ডেনিয়েল ডেনেটের Breaking the spell বইটা পড়ে Lancet liver fluke পরজীবির কথা জানতে পারি যেটার কথা আমার এলোমেলো চিন্তাঃ বিবর্তনময় জীবন এই লেখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম। এই পরজীবি তার জৈবিক চক্রের একটি ধাপে যখন পিঁপড়ের মাঝে বংশবৃদ্ধি করে তখন এক পর্যায়ে পিঁপড়ের মস্তিষ্কের দখল নিয়ে ফেলে এবং পিঁপড়েটিকে এক প্রকার সুখানুভুতি প্রদানের মাধ্যমে বাধ্য করে পরজীবিটির নিজ উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করার জন্য। ডেনেট মানুষের বিশ্বাস ব্যবস্থাকে সেরকম কিছু পরজীবির সাথে তুলনা করেছেন। মানুষ নিজের বিশ্বাসকে রক্ষার্থে নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে পারে, টুইন টাওয়ারে বিমান নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পারে।
কিন্তু বিশ্বাস একটি এবস্ট্রাক্ট কিছু। তাহলে বিশ্বাস কিভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে আত্মহননের মত কাজে। নিশ্চয়ই মানুষের মস্তিষ্কেও সেরকম কোন একটি পোকার অবস্থান রয়েছে যেটি উক্ত কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। হয়তো সেই পোকাও আমাদেরকে এক প্রকার সুখানুভুতি প্রদান করে। যে কারণে কোন কাজ করলে ভাল লাগে, অথবা কোন কাজ করতে ইচ্ছে করে না। নিজের মাঝে এই পোকার অবস্থান সব সময় টের পাই। এই পোকাই বাধ্য করে নিজের আসল গবেষণা ফেলে বনের মোষ তাড়ানোর গবেষণা করতে, ব্লগে লেখা দিতে। এই পোকাই বাধ্য করে সমাজ, বিশ্ব জগৎ ইত্যাদী নিয়ে চিন্তা করতে। আমার বিশ্বাস এ রকম পোকার অস্তিত্ব কম বেশি সবার মাঝেই রয়েছে।
বহুদিন পোকাটির অস্তিত্বটি টের পেলেও, তার পরিচয় জানার সুযোগ হয়নি। সম্প্রতি পোকাটির নাম জানতে পারলাম। এর নাম নাকি ডোপামিন (উচ্চারণটি কি ডোপামাইন হবে?) মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে এই ডোপামিনের তারতম্যের ফলেই নাকি মানুষের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, চেতনা, অনুভূতি, কার্মদক্ষতা , কর্মস্পৃহা ইত্যাদীর তারতম্য দেখা যায়। এই ডোপামিনের অভাবেই পারকিনসসের মত রোগ হয় যার এক মাত্র চিকিৎসা হচ্ছে ডোপামিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া। আবার এর অত্যাধিকতার জন্য অটিজম, সিজ্রোফেনিয়া, হাইপার একটিভিটি, ম্যানিয়া এর মত মানসিক রোগগুলো দেখা যায়। এর প্রভাবেই নাকি মানুষের মাঝে অত্যাধিক বুদ্ধিমত্তা কিংবা ধর্ম/বিশ্ব নিয়ে বেশি চিন্তা করার প্রবনতা, তীব্র প্রতিযোগিতা মনোভাবাপন্নতা দেখা যায়। এর আধিক্যের ফলে অতিপ্রাকৃতিক অনুভূতি লাভ হয়, যার ফলে স্বর্গ/নরক কিংবা ঈশ্বরের দেখা পাওয়ার মত অনুভূতি হতে পারে। এরই ফলে মানুষের মাঝে দূর ভবিষ্যৎ কিংবা মহা বিশ্বের মত বৃহৎ আকার নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হয়। আজ পর্যন্ত যত সমর নায়ক, ধর্ম অবতার, কিংবা দার্শনিক, বিজ্ঞানী এসেছেন তাঁদের মাঝে এই ডোপামিনের আধিক্য ছিল বলে ধারনা করা হয়।
এটি মানুষের সকল কর্মস্পৃহার মূলে। এটি কাজ করে পূরষ্কারের ভিক্তিতে। অর্থাৎ কোন কাজ ভাল লাগলে পুরষ্কার হিসেবে মস্তিষ্কে এই বস্তু কিছুটা নিঃসৃত হলে আপনার মনে এক ধরণের ভাল লাগা অনুভুত হবে যার ফলে আপনি আবার সেই কাজটি করার জন্য উদ্বুদ্ধ হবেন। কোন ভাল খাবার খেলে বা সেক্সের ফলে, বা কোন ভাল কাজের ফলে এই বস্তুর নিঃসরণ ঘটে যার কারণে আমরা তৃপ্তিলাভ করি। একই রকমের অনুভুতি কোকেন বা উদ্দিপক নানান ড্রাগের মাধ্যমেও পাওয়া যায়। শুধু ভাল কাজেই যে তা নয়, আক্রমনাত্মক কাজেও এই বস্তুর নিঃসরণ যুক্ত। মোটকথা এই বস্তুই আমাদের মাথার সেই পোকা যে কিনা আমাদেরকে তার পথে চালায়।
মানুষের আজকের এই আধুনিক বুদ্ধিমত্তার মানুষ হয়ে উঠার পেছনেও নাকি মস্তিষ্কের আকারের তুলনায় এই ডোপামিনের প্রভাবই বেশি বলে এক পক্ষের ধারনা। আমি নিশ্চিত এই লেখাটি আমাদের সেই “নেচার ভার্সেস নেচার” বিতর্ককে আবার উসকে দিবে। এই পক্ষের ধারনা যে মানুষের মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি হলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তা সেভাবে বাড়েনি বরং ২ লক্ষ বছর আগে আধুনিক মানুষের উৎপত্তি হলেও তখনকার তুলনায় মানুষের মস্তিষ্কের আকার বেশি পরিবর্তন হয়নি, বরং কিছুটা কমেছে। কিন্তু আমরা দেখি যে জেনেটিকালি খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তার বেশ উন্নতি হয় এবং সেই উন্নতির পেছনে এই ডোপামিনের অবদানকেই ধরা হচ্ছে। আধুনিক মানুষের আগেও আমাদের যে পূর্বপুরুষেরা ছিল তাঁদের মাঝেও এই ডোপামিন ছিল কিন্তু তার পরিমান আজকের মানুষদের তুলনায় প্রায় অর্ধেক ছিল। এই পক্ষের ধারনা মানুষের আদি পূর্বপুরষদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের যাত্রা শুরু হয় মূলত মাংসাশী প্রাণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে এবং গায়ের লোম কমা শুরুর পর থেকে। ডোপামিন মানুষের দেহ হতে তাপ দ্রুত কমাতে সাহায্য করে। তাই গায়ের লোম কমার পাশাপাশি সে সময় ডোপামিনের পরিমানও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শুধু মাংসাশী প্রাণী এবং তাপ ঝরানোর কারণেই ডোপামিনের পরিমান অনেক বেশি হয়ে যায় না। তাই পরবর্তী ১০০,০০০ বছরে মানুষের বুদ্ধিমত্তায় তেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। সেই সময়কার তাঁদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সেই ধারনাই দেয়।
প্রায় ১৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ হাজার বছরের দিকে কিছু আধুনিক মানুষ পূর্ব আফ্রিকা হতে দক্ষিণের দিকে মাইগ্রেট করে এবং এই সময় সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি থাকার কারণে এবং বড় বড় মাংসাশী প্রাণীর অভাবের কারণে তাঁদের খাদ্যাভাসে সামুদ্রিক প্রাণী/মাছ নিয়ে আসে। সামুদ্রিক মাছ খাদ্য তালিকায় প্রবেশের কারণে তাঁদের শরীরে আয়োডিনের পরিমান বৃদ্ধি পায়। এই আয়োডিনের ফলে, থাইরয়েড প্রন্থির প্রভাবে সেই মানুষের মাঝে ডোপামিনের মাত্রা আরেক দফা বৃদ্ধি পায়। যার কারণে এই সময়কার মানুষের পাথরের যন্ত্রপাতিগুলো উন্নত হয়। যন্ত্রপাতিগুলো আগের চেয়ে ধারালো, এবং কার্যকর হয়। এই সময় মানুষের মাঝে বিভিন্ন সংস্কৃতি, আর্ট এগুলোও দেখা যায়। কিন্তু শুধু্মাত্র মাংসভোজ কিংবা আয়োডিনের প্রভাবেই আজকের এই ডোপামিনের সভ্যতা নয়।
এই সময়টাতেও মানুষ মূলত শিকারী এবং সংগ্রাহক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতো। মানুষ তখনো পুরোপুরি কৃষিনির্ভর হয়ে উঠেনি, যে কারণে তখনো জনসংখ্যার পরিমান বেশি হয়নি এবং এর ঘনত্ব অনেক কম ছিল। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সেভাবে প্রবল হয়ে দেখা দেয়নি। কিন্তু প্রায় ৮০০০ বছর আগে এই শিকারী গোত্রের বেশির ভাগ মানুষই পাকাপাকি ভাবে কৃষিকাজ শুরু করে এবং যার ফলে সমাজের চরিত্র দ্রুত বদলাতে থাকে। জনসংখ্যার বিষ্ফোরণ ঘটে, জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়, বৃহৎ আকারে সমাজ, রাষ্ট্রের মত সংস্থা তৈরী হয়। মানুষের মাঝে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এই চরম প্রতিযোগিতাই মানুষের মাঝে ডোপামিনের পরিমান বৃদ্ধি করে এবং যার ফলে আমরা আজকের এই ডোপামিনিক সভ্যতা দেখতে পাচ্ছি।
ডোপামিনের বৃদ্ধির ফলে মানুষের মাঝে চরম প্রতিযোগিতা মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। লেখকের মতে আমরা এখন হাইপার ডোপামিনিক সময়ের মাঝে আছি। এর শুরু হয়েছে ইন্ড্রাসটিয়াল রেভুলেশানর পর থেকে বা আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরুর পর থেকে। মানুষ এখন আগেরকার যে কোন সময়ের তুলনায় বেঁচে থাকার জন্য সর্বোচ্চ প্রতিযোগীতার মধ্যে দিয়ে যায়। লেখক এই পর্যায়ে এসে অনেকটা দার্শনিক হয়ে যান। তিনি কামনা করেন এই হাইপার ডোপামিনিক সভ্যতা হতে রিভার্স প্রক্রিয়ায় আমরা আরেকটু কম ডোপামিন মাত্রার সভ্যতায় যেতে পারি কিনা সেই প্রশ্ন রেখে। ডোপামিন নিয়ে গবেষণা এখনো শুরুর দিকে। আশা করা যায় ভবিষ্যতে এই বস্তুর প্রভাব আরো ভাল করে বুঝা যাবে। বুঝা যাচ্ছে এর মাধ্যমেই মস্তিষ্কের আচরণকে আরো ভাল করে জানা সম্ভব হবে।
নোটঃ এই লেখাটি Fred H. Previc এর The Dopaminergic Mind in Human Evolution and History বই অবলম্বনে লেখা হয়েছে। আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আগ্রহীদেরকে উক্ত বইটি পড়ে দেখতে বলবো। সময়ের অভাবে পুরো বইটি অনুবাদ করা অসম্ভব আমার পক্ষে। এই লেখাটিকে সারমর্ম হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। তারপরেও মনে করি লেখাটি আরো ভাল হতে পারতো। আরো কিছু বিষয়ে বিস্তারিত লেখা যেতে পারতো। কিছু ছবি যুক্ত করা যেতে পারতো। কিন্তু সেগুলো সব করতে গেলে হয়তো লেখাটিই আর আত্মপ্রকাশ করতো না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে অন্তত কিছু হলেও লেখা উচিৎ মুক্তমনার পাঠক/লেখকদের জন্য। আমি মনে করি মানব মস্তিষ্কের আচরণ সুনির্দিষ্ট ভাবে বুঝার মাঝেই নীহিত রয়েছে মানব সভ্যতার ভবিষ্যত। সবশেষে মুক্তমনা ও সচলায়তনের সদস্য সিরাতকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই বইটির খোঁজ দেওয়ার জন্য। সিরাতের এই লেখাটির মাধ্যমেই প্রথম বইটির কথা জানতে পারি।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment