বন্যা আপাকে আমার আগের লেখায় মন্তব্যে লিখেছিলাম যে আমার জীবন এখন বিবর্তনময় হয়ে গিয়েছে। আমার চারপাশে আমি এখন শুধু বিবর্তনকেই দেখতে পাই। বিবর্তনের আলোকে নিজের অনেক কর্মের ব্যাখ্যা পাই, নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও ঠিক করি। এর জন্য বন্যা আপার “বিবর্তনের পথ ধরে” বইয়ের অবদান অনেক। আজ অফিসিয়ালি কৃতজ্ঞতা জানালাম। বিবর্তনের উপর প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য এই বইটির তুলনা হয় না। তবে আমার মূল আগ্রহ হচ্ছে রাজনৈতিক দর্শনে। প্রাথমিক জ্ঞানটুকু পাবার পর আমি এখন মূলত পড়ি বিবর্তনের আলোকে মানুষ বা সমাজ, বা রাষ্ট্রের চরিত্র বোঝার বিষয়গুলো নিয়ে। আজকের লেখাটি আমার সেই বিবর্তনময় জীবন নিয়ে কিছু আবজাব।
আমি দর্শনকে দু’ভাগে ভাগ করবোঃ বিবর্তন পূর্ব দর্শন এবং বিবর্তন পরবর্তী দর্শন। আজ বিজ্ঞানের অগ্রগতীর ফলে দর্শন এবং বিজ্ঞান এখন প্রায় সমার্থক শব্দ হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক এখন কোন দর্শন সম্ভব নয়। তাই জীব বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ণৃ-বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস সহ সকল ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপস্থিতি লক্ষনীয়। তাই এখন একজন দার্শনিক দর্শন নিয়ে কাজ করেন আবার বিবর্তনের মত বিজ্ঞান নিয়েও কাজ করেন। তাই ডকিন্স, হকিংস এর মত বিজ্ঞানীরা হয়ে উঠেন একই সাথে দার্শনিক আবার ডেনেটের মত দার্শনিকেরা হয়ে উঠেন বিবর্তনীয় বিজ্ঞানী।
আমি যখন ধর্ম সম্পর্কে লেখাকে নিরুৎসাহিত করি তখন সেটা ধর্মকে নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখার কথা বুঝাইনি। ধর্মকে শুধু মাত্র কোরান বা মুহাম্মদের চরিত্রকে খন্ডনের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে দর্শনের আলোকে, ইতিহাসের আলোকে, নৃবিজ্ঞানের আলোকে, বিবর্তনের আলোকেও খন্ডন করার কথা বলি। এই ক্ষেত্রে ডেনেট এর ব্রেকিং দ্যা স্পেল বা ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইগুলোর কথা বলতে পারি। ডেনেট তার এই বইয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শুরু আমাদের লোকজ ধর্মগুলো হতে। তিনি ধর্মকে একটি লোকজ ধারা হিসেবে দেখিয়েছেন যেমনতর আমাদের রয়েছে লোকজ সঙ্গীত, লোকজ সংস্কৃতি বা লোকজ ভাষা। লোকজ সঙ্গীত যেমন বিবর্তিত হয়ে আজ প্রাতিষ্ঠানিক রক, ব্যান্ড, আধুনিক কিংবা জ্যাজ সঙ্গীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনি লোকজ ধর্মগুলো বিবর্তিত হয়ে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আপনি হয়তো রক পছন্দ করেন না, শুধু মেলোডি নির্ভর পছন্দ করেন, তেমনি আরেকজন হয়তো এখনো শুধু লোকজ সঙ্গীতই পছন্দ করেন, কিন্তু তাই বলে নিশ্চয়ই আরেকজনের পছন্দকে পাগল বলে বাতিল করে দেননা।
বিশ্বাস বা ধারণা বা কোন আইডিয়া নামক বস্তুটি আমাদের মস্তিষ্কের মাঝে বিবর্তনের পথে কোন একসময়ে এসেছে। যে কোন বিশ্বাস, বা সঙ্গীত বা চিত্রকলা বা সংস্কৃতি এগুলো আমাদের মস্তিষ্কে একধরনের ভাল লাগার অনুভূতি প্রদান করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সমাজকে সংগঠিত করতে সাহায্য করে, যার ফলে গ্রুপ সিলেকশনে টিকে থাকতে ফিটনেস বাড়ায়। সে কারণে এই সমস্ত বিষয়গুলো আমাদের মস্তিষ্কে বংশপরম্পরায় টিকে থেকে গিয়েছে। এর মধ্যে যেগুলো আবার সমাজের জন্য ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত হবে সেগুলো আবার বিববর্তনের সুত্র মতেই ধীরে ধীরে বংশপরম্পায় বাদ হয়ে যাবে। ধর্ম বিশ্বাসকে আমি সেভাবেই দেখি। এক সময় সেটা সমাজকে সংগঠিত করেছে, কিন্তু আজ সেটাই এখন ক্ষতির কারন হয়ে দাড়াচ্ছে। আমার বাবা/মা যেভাবে ধর্ম পালন করতো, আমি সেভাবে করি না, আর আমার সন্তানরা যে আরো করবে না সেটা বলাই বাহুল্য। তিন/চার হাজার বছরের পুরোন বিশ্বাস চলে যেতে আমাদেরকে প্রায় সেরকম সময় অপেক্ষা করতে হবে। বিবর্তন খুব ধীর গতির যা সহজে আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে পরিবর্তন কিন্তু চোখে পড়বে। টোটাল পরিবর্তনের জন্য আমাদের সময় দিতে হবে। সেটা আমি বা আপনি দেখে যেতে পারবো না।
ডেনেটের একটি বক্তব্য আমার বেশ ভাল লেগেছে তা হল ধারণা বা আইডিয়া কিভাবে একটি মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা কোন একটি ধারণার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে। আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিতে পারি, জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদের জন্য প্রাণ দিতে পারি আবার ধর্মের জন্যেও শহীদ হতে পারি। এ সবই করি কারণ, আমাদের মস্তিষ্কের ধারণা নামক বস্তুটির জন্য। ডকিন্স এটিকেই বলেছেন সেলফিশনেস অফ মিম, অনেকটা সেলফিশনেস অফ জিনের মত। জিন যেমন নিজের বংশবৃদ্ধির জন্য তার হোষ্টকে মরে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম তেমনি মিমও সেটা করতে পারে। একজন মা যেমন তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দিতে পারে তেমনি একজন মানুষ তার বিশ্বাসকে রক্ষার জন্য জীবন দিতে পারে। এই ধারনা বা বিশ্বাস জিনিসটিকে ডেনেট পরজীবী জীবের সাথে তুলনা করেছেন। Lancet liver fluke এর মত পরজীবী যেমন একটি পিঁপড়েকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে আত্মহননে বাধ্য করে তেমনি আমাদের বিশ্বাস একজন মানুষকে বাধ্য করে আত্মহননের মত কাজে। যে কোন মানুষকে আঘাত দেওয়ার আগে তাই কেন মানুষের মাঝে এমন বিশ্বাস নামক বস্তুটির উৎপত্তি হয় সেটা বোঝা জরুরী। তখন আপনি রোগটিকে নিরাময় করতে পারবেন সহজে।
মজার ব্যাপার হল মানুষের মস্তিষ্কে এই ধারণাগুলোর প্রবেশ বা প্রতিস্থাপন করানো কিন্তু খুব সহজ একটি কাজ যেটা আমরা সব সময় করে আসি। ছোটবেলায় বাবা/মার শেখানো নানান বুলিগুলো দিয়ে শুরু হয় ধারণার প্রতিস্থাপন। ধর্মের ধারণাও সবাই পরিবারের কাছ থেকেই পাই প্রথমে। তারপর বন্ধু, আত্মীয় স্বজন, সমাজ সবর্ত্রের মাধ্যমে এই ধারণা আরো পাকাপোক্ত হয়। এর পর থেকে কখন যে বিশ্বাস/ধারণাই চালিকা শক্তি হয়ে যায় সেটা আর টের পাই না। যার ফলে বিদেশে এসে হালাল/হারাম খুঁজি। ধারণা প্রতিস্থাপন নিয়ে সম্প্রতি একটি ছবি হয়েছে, ডিকাপ্রিওর, নাম Inception. দেখতে পারেন। আমার চমৎকার লেগেছে। ছবিটির মাঝে একটি ক্ষুদ্র ধারণা কিভাবে অন্যের মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করা যায় এবং সেটি কিভাবে একজনের দৃষ্টিভঙ্গীকে বদলে দিতে পারে সেটা তুলে ধরা হয়েছে।
মানুষের মনের বা মস্তিষ্কের বিবর্তনের কথা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখবো যে মানুষই এই ধর্মগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে আবার তারাই আজ ধর্মগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা শুরু করেছে। তাই প্রয়োজন নিছক সমালোচনা নয়, প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা। ধর্মকে নিয়ে যত গবেষণা হবে, নৃবিজ্ঞানের আলোকে, ইতিহাসের আলোকে, বিবর্তিনের আলোকে ততই মানুষ ধর্মের বিবর্তন সম্পর্কে আরো বেশি করে জানতে পারবে এবং নিজেই পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে পারবে। ডেনেট তার বইয়ে ধর্ম নিয়ে এই গবেষণার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন প্রয়োজন হলে ধার্মিক/বিশ্বাসী গবেষকদের দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধর্ম নিয়ে গবেষণা করতে। হয় তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার দ্বারা ধর্মকে ব্যাখ্যা করুক, প্রতিষ্ঠিত করুক নয়তো তারা স্বীকার করুক তাঁদের ভুল।
আমরা যারা গবেষক নই তারা কি করতে পারি? তারা ডেনেটের এই বইটি কিংবা ডকিন্স এর সেলফিশ জিন বইয়ের মত বইগুলোকে অনুবাদ করে মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারি। ধর্ম নিয়ে আরেকটি গবেষনা মুলক বইয়ের নাম এখানে দিতে পারি। বইটির নামঃ Where God and science meet : How Brain and Evolutionary Studies Alter Our Understanding of Religion Edited by Patrick McNamara. এর তিনটি খন্ড রয়েছে। প্রথম খন্ডে আপনি পাবেন Evolution, Genes, and the Religious Brain, দ্বিতীয় খন্ডে পাবেনঃ The Neurology of Religious Experience এবং তৃতীয় খন্ডে পাবেনঃ The Psychology of Religious Experience। পুরো ৯০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ে বিবর্তন এবং মনোবিজ্ঞানের আলোকে ধর্মকে নিয়ে গবেষণালব্ধ অনেক কিছুই পাওয়া যাবে যা দিয়ে নিজের যুক্তিগুলোকে শাণিত করতে পারবেন। বইটি কারো লাগলে এখানে ইমেইল ঠিকানা দিলে, আমি পাঠিয়ে দিতে পারবো। শর্ত হল একটি অধ্যায় হলেও পড়ে সারমর্ম পোষ্ট করতে হবে।
বিবর্তন একটি শক্তিশালী শাখা বিজ্ঞানের, এবং এটি আজ শুধু জীববিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ বিবর্তনের বিভিন্ন চিন্তাধারাগুলো এরই মধ্যে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোতে প্রয়োগ করছে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি প্রতিষ্ঠিত শাখা। তেমনি বিবর্তনের দৃষ্টি দিয়ে মানুষের গোষ্ঠিবদ্ধ আচরনকে বোঝার চেষ্টা চলছে যার ফলশ্রুতিতে এখন বিবর্তনীয় সমাজবিজ্ঞান, বিবর্তনীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা বিবর্তনীয় অর্থনীতির মত বিষয়গুলো দেখতে পাই। বলাই বাহুল্য এই বিষয়গুলো সদ্য যাত্রা করেছে এবং এই বিষয়গুলো পরিপূর্ণতা পেতে আরো কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু সেটা যে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা বাংলা ভাষাভাষী যারা রয়েছি তারা এই সম্পর্কের বইগুলো পড়ে সেগুলো সম্পর্কে বেশি বেশি করে লিখতে পারি, যেন তরুন গবেষকরা এই সব বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী হয়। তবেই কিন্তু একটি মুক্তবুদ্ধির সমাজ পাবো।
পরিশেষে ধর্মের উপর লেখাগুলো নিয়ে বিবর্তন আর্কাইভের মত একটি আর্কাইভ খোলার প্রয়োজনীয়তার কথা আবারো বলে যাচ্ছি। আর লেখাটি বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো, তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আগেই।
Wednesday, August 11, 2010
Subscribe to:
Posts (Atom)