Saturday, June 26, 2010

গণতন্ত্র ও তার সমালোচনা

ভুমিকাঃ

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমভাগ হতে (508 BC) গণতন্ত্রের সূচনা হলেও আধুনিক গণতন্ত্রের যে রূপ আমরা আজ দেখি সেটির ধারণা আমরা পাই আঠারো শতাব্দীর শুরুতে এসে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক অবস্থা হতে আজকের আধুনিকতম রূপে আসতে গিয়ে গণতন্ত্রকে নানা রূপান্তরের মাঝে দিয়ে যেতে হয়েছে। গণতন্ত্রের ভবিষ্যত স্বরূপটি কল্পনা করতে হলে এবং এর সুফল পেতে হলে আমাদেরকে এই রূপান্তরগুলো এবং রূপান্তরের কারণগুলোকে জানতে হবে এবং বুঝতে হবে। এই লেখাটিতে আমরা গণতন্ত্রের সেই ক্রমবিকাশকেই দেখবো। প্রথমে আমরা দেখবো গণতন্ত্রের একদম শুরুর কথা যেটাকে আমরা বলবো গণতন্ত্রের প্রাথমিক রূপান্তর। তারপর দেখবো গণতন্ত্রের দ্বিতীয় পরিবর্তনটি। এর পর গণতন্ত্রের বিপক্ষদলের কাছ থেকে আমরা গণতন্ত্রের কিছু সমালোচনা শুনবো এবং সেগুলোকে খন্ডন করে যুক্তিগুলো শুনবো । সবশেষে গণতন্রের কিছু তত্বীয় বিষয় আলোচনা করে এর ভবিষ্যৎ রূপ কেমন হতে পারে সেটি নিয়ে লেখা থাকবে।

গণতন্ত্রের প্রাথমিক রূপঃ সরাসরি গণতন্ত্র বা নগরকেন্দ্রিক গণতন্ত্র

খুব সহজ ভাষায় যদি বলা হয় - কিছু মানুষ সব সময়ই এমন ধারণা পোষণ করতো যে সকল মানুষ রাজনৈতিকভাবে সমান এবং সমষ্টিগত ভাবে নিজেরাই নিজেদের শাসন করার ক্ষমতা রাখে এবং শাসন যন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা অথবা শাসনযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই থাকবে। এই ধারণার উৎপত্তি মূলত গ্রীক দেশে, এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে এথেনিয়ানদের। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরুর দিকে গ্রীসের কিছু ছোট ছোট নগর, যারা মূলত শাসিত হতো বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক শাসক, যেমন রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, স্বৈরশাসক কিংবা কতিপয়তন্ত্রের মাধ্যমে, তারা এমন একটি ব্যবস্থা গ্রহন করলো যেখানে নাগরিকগণ নিজেরাই নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় শাসনযন্ত্রও তারাই পরিচালনা করবে। সে জন্য তাঁদের নির্ধারিত সংসদ ছিল যেখানে নাগরিকগণ তাঁদের মতামত তুলে ধরবে এবং নিজের ভোট প্রদান করবে। এই ছিল গ্রীক সময়কার সহজ এবং সাধারন গণতন্ত্রের ধারণা যা আজকের আধুনিক গণতন্ত্রের মূলেও রয়েছে। এবার তাহলে দেখি গ্রীক গণতন্ত্রের রূপটি কেমন ছিল।

প্রাচীন গ্রীসের গণতান্ত্রিক ধারণার ছয়টি মূল উপাদান ছিলঃ

১। নাগরিকগণেরর মাঝে একরকম ঐক্য থাকবে যেন তারা নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এড়িয়ে সার্বিক ভালোর জন্য কাজ করতে পারে।
২। নাগরিকগণ হবে মানসিকগত, অর্থনৈতিকগত ভাবে বৈষম্যহীন।
৩। গণের আকার ছোট থাকবে অর্থাৎ গণতন্ত্র হবে নগরকেন্দ্রিক।
৪। গণতন্ত্রের ধরণ হবে সরাসরি (Direct democracy), অর্থাৎ প্রতিনিধিমূলক (Representative) নয়।
৫। প্রতিটি নাগরিককেই স্বল্প সময়ের জন্য হলেও শাসনযন্ত্রে অংশ গ্রহন করতে হবে।
৬। নগরটি হতে হবে স্বায়িত্বশাসিত।

গ্রীসের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতাঃ

যদিও আজকের মতো কোন প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব তখন ছিল না, কিন্ত পারিবারিক কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্কের জোরে তখনো ক্ষমতার অপব্যবহার লক্ষ্য করা গিয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যা ছিল যে উক্ত সময়ে গ্রীসের গণতন্ত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণ ছিল না। নারী, দাস, শিশু এদেরকে এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বাহিরে রাখা হয়েছিল যার ফলে সকল নাগরিক রাজনৈতিক ভাবে সমান এই তত্বটি এখানে সত্যিকারভাবে পালিত হয়নি। তাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হলেও ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র একশ্রেণীর নাগরিকদের মাঝে। দ্বিতীয় সমস্য ছিল যে সরাসরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ছোট ছোট নগরকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় কার্যকর, কিন্তু বেশ বড় নগর কিংবা পুরো দেশের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ততটা কার্যকর নয়। অনেক নাগরিকের সে ক্ষেত্রে সংসদে এসে নিজের মতামত তুলে ধরা সম্ভবপর হয় না।

গণতন্ত্রের দ্বিতীয় রূপান্তরঃ প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র বা দেশকেন্দ্রিক গণতন্ত্র

প্রজাতন্ত্রের ধারণাঃ

গণতন্ত্রের কাছাকাছি আরেকটি ধারণা একই সময়ে গড়ে উঠেছিল তা হল প্রজাতান্ত্রিক ধারণা। এই ধারণায় মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রাণী। একজন ভাল মানুষ একজন ভাল নাগরিক এবং একটি গণ হল কিছু ভাল নাগরিকের সমন্বয়ে করা সংস্থা। একজন ভাল নাগরিক হচ্ছে নাগরিকচেতনা গূণাবলি সম্পন্ন একজন মানুষ। প্রজাতান্ত্রিকদের মতে একটি সমাজে সকল মানুষ পুরোপুরিভাবে সমান নয়। তাঁদের মতে সমাজ বিভক্ত কতিপয়তান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক অংশে। সব সময় সমাজে লঘু এবং গরিষ্ঠের অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়। তার সাথে যুক্ত করা যেতে পারে এরিষ্টটলের মতে তৃতীয় অংশেরঃ একের শাসন বা রাজতন্ত্রের। প্রজাতন্ত্রের ধারণার মূলে হচ্ছে শাসন যন্ত্রের মাঝে এক, কতিপয় এবং বহু এই তিন অংশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একধরনের ভারসাম্য রক্ষা করা।

আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমরা এই চিন্তারই প্রতিফলন দেখতে পাই। যেমনঃ আমেরিকা কিংবা ইংলেন্ডে দেখি প্রেসিডেন্ট বা রানী যিনি একের প্রতিনিধিত্ব করে, উচ্চ-কক্ষ সংসদ যাঁদেরকে তুলনা করা যায় অভিজাতশ্রেণী বা কতিপয়শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে এবং সব শেষে নিম্ন-কক্ষ সংসদকে কল্পনা করা যায় গরিষ্ঠের প্রতিনিধি হিসেবে। প্রজাতান্ত্রিক ধারণা পৃথকভাবে আসলেও এটি আধুনিক গণতন্ত্রের দ্বিতীয় পরিবর্তনে বেশ বড় ভুমিকা রাখে। প্রজাতান্ত্রিক ধারণা আসে রোমের শাসন যন্ত্র হতে। কিন্তু তাঁদের শাসন যন্ত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ছিল না। সংসদের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত ছিল না। মূলত বংশগতভাবেই তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করতো। তাই ইতিহাসের এই সময়েও নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের ধারণাটি আসেনি। গ্রীকের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সাথে রোমানদের প্রজাতান্ত্রিক পদ্ধতির বড় পার্থক্য হল যে গ্রীকের ধারণায় সকল নাগরিক শাসন যন্ত্রে অংশগ্রহন করে আর রোমানদের ধারণায় বিভিন্ন প্রতিনিধিরা শাসন যন্ত্র নিয়ন্ত্রন করে।

প্রতিনিধিমূলক ধারণাঃ

গ্রীকদের ধারণা থেকে আমরা দেখি যে বড় আকারের গণের দিকে তাঁদের অনীহা ছিল, এবং তারা কখনোই প্রতিনিধিমূলক শাসনযন্ত্র তৈরী করেনি। ঠিক তেমনি রোমানরাও। এমনকি রোমান সাম্রাজ্যের আকার দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও সংসদই ছিল নিজের মতামত তুলে ধরার একমাত্র স্থান। যে কারণে যখন কেউ সংসদে যোগদান করতে অক্ষম হতো কোন কারণে, সে তার নিজের মতামত পাঠাতো কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে। তারপরেও সেটা বর্তমানের মত প্রতিনিধিমূলক শাসনব্যবস্থা ছিল না। প্রতিনিধিত্ব শুধু মাত্র সীমাবদ্ধ ছিল নিজের মতামত প্রদানের মাধ্যম হিসেবে।

বর্তমান প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থা বাস্তবে আসে প্রথম আঠারো শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের প্রথম গৃহযুদ্ধের পরে। এই প্রথম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, যাঁদের সেই সময় বলা হয় লেভেলার (Leveller) সমস্যায় পড়লো কিভাবে একটি দেশের মত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা যায়। তারা খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছিল যে সরাসরি গণতন্ত্র এই ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর হবে না। তখনই তারা নিয়ে আসে প্রতিনিধিমূলক পদ্ধতি, আরো পরিষ্কার ভাবে বললে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি মূলক গণতন্ত্র, যেখানে জনগণের পক্ষে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদের মতামত দিবেন, সিদ্ধান্ত গ্রহন করবেন। এর ফলে গণতন্ত্রের আকারের (size) যে সীমাবদ্ধতা ছিল সেটা দূর হয়ে গেল।

তবে প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিকরাই প্রথম উদ্ভব করে নি। প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা তারও আগে থেকে মধ্যযুগের রাজতন্ত্র এবং অভিজাততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিদ্যমান ছিল যেখানে বিভিন্ন দূর রাষ্ট্রে রাজার পক্ষে বিভিন্ন প্রতিনিধিরা শাসন পরিচালনা করতো এবং রাজ্যের সংকটকালীন (যুদ্ধ) অবস্থায় রাজাকে পরামর্শ প্রদান করতো। এই ধারণাটিই পরবর্তীতে গণতান্ত্রিকরা ধারণ করেন প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এর কয়েক যুগের মাঝে প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক এবং প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে সকলেই স্বাচ্ছন্দে গ্রহণ করেন।

গণতন্ত্রের সমালোচনাঃ

এই পর্বে থাকছে নৈরাজ্যবাদ* (Anarchism) ও অভিভাবকতন্ত্র (Guardianship) এই দু’য়ের পক্ষ হতে গণতন্ত্রের সমালোচনা এবং সেগুলোকে খন্ডন করে লেখকের দেওয়া যুক্তি। এই দু’টি মতবাদ থেকে গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী সমালোচনাগুলো এসেছে।

নৈরাজ্যবাদীদের পক্ষ থেকেঃ

নৈরাজ্যবাদীদের চিন্তার মূলে হচ্ছে - যেহেতু রাষ্ট্র মাত্রেই বলপ্রয়োগকারী এবং যেকোন ধরনেরর বলপ্রয়োগ যেহেতু কাম্য নহে তাই রাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপন করা উচিত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দিয়ে। রাষ্ট্রবিহীন সমাজ হচ্ছে সহজ দৃষ্টিতে নৈরাজ্যবাদীদের মূলমন্ত্র। নৈরাজ্যবাদীদের মাঝেও আবার নানান ভাগ রয়েছে। যেমন অনেকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রহীন অবস্থায় না গিয়ে সর্বনিম্ন পর্যায়ের রাষ্ট্রের কথা বলে, যেখানে রাষ্ট্রের কাজ হবে খুবই সীমাবদ্ধ। যেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও বল প্রয়োগ থাকবে তাই নৈরাজ্যবাদীদের মতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও কাম্য নয়। নৈরাজ্যবাদীদের আপত্তি মুলত বলপ্রয়োগের সম্ভাবনা থেকে। যেহেতু গণতন্ত্র মানে হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন তাই গণতন্ত্রের আরেক মানে হচ্ছে সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর বলপ্রয়োগ। বলপ্রয়োগ সরাসরি না হলেও আইন এবং শাসন যন্ত্রে সংখ্যাগুরুর মতামতের মাধ্যমে সেটা হয়ে থাকবে।

লেখক এখানে নৈরাজ্যবাদীদের যুক্তির জবাব দিয়েছেন এভাবে যে বল প্রয়োগ কোথায় থাকবে না? এমনকি যে রাষ্ট্রবিহীন সমাজ সেখানেও কি বল প্রয়োগ থাকবে না? ধরুন কোন রাষ্ট্র নেই, কিন্তু সমাজের কিছু লোক অন্যের ক্রমাগত ক্ষতি করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান সেই সব লোককে জোরপূর্বক আইনের ভীতি দেখানো অথবা জেলে দেওয়া। তার মানে এই দাঁড়ায় যে একদম রাষ্ট্রবিহীন সমাজেও বল প্রয়োগ থাকবে। এখন যদি বল প্রয়োগ অবধারিতই হয় তবে সেটা সংখ্যালঘুর শাসন না হয়ে সংখ্যাগুরুর শাসন হলেই বল প্রয়োগ সর্বনিম্ন হবে এবং তাই শাসন হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হওয়াই যুক্তিযুক্ত। যদিও নৈরাজ্যবাদীদের বলপ্রয়োগের যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয় তারপরেও গণতন্ত্রের ফলে যে সংখ্যালঘুদের উপর বল প্রয়োগের সম্ভাবনা রয়ে যায় সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যেন সংখ্যালঘুদের অধিকারও নিশ্চিত থাকে। পরবর্তীতে আমরা এটাই দেখবো যে প্রতিনিধিমূলক পদ্ধতি এবং সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থার দ্বারা সংখ্যালঘুদের উপর বলপ্রয়োগের সম্ভাবনাকে অনেকাংশে কমিয়ে দেওয়া হয়।

অভিভাবকতন্ত্রের পক্ষ থেকেঃ

গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি আসে অভিভাবকতন্ত্রের দিক হতে যে সাধারণ মানুষ নিজেরা নিজেদেরকে শাসনের জন্য পুরোপুরি যোগ্য নয় । এই দাবীর সর্বপ্রথম যে রূপকার তিনি হলে প্লেটো। তিনি তার “রিপাব্লিক” গ্রন্থে বলেছিলেন দার্শনিক রাজার কথা। পরবর্তীতে এরিষ্টটল থেকে শুরু করে বহুজনই ঘুরেফিরে এর কাছাকাছি বক্তব্য প্রদান করেন। সেই দিক দিয়ে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে অভিভাবকতন্ত্র। এর মূল কথা হল যে শাসন যন্ত্র এমন একটি জটিল যন্ত্র যেটা পরিচালনার জন্য যোগ্য মানুষের প্রয়োজন। কেউ বলেন একমাত্র দার্শনিকদেরই হওয়া উচিত রাষ্ট্রের শাসক, কারো মতে প্রতিভাবানদের, কেউ বলেন প্রকৌশলীবিদ, চিকিৎসাবিদ বা পেশাজীবিদের, কেউ বা বলেন মনোবিজ্ঞানীদের। আসল বক্তব্য হল যে সাধারণ মানুষেরা নিজেদের চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে সব সময়। যে কারণে তারা কখনোই সার্বিক বা সকলের ভালোর জন্যে কাজ করবে না। অন্য কথায় গণতন্ত্রের দ্বারা সঠিক পথে রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালিত হবে না। তাই শাসন যন্ত্র পরিচালনার ভার থাকা উচিৎ যোগ্য অভিভাবকদের হাতে। বহুজনের (Democracy) শাসন নাকি কতিপয় যোগ্যজনের শাসন এই বিতর্ক বহু পুরনো বিতর্ক। আসুন দেখি লেখক কী বলেন এই বিষয়ে।

লেখক এখানেও তাঁর যুক্তি তুলে ধরেছেন, উদাহরণ দিয়েছেন, কেন গণতন্ত্র অভিভাবকতন্ত্র হতে উত্তম সব সময়। মূল যুক্তিটি হল যে যোগ্য ব্যক্তিরা অবশ্যই সাধারণ মানুষের তুলনায় উন্নত (বা অধিকতর) জ্ঞান রাখেন কিন্তু কখনই উন্নতর নৈতিকতা ধারণ করেন না। এখন পরবর্তীতে লেখক দেখাচ্ছেন যে শাসন যন্ত্রের ক্ষেত্রে উন্নত জ্ঞানের যেমন প্রয়োজন আছে তেমনি রয়েছে উন্নত নৈতিকতারও প্রয়োজন। এবং একমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এই উন্নত নৈতিকতার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব। কিভাবে, একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

ধরুনঃ আমেরিকার পারমাণবিক বোমার ব্যবহার সম্পর্কে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। এখন অবশ্যই পারমাণবিক বোমার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিষদ জ্ঞান একজন সাধারন মানুষের তুলনায় একজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী বেশি রাখবেন। কিন্তু যখনই প্রশ্ন আসবে বোমার ব্যবহার সম্পর্কে, কোন কোন অবস্থায় বোমা ব্যবহার করা হবে অথবা কোন কোন স্থানে বোমাটি ব্যবহার করা হবে, কিংবা আদৌ মানুষের উপর ব্যবহার করা হবে কি না, এই ধরণের সিদ্ধান্তগুলো যখন আসবে সেগুলো কোন কারিগরী বিষয় নয়, সম্পূর্ণ নীতিগত বিষয়। এবং এই ক্ষেত্রে একজন সাধারণ মানুষের সাথে একজন দার্শনিক, কিংবা প্রতিভাবান কিংবা ট্যাকনোক্র্যাটদের তেমন কোন পার্থক্য নেই। তাই লেখকের প্রথম যুক্তি হচ্ছে যেহেতু নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সকল মানুষের নৈতিকতা কাছাকাছি, কারোরটা খুব বেশি উন্নত নয়, তাই তাঁদের (অভিভাবকদের অথবা যোগ্যদের) এমন কোন অধিকার নেই যে জনগণের পক্ষ হয়ে তারা তাঁদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারেন জনগণের উপর, যদি না তাঁরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়। অর্থাৎ একমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নীতিগত সিদ্ধান্তে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব, কতিপয় যোগ্য লোকের দ্বারা নয়।

এবার দ্বিতীয় যুক্তিটি হল, অভিভাবকতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে। যোগ্য লোকের শাসন, যদি সেটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির আওতায় না থাকে, তার প্রধান সমস্যা হচ্ছে যদি কোন কারণে সাধারণ মানুষের সাথে অভিভাবকদের মতের মিল না হয় তখন তাঁরা বল প্রয়োগের মাধ্যমে সেটাকে সাধারণের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। অভিভাবকগণ সেক্ষেত্রে জনগণের অনুভূতিকে বুঝতে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হন এবং তখন সেটা সংঘাতের সৃষ্টি করে। কিন্তু যদি অভিভাবকগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হতেন তবে এই সংঘাত এড়ানো সম্ভব হতো। কারণ হয় অভিভাবকগণ জনগণের অনুভূতিকে মূল্যায়ন করতো অথবা জনগণ তাঁদেরকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অপসারণ করতো। উদাহরণ হিসেবে আমরা ইতিহাসের দিকে যদি দেখি, লেনিনের ভ্যানগার্ড কিংবা চার্চের শাসন কিংবা মুসলিম খলিফাদের শাসন এক প্রকার অভিভাবকতন্ত্রই ছিল, কিন্তু তাতে সাধারণ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে সামান্যই। পরিশেষে, এই আলোচনা থেকে এটি আমরা পাই যে, হ্যাঁ যদি জনগণ শাসন যন্ত্রের যোগ্য না হয়ে থাকে তবে যোগ্য লোকদেরই শাসনে আসা উচিত, কিন্তু তাদেরকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে, অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নয়।

তাহলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির যৌক্তিকতা কী?

আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থা অথবা আদর্শ রাষ্ট্র কখনোই ছিল না এবং আশা করা যায় কখনো হবেও না। সুতরাং বাস্তব রাষ্ট্রে, বাস্তব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের মাঝে মতভেদ থাকবেই এবং একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই সম্ভব সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে সন্তুষ্ট করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল মানুষ রাজনৈতিক ভাবে সমান হিসেবে বিবেচিত হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল মানুষ সর্বোচ্চ ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারী হয়, যেমনঃ বাক স্বাধীনতার, যাকে খুশি ভোট দেওয়ার, যে কোন রাজনৈতিক দল সমর্থন করার ইত্যাদি। এই ব্যবস্থায় একজন মানুষ সর্বোচ্চ নৈতিক স্বাধীনতাও ভোগ করে। তাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির একটি বড় যুক্তি হচ্ছে যে - কোন একটি গোষ্ঠীতে বা সমাজে বা রাষ্ট্রে কোন একক ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তি অন্যান্য সকল সদস্যের তুলনায় এমনতর উন্নত নয় যে তাঁরা সকলকে শাসন করার অধিকার রাখে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এটা ধারণা রাখা হয় যে গোষ্ঠীর সকল সদস্য সমানভাবে যোগ্য এবং সিদ্ধান্ত প্রণয়নে সমান অধিকার রক্ষা করে। এটাকে লেখক বলেছেন রাজনৈতিক সমতার যুক্তি।

এবার আমরা দেখি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল উপাদান কী কী যা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল উপাদান পাচঁটি এবং এই পাচঁটি উপাদান আবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সমস্যাগুলোও তুলে ধরে।

১। কার্যকরী অংশগ্রহণঃ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকল সদস্যের কার্যকরী অংশগ্রহণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল কথা যেটা আমরা প্রাচীন গ্রীসের মডেলেও দেখতে পাই। যদি বিপুল সংখক মানুষ মতামত প্রদানে বিরত থাকে তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হবে না। একই সাথে চলে আসে তথ্যের অবাধ প্রবাহের বিষয়টি। যদি মতামত প্রদানের পূর্বে সমস্যা সম্পর্কে যথাযত ভাবে সকল সদস্য অবহিত না হয় তবে সে ক্ষেত্রেও প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত সার্বিক লক্ষ্যের জন্য কাজ করবে না। তাই সকলের কার্যকর্রী অংশগ্রহণ এবং মতামত প্রদানের পূর্বে সমস্যা সম্পর্কে যথাযত জ্ঞান রাখা গণতন্ত্রের প্রাথমিক মন্ত্র।

২। সমান ভোটাধিকারঃ রাজনৈতিক ভাবে সকল পূর্ণবয়স্ক নাগরিকেরই সমান ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। ধনী/গরীব, মেধবী/মিডিওকার, নারী/পুরুষ, সাদা/কালো, শ্রমজীবি/পেশাজীবি সকলের সমান ভোটাধিকার হচ্ছে গণতন্ত্রের আরেকটি মৌলিক উপাদান।

৩। ব্যক্তির বিচারবুদ্ধিতাঃ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সমস্যা সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বোঝার ক্ষমতা। যদি অধিকাংশ জনগণের সেই ক্ষমতায় ঘাটতি থাকে তবে সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থ হবে কাক্ষিত ফলাফল অর্জনে। এই সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করে আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে।

৪। এজেন্ডার পরিচালনাঃ কোন্‌ কোন্‌ সমস্যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে এটা যারা পরিচালনা করে, যেমন নির্বাচন কমিশন, তাঁদের কথা বোঝানো হচ্ছে এখানে। নির্বাচন কমিশন যদি যথেষ্ট স্বাধীন ও নিরপেক্ষ না হয় তবে জনগণের প্রকৃত মতামত না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৫। ইনক্লুসিভনেসঃ ভোটের অধিকার কারা কারা সংরক্ষন করবে সেটা নিশ্চিত করা। কিছু গোত্র বা শ্রেণীকে শাসনযন্ত্র হতে বাদ দেওয়ার চেষ্টা নানান সময়েই দেখা গিয়েছে । যেমনঃ বহুদিন নারীদের, কালোদের ভোটাধিকার ছিল না। এখন অবশ্য এই সমস্যাটি আর নেই। এখন যেকোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শিশু, সিদ্ধান্ত নিতে মানসিকভাবে অক্ষম এমন ব্যক্তি, এবং সাজাপ্রাপ্ত ব্যাক্তি ব্যতীত সকলেরই ভোটাধিকার রয়েছে।

উপোরক্ত পাচঁটি উপাদানের পরেও কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যা রয়ে যায়ঃ

সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বনাম সংখ্যালঘুর শাসনঃ

এটি একটি আদি সমস্যা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির। গনতন্ত্র মানে কি সংখ্যালঘুর উপর সব সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন? সহজ উত্তর - সরাসরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হ্যাঁ। প্রতিনিধিমূলক পদ্ধতিতেও হ্যাঁ, তবে কিছুটা কম। এটি কি কোনভাবে এড়ানো সম্ভব? এ ক্ষেত্রেও সরাসরি জবাব না। যে কোন বাস্তব রাষ্ট্রেই মতভেদ থাকবে এবং কারোর মতামত গ্রহণ করা হবে এবং কারোর মতামত উপেক্ষিত হবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মতামত গৃহীত হবে এবং এর দ্বারা সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের সন্তুষ্টি অর্জিত হবে।

তবে প্রশ্ন আসে কোন বিকল্প পদ্ধতি কি সম্ভব? যেমনঃ সকলের মতামতের ভিক্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কিংবা দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন-চতুর্থাংশের ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। সকলের মতামতের (১০০শত ভাগ) ব্যাপারে বলা হয় যে এটি একটি অসম্ভব ব্যবস্থা যে সকলেই কোন কিছুতে একমত হবে। সে ক্ষেত্রে যে কারোর হাতে ক্ষমতা রয়ে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের উপর তার নিজের সিদ্ধান্তকে চাপিয়ে দেওয়ার এবং সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর অবিচার হবে। একই যুক্তি খাটে দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন-চতুর্থাংশ ভোটের ব্যাপারে। তারপরেও বর্তমানে আমরা দেখি যে সংবিধান পরিবর্তনের মত মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে অনেক দেশেই দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন-চতুর্থাংশ ভোটের ব্যবস্থা রয়েছে।

তাহলে প্রশ্ন আসে, কিভাবে সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করা যায়। এর একটি জবাব হতে পারে জনপ্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র, যা সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করে না। এছাড়া অন্যান্য সংস্থা, যেমনঃ বিচার বিভাগ, সংবিধান এর দ্বারাও সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কার্যকরী হতো যদি সকল নাগরিকের মাঝে সামাজিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমতা থাকতো। কিন্তু বাস্তব রাষ্ট্রে যেহেতু সকলের মাঝে নানান ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান, তাই সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হলে সংখ্যালঘুরা সবসময় বঞ্চিত থাকতো। এ কারণেই আজ বেশিরভাগ দেশেই প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা দেখা যায়।

ব্যক্তিগত লক্ষ্য বনাম সার্বিক লক্ষ্যঃ

তাহলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির লক্ষ্য কী? গণতান্ত্রিক পদ্ধতির লক্ষ্য হল সকলের মতামতের ভিক্তিতে সার্বিক ভালোর জন্য কাজ করা। এখানে তাহলে প্রশ্ন জাগে সার্বিক ভালো বলতে আমরা কি বুঝি। সার্বিক ভালো হচ্ছে সেটাই যেটাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সন্তুষ্টি লাভ করা যায় এবং যেহেতু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত পাওয়া সম্ভব তাই এর মাধ্যমেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব। এখানে আরো প্রশ্ন জাগে কীভাবে এই সার্বিক ভালো অর্জন করা সম্ভব। লেখকের যুক্তি হচ্ছে একটি গণ হচ্ছে কতিপয় সদস্যের সমন্বয়ে গড়া একটি সংস্থা যেখানে সকল সদস্য বুদ্ধিগতভাবে, অর্থনৈতিক ভাবে, সামাজিক ভাবে সমান বা প্রায় কাছাকাছি (Homogenous)। অর্থাৎ সদস্যদের মাঝে মতভেদ প্রকট নয়। এমন একটি গণের ক্ষেত্রে যখন প্রতিটি সদস্য যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করবে সে চিন্তা করবে নিজের লাভের কথা এবং সেই ভিক্তিতেই নিজের মতামত প্রদান করবে। এখন প্রতিটি নাগরিক যদি এভাবে নিজের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য মতামত দেয় এবং তাঁদের মাঝে যদি বৈষম্য কম থাকে তবে সেই মতামতের ভিক্তিতে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে তাতে সার্বিক সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে এবং এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের দ্বারা সার্বিক ভালোর লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে। তাহলে এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হচ্ছে যে যদি সদস্যদের মাঝে বৈষম্য (বুদ্ধিগত, অর্থনৈতিকগত, সাংস্কৃতিকগত, জাতিগত ইত্যাদি) প্রকট হয় তবে সবাই নিজ নিজ উদ্দেশ্যে মতামত প্রদান করলে সার্বিক লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভবপর হবে না, যা আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য।

সরাসরি গণতন্ত্র বনাম প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র বনাম সাংবিধানিক গণতন্ত্র বনাম বহুসংস্থার শাসনঃ

আমরা দেখি যে সরাসরি গণতন্ত্রের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরাসরি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যার ফলে সংখ্যালঘু সব সময় নিগৃহীত থাকার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এছাড়া সরাসরি গণতন্ত্র বড় আকারের গণের পক্ষে ততটা কার্যকরী নয়। গণের আকার বড় হয়ে গেলে সকলের কার্যকরী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভবপর হয়ে উঠে না, সে ক্ষেত্রে জনগণের প্রকৃত মতামত না পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। এ কারণে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় পরিবর্তনে আমরা দেখি প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা। প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থার ফলে গণের আকারের সীমাবদ্ধতা আর থাকে না। কিন্তু প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থাও সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করে না। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক ব্যবস্থা অধিকতর কার্যকরী। কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থাকে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিক্তিতেই সংবিধান রচিত হয় তবে সেটা কীভাবে সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করবে? এই ক্ষেত্রে আসে বহুসংস্থার শাসন** (Polyarchy) যেখানে ক্ষমতা শুধু জনপ্রতিনিধি কিংবা সংসদেই সীমাবদ্ধ থাকে না, ক্ষমতার বেকেন্দ্রীকরণ ঘটে নানান স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার হাতে। এমনই কিছু সংস্থা হচ্ছেঃ বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন মিডিয়া ইত্যাদি। এটিকে বলা হয় গণতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর যা আমরা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করবো।

গণতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর বা বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র ঃ

আমরা এটি আগেই আলোচনা করেছি যে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় রূপান্তরের একটি মূল প্রাপ্তি হলো প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা। এর ফলে সরাসরি গণতন্ত্রের যে আকারগত সীমাবদ্ধতা ছিল সেটি নিমিষেই দূর হয়ে গিয়েছে। নগরকেন্দ্রিক গণতন্ত্র থেকে আমরা চলে যাই এখন দেশকেন্দ্রিক গণতন্ত্রে। কিন্তু এর ফলে এখন কিছু নুতন সীমাবদ্ধতার উদ্ভব হয়েছে। প্রথমতঃ প্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতি কী হবে কিংবা ক্ষেত্র কী হবে? নির্বাচন কি পপুলারিস্টিক ভোটের মাধ্যমে হবে নাকি ভোটের হার অনুপাতে হবে? দ্বিতীয়তঃ নাগরিকদের সরাসরি শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ যা গ্রীক গণতন্ত্রের মূলে ছিল সেটা এখন আর সম্ভব নয়। তৃতীয়তঃ রাষ্ট্রের আকার বৃদ্ধির ফলে নাগরিকদের মাঝে বৈচিত্র আরো বেড়ে যায় এবং যার ফলে মতভেদ আরো তীব্র হয়, শাসন ব্যবস্থা আরো জটিলতর হয়।

বৃহৎ আকারের গণতন্ত্রে শাসনযন্ত্রকে সঠিক ভাবে পরিচালিত করার লক্ষ্যে গণতন্ত্রের মাঝে আরো এক ধরনেরর রূপান্তর ঘটে। তৈরী হয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, জন্ম নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের। এর ফলে শাসন যন্ত্র শুধু প্রতিনিধিদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না, ক্ষমতার বন্টন ঘটে নানান প্রতিষ্ঠানের হাতে যারা নিজেরা হয়ে উঠে স্বায়ত্বশাসিত। এভাবে সৃষ্টি হয় বহুসংস্থার শাসন। এমনই কিছু সংস্থা হচ্ছেঃ বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন মিডিয়া ইত্যাদি। বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রকে লেখক বলেছেন গণতন্ত্রের সর্বোচ্চরূপ, যা আমরা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির মাঝে দেখতে পাই।

বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের মৌলিক সাতটি উপাদান লক্ষ্য করা যায়ঃ

১। নির্বাচিত প্রতিনিধি ২। প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ৩। ইনক্লুসিভ সাফরেজ (Inclusive Suffrage) ৪। নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার
৫। বাক স্বাধীনতা ৬। বিকল্প তথ্যের অধিকার ৭। স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা

তাহলে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের উদ্ভব কীভাবে হয়ে থাকে?

যদিও বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র বড় আকারের জনগোষ্ঠীর জন্য গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রুপ তথাপি সকল দেশে এই শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। তাহলে কীভাবে এই শাসনতন্ত্র গড়ে উঠে? তার আগে আমরা ধারণা করি যে এক বা একাধিক অনুকূল পরিস্থিতিতে আমরা নিম্নোক্ত তিন ধরনের শাসন ব্যবস্থা পেতে পারি।

যদি পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে অনুকূল হয় তবে
১। NPR (Non Polyarchy Region) -> PR (Polyarchy Region)
যদি পরিস্থিতি অনুকূল না হয় তবে
২। NPR -> NPR
যদি পরিস্থিতি মাঝামাঝি হয় তবে
৩।(ক) NPR ->PR -> NPR
(খ) NPR -> PR -> NPR -> PR
(গ) NPR->PR->NPR->PR->NPR->PR-> ………(দোদুল্যমান)

তাহলে কি সেই অনুকূল পরিস্থিতিঃ

১। বল প্রয়োগের যন্ত্রগুলোর ক্ষমতার কেন্দ্রঃ রাষ্ট্র সাধারণত বল প্রয়োগ করে থাকে পুলিশ এবং সামরিকবাহিনী দ্বারা। তাই এটি দেখার বিষয় যে এই দু’টি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কাঁদের হাতে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বড় শর্ত হচ্ছে এই দু’বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত বেসামরিক ব্যাক্তির হাতে যিনি গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত। সাম্প্রতিক আফগানিস্তানে আমেরিকার সেনকমান্ডারের আপসারনের চিত্রটি এখানে দ্রষ্টব্য হতে পারে। তবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও বিপক্ষ মতের দমনে বল প্রয়োগ করতে পারে। তাই গণতান্ত্রিক ভাবে তাঁদের অপসারণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

২। আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজঃ ঐতিহাসিক ভাবে দেখা যায় যে, যে সব সমাজে জনগণের আয়ক্ষমতা অধিক, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক, উন্নতর জীবন ব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্রে অবাধ বৈচিত্র, উন্নত শিক্ষার হার, ক্ষুদ্র কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠী, উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন বৃহৎ জনগোষ্ঠী, অধিকতর সংখ্যক স্বায়ত্বশাসিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অধিকতর সংখ্যক পেশাজীবি, ইত্যাদির হার বেশি সেই সব সমাজে বহুসংস্থার শাসন তন্ত্রের দেখা পাওয়া যায় বেশি। এ ধরণের সমাজকেই লেখক আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী (MDP: Modern, Dynamic and Pluralism) সমাজ হিসেবে বলেছেন। কেন এই ধরণের সমাজ বহুজনের শাসনতন্ত্রের জন্য সহায়ক? প্রথমতঃ নানান শিক্ষিত ও স্বনির্ভর জনগোষ্ঠীর কারণে ক্ষমতার পেছনের শক্তিগুলো নানান ক্ষেত্রে ছড়িয়ে যায়। যার ফলে কোন একক ব্যক্তি বা কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে সকল ক্ষমতা থাকা সম্ভবপর হয় না। দ্বিতীয়তঃ স্বনির্ভরতা ও শিক্ষা মানুষকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দিকে পরিচালিত করে।
তারপরেও প্রশ্ন থাকে যে অনেক দেশই পুরোপুরি আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজ না হওয়া সত্বেও বহুসংস্থার শাসন এসেছে। উদাহরণ হিসেবে ভারত, বাংলাদেশের কথা বলা যেতে পারে। ভারত, বাংলাদেশ সে রকম আধুনিক, উন্নত দেশ না হওয়া সত্বেও সেখানে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র বিদ্যমান। এই সব দেশে বহুসংস্থার শাসন এসেছে তাদের উপনেবেশিক শাসকগোষ্ঠী (বৃটিশ শাসন) হতে। তাই বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের জন্য আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজই একমাত্র উপায় এ কথাও জোর করে বলা যায় না।
আবার আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজ হলেও যে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র টিকে থাকবে তাও নয়। বলপ্রয়োগের যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ কাঁদের হাতে সেটি একটি মূল বিষয় যা আগের অংশে বলা হয়েছে। সামরিকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ যদি গণতান্ত্রিক প্রতিনিধির হাতে না হয় তবে যেকোন সময় সেই সমাজে অগণতান্ত্রিক সরকার চলে আসতে পারে। এ ছাড়া, একটি দেশে যদি বিভিন্ন জাতিগত দ্বন্দ্ব থাকে তবে সে ক্ষেত্রেও গণতন্ত্র বাধাগ্রস্থ হয়ে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা গৃহযুদ্ধের আকার ধারণ করে। বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের সম্ভাবনা অনেক কমে যায় যদি জাতিগত বিভেদ প্রকট হয়। এই সব ক্ষেত্রে সকল জাতিকে নিয়ে একধরণের ঐক্যমতের সরকার গঠণ কার্যকরী হয়ে থাকে । অথবা প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীকে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন দিতে হয়। ভারতের ক্ষেত্রে এই কারণেই এত জাতিগত বৈচিত্র থাকা সত্বেও গণতন্ত্রের ভিত ওদের শক্ত। জাতিগত বিভেদ টিকিয়ে রেখে কোনভাবেই বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। জাতিগত বিভেদ ছাড়াও বহিঃশক্তি গণতন্ত্রের একটি নিয়ামক। যদি বহিঃশক্তি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে সমর্থন জুগিয়ে চলে তবে একটি দেশে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্থ হয়।

পরিশেষে, একটি রাষ্ট্রে যদি সামরিক ও পুলিশ বাহিনী নিরপেক্ষ থাকে, যদি আধুনিক ও উন্নত সমাজ ব্যবস্থা থাকে, যদি জাতিগত বিভেদ বা জনগণের মাঝে মতভেদ প্রকট না থাকে, যদি বহিঃশক্তির প্রভাব না থাকে এবং রাজনৈতিক সংস্থাগুলো বহুসংস্থার শাসনে বিশ্বাস ও চর্চা করে তবে সেই রাষ্ট্রে বহুসংস্থার শাসনের উদ্ভব হবে এবং সেটি টিকে থাকবে।

আগামী দিনের গণতন্ত্রঃ

প্রায় দু’সহস্র বছরের অধিক পূর্বে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার চালু হয়েছিল যেখানে সকল সদস্য একে অন্যের তুলনায় রাজনৈতিক ভাবে সমান এবং সমষ্টিগত ভাবে নিজেরাই নিজেদের শাসন যন্ত্রের নিয়ন্ত্রক ছিল। এই ব্যবস্থা অন্যান্য যে কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনায় উৎকৃষ্ট ছিল কারণ- প্রথমতঃ এই ব্যবস্থা সর্বোচ্চ ব্যাক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে, দ্বিতীয়তঃ এই ব্যবস্থা মানব সভ্যতার উন্নয়ন করে, তৃতীয়তঃ মানুষের সার্বজনিন ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করার এটাই সবচেয়ে উন্নত পন্থা ।
গণতন্ত্রের প্রথম রূপান্তরটি ঘটে গণতন্ত্র অথবা প্রজাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্রকে দূর করে ক্ষমতার কেন্দ্রে জনগণকে নিয়ে আসার মাধ্যমে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা ছিল মূলত ক্ষুদ্র নগর কেন্দ্রিক এবং সরাসরি গণতন্ত্র। দ্বিতীয় রুপান্তরটি ঘটে যেখানে প্রতিনিধিমূলক গনতন্ত্রের মাধ্যমে নগর কেন্দ্রিক গণতন্ত্র হতে দেশ কেন্দ্রিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। বৃহৎ আকারের শাসন যন্ত্রের কাজ যথাযত ভাবে সম্পন্ন করার জন্য উদ্ভব হয় শাসন যন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগ, যেমনঃ সংসদ, আদালত, নির্বাচন কমিশন। একে আমরা বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের (polyarchy) প্রথম রূপ বলতে পারি।

শাসন যন্ত্রের ধরন আরো জটিলতর আকার ধারণ করলে নির্বাচিত প্রতিনিধির পক্ষে সকল সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে অনির্বাচিত প্রতিনিধি যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ। তৈরী হয় বিভিন্ন অভিজ্ঞ কমিটি। এটি একধরণের ছদ্ম অভিভাবকত্ব যেখানে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিজেদের ইচ্ছা জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে না কিন্তু জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের উদ্দেশ্য জনপ্রতিনিধিদের সাথে কাজ করছে। বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসিত মিডিয়া কিংবা জনগোষ্ঠী নানান ভাবে জনপ্রতিনিধিগণকে উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে থাকে। এই ধরণের ব্যবস্থাকে আমরা বলতে পারি বহুসংস্থার শাসন যন্ত্রের দ্বিতীয় রূপ। এটিই এই পর্যন্ত গণতন্ত্রের আধুনিকতম রূপ যা আমরা সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেখে থাকি।

এখন বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর কি অবশ্যাম্ভাবী? লেখকের মতে এটি হতে পারে সাধারণ জনগণের সাথে রাজনৈতিক এলিটদের যে জ্ঞানের ব্যবধান রয়েছে সেটিকে কমিয়ে। ক্ষমতায় আরোহীরা সাধারণ জনগণের চেয়ে অধিকতর বোঝদার সেটা নয় বরং তাঁরা সাধারণ জনগণের চেয়ে বেশি তথ্য পেয়ে থাকেন। যদি জনগণের কাছে সকল তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করা যায় তবে জনগণও সঠিক ভাবে যে কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারতো। তাই তথ্যের বিকল্প ব্যবস্থার উপর লেখক জোর দিচ্ছেন এবং অভিবাবকদের উপর নির্ভিরতা কমিয়ে জনগণের উপর নির্ভরতা বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছেন। লেখকের মতে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের শেষ ধাপ হবে যখন জনগণের সরাসরি অংশ গ্রহণেরর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রতিফলিত হবে, অনেকটা প্রাচীন গ্রীসের সরাসরি গণতন্ত্রের মত।

এই অংশের মাঝে দিয়ে বইটির মূল অংশের অনুবাদ শেষ হলো।

আমার নিজস্ব কিছু বিশ্লেষণঃ

এই বইটির মূল অংশ যে কারণে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি তা হল লেখকের যুক্তিবোধ। গণতন্ত্রের প্রতিটি সীমাবদ্ধতাকে লেখক এখানে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন এবং সেগুলোকে সমাধানের চেষ্টা করেছেন। প্রথমত যেটা করেছেন ইতিহাসের আলোকে গণতন্ত্রকে দেখেছেন এবং গণতন্ত্রের প্রধান পরিবর্তনগুলোকে চিহ্নিত করেছেন। অতঃপর গণতন্ত্রের প্রধান সমালোচক, প্রতিদ্বন্দ্বী নৈরাজ্যবাদ এবং অভিবাবকতন্ত্রের চোখ দিয়ে এর সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করেছেন এবং যুক্তি দিয়ে স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন কেন গণতন্ত্র অন্যান্য যে কোন শাসন ব্যবস্থা হতে সর্বোৎকৃষ্ট। যোগ্য লোকের শাসন নাকি সাধারণ জনগণের শাসন – বহুল আলোচিত এই প্রশ্নের কিছু জবাব আমরা এখানে পাই। লেখক শুধু এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল উপাদান, এর নিয়ামকগুলোকে তুলে ধরেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কেন যৌক্তিক, এবং কীভাবে প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা হতে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের উদ্ভব হল সেটি দেখিয়েছেন। সাথে দেখিয়েছেন বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের সহায়ক শক্তিগুলো কী কী এবং কেনই বা কোন কোন দেশে এই শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে কিন্তু অন্য কোন দেশে নয়। বহুসংস্থার শাসন ব্যবস্থাকে তিনি চিহ্নিত করেছেন আধুনিক গণতন্ত্রের সর্বোচ্চরূপে। তারপরে লেখক দেখিয়েছেন যে এই ব্যবস্থাকেও আরো উন্নত করা সম্ভব যদি সাধারণ মানুষকে শাসনযন্ত্রে আরো জড়িত করা যায়, জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ আরো বাড়ানো যায়। সে কারণে জনগণের কাছে তথ্যের সহজগম্যতার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি মূলত জনগণকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে প্রাচীন গ্রীসের মূল গণতান্ত্রিক মডেলেই ফিরে যাবার একটি স্বপ্ন দেখেছেন।

এটি একটি বড় প্রশ্ন, আমরা কি আসলেই প্রাচীন গ্রীসের সেই সরাসরি গণতন্ত্রে ফিরে যেতে পারি। এর তাত্ত্বিক জবাব হতে পারে আজকের এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে একটি দেশের এর মত বৃহৎ আকারের গণের ক্ষেত্রেও এখন সরাসরি গণতন্ত্র সম্ভব। কিছুদিন আগেও আমাদের হাতে উন্নত প্রযুক্তি ছিল না যার মাধ্যমে নিমিষে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মতামত গ্রহন করা সম্ভবপর হতো। কিন্তু আজকের এই মিডিয়া, মোবাইল, ফোন, ইন্টারনেট এর যুগে কয়েক ঘন্টার মাঝেই যেকোন আকারের জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত জানা সম্ভব। তাই তাত্ত্বিক জবাব হল, হ্যাঁ, সরাসরি গণতন্ত্র এখন সম্ভব। তার উপর বিভিন্ন কারণেই আজ প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র মানুষের সার্বজনিন ইচ্ছার প্রতিফলেন ব্যর্থ হচ্ছে। মানুষের মাঝে আজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি এক ধরণের হতাশা দেখা যাচ্ছে। তবে কি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে সরাসরি গণতন্ত্রই হবে আমাদের পরবর্তী রূপান্তর?

কিন্তু সরাসরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কথা আমরা জানি। রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজে যদি জনগণের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তবে সেটা বাস্তবসম্মত ও কার্যকরী হবে কি? আবার সরাসরি গণতন্ত্রের জন্য নাগরিকদের মাঝে বৈষম্য প্রকট না হওয়া উচিত। কিন্তু যে কোন বৃহৎ আকারের জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকবেই। তাই সরাসরি গণতন্ত্র এখনো বাস্তব সম্মত নয়। তাই এর একটি সমাধান হতে পারে প্রতিনিধিমূলক ও সরাসরি গণতন্ত্রের এক মিশ্র ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজ জনগণের পক্ষ হতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা করে যাবেন জনগণের দ্বারা রচিত বিধিমালা (সংবিধান) মোতাবেক। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা কখনই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে না। কেন্দ্রে থাকবে জনগণ। যে কোন মুহুর্তে, যে কোন জনপ্রতিনিধিকে জনগণ অপসারণ করতে পারবে, তাদের ভোটের মাধ্যমে। যেকোন ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে জনগণ, সরাসরি ভোটের মাধ্যমে। এই ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও বিভিন্ন স্বাধীন সংস্থাগুলো জনগণকে সহায়তা প্রদান করবে। বর্তমান পদ্ধতির সাথে এই নুতন পদ্ধতির একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে যে কোন জনপ্রতিনিধিকেই দীর্ঘমেয়াদের জন্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। অনেকটা চাকুরীর ক্ষেত্রে যেমন বছর বছর কাজের মূল্যায়নের উপর নির্ভর করে চাকুরীর নবায়ন করা হয় সেরকম। এ রকম প্রতি ছয় মাস বা প্রতি এক বছর বা যে কোন সময়েই যে কোন জনপ্রতিনিধির কাজের মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকবে। কেউ ভাল কাজ করলে তিনি আজীবন থাকবেন, না হয় নুতন প্রতিনিধি আসবে। এভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব এবং জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল তথ্যের বিকল্প ব্যবস্থার পথ নিশ্চিত করা। জনগণকে ক্ষমতার কেন্দ্রে রাখতে হলে, জনগণের কাছ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত পেতে হলে তথ্যের অবাধ প্রবাহের বিকল্প নেই। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি এই ক্ষেত্রেও সহায়ক হতে পারে। প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠনের তথ্য যদি অন্তর্জাল, পত্রিকা, মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌছানো সম্ভব হয় তবে জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদানে ভুল করবে না এবং এর দ্বারা জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতাও নিশ্চিত করা সম্ভব।

গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ভিন্ন অন্য কোন উন্নতর শাসন ব্যবস্থা সম্ভবপর নয়। তাই শুধু প্রয়োজন এর সীমাবদ্ধতাগুলোকে দূর করে ব্যবস্থাটিকে আরো উন্নত করা। জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতার মাধ্যমে, জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধের মাধ্যমে, জনগণের হাতে মূল ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে আমরা গণতন্ত্রকে আরো সুসংহত করতে পারি। বহুসংস্থার শাসন, ই-গভর্নমেন্ট, ই-ভোটিং, আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচন, ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ আরো বৃদ্ধি করা উচিত যেন জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে না থেকে জনগণই ক্ষমতার প্রকৃত কেন্দ্রে থাকে। গণতন্ত্র আরো সুসংহত হোক এই আশা ব্যক্ত করে লেখাটি এখানেই শেষ করছি।

* Anarchism এর বাংলা অনুবাদ সবখানেই লেখা হয় নৈরাজ্যবাদ, তাই আমিও এটাই ব্যবহার করছি, যদিও আমার কাছে এই অনুবাদটি যথার্থ মনে হয় না। আমার মতে এর যথার্থ হতে পারে রাষ্ট্রহীনতাবাদ বা রাষ্ট্রহীনতন্ত্র, এই জাতীয় কিছু। কারণ Anarchy এর মানে আসলে হচ্ছে শাসকবিহীন (no ruler or absence of government)। নৈরাজ্য কেমন যেন নেগেটিভ অর্থ বহন করে।

** Polyarchy এর অনুবাদ গুগুল ডিকশনারি দেখায় বহুজন কর্তৃক শাসনব্যবস্থা বা বহুশাসনতন্ত্র। কিন্তু আমার কাছে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রকেই সঠিক বলে মনে হয়েছে এর চরিত্র দেখে। বহুজন শাসনতন্ত্র এক প্রকার গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্য। তাই আমি Ployarchy এর অনুবাদ বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করেছি।

নোটঃ এই লেখাটি “গণতন্ত্র ও এর সমালোচনা” (Democracy and its critics (Dahl R. A., 1989)) এই বইটির কিছু মূল অংশ নিজের মত করে লেখা।