Friday, October 16, 2009

দেশ উন্নয়ন ভাবনা

ভুমিকাঃ

কোন নির্দিষ্ট নিয়ম বা নীতিমালা পালনের জন্য মানুষের সৃষ্টি হয়নি। মানুষের পালনের জন্য কিছু নীতিমালার সৃষ্টি হয়ে থাকে। তাই সকল নীতিকে আতসী কাচের নীচে রেখে যাচাই করতে হয় তা আদৌ মানুষের কল্যাণে কাজ করছে কিনা। পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ যে কোন নীতির পরিবর্তন তাই বাঞ্ছনীয়। নীতিকে অলঙ্ঘনীয় ধরে মানুষের পরিবর্তন কখনই কাম্য হতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে ব্যক্তি মানুষের, গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের আচরণ, সংস্কৃতি, ভাষার পরিবর্তন ঘটে থাকে। এই পরিবর্তন হলো অলঙ্ঘনীয়। তাই এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে চলার জন্য বাকী সকল কিছুকে পরিবর্তিত হতে হবে। কোন রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ যদি তাদের নীতিকে সময়ের সাথে উপযোগী না করে তুলে তবে তারা সময়ের তুলনায় পিছিয়ে থাকবে। যেটার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।

কোন দেশ কতটা উন্নত তার একটি নিয়ামক হচ্ছে সেই দেশের নীতি বা সংবিধান কতটা সময়োপযোগী সেটা দেখা। তারা সময়ের সাথে সাথে তাদের সংবিধানকে পরিবর্তন করছে কিনা, জনগণকে উন্নত সেবা প্রদানের জন্য। আমাদের দেশের সংবিধানকে, শাসন ব্যবস্থাকে একুশ শতকের উপযোগী করা এখন সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনামলের শাসন পদ্ধতি আমরা এখনো বহন করে চলছি যার ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রের প্রশাসকদের মাঝে এখনো পুরোনো জমিদারী আচরণ লক্ষ্য করা যায়, দেশকে পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে চিন্তা করার একটি মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়, যা কিনা কোন প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে হওয়া উচিত নয়।

প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা/কর্মচারীকে হত হবে জনগণের সেবক, শাসক নয়। আমাদের দেশে কোন পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের জবাবদিহিতার কোন ব্যবস্থা নেই। সময় এসেছে সেই নীতিমালার, যেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সরকারী/আধা-সরকারী/বেসরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। প্রতিটি সেবা প্রদানের জন্য সর্বোচ্চ সময় উল্লেখ থাকবে। প্রতিটি বিভাগে ভোক্তার অধিকার রক্ষার্থে আলাদা বিভাগ থাকবে যেখানে ভোক্তা তার সেবাটি উক্ত সময়ের মাঝে না পেলে নালিশ করতে পারবে।প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি নাগরিককে জানাতে হবে তার কতটুকু প্রাপ্য, যা না পেলে সে আইনি সাহায্য নিতে পারবে। রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে সেই ধরনের নীতিমালা প্রণয়নের জন্য। এভাবে রাষ্ট্র এবং জনগণের পরস্পরের মিথষ্ক্রিয়ার ফলে একটি দেশ এগিয়ে যাবে।

বলাই বাহুল্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোন শাসক গোষ্ঠীই জনগণের সেবা প্রদানের কোন প্রকার চিন্তা করেনি বরং সর্বক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। রাজনীতিবিদগণ বিশাল জনগোষ্ঠীর শিক্ষা-স্বল্পতার সুযোগ নিয়ে, ধর্ম-ভীরুতার সুযোগ নিয়ে, দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে ভোটের আগে ছলনার আশ্রয় নেয়। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজস্ব গোষ্ঠী এবং নিজের উন্নয়নে, আর জনগণ নিরুপায় হয়ে বারংবার ধর্ষিত হয়।

সময় এসেছে সমস্ত নীতিমালা পর্যালোচনা করে একুশ শতাব্দীর সমাজ গড়ে তোলবার। একটি অসাম্প্রদায়িক, মিশ্র অর্থনীতির, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার। দেশকে নিম্ন আয় হতে মধ্য আয়ের এবং সেখান হতে উন্নত আয়ের দেশে পরিণত করার। আপামর জনগণের মাথাপিছু আয় না বাড়াতে পারলে কোন লক্ষ্যেই আমরা পৌঁছতে পারবো না। এই দারিদ্রতার সাথেই কুশিক্ষা, মৌলবাদ, দুর্নীতি সকল কিছু সম্পর্কিত। একটি জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থাই কেবল পারে একটি দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তাই জনগণকেই সোচ্চার হতে হবে তাদের নিজেদের অধিকারের জন্য নীতিমালা প্রণয়নে রাষ্ট্রের শাসকদের বাধ্য করাতে।

সংবিধান ও গণতন্ত্র

রাষ্ট্র হিসেবে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রই সর্বাপেক্ষা উত্তম যেখানে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস হয়ে থাকে এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সকল প্রজাই সমান হয়ে থাকে। আর রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা বা সরকার পদ্ধতির জন্য গণতন্ত্রই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভাল পন্থা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মূলত দু’ধরণের। প্রথমটি হল - ডিরেক্ট বা সরাসরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যেখানে সকল প্রজা রাষ্ট্রের সকল স্বিদ্ধান্তে নিজের মতামত প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করবে। আর দ্বিতীয়টি হল- জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের সকল স্বিদ্ধান্ত গ্রহন ও প্রয়োগ করবে যা রিপ্রজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধিমুলক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। দু’পদ্ধতিরই ভাল এবং খারাপ দিক রয়েছে।

সরাসরি পদ্ধতির সবচেয়ে ভাল সুবিধে হল এর মাধ্যমে জনগণের সরাসরি চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অনেক সময় নির্বাচিত হয়ে জনগণকে উপেক্ষা করে সে ধরণের প্রতারনার সুযোগ থাকে না। আরো একটি বড় সুবিধে হল যেহেতু এই পদ্ধতিতে জনগণের সরাসরি মিথষ্ক্রি য়া থাকে তাই এতে বিপুল সংখ্যক জনগণের অংশগ্রহন হয়ে থাকে যা একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য খুবই প্রয়োজনীয় অংশ।

এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় অসুবিধে হল একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি স্বিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই মিথষ্ক্রি য়ার আয়োজন সময় ও অর্থ সাপেক্ষ ব্যাপার। এ কারণে এই ধরণের পদ্ধতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী – যেমন সচলায়তন – এর ক্ষেত্রে উপযোগী। বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তাই নির্বাচিত প্রতিনিধিমুলক পদ্ধতিই উপযোগী হয়ে থাকে। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে সরাসরি পদ্ধতির বা গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত সর্বোত্তম পদ্ধতি হলেও এই পদ্ধতিও ত্রুটিমুক্ত নয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ত্রুটিগুলো প্রকান্তরে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিরও ত্রুটি। সরাসরি বা নির্বাচিত যে পদ্ধতিই হোক না কেন গণতন্ত্রের একটি প্রধান সমস্যা হল “বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শাসন”। যদিও গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মতামত জানা, কিন্তু ক্ষুদ্র অংশের মতামতকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। যদি সেই মতামতকে উপেক্ষা করা হয় তবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীটি সর্ব সময় শোষিত হয়ে চলবে যা কোন সমাজের জন্যও ভাল ফল বয়ে আনবে না। এখানেই মানবতার প্রশ্নটি চলে আসে এবং এ কারণেই আসে সংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা। সংবিধান এমন একটি ব্যবস্থা যা ব্যক্তি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিৎ করার জন্য চেষ্টা করে। অন্য ভাবে বলা যায় ক্ষুদ্র অংশকে রক্ষা করে বৃহতৎ অংশের শোষন হতে। রক্ষা করে দুর্বলকে সবলের হাত হতে। রক্ষা করে নারী ও শিশুকে, রক্ষা করে লঘু সম্প্রদায়কে, রক্ষা করে মুক্ত চিন্তাকে, রক্ষা করে দরিদ্রকে।

নির্বাচিত প্রতিনিধিমুলক পদ্ধতির একটি অসুবিধে হচ্ছে সব সময় সঠিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না। অনেক সময় সঠিক জনপ্রতিনিধি পাওয়া যায় না বা অনেক সময় জনগণ সঠিক প্রতিনিধি খুঁজে পেতে ভুল করে। তাই সংবিধানের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাকে সীমিত করে রাখা যেন তাঁর কখনই নিজেদেরকে জনগণের চেয়ে ক্ষমতাশালী বলে ভাবতে না পারে। সুতরাং বলা যায় সংবিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল ব্যক্তির মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণের ক্ষমতাকেও নিশ্চিত করা। যদি আমরা সংবিধানের এই উদ্দেশ্যগুলো পরিষ্কার করে বুঝতে পারি তবেই বুঝবো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কেমনতর সংবিধান প্রয়োজন।

সংবিধান ও সরকার পদ্ধতি

সংবিধানের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের জবাবদিহীতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিতকরণ। একটি গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতির মূল ক্ষমতার উৎস তিনটিঃ নির্বাহী বিভাগ, আইন প্রণয়ন বিভাগ বা সংসদ ও বিচার বিভাগ। এই তিন বিভাগের স্বাধীনতা, পরষ্পরের মিথষ্ক্রি য়ায় তাদের মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্যের উপরই নির্ভর করে প্রকৃত গণতন্ত্রের ভবিষ্যত। অধুনা আরো কয়েকটি বিভাগের স্বাধীনতাও সুষ্ঠ গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় বলে ধরা হয়। এগুলো হলঃ দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন এবং প্রচার মাধ্যম।

সরকার পদ্ধতির মধ্যে বহুল প্রচলিত পদ্ধতিটি হচ্ছে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি যেখানে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের প্রধান হয়ে থাকেন একই ব্যক্তি, যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে থাকেন যারা সরকারের নির্বাহী কাজ পরিচালনা করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীরা কেবল মাত্র সংসদের কাছে জবাবদিহী হয়ে থাকেন। সংসদ চাইলে যেকোন সময় অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে সরকার ভেঙ্গে দিতে পারেন। এই পদ্ধতির প্রধান সুবিধে হল একই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ নির্বাহী এবং সংসদের সদস্য হওয়ায় সরকার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন সহজেই প্রণয়ন করতে পারেন, যা প্রকান্তরে প্রশাসনে গতিশীলতা আনে। কিন্তু একই ব্যক্তি আইন প্রণয়নকারী এবং প্রয়োগকারী হওয়ায় আইনের অপব্যবহার বা কাল-আইনের প্রণয়নের সম্ভাবনা থেকে যায়। এই সরকার পদ্ধতির দ্বিতীয় অসুবিধেটি হল,সরকারের অনিশ্চিত স্থায়ীত্ব বা মেয়াদকাল। যেহেতু যেকোন মুহুর্তে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে সরকারের পতন সম্ভব তাই সরকার প্রধানকে সব সময় নিজ দলের এবং বিরোধী দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সন্তুষ্ট রেখেই সরকার চালাতে হয়। সরকার প্রধানের নিজ দলের মতের বিরুদ্ধে যেয়ে নিজ চিন্তার প্রতিফলন অনেক সময় সম্ভব হয় না। যদিও এর মাধ্যমে সরকারের নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়, তারপরেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারের মাঝে দলীয় আনুগত্য প্রকাশ পেয়ে যায়। ঠিক সেরকম ভাবে দলীয়ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও দলের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের চিন্তার প্রতফলন ঘটান না বেশিরভাগ সময়ই। এটি আরো খারাপ আকার ধারন করে যখন দলীয় পর্যায়েও গণতন্ত্রের অভাব থাকে তখন সরকার পরিচালনায় ব্যক্তিকেন্দ্রীকতা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে এই কথাটি বিশেষভাবে পরীক্ষিত।

দ্বিতীয় সরকার পদ্ধতিটি হল প্রেসিডেন্সিয়াল বা রাষ্ট্রপ্রধান সরকার পদ্ধতি, যেখানে সরকার প্রধান সরাসরি জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধে হলো রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ আইন প্রনয়ন বিভাগ বা সংসদ হতে পৃথক থাকে। নির্বাহী বিভাগ সরকার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের জন্য সংসদে পাঠান এবং সংসদ সেই আইন পর্যালোচনা করে তা আইন হিসেবে পাশ করেন। রাষ্ট্রপ্রধানেরও সংসদের পাশ করা কোন আইনের উপর ভেটো দেওয়ার অধিকার থাকে যা আবার সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে রহিত করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে গতিশীলতা কিছুটা বাধাগ্রস্থ হলেও গণতন্ত্রের জন্য তা ভাল। এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ এক অপরের উপর নির্ভরশীল এবং এর মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা যায়। আরো একটি সুবিধে পাওয়া যায় তা হল সরকারের নিশ্চিত স্থায়ীত্ব। যেহেতু রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের ভোটে নির্বাচিত তাই সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে। আবার নির্বাচিত হবার পর দলীয় আনুগত্য প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা না থাকায় রাষ্ট্রপ্রধান নিজের চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারেন। সরকারের মেয়াদ শেষে জনগণের কাছে ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপ্রধানের মূল্যায়ন হয় বিধায় জনগণের জন্য কাজ করার চেষ্টা থাকবে বেশি।

আগেই বলেছি যে সরকারের মাঝে যত বেশি জবাবদিহীতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে জনগণের অধিকারও তত বেশি নিশ্চিত হবে। সেই জন্যই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা গনতান্ত্রিক সরকারের কাঠামো তিনটির অন্যতম একটি অংশ। বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের সমান্তরাল একটি স্বাধীন বিভাগ। একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করে আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান ভাবে হচ্ছে কিনা এবং সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়ন হচ্ছে কিনা। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যদি দেখি তবে দেখতে পাই যে আমরা এখনো গণতন্ত্রের এই মৌলিক অংশটিই নিশ্চিত করতে পারিনি। যেখানে স্বাধীন বিচার বিভাগই নেই সেখানে গণতন্ত্রের কোন সুফল আশা করা বৃথা। স্বাধীন বিচার বিভাগের পর পরই আসবে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। বেশিরভাগ দেশেই এই পাঁচটি স্বাধীন বিভাগকে ধরা হয় গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো হিসেবে। আরো উন্নত দেশে প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতার উপরও জোর দেওয়া হয় কারণ সেখানে জনগণের সরাসরি মতামত প্রতিফলিত হয়। আর আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে আমি পুলিশ বিভাগকেও স্বাধীন হিসেবে প্রয়োজন বলে মনে করি। অন্তত স্বাধীন না হলেও নির্বাহী বিভাগ হতে পৃথক করে স্বাধীন বিচার বিভাগে দেওয়া যেতে পারে।

সরকারের বাড়তি কিছু জবাবদিহীতার জন্য সংসদকে দু’কক্ষ বিশিষ্ট করা যাতে পারে। নিম্ন কক্ষ বর্তমান সংসদের মতই থাকতে পারে। অর্থ সংশ্লিষ্ট যেকোন কিছুর ব্যাপারে নিম্ন কক্ষের স্বিদ্ধান্তই চুড়ান্ত হতে পারে। তবে উচ্চ কক্ষ মনে করলে সেটা রহিত করতে পারে। উচ্চকক্ষ আইন প্রণয়ন এবং সংবিধানের সংশোধন এর ব্যাপারে স্বিদ্ধান্ত নিবেন। উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিদের জন্য স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। নিম্ন কক্ষে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারে। তবে উচ্চ কক্ষের প্রতিনিধি বাছাই এর ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা অবলম্বন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন জেলা, বিভিন্ন গোত্র, বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন পেশাজীবি, বিভিন্ন শ্রেনী ও লিঙ্গ ভেদে প্রতিনিধি বাছাই করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে সকল গোষ্ঠীর মতামত প্রতিফলিত হবে যা একটি প্রজাতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয়। সর্বশেষ কাঠামোটি হচ্ছে, সরকার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ। রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করে প্রতিটি প্রদেশে দু’কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ এবং নির্বাচিত প্রদেশিক প্রধান এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগকে আলাদা করা হলে সরকারের মাঝে গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে।

এই সমস্ত কিছু আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে এক ধাপেই অর্জন করা সম্ভবপর নয়। তাই আমাদের দেশের জন্য সর্ব প্রথম প্রয়োজন বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী বিভাগ হতে মূক্ত করা। এর মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার হ্রাস সম্ভবপর হবে এবং আইনের প্রয়োগ সমানভাবে সম্ভবপর হবে। শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন পারে দলীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে, যেন একই ব্যক্তি আজীবন দলীয় প্রধানের পদ অলংকৃত করে না রাখতে পারেন। সর্বোপরি প্রয়োজন একটি নুতন গণতান্ত্রিক দল, যারা জনগণের কাছে তুলে ধরবে সরকার পদ্ধতির পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা।


সংবিধান ও ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি

একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল প্রজা রাষ্ট্রের চোখে সমান। সেখানে কোন ধর্ম বিভেদ, ভাষা বিভেদ, অঞ্চল বিভেদ বা জাতি বিভেদ থাকতে পারে না। এটাই প্রজাতন্ত্রের মূল মন্ত্র। মুসলিম, হিন্দু, খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের যেমন রয়েছে ধর্ম পালনের অধিকার, তেমনি রয়েছে অধার্মিকদের কোন ধর্ম না পালনের। একজন মানুষের যেমন শুদ্ধ বাংলা বলার অধিকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে আরেকজনের আঞ্চলিক ভাষা বা আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের। প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতি, রীতি নীতি পালনের অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের যেমন ব্যক্তি পর্যায়ের মানুষের ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রনের অধিকার নেই তেমনি রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতি থাকাও উচিত নয়।

রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ, ভাষা নিরপেক্ষ এবং সংস্কৃতি নিরপেক্ষ। সংবিধানে সেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্যে সচেষ্ট হতে হবে। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে সকল ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা জ্ঞাপন নয় এবং রাষ্ট্রের পক্ষে সকল ধর্মের সমান মর্যাদা প্রদানও সম্ভব নয়। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে বুঝায় রাষ্ট্রের ধর্মহীনতা। রাষ্ট্রের কোন নিজস্ব ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্র যেমন নাস্তিকতায় মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করবে না তেমনি রাষ্ট্র অন্য ধর্ম পালনেও বিরত থাকবে। ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষ যেকোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশেষ কোন ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে নিতে পারে না।

ধর্মের মত সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রকে বিরত থাকা উচিত। নজরুল না রবীন্দ্রনাথ – কে হবেন আমাদের দেশের কবি এই জাতীয় তর্কের রাষ্ট্রের যাওয়া উচিত নয়। এখানেও ব্যক্তি পর্যায়ে বা বেসরকারী পর্যায়ে যে যার মত নজরুল, রবীন্দ্র, লালন জয়ন্তী করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাইকে সমান ভাবে মর্যাদা দেওয়া সম্ভবপর নয়। এবং এইসব কারণেই জাতিতে বিভক্তি আসে। ইংরেজী, না আরবী, না বাংলা নববর্ষ উৎযাপন করা হবে এই ধরণের বিষয়ে রাষ্ট্রের নাক না গলিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। একই কথা প্রযোজ্য খেলাধুলার উপর। ফুটবল না ক্রিকেট না হাডুডু- কোন খেলায় রাষ্ট্র অগ্রাধিকার দিবে, না সকল খেলায় সমান ভাবে বা আনুপাতিক হারে সাহায্য করবে এই সব রাষ্ট্রের চিন্তা হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্র যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকারই নিশ্চিত করতে পারছে না সেখানে এই সব ব্যপারে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। এর ফলে সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়, ধর্ম মন্ত্রনালয়, ক্রীড়া মন্ত্রনালয় এর মত মন্ত্রনালয়গুলোতে জনগণের ট্যাক্সের টাকা নষ্ট হবার হাত হতে রক্ষা পাবে।

ভাষার ব্যাপারটি কিছুটা ভিন্ন , ধর্ম বা সংস্কৃতির তুলনায়। রাষ্টের ধর্ম বা সংস্কৃতির প্রয়োজন না থাকলেও যোগাযোগের মাধ্যমের জন্য কোন না কোন একটি ভাষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বাংলাদেশের সৃষ্টিতে ভাষা এবং ভাষাশহীদদের অবদানের কথা বিবেচনা করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রের ব্যবহারের জন্য প্রথম পছন্দ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে সকল ভাষার সমান অধিকার নিশ্চিত হয় না। এ কারণে অঞ্চলভেদে যারা যার আঞ্চলিক ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। সবশেষে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজী ভাষাকে তৃতীয় পছন্দ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। এভাবে জনগণের সামনে তিনটি বিকল্পের যেকোন একটি বেছে নেবার সুযোগ থাকে।

অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন তা নয়, বিশেষ করে সংস্কৃতির ব্যাপারে। কারণ এতে দেশীয় সংস্কৃতি বা দেশীয় খেলাধুলা বা আমাদের ভাষা ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তবে আমার মতে পরিবর্তন বা বিবর্তন যদি হয়ই , তা সময়ের প্রয়োজনেই হয় এবং সেই পরিবর্তন আমি বা আপনি অস্বীকার করতে পারি কিন্তু ঠেকাতে পারবো না।

সংবিধান ও শিক্ষা

মানুষ পুরোপুরি ব্লাঙ্ক স্লেট হয়ে জন্ম না নিলেও, সুন্দর পরিবেশ এবং সঠিক শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে একটি শিশুকে মুক্ত চিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ কারণে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম একটি উন্নত জাতি গঠনের জন্য। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মাঝে শিক্ষা অন্যতম এবং প্রতিটি মানুষের শিক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। জাতির এক অংশকে শিক্ষার আলো হতে বঞ্চিত রেখে কোন জাতির পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। জনগণের করের অর্থ যদি সর্বপ্রথম কোথাও ব্যবহৃত হতে হয় তবে আমি শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিব। আমাদের সংবিধানেও সকলের জন্য শিক্ষার কথা বলা হয়েছে এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ এ, সকলের জন্য শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

বৈষম্যহীন শিক্ষার জন্য প্রথমত যেটা প্রয়োজন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত অভিন্ন পাঠ্যসুচি প্রণয়ন করা। শিশুর জন্মলগ্ন থেকেই যদি তাকে বাংলা, ইংরেজী, ও আরবী মাধ্যমে বিভক্ত করে ফেলি তাহলে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি কি করে? তারপর যেটা প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারী এবং শহর ও গ্রাম ভিক্তিক শিক্ষার বিভাজন দূর করা। উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক হওয়া উচিত। তবে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশুনা নিখরচার হওয়ার প্রয়োজন নেই এবং প্রয়োজনে সরকার বিনা সুদে বা অল্প সুদে ঋন দিতে পারে। কারিগরী শিক্ষার জন্য সরকার অর্ধেক ঋন এবং অর্ধেক বৃত্তি হিসেবে দিতে পারে। বিদেশ গমন কারীদের জন্য মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিকের পরে ছয়মাস বা এক বছরের কারিগরী ও ভাষার প্রশিক্ষন দেওয়া যেতে পারে। যে কোন চাকুরীর ক্ষেত্রেই মাধ্যমিকের নীচে চাইতে পারবে না এমন নিয়ম করা উচিত। প্রতিবন্দ্বী শিশুদের জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে বা প্রতিটি জেলায় তাঁদের জন্য আলাদা বিভাগ বা বিদ্যালয় রাখা উচিত। এবং দরিদ্র শিশুদের পরিবারের জন্য বৃত্তি প্রদান করা উচিত।

স্নাতক পর্যায় নিয়ে খুব বেশি না বলে স্নাতকোত্তর পর্যায় নিয়ে বলছি। একটি দেশের উন্নতির জন্য খুব প্রয়োজন নিজ দেশের উপযোগী প্রযুক্তি এবং যার জন্য প্রয়োজন গবেষনা। গবেষনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য এই খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বাড়ানো উচিত এবং স্নাতকোত্তর কোন ছাত্র যেন গবেষনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারে তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সকলের স্নাতকোত্তর শিক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধু মাত্র যারা শিক্ষকতা এবং গবেষনায় আগ্রহী হবে তাদেরকেই স্নাতকোত্তর শিক্ষায় ভর্তির সুযোগ দেওয়া উচিত।

সবশেষে ভাল শিক্ষার প্রথম শর্ত হচ্ছে ভাল শিক্ষক। দেশের মেধাবীদের শিক্ষকতার পেশায় আনার জন্য শিক্ষকদের প্রতিটি স্তরে ভাল বেতন প্রদান প্রয়োজনীয়। একজন শিক্ষক যদি জীবন সংগ্রামে নিজেই নৈতিকতার পথ পরিহার করেন, তবে তিনি কি করে অন্যকে শিক্ষা দিবেন। আমরা যতদিন পর্যন্ত শিক্ষককে সম্মানিত না করবো, ততদিন আসলে কোন সংস্কার বা শিক্ষানীতিই কাজে আসবে না। উন্নত শিক্ষক তৈরীর জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষন ব্যবস্থার প্রয়োজন। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটিকে আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা খুব সহজেই ডিজিটাল পাঠ্য পুস্তক, মাল্টিমিডিয়া লেকচার, অনলাইন গ্রন্থাগার তৈরী করতে পারি। নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির সাহায্যে দূর-শিক্ষন পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে দূর-শিক্ষন পদ্ধতি আমি শুধু মাত্র উচ্চ শিক্ষা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করবো। আমাদের দেশের বিপুল জনসংখ্যার বিচারে চাইবো যত বেশি মানুষকে কাজে লাগানো যায়। তবে অবকাঠামো তৈরী করে রাখা যায়, যেন প্রয়োজনে দূর-শিক্ষনের সাহায্য নিতে পারে যে কেউ।


এ ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক নীতির প্রশ্ন চলে আসেঃ

প্রথমত - শিক্ষা দান পদ্ধতি। মূলত আমাদের দেশের শিক্ষা প্রদান পদ্ধতি এবং পরীক্ষন পদ্ধতি যেটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে সেটা মধ্যযুগীয় পদ্ধতি। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষককেরাই শিক্ষা দেওয়া বলতে বুঝায় একটি নির্দিষ্ট বই শুধু পড়ে যাওয়া। যদি শুধু বই এর একটি অংশ পড়তেই হয় তবে তার জন্য শিক্ষকের কি প্রয়োজন, সেটা একজন ছাত্র নিজেই তা করতে পারে। আর পরীক্ষন পদ্ধতিতে এখনো বিচার হয় কে কত বেশি মুখস্থ করতে পারে তা। প্রয়োজন একজন ছাত্র/ছাত্রী বিষয়টুকু কতটুকু বুঝতে পেরেছে সেটি। তার জন্য শিক্ষা প্রদান ও পরীক্ষণ পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজন। তবে এটি সর্বাগ্রে বুঝতে হবে একজন শিক্ষককে।

এই শিক্ষা পদ্ধতির জন্য আমি প্রতিটি বিষয়কে তাত্বিক ও ব্যবহারিক ক্লাসে ভাগ করতে চাই। প্রতিটি বিষয়ে ৩০ মিনিট লেকচারের জন্য থাকবে আর এক ঘন্টা থাকবে ব্যবহারিকের জন্য। লেকচার ও ব্যবহারিক ক্লাস এমন ভাবে সমন্নয় করতে হবে যেন শিক্ষক বুঝতে পারেন তিনি যা দিতে চেয়েছেন তা ছাত্ররা বুঝতে পেরেছে কিনা আর ছাত্র/ছাত্রীরাও বুঝতে পারে শিক্ষক যা বুঝিয়েছেন তা তাঁরা বুঝেছে কিনা। ব্যবহারিক ক্লাসের শেষ দশ বা পনের মিনিটে শিক্ষক ছোট্ট কুইজ নিতে পারেন, যার মাধ্যমে ছাত্ররা কতটুকু বুঝতে পারলো তার একটি পরিমাপও হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে ছাত্রটির ক্লাসেই পড়া হয়ে গেল এবং তাঁর বাসায় গিয়ে আরো বেশি পড়ার প্রয়োজন পড়বে না। সমাপনী পরীক্ষায় শতকরা ৩০ বা ৪০ ভাগের বেশি নম্বর রাখা উচিত নয়।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল পাঠ্যসূচি। কি কি বিষয় পড়ানো উচিত? মৌলিক বিষয় হিসেবে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর নিম্ন বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। উচ্চ-মাধ্যমিক শেষে একজন ছাত্র/ছাত্রী যেন এই মূল বিষয়গুলোর প্রাথমিক পর্যায়ের জ্ঞানগুলো অল্প বিস্তর জানে সেটা আমাদের নিশ্চিত করা উচিত।

ভাষাঃ বাংলা, ইংরেজী, ঐচ্ছিক বিষয়ঃ আঞ্চলিক বাংলা ভাষা, আদিবাসী ভাষা, আরবী ভাষা।
বিজ্ঞানঃ পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, চিকিতসা বিজ্ঞান, জ্যোতির বিজ্ঞান।
গণিতঃ পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতিসহ সকল ধরনের প্রাথমিক গণিত।
সমাজঃ সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, আইন।
ইতিহাসঃ বাংলাদেশের ইতিহাস, উপমহাদেশের ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, সাধারণ জ্ঞান, সম-সাময়িক ঘটনা।
প্রযুক্তিঃ কম্পিউটার প্রযুক্তি, অন্তর্জাল।
সাংস্কৃতিকঃ চিত্র কলা, সঙ্গীত, নাটক, লেখালেখি, বিতর্ক ইত্যাদি।
শারীরিকঃ ড্রিল, খেলাধুলা, সাতার, ভ্রমণ, স্কাউট।
নৈতিকতাঃ সেইফটি জ্ঞান, ধর্ম, দর্শন ।


সবশেষে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯:

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ এর খসড়াতে বেশ কিছু ভাল প্রস্তাব উঠে এসেছে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়েছে এবং সকলের ক্ষেত্রে অভিন্ন পাঠ্য সূচি রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং তা অবৈতনিক রাখা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তর ধরা হয়েছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত। বাস্তবতার বিবেচনায় আমি বলব প্রাথমিক শিক্ষাকে বর্ধিত করা এবং সে পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক রাখা ঠিক আছে। তারপরেও আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে সবাই যেন মাধ্যমিক স্তর শেষ করে। ২০১১-১২ এর মাঝে ১০০ ভাগ শিশুকে শিক্ষার তলে আনার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবন্দ্বী শিশুদের জন্য বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দরিদ্র শিশুদের জন্য উপবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। মুখস্থ বিদ্যা থেকে সরে এসে সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সার্বিকভাবে যেসব প্রস্তাব এসেছে সেগুলো বাস্তাবয়ন করা গেলে শিক্ষার মান অনেকাংশে বাড়বে বলে আমার ধারণা। তবে একটি বিষয় না বললেই নয় তা হল -বলা হয়েছে সাংবিধানিক সেকুলার নীতির কথা। কিন্তু আমাদের বর্তমান সংবিধান সেকুলার নয়। সে ক্ষেত্রে এই নীতি প্রনয়নের আগে সংবিধানের পরিবর্তন বাঞ্চনীয়। আবার সেকুলারের কথা বলেও নৈতিক শিক্ষার জন্য যার যার ধর্মের মাঝেই ফিরে যাই। এখানে একজন ছাত্র/ছাত্রী শুধু তাঁর নিজের ধর্ম পড়বে নাকি যে মূল চারটি ধর্মের কথা বলা হয়েছে সব গুলোই পড়বে তা পরিষ্কার করা হয়নি। যদিও সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদান মানেই সেকুলার নয়, তারপরেও নিদেন পক্ষে সকল ধর্ম সম্পর্কে জানলেও একজন মানুষ ধর্মের মূল সুরটি ধরতে পারবে বলে মনে হয়। তাই বৈষম্যহীন শিক্ষা দিতে হলে সকল ধর্মই প্রতিটি ছাত্র/ছাত্রীর পড়া উচিত।

সবশেষে নীতি কি করা হল সেটার চেয়ে মুখ্য বিষয় হল নীতির কতটুকু গ্রহন করার জন্য আমরা আন্তরিক। আমরা যদি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি নাই করতে পারি তবে আমাদের সকল সংস্কারই ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই মুক্ত চিন্তার জাতি গঠনের জন্য সবার আগে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করতে হবে।

সংবিধান ও স্বাস্থ্যসেবা

শিক্ষার পর মৌলিক যে চাহিদাটি মানুষের প্রয়োজন তা হল স্বাস্থ্যসেবা। আমি সুস্থ আছি সেটা যে কত বড় নিয়ামক সেটা আমরা অসুস্থ হবার আগ পর্যন্ত বুঝিনা। বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতির পরও এখনো অনেক রোগই রয়ে গেছে আমাদের চিকিৎসার বাহিরে। তাই মৃত্যুকে আমরা জয় করতে পারিনি এখনো। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পরিবারের যখন কেউ অসুস্থ হয়ে পরে তখন সেই মানুষটির সুস্থতার জন্য পরিবারের সদস্যরা সর্বপ্রকার চেষ্টাই করে। এটাই মানবের স্বাভাবিক ধর্ম।

একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল মানুষের সমান চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। শুধু মাত্র অর্থের অভাবে কোন প্রাণ বিনা চিকিৎসায় ধীরে ধীরে মৃত্যুকে বরণ করবে সেটা হতে পারে না। তাই সকলের সমান স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দায়ভার রাষ্ট্রের। এমন একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিতে হবে যেন সকল চিকিৎসা কেন্দ্র গুলোতে, তা রাষ্ট্র পরিচালিত হোক বা ব্যক্তিগত ভাবে পরিচালিত হোক, জনগণ সমান স্বাস্থ্যসেবা পায়। তার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।

একটি কেন্দ্রীয় ভাবে পরিচালিত বীমা এই কাজে সাহায্য করতে পারে। ব্যবস্থাটি এমন হবে যে সকল জনগণ তার স্বাস্থ্য সেবার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রকে প্রতি মাসে প্রদান করবে। যদি কোন মাসে সে অসুস্থ হয় তবে তিনি সরাসরি যেকোন ডাক্তার এর কাছে যাবেন এবং চিকিৎসার জন্য যা যা প্রয়োজনীয় তা তিনি করবেন। এর সকল খরচ রাষ্ট্র সরাসরি উক্ত চিকিৎসা কেন্দ্রকে প্রদান করবে। এই বীমা ব্যবস্থা পরিসংখ্যানের কিছু নিয়ম মেনে চলে। ধরা হয় যে, প্রতি মাসে দেশের সকল জনগণ একত্রে অসুস্থ হয়ে পড়বে না। কিন্তু যেহেতু সবাই প্রতি মাসে তাঁদের কিস্তি প্রদান করে থাকে, তাই যারা অসুস্থ হয়নি তাঁদের টাকা দিয়ে অসুস্থদের চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব। এখন, আপনি নিজেও যদি কোন এক সময় কঠিন অসুস্থ হোন, আপনিও চিকিৎসা পাবেন। ব্যাপারটি অনেকটা নিজের ভবিষ্যতের অসুস্থতার কথা চিন্তা করে সব সময় অল্প অল্প করে অর্থ সঞ্চয় করে রাখা।

তবে এরকম একটি ব্যবস্থা রাতারাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও নীতিমালার প্রয়োজন। একটি সমন্বিত তথ্যকেন্দ্র থাকতে হবে যেখানে প্রতিটি নাগরিকের তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। পুরো স্বাস্থ্যসেবাকে একটি কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কের মাঝে নিয়ে আসতে হবে। দূর-চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শুরুতে আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য কিছু বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোকই দরিদ্র, যাদের প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেওয়া সম্ভব হবে না আবার বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে সবসময় ভর্তুকি দিয়েও রাষ্ট্র চলতে পারবে না। এই সমস্যা আমাদের সর্ব ক্ষেত্রেই থাকবে। এ কারণে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় না বাড়িয়ে সত্যিকার অর্থে কিছু করা কষ্টকর হবে। তাই অর্থনীতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

সংবিধান ও অর্থনীতি

মানুষের বাকী মৌলিক চাহিদা গুলো হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান। এই সবগুলো সরাসরি জীবিকার সাথে সম্পর্কিত। এক কথায় বলা যায় একজন মানুষ চায় তাঁর একটি জীবিকা অর্জনের পথ থাকবে যা দিয়ে সে তাঁর এই মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে। মানুষ আসলে কি খুব বেশি কামনা করে? সে চায় সমাজে তাঁর জন্য একটি কাজ থাকবে, যে কাজ দিয়ে সে তাঁর সংসারটিকে সুন্দর ভাবে চালাতে পারবে। পরিবারের সকল সদস্যের মাঝে খাবার তুলে দিতে পারবে। সন্তানদের শিক্ষার আলো দিতে পারবে। পরিবারের কোন সদস্য অসুস্থ হলে তাকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবে। পরিশেষে নিজে যখন কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে, তখন তাঁর সন্তান বা রাষ্ট্র তাঁর দেখাশুনা করবে।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি একটি জটিল ব্যবস্থা। আমরা আজ একটি জটিল ধাঁধার মাঝে আছি। সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী একজোট হয়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় মানুষকে শোষণ করে। আবার সম্পূর্ণ সমবায় ব্যবস্থায় কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজের শ্রম ব্যয় না করে সমবায় ব্যবস্থার সুবিধে নিয়ে অর্থনীতির চাকাকে স্থবির করে দেয়। এখন এই দুই দ্বন্দের মুক্তি হল মিশ্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কিন্তু ঠিক কতটুকু সমবায় আর কতটুকু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা একটি গতিশীল অর্থনীতির জন্য প্রযোজ্য সেটা বের করাই আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য।

সমাজে বিভাজন নেই সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। সমাজে অধিক কর্মক্ষম ব্যক্তি আছে আবার কম কর্মক্ষম ব্যক্তি আছে, অধিক মেধাবী আছে আবার কম মেধাবী আছে, অধিক বয়সী বা অভিজ্ঞ ব্যক্তি আছে আবার কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি আছে, কারিগরী ও প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি আছে আবার নন-ঢেঁকি ব্যক্তি আছে। সুতরাং বিভাজন কিছুটা থাকবেই। তবে বিভিন্ন পেশাবিদদের বেতন স্কেল ভিন্ন না করে অভিন্ন করার পক্ষপাতিত্বে আমি। বেতন স্কেলের বিভাজন কেবল মাত্র হবে কর্মক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও মেধার ভিত্তিতে।

অর্থনীতিকে সবল করতে হলে দেশের আমদানি ও রপ্তানীর মাঝে ভারসাম্য থাকতে হবে। আমদানীকে কমিয়ে রপ্তানী যত বাড়ানো যাবে তত অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। এখন আমদানী কমানোর অনন্য উপায় হচ্ছে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো। সর্বক্ষেত্রে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করা। তার জন্য প্রয়োজন দেশীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো যা বিশ্ববদ্যালয়গুলোতে গবেষনার মাধ্যমে হতে পারে। দেশীয় প্রয়োজন মেটানোর পর, উদ্বৃত্ত দেশের বাহিরে রপ্তানী করা। আমরা যদি কোন পণ্য রপ্তানী নাও করতে পারে, শুধু জনসম্পদ রপ্তানী করেই প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।

রাষ্ট্রের যদি কোন খাতে বিনিয়োগ করতে হয় তবে বিনিয়োগ করা উচিত দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য। মানুষকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া উচিত দেশীয় কল-কারখানা গড়ার জন্য। বিনিয়োগ করা উচিত জনসম্পদ রপ্তানী খাতে। মানুষকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া উচিত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের জন্য এবং বিদেশ গমণের ব্যয়ভার বহনের জন্য। বিনিয়োগ করা উচিত তথ্য প্রযুক্তিতে। দেশের সকল জনগণের জন্য একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা উচিত। দেশের সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে একটি নেটওয়ার্কের মাঝে নিয়ে আসা উচিত। সকল সরকারী/বেসরকারি কর্মকাণ্ড অন্তর্জাল ও মোবাইল এর আওয়তায় নিয়ে আসা উচিত। বিনিয়োগ যদি করতে হয় তবে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা উচিত। গবেষণায় করা উচিত। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় করা উচিত।

শেষ কিছু কথাঃ

অনেকেই লেখাটি পড়ে ভাবতে পারেন পুরোটাই ইউটোপিয় চিন্তাভাবনা। আবার অনেকেই এর মাঝে সোস্যালিষ্ট চিন্তাধারণার ছায়াও পেতে পারেন। হ্যাঁ, অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিন্তাগুলো স্বপ্নের মতই। দেশের যে কোন উন্নতি সম্ভব, এমন ধারণা পোষণকারী খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। কিন্তু আমি বলবো অসম্ভব কোন কিছুই নয়। আমি যে সমাজ ব্যবস্থার কথা বলেছি, তা পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশগুলোতে বিদ্যমান। তাঁরা উন্নত এজন্য নয় যে তাঁদের সমাজ ব্যবস্থা উন্নত। তাঁরা উন্নত কারণ, তাঁরা নিজেদের দেশের অর্থনীতিকে উন্নত করেছে। এ কারণে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করাই হবে আমাদের মৌলিক লক্ষ্য। আবার অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, শাসন ব্যবস্থা সব এক অপরের উপর নির্ভরশীল এবং সম্পর্কিত। একটি ব্যতীত অন্যটিকে উন্নত করা সম্ভব নয়। তাই আসলে প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। প্রয়োজন গণমানুষের মৌলিক চাহিদার লক্ষ্যে একটি নীতিমালা এবং একটি স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা, যেন একটি গতিশীল অর্থনীতি পাওয়া যায় এবং সেই সাথে সকলের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।

সোস্যালিজমের ছায়া পেতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে উন্নত দেশগুলো কিন্তু সোস্যালিষ্ট দেশ নয়। বরং বলা যেতে পারে মিশ্র অর্থনীতির দেশ। ধীরে ধীরে সকল রাষ্ট্রই এই সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবে। আবার এই সমাজ ব্যবস্থাও যে ত্রুটিমুক্ত তা নয় কিন্তু। এখনো উন্নত দেশগুলোর মাঝে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব বিরাজমান, কারণ আমাদের প্রকৃত গনতন্ত্রের অভাব। বর্তমানে যে গণতন্ত্র বিরাজমান তা কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের হাতে জিম্মি। এই কথাটি উন্নত, উন্নয়নশীল সকল দেশের জন্যই প্রযোজ্য। এই অসাধু চক্রটি জনগণের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মুখোশ নিয়ে আসে, কিন্তু আদতে তারা শোষনের যন্ত্রটি ঠিকই চালু রাখে। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য একটিই - জনগণের করের টাকায় জীবন ভোগ (বিভিন্ন রাজনীতিবিদগণ ও ঋনখেলাপীদের হাজার কোটি টাকার সম্পদ দ্রষ্টব্য)। এরা তাই ঋণ খেলাপী হয়েও বড় বড় দলের অর্থের জোগানদার, এরাই দেশের অর্থনীতির নীতি নির্ধারক। এরা তাই দেশের কোন মৌলিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী নয়। এ কারণেই যে সরকারই ক্ষমতা আসুক, শাসন ব্যবস্থা একই ভাবেই চলে।

রাজনীতিবিদগণ ধীরে ধীরে এই অসাধু চক্রটির শোষনের যন্ত্র হয়ে উঠে, কখনোবা নিজেই চক্রটির অংশ হয়ে যায়। এই অসাধু চক্রটিকে চিহ্নিত করতে হবে এবং এদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। বিদ্যমান শাসন যন্ত্রে সেটি কখনই সম্ভব হবে না। আমাদের প্রয়োজন একবিংশ শতাব্দীর জন্য নতুন একটি দল গঠন করা যারা জনগণের সামনে বিকল্প হয়ে আসবে। এটি হতে হবে সম্পূর্ণ এই প্রজন্মের হাতে তৈরি। এদের কাজ হবে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এই অসাধু চক্রটিকে চিহ্নিত করা এবং জনগণের কাছে এদের মুখোশ খুলে দেওয়া। এভাবে আগামী দশ বা পনের বছরে যদি এই দলটি জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে পারে তবেই কাঙ্খিত পরিবর্তন সম্ভব। অন্যথায় এক শ্রেনীর মানুষ শুধু সম্পদের পাহাড় গড়বে আর অধিকাংশ মানুষ শুধু বেঁচে থাকার জন্যই প্রাণান্তকর সংগ্রাম করে চলবে এবং ঈশ্বরের দোষারোপ করে চলবে।

Wednesday, October 7, 2009

রেসিজম

রেসিজম, মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে আদি শত্রু এবং মানুষের সবচেয়ে পুরোন সাথী। মানুষ যেদিন হতে ঈশ্বর আর শয়তান নামের দু’জনকে চিন্তা করতে শুরু করলো এবং ভাল ও খারাপ কাজের জন্য যথাক্রমে দু’জনকে দায়ী করতে থাকলো, সেদিন হতে রেসিজম মানুষের চিন্তার সঙ্গী। ছোটবেলায় পড়েছি, “পাপকে ঘৃনা কর, পাপীকে নয়’- এই কথাটি আজো অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়ে রয়ে আছে। যেদিন হতে আমরা ভেবেছি ভাল কাজ হচ্ছে ঈশ্বরের আর খারাপ কাজ হচ্ছে শয়তানের, তখনই আমরা খারাপ কাজের মানুষগুলোকে আলাদা করে ফেলেছি - কারণ তারা শয়তানের উপাসনা করে, ভালোর নয়।

যুগে যুগে রেসিজমের চিন্তা ধারণা নানান ভাবে আমাদের মধ্য দিয়ে বংশ পরম্পরায় বয়ে চলেছে। একদম আদিম সমাজের মানুষ শুধু মাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে প্রকৃতির সাথে বা প্রকৃতির অন্য জীবের সাথে বা এক অন্যের সাথে লড়াই করতো। সেখানে গোত্রবিশেষের বা মানুষের নিজেদের মাঝে বিদ্ধেষের বিশেষ সুযোগ ছিল না। কিন্তু যখন গোত্র গোত্র বিশেষ মিলে সমাজ হল, সমাজ হতে রাষ্ট্র হল, সমাজে আচরণ বিধি হল, সমাজ ও রাষ্ট্রে শাসক এবং শাসিত গোষ্ঠি হল, এরই কোন পর্যায়ে মানুষে মানুষে বিভেদের সৃষ্টি হল।

ধর্মগুলো মানবতার কথা বললেও রেসিজম থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত হতে পারলো না। ইহুদী ধর্মগ্রন্থে বলা হয় ইহুদীরা ঈশ্বরের পছন্দের জাতি। গ্রীক পূরাণেও গ্রীক জাতি নিজেদের ঈশ্বরের সন্তান মনে করে। এভাবে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে যে ধরণের হিংসার বীজ রয়েছে, তাতে মনে হয়েছে যে ধর্মগ্রন্থগুলো ঈশ্বরের বাণী হতে পারে না। একজন ঈশ্বরের কাছে তার সৃষ্টির মাঝে কোন পার্থক্য থাকতে পারে না। শুধু ধর্মগ্রন্থই নয়, দর্শনগুলোও নিজেদের সম্পুর্ণ মুক্ত করতে পারেনি রেসিজম হতে। একারণেই আমরা দেখি এরিষ্টটল, কান্ট, হেগেলের মত বিখ্যাত দার্শনিকদেরকেও রেসিজমের বীজ অন্তরে ধারণ করতে। এরিষ্টটল মনে করতেন যে গ্রীক জাতি প্রকৃতগত ভাবে মুক্ত এবং বর্বর (প্যাগান বা নন-গ্রীক) জাতি প্রকৃতগত ভাবেই দাস। কান্ট এবং হেগেল উভয়েই মনে করতেন যে, কালো মানুষদের বুদ্ধি কম এবং তারা সাদা মানুষের তুলনায় নীচু জাতের।

আমার মতে, রেসিজমের মূলে রয়েছে অন্ধ-বিশ্বাস এবং অহংকার। আমার বিশ্বাস, বা ধর্ম, বা জাত অন্যদের তুলনায় ভিন্ন এবং উৎকৃষ্ট - এই ধরণের চিন্তার প্রতফলনই হল রেসিজম। তাই আমরা দেখি ধর্মযুদ্ধগুলো থেকে শুরু করে বিশ্বযুদ্ধ এবং আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে বা হচ্ছে তার সবকয়টির সাথেই এই রেসিজম ওতপ্রেতভাবে জড়িত। মানবতা হয়েছে লুন্ঠিত। অন্ধ-বিশ্বাসের প্রকৃতিটি বুঝা খুব জরুরী যদি আমরা রেসিজমকে চিহ্নিত করতে চাই। নিজের বিশ্বাসকে অন্ধ ভাবে পালন করে যদি মানবতাকে উপেক্ষা করি এবং মানুষের মাঝে বিভেদের দেয়াল তুলে দেই তবে, নিজের অজান্তেই রেসিজমের বীজ বপণ করে চলবো। এক জন ধর্মপ্রাণ মানুষ, যিনি কোনদিন হয়তো মিথ্য বলেননি বা অন্যায় করেননি, তিনিও হয়তো একজন নাস্তিককে ঘৃনা করতে পারেন, কিংবা একজন নাস্তিক, নিজেকে মুক্তচিন্তার অধিকারী দাবী করেও, যদি এই ধারণা পোষন করেন যে ধর্মপ্রাণ মানুষই সমাজকে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে, তাহলে তিনিও রেসিজম অন্তরে ধারণ করছেন। ধর্ম নয়, ধর্মের মাঝে বিদ্যমান রেসিজমই দায়ি সভ্যতাকে পেছনে নেওয়ার জন্য।

অন্ধ-বিশ্বাস শুধু মাত্র ধর্ম বা বর্ণেই বিদ্যমান তা নয়। যদি নিজের মতবাদকেই সেরা হিসেবে গন্য করি, , বা সিনিয়র কলিগ হয়ে জুনিয়র কলিগদের তাচ্ছিল্য করি, বা একজন ব্লগার হয়ে সহব্লগারের মতামতকে হেয় প্রতিপন্য করি, বা দেশের সমস্ত রাজনীতিবিদদের চোর মনে করি, বা প্রবাসী সব ভাইয়দের স্বার্থপর মনে করি, বা গরীবলোক মানেই চুরি করে মনে করি, বা কাজের লোকদের যথাযথ সম্মান না দিই, বা বুয়েটের ছাত্র বা ইডেনের ছাত্রী বলে নিজেকে একটু ভিন্ন মনে করি, বা আমার ছেলে কোন অপরাধ করতে পারে না এমন ধারণা মা হিসেবে পোষন করি, বা সকল তরুণদের উচ্ছৃঙ্ঘল মনে করি, বা সকল বুইড়াদের ফালতু মনে করি – এই সবই অন্ধ-বিশ্বাসের প্রতিফলন। আর যখন এই অন্ধ-বিশ্বাষটুকু প্রকট হয়, তখন ভিন্ন মতালম্বী মানুষটিকে আর মানুষ হিসেবে দেখা হয় না – যাহাই রেসিজমের সৃষ্টি করে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নিজেকে মুক্তচিন্তার মানুষ বলে দাবী করলেও, প্রকৃত রেসিজম থেকে মুক্ত থাকা কতটা কষ্টকর। নিজেও যে এর উর্ধ্বে ছিলাম দাবী করি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় কালে অমনোযোগী ছাত্রদের হেয় করেছি, দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেছি সেটা তাদের ভালোর জন্যই করেছি, কিন্তু আজ উক্ত কাজ ভুল ছিল স্বীকার করি। মানবতা এবং অহিংসাকে জীবনের পাথেয় করেছি। সকল মানুষ সমান এবং সকলের সমান ভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে এই পৃথিবীতে, এটা বিশ্বাস করি। শুধু সকল মানুষ নয়, সকল জীবেরই বাঁচার সমান অধিকার রয়েছে বলেই মনে করি। একে অন্যের বিশ্বাস এবং মতামতের উপর সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাশীলতার মাধ্যমেই আমরা পারি রেসিজমকে পেছনে ফেলে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।