়েও মানুষের মৌলিক অধিকার গুলো বাস্তাবায়নের চেষ্টা করছে। উন্নত দেশেও যে সমস্যা নেই তা নয়। ধনী-গরিবের ব্যবধান নেই, বেকারত্ব নেই, অপরাধ নেই তা নয়। যেখানেই সমাজ আছে তা থাকবেই এবং সে গুলো দূর করার চেষ্টাই হল আদর্শ রষ্ট্রের কাজ।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এখন যেটা সব থেকে বেশি প্রয়োজনঃ
১। একটি আদর্শ নির্ভর তৃতীয় শক্তির দল। একটি যোগ্য নেতৃত্ব দেবার মত একটি দল। যাদের প্রধান উদ্দেশ্য হবে রাষ্ট্রীয় তত্বাবধানে (পরিচালিত নয়) দেশীয় শিল্পকে প্রতিষ্ঠিত করা। দেশের অর্থনীতিকে সবল করা। দেশকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে একটি মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত করা। রপ্তানী নির্ভর শিল্প গড়ে তুলা।
২। দেশের সকল বিভাগ হতে দুর্নীতি দূর করা। বিচার ব্যবস্থা, পুলিশি ব্যবস্থা, এবং সচিবালয় বা সরকারী ব্যবস্থাকে স্বাধীন ভাবে নিজ নিজ বিভাগের রুলস অনুসারে চলতে দেওয়া। প্রয়োজন হলে দেশের সকল সরকারী/বেসরকারী বিভাগের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন করে দেওয়া, যার বাহিরে কেউই চলতে পারবে না।
৩। দেশের জনসংখ্যার বিষ্ফোরন রোধ করা। বিশাল জনসংখ্যাকে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। প্রতিটি মানুষকে একটি জাতীয় নম্বর দেওয়া যেতে পারে, যার বিপরীতে তার যাবতীয় (জন্ম, আয়, চাকুরী, সম্পত্তি, বিবাহ, সন্তান, বিদেশ গমন, যা যা সম্ভব) তথ্য থাকবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই নম্বর প্রদান করতে হবে, তাতে করে একই নামে অঢেল সমপত্তি বা কর ফাঁকি, বা বহু বিবাহ সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রন করা সহজ হয়ে যাবে।
আমাদের দেশের শাসকেরা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা বিবেচনা করে দেশ পরিচালনা করে থাকে, কখনো বা দলীয় স্বার্থে। দেশের স্বার্থ বিবেচনা বা সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থের চিন্তা তাঁরা কখনই করে না। অথচ শুধু মাত্র পাঁচ বছরই যদি দেশের স্বার্থের কথা বিবচনা করে দেশ পরিচালনা করতো তবে আজ আমাদের দেশ প্রভুত উন্নতি করতে পারতো। এটা আমরা সবাই জানি। সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ ও জানে এটা। গত দশ বছরে দেশের মোবাইল, বেসরকারী টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা, ইন্টারনেট এর বদৌলতে এখনকার মানুষ আগের তুলনায় অনেক সচেতন। মানুষ পরিবর্তন চায়, কিন্তু পরিবর্তনের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজে পায় না। তাই হতাশ হয়ে মইন বা ইউনুস বা ফখরউদ্দিন যাকে পায় তাকেই ধরার চেষ্টা করে। আমি আমাদের প্রজন্মকে অনুরোধ করবো রাজনীতিতে আসুন। নুতন দল গঠন করুন। সেই আদর্শের বানী নিয়ে প্রতিটি জনগণের কাছে যান। ভুলে যান অতীতের ব্যর্থতা। ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন প্রতিটি সমাজে, জাতিতে, এ রকম ক্রান্তিকালে তাদের নব জাগরন হয়েছে। আমাদের দেশেও সেই নব জাগরনের সূচনা হোক আমাদের হাত ধরে।
আমার এই লেখার মুল উদ্দেশ্য বিশেবিদ্যালয়ে পড়ুয়া সেই সব মেধাবী ছাত্রদের প্রতি যারা মানুষের জন্য একটি নুতন সমাজ গড়ার উদ্দেশ্যে নিজের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়গুলো ব্যয় করে চলে আর জাতিকে উপহার দেয় পরবর্তিতে কিছু হতাশাগ্রস্থ যুবক। এটা যতটা না তাদের ব্যর্থতা তার চেয়ে বেশী হল আমাদের তথাকথিত বাম রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা। আমার কথা হল- ইস্তেহারটি নিজে পড়, সাথে মার্ক্স এর আরো কিছু বই পড়, এংগেলস এর কিছু লেখা পড়। সব লেখাই http://www.marxists.org/ এই ঠিকানায় পাওয়া যায়। তারপর নিজের বিবেচনা বুদ্ধি কাজে লাগাও। অন্ধের মত যে কোন কিছু বিশ্বাস করাকে আর যাই বলুক প্রগতিশীল বলা যায় না। একটি নুতন সমাজ গড়ার আগে নিজেকে গড়তে হবে। তার জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হবে, পড়তে হবে, জানতে হবে। প্রতিটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। সর্বোপরি মানব সভ্যতার ইতিহাসটুকু জানতে হবে।
১. http://en.wikipedia.org/wiki/Materialism২. http://en.wikipedia.org/wiki/Dialectic৩. http://en.wikipedia.org/wiki/History_of_philosophy৪. http://www.marxists.org/reference/archive/hegel/index.htm৫. মার্ক্সবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের কয়েকটি দিক- শিবদাস ঘোষ http://www.ganadabi.in/works1/marxism_b.pdf
৬. http://www.marxists.org/reference/subject/economics/rousseau/social-contract/ch01.htm৭. http://www.marxists.org/bangla/archive/marx-engels/1848/communist-manifesto/istahar.pdf৮. http://www.marxists.org/bangla/archive/marx-engels/1880/utopia/Socialism,%20Utopian%20and%20Scientific.pdf
৯. http://www.marxists.org/archive/kautsky/1930s/demvscom/index.htm
পরিশিষ্টঃ আজকের যুগে প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া কারা
[লেখাটি লিখার পর অনেকেই নানান মন্তব্য করেছেন। তবে একজন মার্ক্সবাদী, তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমি প্রলেতারিয়েত বা বুর্জোয়ার সজ্ঞা সঠিক বুঝতে পেরেছিলাম কিনা। সাধারনত আমি মুল বইয়ের কোন উদ্ধৃতি সরাসরি দিই না। আমি মনে করি একটি নির্দিষ্ট লাইন তুলে দিয়ে কখনই একজন লেখকের পুরো বক্তব্য বুঝানো যায় না, তার জন্য মুল বই পুরো পড়তে হয়। উক্ত মন্তব্যের জবাবে আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি মার্ক্স এর ভাষায় কাদের তিনি প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া বলেছেন এবং সেই সজ্ঞা মেনে আমি আজ উত্তর আধুনিক যুগে কাদের প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া বলবো]
যা হোক - কমিউনিজমের মূলনীতি [১] থেকে প্রলেতারিয়েতের যে সজ্ঞাটি পাইঃ
"The proletariat is that class in society which lives entirely from the sale of its labor and does not draw profit from any kind of capital; whose weal and woe, whose life and death, whose sole existence depends on the demand for labor – hence, on the changing state of business, on the vagaries of unbridled competition. The proletariat, or the class of proletarians, is, in a word, the working class of the 19th century. "
একই বইয়ের [১] আরো এক স্থানে তিনি বলেছেনঃ
"The class of the wholly propertyless, who are obliged to sell their labor to the bourgeoisie in order to get, in exchange, the means of subsistence for their support. This is called the class of proletarians, or the proletariat. "
সুতরাং এই দুই সজ্ঞা থেকে এবং মার্ক্স ও এংগেলস আর অন্যান্য লেখা থেকে আমি যা বুঝেছি - প্রলেতারিয়েত হল তারাই যারা জীবন ধারণের জন্য তাদের শ্রম বিক্রি করে এবং যারা কোন লভ্যাংশ পায়না তাঁদের সে শ্রম দ্বারা তৈরী পূঁজি বা মুনাফা হতে। প্রলেতারিয়েতের কোন নিজস্ব সম্পত্তি নেই, যার কারনে তাঁদের শ্রম বিক্রি ব্যাতীত অন্য কোন উপায় নেই বেঁচে থাকার জন্য। সেই শ্রমের বিনিময়ে যেটুকু মুজুরী পায় তা দিয়ে তাঁরা কোনমতে বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু কোন সম্পত্তি গড়তে পারে না। শিল্প বিপ্লব এর সময়কালের ইংল্যান্ডে তাই মার্ক্স প্রলেতারিয়েত বলতে বুঝিয়েছেন তখনকার কারখানার কর্মজীবি শ্রমিক শ্রেনীদের।
ঠিক এ কারনেই আমি বুঝি আজকের যুগে প্রলেতারিয়েত হল আমাদের দেশের খেঁটে খাওয়া মানুষেরা, যারা শুধু শ্রম বিক্রি করে জীবন ধারণ করে থাকে। যারা দিন আনে দিন খায়। কোন বেলা কাজ না থাকলে তাদের সংসারে খাবার থাকে না। তাঁদের আয় এতই কম যে তা মৌলিক চাহিদা পূরোনেও যথেষ্ট নয়। এ কারনেই আমি আমাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বা নিম্ন বিত্ত শ্রেনীকে বলেছি প্রলেতারিয়েত হিসেবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় – গার্মেন্টস কর্মী, বর্গা চাষী, দৈনিক মুজুর, রিক্সাচালক, সরকারী/বেসরকারী চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী ইত্যাদিদের। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই শ্রেনী সংখ্যা গরিষ্ঠ কিনা তা আমি জানি না, তবে তাদের সংখ্যা যে অনেক তাতে কোন সন্দেহ নেই। একই কারনে আমি মনে করি না আমার বা আপনার মত পেশাবিদ শ্রমিকেরা প্রলেতারিয়েতের শ্রেনীতে পরি। কারন আমরা যে মুজুরী পাই তা থেকে উদ্ধৃত থাকে এবং তা দিয়ে আমরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানাতে পারি, যদিও আমরাও শ্রম বিক্রি করেই জীবিকা অর্জন করে থাকি।
উন্নত পুঁজিবাদী দেশে কোন প্রলেতারিয়েত শ্রেনী পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কারণ সেখানে শুধু শ্রম বিক্রির আয় ছাড়াও সরকার থেকে অনেক ধরণের সুবিধে পাওয়া যায়, যেমন বিনামুল্যে চিকিৎসা, সাবসিডাইজড বাসা, বিনামুল্যে পড়াশুনা ইত্যাদি। এগুলো আসে জনগণের ট্যাক্স এর টাকা থেকে। এবং ট্যাক্স আসে উচ্চ আয়ের লোকদের কাছ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের থেকে। সুতরাং সেখানে নিম্নবিত্তের লোকেরাও ঘুরিয়ে রাষ্ট্রে মাধ্যমে এক ধরণের লভ্যাংশ/সেবা পায়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে দেখবেন যে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা বছর শেষে বেতনের বাহিরেও প্রতিষ্ঠানের মূল লভ্যাংশের ভাগ পায়। সে ক্ষেত্রেও এদেরকে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতে ফেলতে পারবেন না।
এবার আসি বুর্জোয়া প্রসংগে। একই বইয়ে [১] তিনি বলেছেন-
"The class of big capitalists, who, in all civilized countries, are already in almost exclusive possession of all the means of subsistance and of the instruments (machines, factories) and materials necessary for the production of the means of subsistence. This is the bourgeois class, or the bourgeoisie. "
বৃহত পূঁজিপতি শ্রেনী, যারা উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সকল উপাদান (কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, কারখানা) এর একচেটিয়া অধিকার সংরক্ষণ করে। এখানে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের কোন প্রশ্ন নেই। যারাই পূঁজি খাঁটিয়ে লাভ করে তারাই বুর্জোয়া শ্রেনী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- কারখানার মালিক শ্রেনী, বাড়িওয়ালা, বড় দোকানি, বড় ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের।
মার্ক্স এর সময়কালে হয়তো ইংল্যান্ডে মধ্যবিত্তেরাই বেশী ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিল। উচ্চবিত্তের প্রচুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকার কারনে তাঁরা সেই সব সম্পত্তির থেকে প্রাপ্ত খাঁজনা থেকেই জীবিকা অর্জন করতো। এ কারনেই হয়তো মার্ক্স সে সময়কার মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলেছিলেন, এবং যাদের ধ্বংসের মাঝে দিয়ে নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আমি সকল ব্যবাসায়ী বা পূজিঁপতিদের কে বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলতে রাজী নই। সে কারনেই রাজী নই আজকের যুগের মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে বুর্জোয়ার সজ্ঞায় ফেলতে। আমি যা বুঝেছি তা হল বুর্জোয়া তারাই যারা সমাজকে শোষণ করে অন্যায়ের মাধ্যমে, অসৎ পথে, দূর্ণীতির মাধ্যমে। তাঁরাই দেশের শত্রু হতে পারে, সমাজের শত্রু হতে পারে, সকল ব্যবসায়ী বা পূঁজিপতি নয়। তাই বলেছিলাম আজকের যুগে আমার চোঁখে বুর্জোয়া হতে পারে – দূর্ণীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ, দূর্ণীতিগ্রস্থ আমলা, দূর্ণীতিগ্রস্থ পেশাবিদ, অসৎ ব্যবসায়ী, ঋণখেলাপী ব্যবসায়ী, কালোবাজারি ব্যবসায়ী ইত্যাদি।
আমি খুব চিন্তিত ছিলাম আমি নিজে কোন শ্রেনীতে পড়ি তা নিয়ে। সেটার জবাব পেলাম ইস্তেহারে [২]।
"A part of the bourgeoisie is desirous of redressing social grievances in order to secure the continued existence of bourgeois society. To this section belong economists, philanthropists, humanitarians, improvers of the condition of the working class, organisers of charity, members of societies for the prevention of cruelty to animals, temperance fanatics, hole-and-corner reformers of every imaginable kind. This form of socialism has, moreover, been worked out into complete systems."
আমার মনে হয় আমার মত পেশাবিদরা – ডাক্তার, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, আইনবিদ ইত্যাদিরা – সরাসরি বুর্জোয়া না হলেও আমাদের সহানুভুতি থাকবে সমাজের উচ্চশ্রেনীর প্রতিই। সেটা মনে করেই মার্ক্স হয়তো আমাদেরকে রক্ষনশীল বুর্জোয়া শ্রেনীতে ফেলেছেন। প্রশ্নদাতার কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল যে তিনি নিজে পেশাবিদ হয়েও কোন কারনে নিজেকে মার্ক্সবাদী বলছেন অথচ যেখানে কমিউনিজম হচ্ছে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর শাসন। অথবা নিজেকে তিনি প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতেই ভাবছেন কিভাবে? আমি উনাকে আরো প্রশ্ন রেখেছিলাম, আজকের যুগে কাদেরকে আপনি বুর্জোয়া বা প্রলেতারিয়েত বলে মনে করেন তা আমার মত উদাহরণ সহকারে তুলে ধরলে আমার নিজেই বুঝতে পারতাম কোথায় আমাদের মতবিরোধ।
উনার মন্তব্যের একটি বক্তব্যের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করছিলাম। উনি বলেছেন আমার লেখা সম্পর্কে যে ঃ
“আমি মধ্য আয়ের বেতন ভোগী ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিতদেরকে মধ্যবিত্ত বা পেটিবুর্জোয়া বলেছি”
কিন্তু আমি পেশাবিদদের মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে ফেলিনি আর পেটি-বুর্জোয়াতেতো নয়ই। আমি তাঁদের ফেলেছি উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে বা বুর্জোয়া সমাজের যন্ত্রবিশেষ হিসেবে। পেটি-বুর্জোয়া বলতে আমি বুঝেছি মধ্যবিত্তের নিম্ন শ্রেনী বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেনী কে, যারা স্বল্পপূঁজির ব্যবসায়ী, কিন্তু বৃহৎ পুঁজির শোষণে একদিন প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতেই রূপান্তরিত হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আমাদের দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (হস্তশিল্পী, ফুটপাতের ব্যবসায়ী) সরকারী/বেসরকারী দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারী ইত্যাদিদের। যাদের আয় খুব সামান্য এবং যে কোন বড় বিপদে সর্বসান্ত হয়ে পথের ভিকিরি হয়ে যায়।
পেটি বুর্জোয়া সম্পর্কে ইস্তেহারে [২] যা মার্ক্স বলেছেনঃ
"The lower strata of the middle class — the small tradespeople, shopkeepers, and retired tradesmen generally, the handicraftsmen and peasants — all these sink gradually into the proletariat, partly because their diminutive capital does not suffice for the scale on which Modern Industry is carried on, and is swamped in the competition with the large capitalists, partly because their specialised skill is rendered worthless by new methods of production. Thus the proletariat is recruited from all classes of the population. "
ইস্তেহারের [২] অন্য এক স্থানে বলেছেন -
"In countries where modern civilisation has become fully developed, a new class of petty bourgeois has been formed, fluctuating between proletariat and bourgeoisie, and ever renewing itself as a supplementary part of bourgeois society. The individual members of this class, however, are being constantly hurled down into the proletariat by the action of competition, and, as modern industry develops, they even see the moment approaching when they will completely disappear as an independent section of modern society, to be replaced in manufactures, agriculture and commerce, by overlookers, bailiffs and shopmen. "
আমি আমার অবস্থান পরিষ্কার করেছি। কোন্কারণে এবং কাদের কে আমি কোন্শ্রেনীতে ফেলেছি। আমার স্বল্প জ্ঞানের অভাবে বুঝার ভুল হতে পারে। তবে নিশ্চিত থাকবেন ভুল বুঝে থাকলে তা শুধরে নেওয়ার সুযোগ আমার কাছে সব সময় আছে। আপনার মত সমাজের পরিবর্তন আমিও চাই। তবে কিভাবে চাই সেটাই এখনো খুঁজছি। আমি মার্ক্স বা এঙ্গেলস এর লেখা দিয়ে তাঁদের বুঝতে চাই, লেনিন বা মাও বা অন্য কারোর চোখ দিয়ে নয়। তাই নিজের মত করেই তাঁদের বুঝতে চাই।
১. http://www.marxists.org/archive/marx/works/1847/11/prin-com.htm
২. http://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/communist-manifesto/index.htm
আমার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মার্ক্সবাদী ভাইয়ের জবাবঃ
স্বাধীন, আপনাকে নতুন করে আলোচনা করার জন্য ধন্যবাদ। আপনার আলোচনার ধরনটা বেশ ভালো লাগলো কেননা গ্রহন বর্জন করার একটা মানসিকতার ছাপ রয়েছে সেখানে। আর আদর্শগত অর্থে আপনিও আমার মত এই বুর্জোয়া সমাজ ব্যাবস্থার আমুল পরিবর্তনই বোধহয় চাইছেন। যাই হোক, আমার মনে হয় আমার আগের মন্তব্যে আমি আজকের যুগে কারা প্রলেটারিয়াত আর কারা বুর্জোয়া সে বিষয়ে আমার বক্তব্য পরিস্কার করার চেষ্টা করেছিলাম। তারপরও এখানে একটি উদাহরণ দিয়ে আমার আগের বক্তব্যটি পরিস্কার করার চেষ্টা করি। ধরা যাক এক জন প্রকৌশলী একটি রিয়েল এস্টেট কম্পানি খুলেছেন যেখানে তিনি আরও ১০ জন প্রকৌশলী, ২০ জন টেকনিশিয়ান, ১০০ জন নির্মান শ্রমিককে বেতন দিয়ে পোষেন। কোম্পানীর মালিক প্রকৌশলী পুজি বিনিয়োগ করে বিভিন্ন প্লটে ফ্লাট বানানোর কাজ শুরু করেন। প্রকৌশলী এবং টেকনিশিয়ানরা তাদের দক্ষ/আধা দক্ষ শ্রম দিয়ে নকশা এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার কাজ করেন। নির্মান শ্রমিকেরা সেই নকশা অনুযায়ী তাদের অদক্ষ/আধা দক্ষ শ্রম দিয়ে সেই কাজটিকে বাস্তবায়ন করেন। এখন এখানে কার কি শ্রেণী অবস্থান?
# নিয়োগ কারী প্রকৌশলী যেহেতু পুজি বিনিয়োগ করে উদ্বৃত্ত আত্মসাত করেন এবং সেই উদ্বৃত্ত পুনরায় বিনিয়োগ করেন আরও বেশী মুনাফার জন্য, সেহেতু মার্ক্সবাদ অনুসারে তিনি হলেন একজন বুর্জোয়া। এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। তিনি ব্যাক্তি হিসেবে অত্যন্ত ভালো মানুষ হতে পারেন কিন্তু যেহেতু পুজিবাদী উতপাদন পদ্ধতিতে তার নিয়োগকৃত শ্রমিক, প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের উতপাদিত উদ্বৃত্তে তিনি ভাগ বসাচ্ছেন, সেই কারণে তিনি শোষণকারী বুর্জোয়া।
# বেতন ভোগী প্রকৌশলী/টেকনিশিয়ান আর মজুরী ভোগী নির্মান শ্রমিক প্রত্যেকেই শ্রমিকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত যেহেতু তারা তাদের শ্রম বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করছেন। বেতনভোগী প্রকৌশলী টেকনিশিয়ানরা হলো হোয়াট কালার শ্রমিক যেহেতু এদের শ্রমের মূল্য অপেক্ষাকৃত বেশী দেয়া হয়, যেহেতু এরা মূলত মানসিক শ্রম বিক্রী করে এবং এদের শ্রমকে দক্ষ শ্রম বলা হয় যেটাকে অর্জন করতে নির্দিষ্ট ধরনের ট্রেনিং বা শিক্ষার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। আর নির্মান শ্রমিকরা হলো ব্ল-কলার শ্রমিক যেহেতু এদের শ্রমের মূল্য কম দেয়া হয়, যেহেতু এদের শ্রম অদক্ষ বা আধা দক্ষ এবং শারীরিক শ্রম নির্ভর। এরা শ্রম বিক্রিয়কারী হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত বা Class in itself হলেও চেতনাগত অর্থে প্রলেতারীয় শ্রমিক শ্রেণীর চেতনা ধারণ নাও করতে পারে অর্থাত Class for itself হলো রাজনৈতিক চেতনার ব্যাপার যা অর্জন করার বিষয়।
উচ্চ বেতন ও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কারণে বেতনভোগী প্রকৌশলীরা নিজেকে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ইত্যাদি অনেক কিছুই ভাবতে পারে কিংবা নিজেদের সুবিধা জনক অবস্থান বজায় রাখা এবং মূল্যবান চাকুরীটি হারানোর ভয়ে মালিক প্রকৌশলীর একান্তঅনুগত হিসেবে সেই বুর্জোয়া মালিকের শোষণের যন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে—অর্থাত সাংস্কৃতিক বিবেচনা, লাইফস্টাইল মূল্যবোধ ইত্যাদি অর্থে সে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত বিভিন্ন ধরণের মানসিকতা ধারণ করতে পারে কিন্তু অর্থনেতিক হিসেবে উতপাদনের উপকরণের সাথে মালিকানা সম্পর্ক বিচারে তার অবস্থান কিন্তু শ্রমিকতার অবস্থান। একইভাবে একজন টেকনিশিয়ান এমনকি কোন কোন উচ্চমজুরী প্রাপ্ত দক্ষ নির্মান শ্রমিকও পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিচারে নিজেকে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ভাবতে পারে, চাকুরী হারানো বা অন্যান্য বিবেচনায় মালিক শ্রেণীর স্বার্থবাহক শোষনের যন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে কিন্তু তাই বলে সে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিচারে কখনও বুর্জোয়া বা পেটিবুর্জোয়া মধ্যবিত্ত হয়ে যায় না। উচ্চ বেতন পাওয়ার জন্য হোয়াট কলার শ্রমিকদের কারও কারও হাতে উদ্বৃত্ত থাকলেও যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সেই অর্থকে পুজিতে রুপান্তর না করছে অর্থ মুনাফা অর্জনের জন্য শ্রমিক নিয়োগ করে কারখানা বা কোম্পানী না খুলছে ততক্ষণ পর্যন্ত উতপাদন সম্পর্ক বিচারে তারা শ্রমিক শ্রেণীরই অংশ, যাদের কে লেনিনের ভাষায় বলা যায় লেবার এরোস্টেক্রেট। লেনিন উন্নত ধনবাদী দেশে ক্রমশ এই লেবার এরোস্প্রোক্রেটদের বৃদ্ধি দেখে বলেছিলেন কার্যকর শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই লেবার এরোস্ট্রোক্রেসি একাটা বিরাট বাধা, কাজেই এটাকে ভাঙা খুবই জরুরী।
এভাবে হোয়াইট কলার শ্রমিকেরা স্বাভাবিক সময়ে তাদের সুবিধাজনক অবস্থা হারানোর ভয়ে পুজি ও শ্রমের দ্বন্দ্বে পুজির পক্ষাবলম্বন করলেও সংকটের সময় যখন ব্ল-কলার শ্রমিকদের মতই তাদেরকে ছাটাই হতে হয় তখন কিন্ত দেখা যায় এরা শ্রমিকদের মতই ট্রেড ইউনিয়ন জাতীয় সংগঠন করে মালিক বুর্জোয়ার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। আপনি আপনি আপনার আলোচনায় যেসব স্যোসাল ওয়েল ফেয়ারের উদাহরণ দিয়েছেন এগুলো কিন্তু এই হোয়াট কলার আর ব্লু কলার শ্রমিকদের মিলিত আন্দোলনের ফল। এখন তারা তাদের সেই শ্রেণী চেতনা কতটুকু ধরে রাখবে এটা পুরোপুরি নির্ভর করে সেই সময়ের রাজনৈতিক অর্থনেতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সর্বপরি শ্রমিক শ্রেণীর চেতনাগত মান ও তার প্রয়োগ সক্ষমতার উপর।
আর আমি নিজে একজন প্রকৌশলী হয়েও কেন সর্বহারা শ্রেণীর শাসন কমিউনিজমে বিশ্বাস করি তার উত্তরে বলবো মার্কস/এঙ্গেলস নিজেরাও কিন্তু সেই অর্থে কারখানায় কাজ করা সর্বহারা শ্রমিক ছিলেন না কিন্তু চেতনাগত অর্থে তারা সর্বহারার সাথে একাত্মতা বোধ করেছেন অর্থাত ডি-ক্লাসড হয়েছিলেন। আর আমি তো নিজে একজন হোয়াট কলার শ্রমিক- আমার কেবল দরকার নিজেকে মধ্যবিত্তের মানসিকতা থেকে বের করে নিজের শ্রেণী অবস্থানটাকে বুঝে নেয়া এবং সে অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করা।
যার প্রেক্ষিতে আমার জবাব ও উপসংহারঃ
ধন্যবাদ আপনাকে আপনার মন্তব্যের জন্য। আপনার বক্তব্যের পর এটা বুঝতে পারলাম আপনার সাথে আমার চিন্তার পার্থক্য খুবই সামান্য, তবে তা মৌলিক পার্থক্য। শুধু এইটুকু পার্থক্যের জন্যই আপনি নিজেকে প্রলেতারিয়েত শ্রেনীতে একাত্মতাবোধ করেন এবং মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী হয়ে সমাজ পরিবর্তণের স্বপ্ন দেখেন। পার্থক্যটি হল যত না প্রলেতারিয়েতের সজ্ঞায় তার চেয়েও বেশী বুর্জোয়ার সজ্ঞায়। প্রলেতারিয়েত এখানে মূল বিষয় নয়, শোষিত শ্রেনী মানেই প্রলেতারিয়েত। কিন্তু বুর্জোয়া কারা।
আপনারই ভাষায় -নিয়োগ কারী প্রকৌশলী যেহেতু পুজি বিনিয়োগ করে উদ্বৃত্ত আত্মসাত করেন এবং সেই উদ্বৃত্ত পুনরায় বিনিয়োগ করেন আরও বেশী মুনাফার জন্য, সেহেতু মার্ক্সবাদ অনুসারে তিনি হলেন একজন বুর্জোয়া। এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। তিনি ব্যাক্তি হিসেবে অত্যন্ত ভালো মানুষ হতে পারেন কিন্তু যেহেতু পুজিবাদী উতপাদন পদ্ধতিতে তার নিয়োগকৃত শ্রমিক, প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের উতপাদিত উদ্বৃত্তে তিনি ভাগ বসাচ্ছেন, সেই কারণে তিনি শোষণকারী বুর্জোয়া।
আমিও ঠিক এটাই বুঝেছি যে মার্ক্স তাই বুঝিয়েছেন। আমি বলেছি- বৃহত পূঁজিপতি শ্রেনী, যারা উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সকল উপাদান (কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, কারখানা) এর একচেটিয়া অধিকার সংরক্ষণ করে। এখানে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের কোন প্রশ্ন নেই। যারাই পূঁজি খাঁটিয়ে লাভ করে তারাই বুর্জোয়া শ্রেনী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- কারখানার মালিক শ্রেনী, বাড়িওয়ালা, বড় দোকানি, বড় ব্যবসায়ী ইত্যাদিদের।
সুতরাং দেখতেই পারছেন আমার মার্ক্স এর সজ্ঞা বুঝায় আর আপনার সজ্ঞায় তেমন বেশী পার্থক্য নেই। পার্থক্য হল আমি মার্ক্স এর এই সজ্ঞাকে মনে করি খুবই সরলিকৃত একটি সজ্ঞা হিসেবে। সকল পুঁজিপতিদেরই তিনি শত্রুর কাঁতারে ফেলেছেন। তিনি যেটা দেখেছেন যে সকলে মিলে লাভ করা হয়, কিন্তু সে লভ্যাংশ শুধু পায় পুঁজিপতি। সেই বাড়তি মুনাফা আবার বিনিয়োগ হয়, তা থেকে আরো মুনাফা হয়, সেটাও যায় পুঁজিপতির ঘরেই। সুতরাং যে কারোরই সেই পুঁজিপতির উপর ক্ষোভ হতেই পারে।
কিন্তু পুঁজিপতি যে বিনিয়োগটি করছে তার যে রিস্ক আছে সেটাও তো পুঁজিপতির, তাই না। সে কিছু লাভের আশায় ব্যবসায় এসেছে। আপনার সেই প্রকৌশলী তো নিজে ব্যবসায় না এসে সারাজীবন শ্রম বিক্রি করেই চলতে পারতো। কিন্তু সে ব্যবসায় এসেছে কারণ ব্যবসায় লাভ আছে আবার লোকসানের ভয়ও আছে। এখানে আপনি যে সিস্টেম এর কথা বলছেন সেটাই ক্লাসিকাল অর্থনীতি। সেই একই অর্থনীতি মেনেই কমিউনিষ্ট সমাজেও রাষ্ট্রকে ব্যবসা করতে হবে। পুঁজি খাটাতে হবে, সেখান হতে মুনাফা করতে হবে, সেই বাড়তি মুনাফা দিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরী করতে হবে। যদি এটা না করে তবে সে দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়বে। তবে এটাও মনে রাখা উচিৎ রাষ্ট্রের পক্ষে ব্যবসা করে মুনাফা করা এত সহজ কথা নয়, যার প্রমান আমাদের দেশের সকল রাষ্ট্রীয় শিল্প বা প্রতিষ্ঠান গুলো। যে কারনেই ব্যক্তি মালিকানায় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হয়। রাষ্ট্র সেখান হতে কর আদায় করে, অর্থ্যাৎঘুরিয়ে বললে রাষ্ট্র একটু কম মুনাফা করলো। রাষ্ট্রের বাকি মুনাফা ব্যক্তিকে দেওয়া হল কারণ সেই ব্যক্তি নিজে রিস্ক নিয়ে একটি কর্মক্ষেত্র তৈরী করলো এবং রাষ্ট্রকে মুনাফা দিল। রাষ্ট্র শুধু পুঁজি ধার দিয়ে মুনাফা করলো, আর ব্যক্তি তার শ্রম ও মেধা খাটিয়ে নিজে ও রাষ্ট্রকে মুনাফা দিল। এমন ব্যক্তিকে আমি কিভাবে শত্রু শ্রেনী হিসেবে চিহ্নিত করবো। আমার সাথে আপনার বা মার্ক্স এর মূল পার্থক্য এখানেই।
আরেকটি ক্ষুদ্র পার্থক্য হল, মানবতাবোধ বা নীতিবোধ। আপনি যেভাবে খুব সহজ করে বলে দিতে পারেন এখানে সত-অসত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিবেচনার কোন জায়গাই নেই। আমি তা পারিনা। কারণ নীতি এবং মানবতা আমার কাছে অনেক বড়। একজন মানুষকে আমি শ্রেনী শত্রু আখ্যা দিয়ে মেরে ফেলে আর যাই করি কারোর ভাল করতে পারবো এ ধরণের বিশ্বাস আমার পক্ষে অসম্ভব। সে কারনেই বোমা মেরে মানুষকে ধর্মের বাণী পৌছে দেওয়া সম্ভব বলেও আমি মনে করি না।
মুনাফা, সে ব্যক্তিই করুক বা রাষ্ট্রই করুক, রাষ্ট্রের উচিৎ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তাবায়ন হচ্ছে কিনা তার তদারকি করা। অর্থাৎ সেই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা পর্যাপ্ত মুজুরি পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিৎ করা রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্র সেটা না করলে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে পারে, তার জন্য আন্দোলন হতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পরিবর্তন সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। কারন মার্ক্স যাকে পুঁজিবাদ বলেন তাকে আমি বলি আধুনিক অর্থনীতি ব্যবস্থা। মার্ক্স যাকে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা বলেন আমি তাকে বলি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই অর্থনৈতিক বা সমাজ ব্যবস্থা এসেছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের অংশ হিসেবেই। সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করা মানে হল সভ্যতার চাকাকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া ।
এটা ঠিক যে আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। গণতন্ত্রের চেয়ে উত্তম শাসন ব্যবস্থা এখনো পাওয়া যায়নি। তাই বলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। যদি সমাজে পরিবর্তন আনতেই হয় তবে আমি বর্তমান ব্যবস্থাকেই ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করবো। আমি সভ্যতার চাকাটিকে সামনের দিকেই নিয়ে যাবার চেষ্টা করবো, পেছনের দিকে নয়।
Subscribe to:
Posts (Atom)