Thursday, February 25, 2010

ছাত্র রাজনীতিঃ পক্ষ-বিপক্ষ

বিগত কিছুদিনের ছাত্র সংঘর্ষে সবার সামনে আবারো ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা/অপ্রয়োজনীয়তার প্রশ্নটি চলে এসেছে।মানুষ পক্ষ এবং বিপক্ষ এই দু’দলে বিভক্ত, কিন্তু আপাত সহজ কোন সমাধান কারোর কাছেই নেই। দু’পক্ষরই উদ্দেশ্য বর্তমান ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত মুক্ত করা, শুধু তাঁদের পন্থা ভিন্ন। যারা ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে তাঁদের যুক্তি হল বর্তমান ছাত্র রাজনীতির দৈন্যদশাঃ দলীয় কোন্দল, চাঁদাবাজি, হল দখল, সংঘর্ষ, মৃত্যু। তাই তাঁরা এই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে। অন্য পক্ষ যারা ছাত্র রাজনীতি বলবৎ রাখার পক্ষে তাঁরাও এই দৈন্যদশার অবসান যে চান না তা নয়, কিন্তু এ জন্য তাঁরা সরাসরি ছাত্র রাজনীতিকে দায়ী করতে রাজী নন। বরং ছাত্র রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সত্যিকার ভাবে দায়ি যে কারণ গুলো তা খুঁজে বের করার পক্ষপাতি, যদিও সমস্যার মূলে খুব কম মানুষই যায়। একটি কথা বারংবার আলোচনায় উঠে আসে তা হল দলীয় লেজুড়ভিক্তিক ছাত্র রাজনীতির কারণেই আজ এই দশা, কিন্তু এর সহজ কোন সমাধান কেউ বলতে পারেন না। কিভাবে বর্তমান অবস্থায় ছাত্র রাজীতিকে দলীয় প্রভাব মুক্ত রাখা সম্ভব সেটা নিয়ে কেউ আলোচনা করেন না। এ কারণে সহজ সমাধান হিসেবে আমরা পাই ছাত্র রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করাকে।

মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে একটি বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরী বলে মনে করি। প্রশ্ন হল রাজনীতি বলতে আমরা কি বুঝি? রাষ্ট্রের বা সরকারের বা জনগণের বিভিন্ন সমস্যা, সুযোগ সুবিধে, ভাল মন্দ নিয়ে কথা বলা বা সমালোচনা করা কি রাজনীতি? বর্তমানে পাহাড়ের অস্থিতিশীলতা নিয়ে কথা বলা বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা বলা কি রাজনীতি? নাকি এই সব বিষয়ে ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসাবিদ, প্রকৌশলীবিদ, সামরিকবিদ বা সরকারী চাকুরীজীবি বা খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলা অনুচিত? ছাত্রদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলা বা শিক্ষকদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে বা শ্রমজীবি মানুষের নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলা কি রাজনীতি? তাহলে রাজনীতি কি শুধু নির্বাচনে প্রতিদন্দ্বীতা করা আর না করার মাঝেই সীমাবদ্ধ? নাকি চাঁদাবাজি, হল-দখল, জমি-দখল, খাল-দখল, সন্ত্রাস এই সব হল রাজনীতি।

আমার মনে হয় না রাজনীতির মাঝে এই সব সন্ত্রাস কেউ চাইবে বা এগুলোকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে কেউ থাকবে। তাহলে বাকি রইল দেশ ও দেশের মানুষের বা নিজেদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এর কি প্রয়োজন আছে বা ছাত্রদের, শিক্ষকদের, বিভিন্ন পেশাজীবিদের বা শ্রমজীবি মানুষের কি দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে? আপনার কি মনে হয়? আর দেশের কথা যদি এই সকল শ্রেনীর মানুষেরা চিন্তা না করে তবে কারা তাঁদের পক্ষে চিন্তা করবেঃ কর্পোরেট ব্যবসায়ীবৃন্দ আর বিদেশী কূটনীতিকবৃন্দ?

যদিও লেখাটির মূল আলোচনা ছাত্র রাজনীতি নিয়ে কিন্তু আমার মতে ছাত্র রাজনীতি পৃথক কোন বিষয় নয়। এর সাথে শিক্ষক রাজনীতি , বিভিন্ন পেশাজীবিদের রাজনীতি বা শ্রমজীবি সংগঠনের বিষয়গুলো সম্পৃক্ত। কোনটিকে অন্যটির থেকে পৃথক করে দেখার অবকাশ নেই। দলীয় লেজুরভিক্তিক ছাত্র সংগঠন বা শিক্ষক সংগঠন বা পেশাজীবি বা শ্রমজীবি সংগঠনের বিরোধিতা আমিও করি কিন্তু সেই সঙ্গে এও বলতে চাই যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই সব সংগঠনের প্রয়োজনীয়তাও অপরিসীম। প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্কের অধিকার রয়েছে এবং উচিতও প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সজাগ থাকা এবং সে আলোকে নিজের মতামত প্রদান করা। কোন আইন করে নির্দিষ্ট কোন গোষ্ঠী বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয় যদি না সে গোষ্ঠী বা সংগঠন আদর্শগত ভাবে হিংসাত্বক বা ধ্বংসাত্বক কাজে যুক্ত থাকে। তাই আইন করে ছাত্র বা শিক্ষক বা কোন পেশাজীবি বা শ্রমজীবি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা সম্ভবপর নয় বা করাও উচিত নয় বলে আমার মনে হয় । তাহলে এই গোলক ধাঁধার কি কোন সমাধান নেই? দলীয় লেজুড়বৃত্তি ব্যতীত সংগঠন কি সম্ভবপর নয়? সবাই দলীয় লেজুড়বৃত্তি মুক্ত সংগঠন কামনা করেন কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব সেটা নিয়ে কেউ আলোকপাত করেন না। আমি এখানে একটি সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করতে চাই।

আমার মতে এর একটি মূল কারণ হচ্ছে আমাদের বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতির একটি বড় দুর্বলতা এবং তা হল সঠিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অক্ষমতা। আঞ্চলিক ভেদে জনসংখ্যার অনুপাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠির প্রকৃত চিত্র চিত্রিত করে না। বর্তমান জনপ্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি পুরোপুরি দলীয় নির্ভর নির্বাচন পদ্ধতি। এখানে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত না হয়ে দলীয় প্রতিনিধি নির্বাচন হয়। বাস্তবতায় জনগণও ব্যক্তিকে ভোট না দিয়ে একটি দলকেই ভোট দেয়। এই চিত্রটি যে শুধু আমাদের দেশেই তা নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অগ্রসর দেশেগুলোতেও জনগণ দলকেই নির্বাচন করে। এ কারণে সে সব দেশেও ঘুরে ফিরে একেক বার একেক দল সরকার গঠণ করে। দলীয় ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি খুব কমই দলীয় আনুগত্যের বাহিরে যেতে পারেন। তাই এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কখনই জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে গমণ করেন না। এই চিত্রটি করুণ আকার ধারণ করে উন্নয়শীল বা অনুন্নত দেশগুলোতে যেখানে শিক্ষার হার অনেক কম এবং দারিদ্রের হার অনেক বেশি। দলীয় আনুগত্য তখন সকল প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে এবং সেটারই বহিঃপ্রকাশ দেখি দলীয় লেজুরভিক্তিক সংগঠন গুলোতে।

তবে আনুগত্য শুধু দলের প্রতি সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়। বর্তমান পদ্ধতিতে যেহেতু ছাত্র বা শিক্ষক বা শ্রমিক বা পেশাজীবিদের সরাসরি আইন প্রণয়নে কোন ভুমিকা থাকে না তাই তাঁদের যে কোন কিছুর জন্য আঞ্চলিক জনপ্রতিনিধির পেছনেই অবস্থান নিতে হয়। এভাবেই জনপ্রতিনিধিরা হয়ে উঠেন ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে, এবং এভাবেই তাঁরা বিভিন্ন পেশাজীবিদের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠে আর এভাবেই শুরু হয় দলের ভেতরেও উপদল। দলীয় লেজুরভিক্তিকতার পাশাপাশি এই ব্যক্তিনির্ভরতাও দায়ী পেশাজীবি ও শ্রমজীবি সংগঠন গুলোর মাঝে সন্ত্রাসের বিষ ছড়াতে। তাই আমাদের প্রয়োজন এই পেশাজীবিদের সরাসরি সরকার ব্যবস্থায় প্রবেশ করানো যেন তাঁদের অন্যদের উপর নির্ভর না করতে হয়।

এ কারণে আমি মনে করি প্রকৃত রিপ্রজেন্টেটিভ বা জনপ্রতিনিধি শুধু অঞ্চলভেদে নির্বাচন না করে জনগণের মাঝে যত প্রকার বৈচিত্র রয়েছে সব ক্ষেত্র হতেই স্যাম্পল আসা উচিত। তাই অঞ্চলভেদে প্রতিনিধির পাশাপাশি প্রতিনিধি আসা উচিত বয়স অনুপাতে, ধর্মীয় বিশ্বাস অনুপাতে, বিভিন্ন পেশাজীবিঃ ছাত্র, শিক্ষক, চিকিতসা, প্রকৌশলী অনুপাতে,, বিভিন্ন শ্রমজীবি পেশা অনুপাতে, লিঙ্গ অনুপাতে। অর্থাৎ প্রতিটি বিভাগ হতেই প্রতিনিধি নির্বাচন করে যে সরকার ব্যবস্থা গঠিত হবে সেখানে সকল মানুষের মনোভাব উঠে আসবে। অন্যথায় জনগণ এর চিন্তার সাথে সরকারের চিন্তার মাঝে পার্থক্য রয়ে যাবে।

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে এভাবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা কতটা বাস্তব সম্মত। যদি শুধু মাত্র ছাত্র প্রতিনিধির কথাই উদাহরণ হিসেবে বলি তবে প্রতিটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল একটি মাত্র ছাত্র সংসদ থাকবে যারা নির্বাচিত হবে সরাসরি ছাত্রদের ভোটের মাধ্যমে। এভাবে প্রতিটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত সংসদ নির্বাচন করবে তাঁদের কেন্দ্রিয় কার্যনির্বাহী পরিষদ ও সভাপতি। নির্বাচিত সভপতি একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য (দু’বছর) সংসদে উক্ত সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন। এভাবে প্রতিটি পেশাজীবি বা ধর্মীয় গোত্র বা আদিবাসী সহ সকল শ্রেনীর মানুষ তাঁদের নিজ নিজ সংগঠনের মাধ্যমে তাঁদের প্রতিনিধি পাঠাবেন সংসদে। এই প্রক্রিয়া আরো সহজতর করা সম্ভম তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে। প্রতিটি প্রাপ্তবয়ষ্ক নাগরিক যখন ভোটার হবেন তখন তিনি তাঁর বয়স, ধর্ম, পেশা, অঞ্চল এগুলো উল্লেখ করবেন। পরবর্তীতে নির্বাচনের সময় তিনি তাঁর ক্যাটাগরি অনুসারে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে একই ব্যক্তি একই সংসদে নিজ নিজ বয়স, ধর্ম, পেশা ও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমের সংসদকে আরো প্রতিনিধিমুলক করবেন।

এই ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় চলে আসে। এক কক্ষ বিশিষ্ট বনাম দু’কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ। আমি ব্যক্তিগত ভাবে দু’কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পক্ষপাতি। বিভিন্ন পেশা, ধর্ম, বয়স এবং অঞ্চল অনুপাতে যে সংসদ গঠিত হবে সেটাকে আমি যেহেতু প্রকৃত প্রতিনিধিমুলক বলে মনে করি তাই এই সংসদকে আমি রাখতে চাই উচ্চ কক্ষে যাঁদের কাজ হবে কেবল আইন প্রণয়ন বা বিভিন্ন জাতীয় নীতি প্রণয়ন বা সংবিধান পর্যালোচনা করা। শুধু মাত্র অঞ্চলভেদে একটি সংসদ (বর্তমান সংসদ) হতে পারে যাঁদের কাজ হবে দেশ পরিচালনা করা এবং জনগণের করের অর্থের যথার্থ ব্যবহার করা সংবিধান অনুসারে। নিম্ন কক্ষ হবে দেশের নির্বাহী বিভাগ এবং উচ্চ কক্ষ হবে আইন প্রণয়নকারী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ হবে আইন প্রয়োগকারী বিভাগ। আবার শুধু মাত্র একটি সংসদ দিয়েও দেশ পরিচালনা সম্ভবপর হবে যদি সেই সংসদে সকল শ্রেনীর জনগণের প্রতিনিধির উপস্থিতি থাকে। সে ক্ষেত্রে সংসদ হবে সকল ক্ষমতার উৎস এবং সরকার হবে সংসদের একটি ক্ষুদ্র অংশ। কিন্তু বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ এবং সরকার একই প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সরকারের বা সংসদের জবাবদীহিতার কোন উপায় নেই। ভোটাধিকার প্রয়োগ হচ্ছে জনগণের ক্ষমতার উৎস এবং সেই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন জনগণের চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে বারংবার ব্যর্থ হয় তখনই জনগণ অসিহুষ্ণ হয়ে ধ্বংসাত্বক পথ অবলম্বন করে। তাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে জনগণের অবস্থান নিশ্চিত করার জন্যই প্রয়োজন সংসদে সকল শ্রেনীর প্রতিনিধি প্রেরণ।

রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমার দেশের সমস্যা এবং সরকারের ভাল মন্দ নিয়ে কথা বলার অধিকার রয়েছে। তেমনি অধিকার রয়েছে যে কোন সংগঠনে জড়িত হবার হোক না তা বিজ্ঞান ভিক্তিক কিংবা সাংস্কৃতিক ভিক্তিক বা ধর্ম ভিক্তিক বা রাজনীতি ভিক্তিক। নিজে ছাত্র বা শিক্ষক হয়েও যদি নিজের শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যহত না করে দেশ গঠনে বা সমাজ গঠনে কোন ভুমিকা রাখতে পারি তবে তা কেন করবো না। কিন্তু আজ কোন আইন করে যদি বলা হয় যে ছাত্রত্ব/শিক্ষকতা অথবা দেশ গঠনের মাঝে কেবল একটিকেই বেছে নিতে হবে তাহলে তা কতটা যুক্তিযুক্ত? কিছু ছাত্র বা শিক্ষক ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে রাজনীতিতে যুক্ত হয় যাঁদের মাঝে নৈতিকতার কোন চিহ্ন নেই। তাঁদেরকে শাস্তি প্রদানের জন্য যদি সকল ছাত্র বা শিক্ষক সমাজের উপর আঘাত আনি সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত? শিক্ষক সমাজকে আমি মনে করি একটি জাতির চক্ষু স্বরুপ এবং একজন শিক্ষককের হওয়া উচিত একজন দার্শনিকের মত। তিনি শুধু পাঠ্যবই থেকেই শিক্ষা দিবেন না তিনি সেই শিক্ষাকে নিজের মাঝে ধারণ করবেন যা থেকে ছাত্ররা বা সমাজের অন্য ব্যক্তিরা শিক্ষা লাভ করতে পারে। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে আজ সেই শিক্ষক সমাজ নেই। সমাজের অবক্ষয়ের এটাও একটি কারণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা প্রবেশ করেছি এটা সত্য , কিন্তু সেই সাথে উপেক্ষা করেছি শিক্ষক সমাজকে আর মাথায় তুলে নিয়েছি জনপ্রতিনিধিদের। একজন জনপ্রতিনিধি কেবল দেশকে শাসন করতে পারে, কিন্তু একজন শিক্ষক দেশকে বা সমাজকে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তাই প্রয়োজন উন্নত চরিত্রের মানুষদের শিক্ষকতার পেশায় আসা এবং সাথে সাথে রাজনীতিতেও আসা।

Monday, February 15, 2010

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও একটি জোট (WCSF)

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে বরাহরা প্রস্তুত, কিন্তু আমরা প্রস্তুত তো। সচলায়তনে এই নিয়ে কিছুদিন পর পর লেখা আসছে, আলোচনা চলছে এবং এটা চলতে থাকা উচিত সরকারকে এক প্রকার চাপে রাখার জন্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে। সচলের বাহিরেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কার্যক্রম চলছে এবং এ রকমই একটি জোট হচ্ছে War Crimes Strategy Forum (WCSF) ।

এটি মূলত স্বেচ্ছাসেবকদের গড়া একটি জোট বা কোয়ালিশন যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আসন্ন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে সর্বতোভাবে সহায়তা করা, মূলতঃ নাগরিক উদ্যোগগুলোকে সমন্বিত করার মাধ্যমে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি জটিল এবং বিস্তৃত প্রক্রিয়া। আর এটি এমনই বিস্তৃত একটি প্রক্রিয়া যে এককভাবে কোন সরকারের পক্ষেই হয়তো এর সুষ্ঠু সম্পাদন করা কঠিন, এমনকি হয়তো অসম্ভবও, যদি না নাগরিক পর্যায়ের উদ্যোগগুলো উল্লেখ করার মতো সম্পূরক ভূমিকা পালন না করে এই কর্মযজ্ঞে। এই উদ্দেশ্যটিকে মাথায় রেখে এই বিচার প্রক্রিয়াকে ঘিরে কিছু মৌলিক বিষয়ে সমমনা সংগঠনগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রয়াশে এই জোট কাজ করে যাচ্ছে।

সংক্ষেপে এই কোয়ালিশন এর মূল উদ্দেশ্যগুলো হলঃ

১। যুদ্ধাপরাধ সংশ্লিষ্ট প্রাপ্য তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষন ও পর্যালোচনা করা ।
২। যুদ্ধাপরাধ সংশ্লিষ্ট নির্দিষ্ট ইস্যুতে নুতন গবেষনা এবং নুতন তথ্যের খোঁজ করা।
৩। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে গণমানুষের মাঝে সচেতনা তৈরি করা।
৪। দেশি/বিদেশি সমমনা গোত্রের মানুষ/দলের সাথে যোগযোগ রক্ষা করা।
৫। দেশি/বিদেশি মিডিয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা
৬। বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষন করা এবং
৭। অভিজ্ঞ আইনবিদদের সহায়তায় বিচারের কাজে পরামর্শ প্রদান করা।

ফেব্রুয়ারী ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে WCSF আজ প্রায় এক বছরে উল্লেখযোগ্য পথ পাড়ি দিয়েছে। WCSF এর মূল শক্তি এর স্বেচ্ছসেবকেরা এবং স্বেচ্ছাসেবকেরা ছড়িয়ে রয়েছে পৃথিবীর সর্বত্র। ছাত্র, শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনীতিবিদ, সকল পেশাজীবিঃ যেমন আইনবিদ, চিকিৎসাবিদ, প্রকৌশলীবিদ, গবেষনাবিদ, সাংবাদিক, সামরিকবিদ, সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো সকল শ্রেনীর মানুষের সমন্বয়ে গড়া এই কোয়ালিশন। প্রতিদিনই নুতন নুতন মানুষ এবং নুতন নুতন সংগঠন যুক্ত হচ্ছেন বা WCSF এর সাথে সহানুভুতি জ্ঞাপন করছেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সামনে রেখে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ প্রকল্প আকারে হাতে নেওয়া হয়েছে।

প্রথম প্রকল্পটি হল মিডিয়া আর্কাইভ, যেখানে যুদ্ধাপরাধ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রাসঙ্গিক প্রতিদিনকার পত্রিকার খবর/নিবন্ধ/সাক্ষাতকার, ব্লগ, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার খবর, অন্তর্জালে প্রাপ্ত খবর বা চলচ্চিত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষন করা হয়। যুদ্ধাপরাধের-বিচার বিষয়ে ঘটনার গতি-প্রকৃতি-অগ্রগতি খুব সহজে একটি পোর্টালের ভেতরেই মনিটর করা এবং সে অনুযায়ী কর্মপন্থা নির্ধারণ-পরিবর্তন করাই মূলত এই আর্কাইভের উদ্দেশ্য।

দ্বিতীয় প্রকল্পটি হল ই-লাইব্রেরী যেখানে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ এর উপর প্রকাশিত দেশি/বিদেশি বই/জার্নাল সংগ্রহ ও সংরক্ষন করা হয়। লাইব্রেরীতে ইতোমধ্যেই শতাধিক ভুক্তি সংযুক্ত করা হয়েছে এবং প্রতিদিনই আরও নতুন নতুন ভুক্তি যোগ করা হচ্ছে। এই লাইব্রেরীর মূল উদ্দেশ্যে হল ভৌগলিক বাধা অতিক্রম করে উন্নততর রেফারেন্স লেখক-পাঠকদের কাছে সহজলভ্য করার মাধ্যমে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের ইতিহাস, যুদ্ধাপরাধ এবং বিচার প্রক্রিয়া বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার পথকে সুগম করা।

একটি ব্লগ খোলা হয়েছে যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গতি-প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা যাবে এবং সে মোতাবেক কর্মপন্থা নির্ধারন করা সম্ভব হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্ভাব্য প্রকৃতি নিয়ে WCSF এর দেশি এবং বিদেশি আইনবিদগণের সমন্বয়ে গড়া প্যানেল এর মাঝেই কাজ শুরু করেছেন। এই কাজে স্বেচ্ছাসেবকদের ভিন্ন ভিন্ন দল সহায়তা করে যাচ্ছেন। কিছু সদস্য কাজ করছেন প্রত্যক্ষদর্শীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্য, আর কিছু সদস্য কাজ করছেন বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরিতে।

এগুলো ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালু রয়েছে। বাংলা ও ইংরেজী উইকিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, যুদ্ধাপরাধীদের কার্যকলাপ লিপিবদ্ধের জন্য একটি দল কাজ করে যাচ্ছে এবং এই কাজে সচলয়াতনের অনেকেই যুক্ত আছেন। এ ছাড়া একটি অনুবাদ প্রকল্প চিন্তার পর্যায়ে রয়েছে যেন মুক্তিযুদ্ধের উপর তথ্যগুলো বিদেশী গবেষকেদের কাছে সহজলভ্য করা যায়।

এই ফোরাম যদিও স্বেচ্ছেসেবকদের দ্বারা পরিচালিত, কিন্তু এটি একটি আদর্শ সমন্বয়কৃত ফোরাম। স্বেচ্ছসেবকদের মতামতের ভিক্তিতেই নুতন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় এবং স্বেচ্ছসেবকদের দ্বারাই পরিচালিত হয়। তবে প্রকল্পগুলোর মূল উদ্দেশ্য থাকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অথবা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংশ্লিষ্ট। WCSF এর প্রতিটি বিভাগেই প্রচুর স্বেছাসেবকের প্রয়োজন। আপনি আপনার ক্ষেত্র বুঝে যে কোন প্রকল্পে WCSF এর সাথে যুক্ত হতে পারেন। আগ্রহীরা wcsf-recruitmentএটgooglegroupsডটcom এ ইমেইল করতে পারেন।

আপনি যদি এখনই WCSF এর কাজের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত না হতে পারেন, তবে আপনি WCSF এর কথা আপনার পরিচিত জনের মাঝে ছড়িয়ে দিন। আপনি এই ব্লগটিকে ফেইসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারেন, কিংবা ফেইসবুকে WCSF এর ফ্যান পেইজে যুক্ত হতে পারেন। WCSF এর জন্য বেশ কিছু ব্যাজ তৈরী করে দিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক পৃথা। আপনি এই ব্যাজকে আপনার ফেইসবুক প্রোফাইল ছবি হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন কিছুদিনের জন্য। হয়তো এর মাধ্যমে WCSF কিছু নতুন সক্রিয় স্বেচ্ছসেবক পেতে পারেন কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনার সৃষ্টি হবে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি কোন দলের দাবি নয়, এটি গণমানুষের দাবি। কিন্তু শুধু দাবি জানানো আর আইনের মাধ্যমে এদের বিচার করা এক কথা নয়। তাই আমাদের সকলকে এক সাথে কাজ করতে হবে এবং এ জন্য WCSF একটি কার্যকর প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। আসুন, দল-মত নির্বিশেষে অন্তত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এই ইস্যুতে আমরা সকলে মনে-প্রাণে সক্রিয় হই।