বাঁধ বা ব্যারাজ এর ফলে কি হবে তা আমাদের সংসদীয় কমিটি অল্প বিস্তর জানেন বলেই আমার বিশ্বাস। IWM এর অপ্রকাশিত রিপোর্ট করা হয়েছে সরকারের নির্দেশে এবং সেটার রিপোর্ট একমাত্র সরকারের কাছেই আছে। তাছাড়া সংসদীয় কমিটিতে মনোয়ার স্যার আছেন যিনি নিজে একজন morphology বিশেষজ্ঞ। এ ছাড়া আরো অনেক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য এর মাঝেই বেশ কিছু পত্রিকায় এসেছে। সুতরাং বাঁধের প্রভাব আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কি হবে তা তাঁরা জানেন। কথা হল সমাধাণ বিশেষজ্ঞদের হাতে খুব বেশি নয়। সমাধাণ রাজনীতিবিদ বা দেশের নেতৃত্বের হাতে। তাঁরা যদি দেশের পরিণাম জেনেও কিছু না করতে চায় তবে আমাদের বিকল্প পথ চিন্তা করতে হবে। আমরা বরং বিকল্প গুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।
আমি যদি ধাঁপে ধাঁপে চিন্তা করি –
প্রথমতঃ ইন্ডিয়ার কাছে বিদ্যুতের জন্য বা বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ বিকল্প কোন পথ আছে কিনা সেটা বের করা।
দ্বিতীয়তঃ বিদ্যুতের জন্য আমাদের কোন বিকল্প আছে কিনা সেটা জানা। বা বাঁধ যদি দেওয়াই হয় তবে আমাদের বিকল্প বা করণীয় কি হতে পারে?
তৃতীয়তঃ আন্ত নদী গুলো সম্পর্কে দু'দেশের অবস্থান। তাঁরা সেঁচ করবেই কিনা বা ব্রম্মপুত্র হতেও পানি সরাবে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। মোট কথা এক সাথে সকল আন্ত নদী সম্পর্কে একটি চুক্তিতে আসা। সেই চুক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে তা ঠিক করা। আমরা একবার বরাক নিয়ে তারপর ব্রম্মপুত্র নিয়ে আন্দোলন করবো, এভাবে বারবার সময় নষ্ট করতে পারি না।
চতুর্থতঃ ইন্ডিয়া আমাদের কথা কেন শুনবে? ইন্ডিয়াকে কিভাবে আমাদের মতামত গ্রহন করানো / বা শুনানো যায় তার জন্য সম্ভাব্য পথ গুলো চিন্তা করা। তারপর ইন্ডিয়া যদি আমাদের কথা একদমই না মানতে চায় তবে আমাদের শেষ বিকল্প কি হতে পারে তা চিন্তা করা।
পঞ্চমতঃ আমাদের দেশের সরকার বা বিরোধী দল কি দেশের স্বার্থ দেখছে? যদি না দেখে তবে আমাদের কি করণীয়। এটা দুঃখজনক যে আমাদেরকেই আমাদের দেশের রাজনীতিবিদের বুঝানোর কথা চিন্তা করতে হচ্ছে।
আর কোন পয়েন্ট প্রয়োজন মনে করলে দয়া করে জানাবেন।
প্রথম পয়েন্টের জবাবে বলতে পারি ইন্ডিয়া আমেরিকার সাথে নিউক্লিয়ার এনার্জির চুক্তি করেছে বলে পেপারে দেখেছি, যেটা জাহিদের লেখায়ও এসেছে। যদি বিদ্যুতের সমাধাণ অন্যখাত হতে পাওয়া যায় তবে শুধু বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। জাহিদের লেখায় যেটা এসেছে বাঁধ সাময়িক ভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও, লং টার্মে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কারণ বাঁধের ফলে যে অতিরিক্ত ক্ষয় হবে তা আবার ভাটিতে জমে নদীর ভূমির তলদেশের উচ্চতা বাড়িয়ে দিবে। তখন আগে যে প্রবাহতে বন্যা হতো না, তাতেই এখন বন্যা হবে। মনে রাখতে হবে যে বন্যা অতিরিক্ত পানি প্রবাহের কারণে হয় না, হয় পানির উচ্চতার জন্য। নদীর তলদেশ উচ্চে উঠে আসার কারণে এখন অল্প প্রবাহেই পানির উচ্চতা আগের মতই হতে পারে এবং বন্যা হতে পারে। এ কারণেই এখন বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধের কথা না বলে বলা হয় বন্যার সাথে বসবাস উপযোগী ব্যবস্থা নেওয়াই হল সবচেয়ে উত্তম। যেমন উচ্চস্থানে বাড়ি করা বা বেশি পানি উপযোগী ধান বা উচু রাস্তা এবং রাস্তার মাঝে মাঝে কালভার্ট করা যেন বন্যার পানির প্রবাহ ঠিক থাকে, নদীর তলদেশ খনন করে নদীর প্রবাহশক্তি বাড়ানো, হাওর, বিল বা পুকুর খনন করে বন্যার পানি সংরক্ষন ইত্যাদি। যেটাকে আমরা বলি non-structural measure। তবে পরিবেশের ক্ষতি কম করে বাঁধ বানানো সম্ভব বলে আমার জানা নেই। যে কারণে আজ উন্নত বিশ্বে আর কোন নতুন বাঁধ তৈরির প্রকল্প হাতে নেয় না। ইউরোপ বা আমেরিকায় যত বাঁধ হয়েছে তা হয়েছে তখন যখন জলবিদ্যুত ভিন্ন অন্য কোন বিকল্প ছিল না।
দ্বিতীয় পয়েন্টের জবাবে বলতে পারি বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য বিকল্প হিসেবে সচলে বেশ কিছু লেখা এসেছে। নিউক্লিয়ার এনার্জির কথা আমরাও চিন্তা করতে পারি। নিউক্লিয়ার এনার্জির প্রধান সমস্যা প্রাথমিক বিনোয়গের অর্থ এবং নিউক্লিয়ার বর্জ্য। প্রয়োজন মনে করলে আমেরিকার সাথে আমরাও চুক্তি করতে পারি নিউক্লিয়ার এনার্জির জন্য। আমাদের দেশে বিদ্যুতের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে আমাদেরকে বিকপ্ল কিছু চিন্তা করতেই হবে। সবচেয়ে খারাপ যদি হয় যে আমরা কোনভাবেই ইন্ডিয়াকে বাঁধ করা থেকে বিরত রাখতে পারছি না তবে যেন মন্দের ভাল হিসেবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমরা স্বল্প দামে বিদ্যুত কিনতে পারি তার জন্য নেগোসিয়েশন করা যেতে পারে। আমি বলেছি এটা হতে পারে একদম শেষ বিকল্প, এখানে ভারত প্রেম কিংবা আমেরিকা প্রেম আবিষ্কারের চিন্তা আমাদের আলোচনাকে শুধু ভিন্ন পথেই প্রবাহিত করবে। বাঁধ যদি দেওয়াই হয় তবে বাঁধের প্রভাব কি হবে তার জন্য পর্যাপ্ত ও নির্দিষ্ট ডাটা নিয়ে two-dimensional hydrodynamic and morphological model দিয়ে দেখতে হবে আমাদের হাওড় গুলো এবং নদী গুলোর কি হবে। IWM যে স্টাডি করেছিল তা শুধু হাইড্রোলজিকাল এবং হাইড্রোডাইনামিকাল মডেল এবং তারও তথ্য কল্পনা করে। কোন মর্ফোলজিকাল এন্যালাইসিস করা হয়নি। কিন্ত মর্ফোলজিকাল মডেল চালানো খুবই জরুরী। মর্ফোলজিকাল মডেল এর মাধ্যমে জানা যাবে নদীর কোথায় কোথায় ভাংগতে পারে আর কোথায় পলি পড়তে পারে। যদি শহরের আশে পাশে ভাঙ্গনের প্রেডিকশন থাকে তবে শহর রক্ষা বাঁধের জন্য চিন্তা করতে হবে। যেখানে পলি জমবে সেখানে ড্রেজিং করতে হবে। দরকার হলে হাওর এর পানি প্রবাহের জন্য কৃত্রিম খাল খনন করা যেতে পারে। মোট কথা যদি বাঁধ দেওয়াই হয় সেটাকে মোকাবেলা করার জন্য এ ধরণের স্টাডি করতেই হবে। এবং সেটা প্রতি বছর করতে হবে যতদিন না নদী তার নতুন প্রবাহের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। এ ধরণের স্টাডি সরকার লুকিয়ে না করে IWM এবং বুয়েটের পানি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে করতে পারেন। এবং স্টাডি থেকে আমাদের ক্ষয় ক্ষতির একটি আনুমানিক আর্থিক হিসেব করা প্রয়োজনীয়। যদি ইন্ডিয়াকে বাঁধ বানানো থেকে বিরত না রাখা যায় তবে সে ক্ষেত্রে এসব ক্ষতি পূরণ আদায়ের জন্য নেগোসোশিয়েন করা যেতে পারে। এই সব করণীয়র প্রশ্ন আসবে তখনই যদি ইন্ডিয়া বাঁধ বানায়ই তবে।
তৃতীয় পয়েন্টের জবাবে আন্তনদী সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অবস্থান হচ্ছে আন্তঅর্জাতিক আইনে যা বলা আছে সে আলোকে দু’দেশের মধ্য সকল আন্তনদী নিয়ে চুক্তি করা বিশেষ প্রয়োজন। এবং সেটা এখন করাই সবচেয়ে উত্তম। এটা করার জন্য দু’দেশের সকল রাজনীতিবিদ দের নিয়ে করতে হবে কারণ চুক্তির মূল বিষয় থাকে সকল সরকারের সময় চুক্তির ধারাবাহিকতা। চুক্তি যেন অবশ্যই পাঁচ বা দশ বছর পর পর পর্যালোচনা করা হয় এবং তা নবায়ণ করা হয়।
চতুর্থ পয়েন্ট হল সবচেয়ে কঠিন আমার মতে। এ ব্যাপারে সকলের বাস্তব সম্মত মতামত কামনা করছি। এ ব্যাপারে আমার মতামত হল সময় এসেছে ইন্ডিয়াকে মেসেজ দেওয়া যে দেশের স্বার্থ বিরোধী কোন কিছু মেনে নেওয়ার দিন ফুঁরিয়ে গেছে। প্রথমত করণীয় সকল রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, পেশাজীবি, সুর্ব সাধারণের বিরোধ ভুলে দেখানো যে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছুতে জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকে। আমাদের মাঝের হাসিনা বা খালেদা, বাম বা ডান এই সব বিরোধের ফায়দা লুটে বহিরাশক্তিরা। একদিকে পাকি মারে অন্যদিকে ভারত মারে। মাঝখানে নিরীহ মানুষ মরে। আমি মনে করি বহিরাশক্তি যদি দেখে যে দেশ স্বার্থ বিরোধী যে কোন কিছুতে আমরা ঐক্যবদ্ধ তখন যে কোন কিছু করার আগে দু’বার ভাববে। সমস্যা হল রাজনীতিবিদদের সকলকে এক সুঁরে কথা বলাতে বাধ্য করা। এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেটার জন্যই আমার পঞ্চম পয়েন্টের অবতারণা। আশা করি আরো কিছু মতামত আসবে সকলের মন্তব্য হতে। আমরা কি হার্ড লাইনে যেতে পারি কিনা সেটাও আলোচনায় আসতে পারে। মনে রাখতে হবে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। সুতরাং আমরা আসলে কতটুকু করতে পারি সেটা আলোচনায় আসতে পারে। হার্ড লাইন সম্পর্কে আমার নিজের বক্তব্য হল ভাটির পনের কোটি মানুষকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলার কোন যুক্তি ইন্ডীয়ার থাকতে পারে না। এটা মানবিধাকারের চরম লঙ্ঘন। ফারাক্কার কারনে আজ দেশের একাংশ মরুভুমিতে পরিণত। এখন এই বাঁধ ও ফুলরতলের ব্যারাজের কারণে বাকি অংশও মরুভুমিতে পরিণত হবে। তারপর ব্রম্মপুত্র থেকে পানি সরালে এই পনের কোটি মানুষ এমনিতেই না খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরবে। আমাদেরকে যদি দেয়ালে পিঠ ঠেকাতে তারা বাধ্য করেই তবে আমাদেরও যুদ্ধ বিনা কোন গতি নেই। আমি বলছি না আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি, কিন্তু ইন্ডিয়াকে মেসেজ দেওয়া যে আমরা দেশের স্বার্থে সেটি চিন্তা করতে পিছপা হব না। এখন ইন্ডিয়ার ডিসিশন নেবার পালা তারা প্রতিবেশি দু’ই দেশের সাথে যুদ্ধে যাবার ঝুকি নিবে কি নিবে না। অনেকটা বল তাঁদের কোর্টে ঠেলে দিয়ে দেখা তারা কি করে। এই ব্যাপারে সকলের আরো সুচিন্তিত মতামত কামণা করছি। তবে হার্ড লাইনে যাবার আগে আর্ন্তজাতিক আদালতে যাবার বিকল্প আমাদের হাতে আছে, যদিও সেটা কতটুকু ফলপ্রসু হবে আমার ধারণা নেই।
সবশেষে, কিভাবে সরকারকে এবং বিরোধী দলকে এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদ বা সুশীল সমাজকে বাধ্য করা যায় জনগণের কথা শুনতে। জনগণের মেসেজটা কিভাবে সরকারের কানে প্রবেশ করা যায়। আমার মতে মিডিয়া চেষ্ট কছে, প্রতিটী ব্লগ মাধ্যম চেষ্টা করছে । বাম দল গুলো ও চেষ্টা করছে। সবাই বিচ্ছিন্ন ভাবে চিন্তা করছে এবং চেষ্টা করছে তাদের কথাগুলো বলার জন্য।
একবারেই সফলতা চলে আসবে এমন ভাবনা করিনা। কিন্তু নিজেকে তো বুঝাতে পারবো চেষ্টাতো করেছি। প্রথমত যেটা করতে পারি, এই আলোচনায় অংশগ্রহন করে নিজেদের মতামত দিতে পারি। আগামী এক মাসের বা দু’সপ্তাহের মাঝে আমরা সকলের মতামতের উপর ভিক্তি করে আমাদের দেশের কি কি করণীয় তার উপর একটি রিপোর্ট তৈরী করতে পারি। দ্বিতীয়ত যেটা করতে পারি আমরা একটি দিন ঠিক করতে পারি, যে দিন বিশ্বের প্রতিটি শহরে বাজ্ঞালীরা গ্রিনিচ সময়ে এক সাথে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পারি এবং সে দিন আমাদের রিপোর্টটি সংসদীয় কমিটি বা সরকারের কাছে ও সকল পত্রিকায় পৌঁছে দিতে পারি। সেটা দশ জনের হোক বা একশত জনের হোক। আমরা সবাই যার যার পক্ষ থেকে জনসংযোগ শুরু করতে পারি। আমরা সকল মিডিয়ার কাছে যেতে পারি সাহায্যের জন্য, সকল ব্লগের সাহায্য নিতে পারি। আমরা সকল রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, পেশাজীবি, সর্ব সাধারণ এর কাছে আমাদের বার্তা পৌছে দিতে পারি। দিনটি আজ থেকে এক মাস পর হলে ভাল হয়। এর মাঝে আমরা জনসংযোগ করতে পারি এবং আমাদের রিপোর্টটি প্রস্তুত করতে পারি। প্রবাসীদের কথা চিন্তা করে শনি বা রোববার করতে পারি। বাংলাদেশের সকল বিভাগে বা জেলায় করতে পারি।
আমার উদ্দেশ্য সকলের আলোচনা হতে একটি করণীয় ঠিক করা, যেটাকে আমরা সামনে রেখে এগোতে পারি। যে কোন কিছুতে নামার আগে সর্বপ্রথম লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। আসুন আমরা সকলে আগে সেই লক্ষ্যটি ঠিক করি, ঠিক করি আমরা আসলে কি চাই। দ্বিতীয়টি যদি আমাদের পক্ষে আয়োজন করা সম্ভব নাও হয় ক্ষতি নেই। আমরা রিপোর্টটি তৈরি করি এবং সেই রিপোর্ট আমরা সকল পত্রিকায় ও সরকারে কাছে এক সাথে তুলে দিব। তারপর দেশের জনগণ নিজেদের ভাগ্য বেছে নিক।
Thursday, August 13, 2009
Subscribe to:
Posts (Atom)