কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস এবং সালফার এই ছয়টি উপাদান হচ্ছে আমাদের সকল প্রাণের মূলে। ফসফরাস আমাদের ডিএনএ এবং আরএনএ এর রাসায়নিক গঠনের কেন্দ্রীয় উপাদান, যেগুলোকে আমাদের জিনের মূল হিসেবে আমরা চিহ্নিত করে থাকি। আমাদের প্রাণকে আবার কার্বন ভিক্তিক প্রাণও বলা হয়, কারণ কার্বনের রয়েছে নিজের সাথে নিজেকে যুক্ত করে যৌগিক অনু তৈরী করার ধর্ম। হকিং তার গ্রান্ড ডিজাইন বইয়ে কার্বন ভিক্তিক ব্যতীত প্রাণের কথা বলেছেন। কার্বনের মতই ধর্ম দেখা যায় সিলিকনের মাঝে। তাই হকিং তার বইয়ে বলেছেন বহিঃবিশ্বে আমরা হয়তো কার্বন ভিক্তিক প্রাণ পেলাম না, কিন্তু কে বলতে পারে, সিলিকন ভিক্তিক প্রাণ পেতে পারি। তারপরেও এটি কেবল তাঁর একটি অনুমান ছিল। তাই বহিঃবিশ্বে আমরা শুধু আমাদের মত প্রাণের কথাই চিন্তাই করেছি এবং আমাদের পৃথিবীর পরিবেশের মত আরেকটি পরিবেশই খুঁজছি।
কিন্তু আমরা যে আমাদের নিজেদের বাড়ির সীমানাই ভাল করে জানিনি তার একটি প্রমাণ পাওয়া গেল সাম্প্রতিক নাসার এস্ট্রোবায়োলজি গ্রুপের গবেষণায়। এবার নাসার গবেষকেরা গবেষণায় পেয়েছেন এমন একটি প্রাণ যার গঠন আমাদের প্রাণের গঠন থেকে ভিন্ন। এই গবেষণা আমাদের প্রাণের সংজ্ঞাকে আরো বৃহৎ ব্যাপ্তিতে নিয়ে যাবে, এবং পাঠ্য বইয়ের প্রাণের সংজ্ঞাকে বদলে দিবে। এর ফলে মহাবিশ্বে এখন আমরা শুধু আমাদের পৃথিবীর মতই পরিবেশ খুঁজবো না, কিংবা আমাদের মতই প্রাণ খুঁজবো না। আমরা এখন যে কোন বিরূপ পরিবেশেও প্রাণের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিবো না। এই গবেষণা মহাবিশ্বে প্রাণ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাকে আরো অনেক গুণে বাড়িয়ে দিল।
আর্সেনিক আমাদের মত ফসফরাস ভিক্তিক প্রাণের জন্য ক্ষতিকারক। কিন্তু আর্সেনিক এবং ফসফরাসের ধর্ম অনেক কাছাকাছি। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিল যে যদি ফসফরাসকে আর্সেনিক দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা সম্ভবপর হয় তবে ভিন্ন প্রাণ সম্ভব হলেও হতে পারে। তাই গবেষকেরা যেটা করেছিলো ক্যালিফোর্নিয়ার মুনু লেক, যেখানকার পানি প্রচুর আর্সেনিকযুক্ত, লবনাক্ত, সেখানে হতে কিছু মাইক্রোব সংগ্রহ করেছেন। এই মাইক্রোবগুলো অনেক ক্ষুদ্র আকারের ব্যাকটেরিয়া সদৃশ প্রাণী। বিজ্ঞানীরা এরকম মাইক্রোবকে খুব অল্প ফসফরাস কিন্তু বেশি আর্সেনিক এর মত পরিবেশে রেখে দেখতে পেল যে মাইক্রোবগুলো সেই পরিবেশেও টিকে আছে এবং সংখ্যায় বৃদ্ধি করছে নিজেদেরকে। এর পর গবেষকেরা ফসফরাস সম্পূর্ণ সরিয়ে শুধু আর্সেনিক পূর্ণ পরিবেশে এই মাইক্রোবদেরকে পরীক্ষা করে দেখতে পেল যে সেই পরিবেশেও মাইক্রোবগুলো টিকে থাকছে এবং সংখ্যায় বৃদ্ধি করছে।
এটি একটি সম্পূর্ণ নুতন বিষয় বিজ্ঞানীদের জন্য। কারণ ফসফরাস ভিন্ন প্রাণের সম্ভাবনা বিজ্ঞানীরা কখনো ভাবেননি। দেখা যাচ্ছে যে এই মাইক্রোবগুলোর প্রাণের গঠন এখন সম্পূর্ণ আর্সেনিক ভিক্তিক এবং বিজ্ঞানীরা এই আর্সেনিক কোথায় যুক্ত হয়েছেন সেটাও জানতে পারছেন। এই নুতন মাইক্রোবগুলোর ডিএনএ তে ফসফরাসের বদলে এখন আর্সেনিক যুক্ত হয়েছে। আগের প্রাণের সংজ্ঞায় এদেরকে জীবিত বলা সম্ভবপর ছিল না। কিন্তু এই নুতন মাইক্রোবগুলো জীবিত এবং বংশবৃদ্ধি করছে। অর্থাৎ এদেরকেও এখন আমাদের পাশাপাশি নুতন প্রাণ হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে। এখন আমরা আশা করতে পারি যে অন্য কোন গ্রহেও প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে, কিন্তু তারা হতে পারে ভিন্ন রাসায়নিক গঠনের।
বিবর্তন বিদ্যাকেও এখন আবার নুতন ভাবে চিন্তা করতে হবে। শুধু মাত্র একটি ট্রি অফ লাইফ হিসেবে চিন্তা না করে একাধিক ট্রি অফ লাইফকে সম্ভাবনায় রাখতে হবে। কে বলতে পারে হয়তো বিলিয়ন বছর পরে এই আর্সেনিক যুক্ত প্রাণ থেকেও উন্নতর বুদ্ধিমত্তা বিশিষ্ট প্রাণ তৈরী হতে পারে। ততদিন এই মানুষ টিকে থাকবে না কিনা সেটা তারচেয়েও বড় প্রশ্ন। আমরা পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন, ওজোন স্তর নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটলেও, মানুষ বা কার্বন/ফসফরাস ভিক্তিক প্রাণ ধ্বংস হয়ে গেলেও, এই আর্সেনিক ভিক্তিক প্রাণ হয়তো টিকে থাকতে পারে এবং কিংবা নুতন প্রাণের উদ্ভব হতে পারে এবং প্রাণের বিকাশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কে জানে?
নোটঃ মূল খবরটি নাসার ওয়েবসাইট হতে পাবেন। এবং আরো বিস্তারিত জানতে মূল লিঙ্কটি ঘুরে দেখার অনুরোধ রইল। খবরটি দেখার পর থেকে অভিজিৎ ও বন্যা উনাদের কারোর লেখার জন্যে অপেক্ষা করে, এখনো কোন লেখা না দেখে, আমিই দিয়ে দিলাম। এমন চমকপ্রদ খবর মুক্তমনার পাঠকদের সাথে ভাগ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। এই বিষয়ে লেখার জন্য যে পরিমান জ্ঞান থাকা দরকার তার চেয়ে জ্ঞান অনেকটা কম আছে। লেখায় কোন ভুল তথ্য চোখে পড়লে জানাবেন, ঠিক করে দিবো।
Saturday, December 4, 2010
Thursday, November 25, 2010
জিন এবং মিম
সতর্কবার্তাঃ লেখাটি নিজ দায়িত্বে পড়ুন। লেখাটি পড়ার পর আপনার মস্তিষ্ক একটি ভাল/খারাপ মিম দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। উক্ত মিম আপনার জীবনের গতিপথ বদলে দিতে পারে যেটা আপনার জন্য ভাল/খারাপ হতে পারে। যদি ভালো হয় তার কৃতিত্ব যেমন আপনার, কারণ মিমটি আপনি গ্রহন করেছেন, তেমনি খারাপ হলেও দায়িত্ব আপনার। লেখকের এখানে কোন দায় নেই।
অমরত্বের ইচ্ছে মানুষের সব সময়। মানুষ কোন না কোন ভাবে চায় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। এই সেদিন আমার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটি হু হু করে কাঁদছিলো মৃত্যু ভয়ে। সে মরতে চায় না। এই বয়সেই তার মাঝে মৃত্যু ভয় চলে এসেছে। আমি জানতে চাইলাম কেন তুমি এতো ভয় পাচ্ছো? ভয়টা কিসের? সে জবাব দিল, মারা গেল তার ঘুম আর ভাঙ্গবে না, সে আর কোন দিন খেলা করতে পারবে না, সে আর কোন বন্ধুর সাথে কথা বলতে পারবে না, এটা সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। একটু ভাল ভাবে খেয়াল করে দেখুন এখানে কিন্তু নরকের কোন ভয় নেই। তাহলে দেখতে পারছেন যে কোন প্রকার নরক নামক বস্তুর ভয় ব্যতীতও একজন স্বাভাবিক মানুষের মনে মৃত্যু ভয় চলে আসতে পারে। তারজন্য ধর্ম পর্যন্ত যেতে হয় না। এরকম মৃত্যু ভয়ই হতে পারে একজন দয়ালু ঈশ্বর নামক চিন্তার শুরু।
যা হোক, দু’ভাবে মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। একঃ তাঁর নিজের জিনের প্রতিলিপি তৈরীর মাধ্যমে, দুইঃ তার নিজের বিশ্বাস/আদর্শ/সংস্কৃতি/ভাষা/ ইত্যাদী মিমের প্রতিলিপ তৈরীর মাধ্যমে। জিনের প্রতিলিপ সম্ভব সেক্সের মাধ্যমে অথবা ক্লোনিং এর মাধ্যমে আর মিমের প্রতিলিপ সম্ভব মস্তিষ্কের মাধ্যমে। জিন এবং মিম এই দু’টোর প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যমেই কেবলমাত্র নিশ্চিত করা যায় যে একজন মানুষের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি তৈরী হয়েছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে কোন ভাবেই একজন মানুষ তার সম্পূর্ণ প্রতিলিপি রেখে যেতে পারে না। ক্লোনিং এর ফলে জিনের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি সম্ভব হলেও যে মিমের প্রতিলিপি একই হবে তার নিশ্চয়তা নেই। যে কারণে টুইন বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জেনেটিক বৈশিষ্ট একই থাকলেও তাঁদের চরিত্র ভিন্ন হতে পারে। আবার সেক্সের ফলে জিনের যে প্রতিলিপ তৈরী হয় সেখানে কখনই বাবা/মার একশত ভাগ প্রতিলিপি আসে না।
আমরা যদি ক্লোনিং এর প্রসঙ্গকে আপাতত বাহিরে রাখি, তবে সেক্সই কেমাত্র উপায় জিনের প্রতিলিপি জন্য। তেমনি মিমও কেবলমাত্র প্রতিলিপি তৈরী করতে পারে যদি সে কোন মস্তিষ্কের সংস্পর্শে আসে। যেমন আপনি যদি নির্দিষ্ট কোন সংস্কৃতি/ভাষা/বিশ্বাস এর কথা কোনদিন নাই শুনেন তবে সেই মিমটি সম্পর্কে কোন ধারনাই আপনার মস্তিষ্কে থাকবে না। একটি মিম মস্তিষ্কে তার প্রতিলিপ তৈরী করতে পারে আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। চোখ, কান, ত্বক, ঘ্রাণ, এগুলোর মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকেই তাহলে আমরা মিম হিসেবে সংঙায়িত করতে পারি। যিনি বর্ণান্ধ তার মস্তিষ্কে রঙের কোন ভিন্নতা নেই। তাই মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট কোন মিমের সংস্পর্শে না আসলে মস্তিষ্কে সেই মিমের প্রতিলিপি তৈরী হয় না। মিমের সংস্পর্শে আমরা প্রতিনিয়তই আসছি। এই যে লেখাটি পড়ছেন, আপনি একটি মিম পাচ্ছেন। একটি বই পড়ছেন, মুভি দেখছেন, টিভি/রেডিও দেখছেন/শুনছেন প্রতিনিয়ত মিমের সংস্পর্শে আসছেন। বাবা-মা সন্তাদের সব সময় কোন না কোন মিম দিচ্ছেন। আপনার বন্ধু/বান্ধব, স্কুল/কলেজ, অফিস/আদালত সব কিছু হতে আপনি মিম পাচ্ছেন।
এখন কে বেশি শক্তিশালী তাহলে? জিন নাকি মিম? প্রশ্নটির জবাব পেতে হলে আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে কার প্রতিলিপি তাহলে বেশি তৈরি হচ্ছে? কে বেশি ছড়িয়ে দিতে পারছে নিজেকে? সেক্সের দ্বারা আপনি আপনার নিজের জিনের কতগুলো প্রতিলিপি তৈরি করতে পারছেন? চেঙ্গিস খানের মত হলেও এক জীবন বেশি হলে একশত সন্তান রেখে যেতে পারলেন একাধিক স্ত্রীর ঘরে। তারপরেও কথা থাকে - জিনের প্রতিলিপি কখনই নিজের একশত ভাগ হয় না এবং জিনের প্রতিলিপি হলেই মিমের প্রতিলিপি তৈরি হয় না। অন্যদিকে মিমের প্রতিলিপি আপনি যে কারোর মাঝেই ছড়িয়ে দিতে পারেন, তার জন্য নিজের জেনেটিক প্রতিলিপির দরকার নেই। যে কারণে খুব সহজেই একটি মিম কোটি কোটি মানুষের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যেতে পারে।
তাহলে বুঝতেই পারছেন কেন মানুষ আজ এগিয়ে গিয়েছে অন্য জীবের তুলনায়। অন্যান্য প্রাণী গোষ্ঠী যেখানে কেবলমাত্র জিনের প্রতিলিপি তৈরি করে সেখানে মানুষ জিনের প্রতিলিপির সাথে মিমেরও প্রতিলিপি তৈরি করে। জিনের মিউটেশান যেখানে খুব ধীর গতির, মিমের মিউটেশান সেখানে দ্রুত গতির। যে কারণেই বিবর্তনের এক দম শেষ দিবসে এসে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হলেও খুব সহজেই মানুষ অন্যান্য জীব গোষ্ঠি্কে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে হুর হুর করে, এবং এ সম্ভব হয়েছে মস্তিষ্কের এই মিমের প্রতিলিপির ফলেই। মানুষ তার পূর্ব-অভিজ্ঞতায় অর্জিত জ্ঞান তার পরবর্তী জেনেরাশানে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, এবং ছড়িয়ে দিতে পেরেছে অন্যান্য মানুষের মাঝেও।
মিমের বিবর্তন দ্রুত গতির হলেও, সেটিও প্রাকৃতিক নির্বাচনের বাহিরে নয় মোটেই। যে মিমগুলো সময়ের প্রেক্ষিতে টিকে থাকায় সহায়তা করেছে তারাই নির্বাচিত হয়েছে এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছে। ধর্ম, নৈতিকতা, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ সহ যে কোন মিমকেই এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব। প্রতিটি মিমের কাজ হচ্ছে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া, নিজের প্রতিলিপি তৈরি করা। মানুষের মস্তিষ্কই এই মিমগুলো ধারণ করে আবার বর্জন করে। সময়ের প্রয়োজনেই ধর্মগুলো এসেছিলো, আবার তাঁদের কার্যকারিতা না থাকলে সময়ের প্রয়োজনেই সেগুলো বিবর্তিত হবে অথবা হারিয়ে যাবে।
জিনপুলে যেমন পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে যাওয়ার আগে ড়্যান্ডম মিউটেশান ঘটে তেমনি মিমের ক্ষেত্রেও ঘটে। এক বাংলা ভাষাই যদি দেখেন তবে দেখবেন যে আজকে আমরা যে ভাষায় কথা বলি সে ভাষাতেই কি আমাদের কয়েক পূর্বপুরুষ আগের মানুষেরা কথা বলতো। সামনের দিকে ভাষার মাঝে আরো পরিবর্তন আসবে, এবং সেটাই স্বাভাবিক। এখন যখন কোন মিম নিজেকে অবিকৃত রেখে ছড়াতে চায় তখনই কনফ্লিক্ট শুরু হয়। ধর্ম যদি নিজেকে বিবর্তিত করতে পারতো তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু ধর্ম যখন নিজেকে ঈশ্বরের বাণী বলে অবিকৃত থাকতে যায়, তখনই সে অন্যান্য মিউটেডেট মিমের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।
মিউটেশন অবশ্যই নন-মিউটেশানের তুলনায় উন্নত হবে। মিউটেশানের ফলে জিনপুলে, মিমপুলে অনেক বৈচিত্র থাকে। যার ফলে যে কোন প্রতিকূল পরিবেশে এই বৈচিত্রের মধ্য হতে কারোর না কারোর টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকবে এবং তারাই পরবর্তীতে বংশবৃদ্ধি করবে। কিন্তু সবাই একই রকমের হলে পুরো মানবকূল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে কারণে আমার ব্যক্তিগত অভিমত মানব ক্লোনিং যদি কোন দিন বৈধ হয়ও, সেক্সের ফলে সৃষ্ট মানব জাতিই টিকে থাকবে, ক্লোনিং মানব জাতি নয়। এ কারণেই আমি মনে করি ঐশ্বরিক ধর্মের মিমগুলো যদি সময়ের সাথে নিজেদেরকে বিবর্তিত না করে তবে তারা অন্যান্য প্রগতিশীল মিমগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এবং হারিয়ে যাবে মানুষের মস্তিষ্কে থেকে যেভাবে হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী হতে বহু ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি। ধর্মে বিশ্বাসীরা এই বাস্তবতা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততই সভ্যতার জন্য মঙ্গল হবে।
নোটঃ উপরের সতর্কবার্তাটির ধারণাটি “Virus of the mind : the new science of the meme / Richard Brodie ” বইয়ের সূচনা থেকে ধার করা। মিম নিয়ে নিজেও মাত্রই জানছি। তাই স্বতস্ফুর্ত আলোচনা হোক এটাই কামনা করি। আর আমি ঠিক করেছি এখন থেকে কোন বিষয় নিয়ে লিখলে লেখার সাথে চেষ্টা করবো একটি হলেও মূল বই সংযুক্ত করে দিতে যেন আগ্রহী পাঠকেরা চাইলে মূল বই থেকে আরো বেশি জানতে পারে। শুধু লেখার উদ্দেশ্য এবং নিজের আনন্দের জন্যই আমার কোন লেখা নয়। লিখি যেন নিজের চিন্তাগুলো অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি। তাই অনুরোধ থাকবে মূল বইগুলো পড়ুন। নিজেও জানুন এবং অন্যের মাঝেও ছড়িয়ে দিন। এভাবেই একমাত্র সম্ভব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর মিমগুলোকে আউট নাম্বার করা।
আজ মিম নিয়ে একটি বই দিচ্ছি যেটি আমার ইস্নিপ্স ফোল্ডার থেকে ডাউনলোড করতে পারবেন Darwinizing culture : the status of memetics as a science / edited by Robert Aunger ; with a foreword by Daniel Dennett. । বইটি্র সফট কপি জোগাড় করে দেওয়ার জন্য সচলায়তন সদস্য শুভাশীষকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
অমরত্বের ইচ্ছে মানুষের সব সময়। মানুষ কোন না কোন ভাবে চায় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। এই সেদিন আমার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটি হু হু করে কাঁদছিলো মৃত্যু ভয়ে। সে মরতে চায় না। এই বয়সেই তার মাঝে মৃত্যু ভয় চলে এসেছে। আমি জানতে চাইলাম কেন তুমি এতো ভয় পাচ্ছো? ভয়টা কিসের? সে জবাব দিল, মারা গেল তার ঘুম আর ভাঙ্গবে না, সে আর কোন দিন খেলা করতে পারবে না, সে আর কোন বন্ধুর সাথে কথা বলতে পারবে না, এটা সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। একটু ভাল ভাবে খেয়াল করে দেখুন এখানে কিন্তু নরকের কোন ভয় নেই। তাহলে দেখতে পারছেন যে কোন প্রকার নরক নামক বস্তুর ভয় ব্যতীতও একজন স্বাভাবিক মানুষের মনে মৃত্যু ভয় চলে আসতে পারে। তারজন্য ধর্ম পর্যন্ত যেতে হয় না। এরকম মৃত্যু ভয়ই হতে পারে একজন দয়ালু ঈশ্বর নামক চিন্তার শুরু।
যা হোক, দু’ভাবে মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। একঃ তাঁর নিজের জিনের প্রতিলিপি তৈরীর মাধ্যমে, দুইঃ তার নিজের বিশ্বাস/আদর্শ/সংস্কৃতি/ভাষা/ ইত্যাদী মিমের প্রতিলিপ তৈরীর মাধ্যমে। জিনের প্রতিলিপ সম্ভব সেক্সের মাধ্যমে অথবা ক্লোনিং এর মাধ্যমে আর মিমের প্রতিলিপ সম্ভব মস্তিষ্কের মাধ্যমে। জিন এবং মিম এই দু’টোর প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যমেই কেবলমাত্র নিশ্চিত করা যায় যে একজন মানুষের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি তৈরী হয়েছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে কোন ভাবেই একজন মানুষ তার সম্পূর্ণ প্রতিলিপি রেখে যেতে পারে না। ক্লোনিং এর ফলে জিনের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি সম্ভব হলেও যে মিমের প্রতিলিপি একই হবে তার নিশ্চয়তা নেই। যে কারণে টুইন বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জেনেটিক বৈশিষ্ট একই থাকলেও তাঁদের চরিত্র ভিন্ন হতে পারে। আবার সেক্সের ফলে জিনের যে প্রতিলিপ তৈরী হয় সেখানে কখনই বাবা/মার একশত ভাগ প্রতিলিপি আসে না।
আমরা যদি ক্লোনিং এর প্রসঙ্গকে আপাতত বাহিরে রাখি, তবে সেক্সই কেমাত্র উপায় জিনের প্রতিলিপি জন্য। তেমনি মিমও কেবলমাত্র প্রতিলিপি তৈরী করতে পারে যদি সে কোন মস্তিষ্কের সংস্পর্শে আসে। যেমন আপনি যদি নির্দিষ্ট কোন সংস্কৃতি/ভাষা/বিশ্বাস এর কথা কোনদিন নাই শুনেন তবে সেই মিমটি সম্পর্কে কোন ধারনাই আপনার মস্তিষ্কে থাকবে না। একটি মিম মস্তিষ্কে তার প্রতিলিপ তৈরী করতে পারে আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। চোখ, কান, ত্বক, ঘ্রাণ, এগুলোর মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকেই তাহলে আমরা মিম হিসেবে সংঙায়িত করতে পারি। যিনি বর্ণান্ধ তার মস্তিষ্কে রঙের কোন ভিন্নতা নেই। তাই মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট কোন মিমের সংস্পর্শে না আসলে মস্তিষ্কে সেই মিমের প্রতিলিপি তৈরী হয় না। মিমের সংস্পর্শে আমরা প্রতিনিয়তই আসছি। এই যে লেখাটি পড়ছেন, আপনি একটি মিম পাচ্ছেন। একটি বই পড়ছেন, মুভি দেখছেন, টিভি/রেডিও দেখছেন/শুনছেন প্রতিনিয়ত মিমের সংস্পর্শে আসছেন। বাবা-মা সন্তাদের সব সময় কোন না কোন মিম দিচ্ছেন। আপনার বন্ধু/বান্ধব, স্কুল/কলেজ, অফিস/আদালত সব কিছু হতে আপনি মিম পাচ্ছেন।
এখন কে বেশি শক্তিশালী তাহলে? জিন নাকি মিম? প্রশ্নটির জবাব পেতে হলে আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে কার প্রতিলিপি তাহলে বেশি তৈরি হচ্ছে? কে বেশি ছড়িয়ে দিতে পারছে নিজেকে? সেক্সের দ্বারা আপনি আপনার নিজের জিনের কতগুলো প্রতিলিপি তৈরি করতে পারছেন? চেঙ্গিস খানের মত হলেও এক জীবন বেশি হলে একশত সন্তান রেখে যেতে পারলেন একাধিক স্ত্রীর ঘরে। তারপরেও কথা থাকে - জিনের প্রতিলিপি কখনই নিজের একশত ভাগ হয় না এবং জিনের প্রতিলিপি হলেই মিমের প্রতিলিপি তৈরি হয় না। অন্যদিকে মিমের প্রতিলিপি আপনি যে কারোর মাঝেই ছড়িয়ে দিতে পারেন, তার জন্য নিজের জেনেটিক প্রতিলিপির দরকার নেই। যে কারণে খুব সহজেই একটি মিম কোটি কোটি মানুষের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যেতে পারে।
তাহলে বুঝতেই পারছেন কেন মানুষ আজ এগিয়ে গিয়েছে অন্য জীবের তুলনায়। অন্যান্য প্রাণী গোষ্ঠী যেখানে কেবলমাত্র জিনের প্রতিলিপি তৈরি করে সেখানে মানুষ জিনের প্রতিলিপির সাথে মিমেরও প্রতিলিপি তৈরি করে। জিনের মিউটেশান যেখানে খুব ধীর গতির, মিমের মিউটেশান সেখানে দ্রুত গতির। যে কারণেই বিবর্তনের এক দম শেষ দিবসে এসে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হলেও খুব সহজেই মানুষ অন্যান্য জীব গোষ্ঠি্কে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে হুর হুর করে, এবং এ সম্ভব হয়েছে মস্তিষ্কের এই মিমের প্রতিলিপির ফলেই। মানুষ তার পূর্ব-অভিজ্ঞতায় অর্জিত জ্ঞান তার পরবর্তী জেনেরাশানে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, এবং ছড়িয়ে দিতে পেরেছে অন্যান্য মানুষের মাঝেও।
মিমের বিবর্তন দ্রুত গতির হলেও, সেটিও প্রাকৃতিক নির্বাচনের বাহিরে নয় মোটেই। যে মিমগুলো সময়ের প্রেক্ষিতে টিকে থাকায় সহায়তা করেছে তারাই নির্বাচিত হয়েছে এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছে। ধর্ম, নৈতিকতা, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ সহ যে কোন মিমকেই এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব। প্রতিটি মিমের কাজ হচ্ছে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া, নিজের প্রতিলিপি তৈরি করা। মানুষের মস্তিষ্কই এই মিমগুলো ধারণ করে আবার বর্জন করে। সময়ের প্রয়োজনেই ধর্মগুলো এসেছিলো, আবার তাঁদের কার্যকারিতা না থাকলে সময়ের প্রয়োজনেই সেগুলো বিবর্তিত হবে অথবা হারিয়ে যাবে।
জিনপুলে যেমন পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে যাওয়ার আগে ড়্যান্ডম মিউটেশান ঘটে তেমনি মিমের ক্ষেত্রেও ঘটে। এক বাংলা ভাষাই যদি দেখেন তবে দেখবেন যে আজকে আমরা যে ভাষায় কথা বলি সে ভাষাতেই কি আমাদের কয়েক পূর্বপুরুষ আগের মানুষেরা কথা বলতো। সামনের দিকে ভাষার মাঝে আরো পরিবর্তন আসবে, এবং সেটাই স্বাভাবিক। এখন যখন কোন মিম নিজেকে অবিকৃত রেখে ছড়াতে চায় তখনই কনফ্লিক্ট শুরু হয়। ধর্ম যদি নিজেকে বিবর্তিত করতে পারতো তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু ধর্ম যখন নিজেকে ঈশ্বরের বাণী বলে অবিকৃত থাকতে যায়, তখনই সে অন্যান্য মিউটেডেট মিমের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।
মিউটেশন অবশ্যই নন-মিউটেশানের তুলনায় উন্নত হবে। মিউটেশানের ফলে জিনপুলে, মিমপুলে অনেক বৈচিত্র থাকে। যার ফলে যে কোন প্রতিকূল পরিবেশে এই বৈচিত্রের মধ্য হতে কারোর না কারোর টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকবে এবং তারাই পরবর্তীতে বংশবৃদ্ধি করবে। কিন্তু সবাই একই রকমের হলে পুরো মানবকূল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে কারণে আমার ব্যক্তিগত অভিমত মানব ক্লোনিং যদি কোন দিন বৈধ হয়ও, সেক্সের ফলে সৃষ্ট মানব জাতিই টিকে থাকবে, ক্লোনিং মানব জাতি নয়। এ কারণেই আমি মনে করি ঐশ্বরিক ধর্মের মিমগুলো যদি সময়ের সাথে নিজেদেরকে বিবর্তিত না করে তবে তারা অন্যান্য প্রগতিশীল মিমগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এবং হারিয়ে যাবে মানুষের মস্তিষ্কে থেকে যেভাবে হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী হতে বহু ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি। ধর্মে বিশ্বাসীরা এই বাস্তবতা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততই সভ্যতার জন্য মঙ্গল হবে।
নোটঃ উপরের সতর্কবার্তাটির ধারণাটি “Virus of the mind : the new science of the meme / Richard Brodie ” বইয়ের সূচনা থেকে ধার করা। মিম নিয়ে নিজেও মাত্রই জানছি। তাই স্বতস্ফুর্ত আলোচনা হোক এটাই কামনা করি। আর আমি ঠিক করেছি এখন থেকে কোন বিষয় নিয়ে লিখলে লেখার সাথে চেষ্টা করবো একটি হলেও মূল বই সংযুক্ত করে দিতে যেন আগ্রহী পাঠকেরা চাইলে মূল বই থেকে আরো বেশি জানতে পারে। শুধু লেখার উদ্দেশ্য এবং নিজের আনন্দের জন্যই আমার কোন লেখা নয়। লিখি যেন নিজের চিন্তাগুলো অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি। তাই অনুরোধ থাকবে মূল বইগুলো পড়ুন। নিজেও জানুন এবং অন্যের মাঝেও ছড়িয়ে দিন। এভাবেই একমাত্র সম্ভব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর মিমগুলোকে আউট নাম্বার করা।
আজ মিম নিয়ে একটি বই দিচ্ছি যেটি আমার ইস্নিপ্স ফোল্ডার থেকে ডাউনলোড করতে পারবেন Darwinizing culture : the status of memetics as a science / edited by Robert Aunger ; with a foreword by Daniel Dennett. । বইটি্র সফট কপি জোগাড় করে দেওয়ার জন্য সচলায়তন সদস্য শুভাশীষকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
Wednesday, November 17, 2010
এলোমেলো চিন্তাঃ “ডোপামিন” তার নাম
ডেনিয়েল ডেনেটের Breaking the spell বইটা পড়ে Lancet liver fluke পরজীবির কথা জানতে পারি যেটার কথা আমার এলোমেলো চিন্তাঃ বিবর্তনময় জীবন এই লেখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম। এই পরজীবি তার জৈবিক চক্রের একটি ধাপে যখন পিঁপড়ের মাঝে বংশবৃদ্ধি করে তখন এক পর্যায়ে পিঁপড়ের মস্তিষ্কের দখল নিয়ে ফেলে এবং পিঁপড়েটিকে এক প্রকার সুখানুভুতি প্রদানের মাধ্যমে বাধ্য করে পরজীবিটির নিজ উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করার জন্য। ডেনেট মানুষের বিশ্বাস ব্যবস্থাকে সেরকম কিছু পরজীবির সাথে তুলনা করেছেন। মানুষ নিজের বিশ্বাসকে রক্ষার্থে নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে পারে, টুইন টাওয়ারে বিমান নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পারে।
কিন্তু বিশ্বাস একটি এবস্ট্রাক্ট কিছু। তাহলে বিশ্বাস কিভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে আত্মহননের মত কাজে। নিশ্চয়ই মানুষের মস্তিষ্কেও সেরকম কোন একটি পোকার অবস্থান রয়েছে যেটি উক্ত কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। হয়তো সেই পোকাও আমাদেরকে এক প্রকার সুখানুভুতি প্রদান করে। যে কারণে কোন কাজ করলে ভাল লাগে, অথবা কোন কাজ করতে ইচ্ছে করে না। নিজের মাঝে এই পোকার অবস্থান সব সময় টের পাই। এই পোকাই বাধ্য করে নিজের আসল গবেষণা ফেলে বনের মোষ তাড়ানোর গবেষণা করতে, ব্লগে লেখা দিতে। এই পোকাই বাধ্য করে সমাজ, বিশ্ব জগৎ ইত্যাদী নিয়ে চিন্তা করতে। আমার বিশ্বাস এ রকম পোকার অস্তিত্ব কম বেশি সবার মাঝেই রয়েছে।
বহুদিন পোকাটির অস্তিত্বটি টের পেলেও, তার পরিচয় জানার সুযোগ হয়নি। সম্প্রতি পোকাটির নাম জানতে পারলাম। এর নাম নাকি ডোপামিন (উচ্চারণটি কি ডোপামাইন হবে?) মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে এই ডোপামিনের তারতম্যের ফলেই নাকি মানুষের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, চেতনা, অনুভূতি, কার্মদক্ষতা , কর্মস্পৃহা ইত্যাদীর তারতম্য দেখা যায়। এই ডোপামিনের অভাবেই পারকিনসসের মত রোগ হয় যার এক মাত্র চিকিৎসা হচ্ছে ডোপামিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া। আবার এর অত্যাধিকতার জন্য অটিজম, সিজ্রোফেনিয়া, হাইপার একটিভিটি, ম্যানিয়া এর মত মানসিক রোগগুলো দেখা যায়। এর প্রভাবেই নাকি মানুষের মাঝে অত্যাধিক বুদ্ধিমত্তা কিংবা ধর্ম/বিশ্ব নিয়ে বেশি চিন্তা করার প্রবনতা, তীব্র প্রতিযোগিতা মনোভাবাপন্নতা দেখা যায়। এর আধিক্যের ফলে অতিপ্রাকৃতিক অনুভূতি লাভ হয়, যার ফলে স্বর্গ/নরক কিংবা ঈশ্বরের দেখা পাওয়ার মত অনুভূতি হতে পারে। এরই ফলে মানুষের মাঝে দূর ভবিষ্যৎ কিংবা মহা বিশ্বের মত বৃহৎ আকার নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হয়। আজ পর্যন্ত যত সমর নায়ক, ধর্ম অবতার, কিংবা দার্শনিক, বিজ্ঞানী এসেছেন তাঁদের মাঝে এই ডোপামিনের আধিক্য ছিল বলে ধারনা করা হয়।
এটি মানুষের সকল কর্মস্পৃহার মূলে। এটি কাজ করে পূরষ্কারের ভিক্তিতে। অর্থাৎ কোন কাজ ভাল লাগলে পুরষ্কার হিসেবে মস্তিষ্কে এই বস্তু কিছুটা নিঃসৃত হলে আপনার মনে এক ধরণের ভাল লাগা অনুভুত হবে যার ফলে আপনি আবার সেই কাজটি করার জন্য উদ্বুদ্ধ হবেন। কোন ভাল খাবার খেলে বা সেক্সের ফলে, বা কোন ভাল কাজের ফলে এই বস্তুর নিঃসরণ ঘটে যার কারণে আমরা তৃপ্তিলাভ করি। একই রকমের অনুভুতি কোকেন বা উদ্দিপক নানান ড্রাগের মাধ্যমেও পাওয়া যায়। শুধু ভাল কাজেই যে তা নয়, আক্রমনাত্মক কাজেও এই বস্তুর নিঃসরণ যুক্ত। মোটকথা এই বস্তুই আমাদের মাথার সেই পোকা যে কিনা আমাদেরকে তার পথে চালায়।
মানুষের আজকের এই আধুনিক বুদ্ধিমত্তার মানুষ হয়ে উঠার পেছনেও নাকি মস্তিষ্কের আকারের তুলনায় এই ডোপামিনের প্রভাবই বেশি বলে এক পক্ষের ধারনা। আমি নিশ্চিত এই লেখাটি আমাদের সেই “নেচার ভার্সেস নেচার” বিতর্ককে আবার উসকে দিবে। এই পক্ষের ধারনা যে মানুষের মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি হলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তা সেভাবে বাড়েনি বরং ২ লক্ষ বছর আগে আধুনিক মানুষের উৎপত্তি হলেও তখনকার তুলনায় মানুষের মস্তিষ্কের আকার বেশি পরিবর্তন হয়নি, বরং কিছুটা কমেছে। কিন্তু আমরা দেখি যে জেনেটিকালি খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তার বেশ উন্নতি হয় এবং সেই উন্নতির পেছনে এই ডোপামিনের অবদানকেই ধরা হচ্ছে। আধুনিক মানুষের আগেও আমাদের যে পূর্বপুরুষেরা ছিল তাঁদের মাঝেও এই ডোপামিন ছিল কিন্তু তার পরিমান আজকের মানুষদের তুলনায় প্রায় অর্ধেক ছিল। এই পক্ষের ধারনা মানুষের আদি পূর্বপুরষদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের যাত্রা শুরু হয় মূলত মাংসাশী প্রাণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে এবং গায়ের লোম কমা শুরুর পর থেকে। ডোপামিন মানুষের দেহ হতে তাপ দ্রুত কমাতে সাহায্য করে। তাই গায়ের লোম কমার পাশাপাশি সে সময় ডোপামিনের পরিমানও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শুধু মাংসাশী প্রাণী এবং তাপ ঝরানোর কারণেই ডোপামিনের পরিমান অনেক বেশি হয়ে যায় না। তাই পরবর্তী ১০০,০০০ বছরে মানুষের বুদ্ধিমত্তায় তেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। সেই সময়কার তাঁদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সেই ধারনাই দেয়।
প্রায় ১৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ হাজার বছরের দিকে কিছু আধুনিক মানুষ পূর্ব আফ্রিকা হতে দক্ষিণের দিকে মাইগ্রেট করে এবং এই সময় সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি থাকার কারণে এবং বড় বড় মাংসাশী প্রাণীর অভাবের কারণে তাঁদের খাদ্যাভাসে সামুদ্রিক প্রাণী/মাছ নিয়ে আসে। সামুদ্রিক মাছ খাদ্য তালিকায় প্রবেশের কারণে তাঁদের শরীরে আয়োডিনের পরিমান বৃদ্ধি পায়। এই আয়োডিনের ফলে, থাইরয়েড প্রন্থির প্রভাবে সেই মানুষের মাঝে ডোপামিনের মাত্রা আরেক দফা বৃদ্ধি পায়। যার কারণে এই সময়কার মানুষের পাথরের যন্ত্রপাতিগুলো উন্নত হয়। যন্ত্রপাতিগুলো আগের চেয়ে ধারালো, এবং কার্যকর হয়। এই সময় মানুষের মাঝে বিভিন্ন সংস্কৃতি, আর্ট এগুলোও দেখা যায়। কিন্তু শুধু্মাত্র মাংসভোজ কিংবা আয়োডিনের প্রভাবেই আজকের এই ডোপামিনের সভ্যতা নয়।
এই সময়টাতেও মানুষ মূলত শিকারী এবং সংগ্রাহক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতো। মানুষ তখনো পুরোপুরি কৃষিনির্ভর হয়ে উঠেনি, যে কারণে তখনো জনসংখ্যার পরিমান বেশি হয়নি এবং এর ঘনত্ব অনেক কম ছিল। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সেভাবে প্রবল হয়ে দেখা দেয়নি। কিন্তু প্রায় ৮০০০ বছর আগে এই শিকারী গোত্রের বেশির ভাগ মানুষই পাকাপাকি ভাবে কৃষিকাজ শুরু করে এবং যার ফলে সমাজের চরিত্র দ্রুত বদলাতে থাকে। জনসংখ্যার বিষ্ফোরণ ঘটে, জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়, বৃহৎ আকারে সমাজ, রাষ্ট্রের মত সংস্থা তৈরী হয়। মানুষের মাঝে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এই চরম প্রতিযোগিতাই মানুষের মাঝে ডোপামিনের পরিমান বৃদ্ধি করে এবং যার ফলে আমরা আজকের এই ডোপামিনিক সভ্যতা দেখতে পাচ্ছি।
ডোপামিনের বৃদ্ধির ফলে মানুষের মাঝে চরম প্রতিযোগিতা মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। লেখকের মতে আমরা এখন হাইপার ডোপামিনিক সময়ের মাঝে আছি। এর শুরু হয়েছে ইন্ড্রাসটিয়াল রেভুলেশানর পর থেকে বা আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরুর পর থেকে। মানুষ এখন আগেরকার যে কোন সময়ের তুলনায় বেঁচে থাকার জন্য সর্বোচ্চ প্রতিযোগীতার মধ্যে দিয়ে যায়। লেখক এই পর্যায়ে এসে অনেকটা দার্শনিক হয়ে যান। তিনি কামনা করেন এই হাইপার ডোপামিনিক সভ্যতা হতে রিভার্স প্রক্রিয়ায় আমরা আরেকটু কম ডোপামিন মাত্রার সভ্যতায় যেতে পারি কিনা সেই প্রশ্ন রেখে। ডোপামিন নিয়ে গবেষণা এখনো শুরুর দিকে। আশা করা যায় ভবিষ্যতে এই বস্তুর প্রভাব আরো ভাল করে বুঝা যাবে। বুঝা যাচ্ছে এর মাধ্যমেই মস্তিষ্কের আচরণকে আরো ভাল করে জানা সম্ভব হবে।
নোটঃ এই লেখাটি Fred H. Previc এর The Dopaminergic Mind in Human Evolution and History বই অবলম্বনে লেখা হয়েছে। আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আগ্রহীদেরকে উক্ত বইটি পড়ে দেখতে বলবো। সময়ের অভাবে পুরো বইটি অনুবাদ করা অসম্ভব আমার পক্ষে। এই লেখাটিকে সারমর্ম হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। তারপরেও মনে করি লেখাটি আরো ভাল হতে পারতো। আরো কিছু বিষয়ে বিস্তারিত লেখা যেতে পারতো। কিছু ছবি যুক্ত করা যেতে পারতো। কিন্তু সেগুলো সব করতে গেলে হয়তো লেখাটিই আর আত্মপ্রকাশ করতো না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে অন্তত কিছু হলেও লেখা উচিৎ মুক্তমনার পাঠক/লেখকদের জন্য। আমি মনে করি মানব মস্তিষ্কের আচরণ সুনির্দিষ্ট ভাবে বুঝার মাঝেই নীহিত রয়েছে মানব সভ্যতার ভবিষ্যত। সবশেষে মুক্তমনা ও সচলায়তনের সদস্য সিরাতকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই বইটির খোঁজ দেওয়ার জন্য। সিরাতের এই লেখাটির মাধ্যমেই প্রথম বইটির কথা জানতে পারি।
কিন্তু বিশ্বাস একটি এবস্ট্রাক্ট কিছু। তাহলে বিশ্বাস কিভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে আত্মহননের মত কাজে। নিশ্চয়ই মানুষের মস্তিষ্কেও সেরকম কোন একটি পোকার অবস্থান রয়েছে যেটি উক্ত কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। হয়তো সেই পোকাও আমাদেরকে এক প্রকার সুখানুভুতি প্রদান করে। যে কারণে কোন কাজ করলে ভাল লাগে, অথবা কোন কাজ করতে ইচ্ছে করে না। নিজের মাঝে এই পোকার অবস্থান সব সময় টের পাই। এই পোকাই বাধ্য করে নিজের আসল গবেষণা ফেলে বনের মোষ তাড়ানোর গবেষণা করতে, ব্লগে লেখা দিতে। এই পোকাই বাধ্য করে সমাজ, বিশ্ব জগৎ ইত্যাদী নিয়ে চিন্তা করতে। আমার বিশ্বাস এ রকম পোকার অস্তিত্ব কম বেশি সবার মাঝেই রয়েছে।
বহুদিন পোকাটির অস্তিত্বটি টের পেলেও, তার পরিচয় জানার সুযোগ হয়নি। সম্প্রতি পোকাটির নাম জানতে পারলাম। এর নাম নাকি ডোপামিন (উচ্চারণটি কি ডোপামাইন হবে?) মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে এই ডোপামিনের তারতম্যের ফলেই নাকি মানুষের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, চেতনা, অনুভূতি, কার্মদক্ষতা , কর্মস্পৃহা ইত্যাদীর তারতম্য দেখা যায়। এই ডোপামিনের অভাবেই পারকিনসসের মত রোগ হয় যার এক মাত্র চিকিৎসা হচ্ছে ডোপামিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া। আবার এর অত্যাধিকতার জন্য অটিজম, সিজ্রোফেনিয়া, হাইপার একটিভিটি, ম্যানিয়া এর মত মানসিক রোগগুলো দেখা যায়। এর প্রভাবেই নাকি মানুষের মাঝে অত্যাধিক বুদ্ধিমত্তা কিংবা ধর্ম/বিশ্ব নিয়ে বেশি চিন্তা করার প্রবনতা, তীব্র প্রতিযোগিতা মনোভাবাপন্নতা দেখা যায়। এর আধিক্যের ফলে অতিপ্রাকৃতিক অনুভূতি লাভ হয়, যার ফলে স্বর্গ/নরক কিংবা ঈশ্বরের দেখা পাওয়ার মত অনুভূতি হতে পারে। এরই ফলে মানুষের মাঝে দূর ভবিষ্যৎ কিংবা মহা বিশ্বের মত বৃহৎ আকার নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হয়। আজ পর্যন্ত যত সমর নায়ক, ধর্ম অবতার, কিংবা দার্শনিক, বিজ্ঞানী এসেছেন তাঁদের মাঝে এই ডোপামিনের আধিক্য ছিল বলে ধারনা করা হয়।
এটি মানুষের সকল কর্মস্পৃহার মূলে। এটি কাজ করে পূরষ্কারের ভিক্তিতে। অর্থাৎ কোন কাজ ভাল লাগলে পুরষ্কার হিসেবে মস্তিষ্কে এই বস্তু কিছুটা নিঃসৃত হলে আপনার মনে এক ধরণের ভাল লাগা অনুভুত হবে যার ফলে আপনি আবার সেই কাজটি করার জন্য উদ্বুদ্ধ হবেন। কোন ভাল খাবার খেলে বা সেক্সের ফলে, বা কোন ভাল কাজের ফলে এই বস্তুর নিঃসরণ ঘটে যার কারণে আমরা তৃপ্তিলাভ করি। একই রকমের অনুভুতি কোকেন বা উদ্দিপক নানান ড্রাগের মাধ্যমেও পাওয়া যায়। শুধু ভাল কাজেই যে তা নয়, আক্রমনাত্মক কাজেও এই বস্তুর নিঃসরণ যুক্ত। মোটকথা এই বস্তুই আমাদের মাথার সেই পোকা যে কিনা আমাদেরকে তার পথে চালায়।
মানুষের আজকের এই আধুনিক বুদ্ধিমত্তার মানুষ হয়ে উঠার পেছনেও নাকি মস্তিষ্কের আকারের তুলনায় এই ডোপামিনের প্রভাবই বেশি বলে এক পক্ষের ধারনা। আমি নিশ্চিত এই লেখাটি আমাদের সেই “নেচার ভার্সেস নেচার” বিতর্ককে আবার উসকে দিবে। এই পক্ষের ধারনা যে মানুষের মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি হলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তা সেভাবে বাড়েনি বরং ২ লক্ষ বছর আগে আধুনিক মানুষের উৎপত্তি হলেও তখনকার তুলনায় মানুষের মস্তিষ্কের আকার বেশি পরিবর্তন হয়নি, বরং কিছুটা কমেছে। কিন্তু আমরা দেখি যে জেনেটিকালি খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তার বেশ উন্নতি হয় এবং সেই উন্নতির পেছনে এই ডোপামিনের অবদানকেই ধরা হচ্ছে। আধুনিক মানুষের আগেও আমাদের যে পূর্বপুরুষেরা ছিল তাঁদের মাঝেও এই ডোপামিন ছিল কিন্তু তার পরিমান আজকের মানুষদের তুলনায় প্রায় অর্ধেক ছিল। এই পক্ষের ধারনা মানুষের আদি পূর্বপুরষদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের যাত্রা শুরু হয় মূলত মাংসাশী প্রাণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে এবং গায়ের লোম কমা শুরুর পর থেকে। ডোপামিন মানুষের দেহ হতে তাপ দ্রুত কমাতে সাহায্য করে। তাই গায়ের লোম কমার পাশাপাশি সে সময় ডোপামিনের পরিমানও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শুধু মাংসাশী প্রাণী এবং তাপ ঝরানোর কারণেই ডোপামিনের পরিমান অনেক বেশি হয়ে যায় না। তাই পরবর্তী ১০০,০০০ বছরে মানুষের বুদ্ধিমত্তায় তেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। সেই সময়কার তাঁদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সেই ধারনাই দেয়।
প্রায় ১৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ হাজার বছরের দিকে কিছু আধুনিক মানুষ পূর্ব আফ্রিকা হতে দক্ষিণের দিকে মাইগ্রেট করে এবং এই সময় সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি থাকার কারণে এবং বড় বড় মাংসাশী প্রাণীর অভাবের কারণে তাঁদের খাদ্যাভাসে সামুদ্রিক প্রাণী/মাছ নিয়ে আসে। সামুদ্রিক মাছ খাদ্য তালিকায় প্রবেশের কারণে তাঁদের শরীরে আয়োডিনের পরিমান বৃদ্ধি পায়। এই আয়োডিনের ফলে, থাইরয়েড প্রন্থির প্রভাবে সেই মানুষের মাঝে ডোপামিনের মাত্রা আরেক দফা বৃদ্ধি পায়। যার কারণে এই সময়কার মানুষের পাথরের যন্ত্রপাতিগুলো উন্নত হয়। যন্ত্রপাতিগুলো আগের চেয়ে ধারালো, এবং কার্যকর হয়। এই সময় মানুষের মাঝে বিভিন্ন সংস্কৃতি, আর্ট এগুলোও দেখা যায়। কিন্তু শুধু্মাত্র মাংসভোজ কিংবা আয়োডিনের প্রভাবেই আজকের এই ডোপামিনের সভ্যতা নয়।
এই সময়টাতেও মানুষ মূলত শিকারী এবং সংগ্রাহক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতো। মানুষ তখনো পুরোপুরি কৃষিনির্ভর হয়ে উঠেনি, যে কারণে তখনো জনসংখ্যার পরিমান বেশি হয়নি এবং এর ঘনত্ব অনেক কম ছিল। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সেভাবে প্রবল হয়ে দেখা দেয়নি। কিন্তু প্রায় ৮০০০ বছর আগে এই শিকারী গোত্রের বেশির ভাগ মানুষই পাকাপাকি ভাবে কৃষিকাজ শুরু করে এবং যার ফলে সমাজের চরিত্র দ্রুত বদলাতে থাকে। জনসংখ্যার বিষ্ফোরণ ঘটে, জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়, বৃহৎ আকারে সমাজ, রাষ্ট্রের মত সংস্থা তৈরী হয়। মানুষের মাঝে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এই চরম প্রতিযোগিতাই মানুষের মাঝে ডোপামিনের পরিমান বৃদ্ধি করে এবং যার ফলে আমরা আজকের এই ডোপামিনিক সভ্যতা দেখতে পাচ্ছি।
ডোপামিনের বৃদ্ধির ফলে মানুষের মাঝে চরম প্রতিযোগিতা মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। লেখকের মতে আমরা এখন হাইপার ডোপামিনিক সময়ের মাঝে আছি। এর শুরু হয়েছে ইন্ড্রাসটিয়াল রেভুলেশানর পর থেকে বা আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরুর পর থেকে। মানুষ এখন আগেরকার যে কোন সময়ের তুলনায় বেঁচে থাকার জন্য সর্বোচ্চ প্রতিযোগীতার মধ্যে দিয়ে যায়। লেখক এই পর্যায়ে এসে অনেকটা দার্শনিক হয়ে যান। তিনি কামনা করেন এই হাইপার ডোপামিনিক সভ্যতা হতে রিভার্স প্রক্রিয়ায় আমরা আরেকটু কম ডোপামিন মাত্রার সভ্যতায় যেতে পারি কিনা সেই প্রশ্ন রেখে। ডোপামিন নিয়ে গবেষণা এখনো শুরুর দিকে। আশা করা যায় ভবিষ্যতে এই বস্তুর প্রভাব আরো ভাল করে বুঝা যাবে। বুঝা যাচ্ছে এর মাধ্যমেই মস্তিষ্কের আচরণকে আরো ভাল করে জানা সম্ভব হবে।
নোটঃ এই লেখাটি Fred H. Previc এর The Dopaminergic Mind in Human Evolution and History বই অবলম্বনে লেখা হয়েছে। আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আগ্রহীদেরকে উক্ত বইটি পড়ে দেখতে বলবো। সময়ের অভাবে পুরো বইটি অনুবাদ করা অসম্ভব আমার পক্ষে। এই লেখাটিকে সারমর্ম হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। তারপরেও মনে করি লেখাটি আরো ভাল হতে পারতো। আরো কিছু বিষয়ে বিস্তারিত লেখা যেতে পারতো। কিছু ছবি যুক্ত করা যেতে পারতো। কিন্তু সেগুলো সব করতে গেলে হয়তো লেখাটিই আর আত্মপ্রকাশ করতো না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে অন্তত কিছু হলেও লেখা উচিৎ মুক্তমনার পাঠক/লেখকদের জন্য। আমি মনে করি মানব মস্তিষ্কের আচরণ সুনির্দিষ্ট ভাবে বুঝার মাঝেই নীহিত রয়েছে মানব সভ্যতার ভবিষ্যত। সবশেষে মুক্তমনা ও সচলায়তনের সদস্য সিরাতকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই বইটির খোঁজ দেওয়ার জন্য। সিরাতের এই লেখাটির মাধ্যমেই প্রথম বইটির কথা জানতে পারি।
Monday, November 1, 2010
এলোমেলো চিন্তাঃ জীবনের উদ্দেশ্য এবং Inception
জীবনের উদ্দেশ্য কি? - এই প্রশ্ন মানুষের মনে প্রথম কবে আসে বলা মুশকিল। মানুষ যখন মূলত শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো তখন, নাকি যখন প্রথম কৃষিজীবি হয়ে উঠে তখন থেকেই এই প্রশ্নের উৎপত্তি। প্রশ্নের শুরু যখন থেকেই হোক সেই প্রশ্ন যে বংশপরম্পরায় আজো আমরাও বহন করে চলছি তার প্রমান পাই আজো সবার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজা দেখে। এই প্রশ্নের পেছনে কোন একক নির্দিষ্ট জাতি শুধু সময় ব্যয় করেনি- বলা যায় ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সকলেই কোন না কোন জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এর সবচেয়ে সহজ যে জবাবটি আমরা দেখি তা হল দু’স্বত্বা, দু’জগত এবং এক বা বহু সৃষ্টিকর্তার চিন্তাতে। এই বিশ্বাস মূলত নির্ভর করছে দেহ এবং আত্মা এই দুটি বিষয়ের উপর। দেহের মৃত্যুর পর আত্মার অমরণশীলতা এবং সে সাথে নুতন একটি জগতে প্রবেশ করা, এই ধারণার উপর ভিক্তি করে এই জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা।
সকলেই যে এই মতবাদে বিশ্বাসী তা নয়। তারা কোন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী নয় বা মৃত্যুর পরের কোন জগতেও বিশ্বাসী নয়। তাছাড়া, আধুনিক বিজ্ঞানেও মন বা আত্মার আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া/প্রতিক্রিয়ার মাঝেই মনের অবস্থান। মস্তিষ্কের মৃত্যুর মাঝে মনেরও মৃত্যু ঘটে। আত্মা যদি নাও থাকে সমস্যা রয়েই যায়, তা হলো এই জীবনের উদ্দেশ্য কি? কেনই বা এই পৃথিবী আর কেনই বা এত দ্বন্দ্ব।
এই কিছুদিন আগেও মানুষের কাছে এর জবাব ছিলনা। কিন্তু অধুনা জেনেটিক বিজ্ঞান, ণৃ-বিজ্ঞান, এবং জীববিজ্ঞানের ফলে মানুষ আজ তার নিজের বিবর্তন সম্পর্কে অতীতের চেয়েও অনেক বেশি জানে। জীববিজ্ঞানের শাখায় বিবর্তন আজ একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়। এটি শুধু জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ না থেকে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, জেনেটিক্স এর মত শাখাগুলোতেও আজ প্রয়োগ হচ্ছে। AIDS ভাইরাস বা সুপারবাগ ব্যাক্টেরিয়ার মত প্রাণঘাতী জীবগুলোর প্রতিষেধক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিবর্তনের জ্ঞানকে কাজে লাগানো হচ্ছে। মানুষের আচার/ব্যবহার বিশ্লেষণের জন্য, মানুষের বিভিন্ন মানসিক রোগ অথবা অটিজমের মত রোগগুলোকে বিশ্লেষণের জন্য মনোবিদ্যায় বিবর্তনকে কাজ লাগানো হচ্ছে। এ ছাড়া মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ আচরনকে বোঝার জন্য কিংবা জাতিগত দ্বন্দ্ব নিরসনে, বা অর্থনীতির মত বিষয়গুলোকে বোঝার জন্যেও আজ বিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে বিবর্তনীয় সমাজবিজ্ঞান,বিবর্তনীয় অর্থনীতির মত বিষয়গুলোর চালু হয়েছে।
আজকের এই লেখায় বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার আলোকে জীবনের উদ্দেশ্য তুলে ধরার কিছুটা চেষ্টা করবো। বিবর্তনীয় মনোবিদ্যা অনুসারে মানুষের মস্তিষ্ক তার অন্যান্য অঙ্গের মতই দীর্ঘ বিবর্তনের একটি ফসল। অন্যান্য প্রাণীদের থেকে আমরা এগিয়ে গিয়েছি আমাদের এই বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মস্তিষ্কের জন্য। এ জন্য আমাদের মস্তিষ্কের আকার অন্যান্য প্রাণীদের থেকে বড়। বিবর্তনের উপর প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য মুক্তমনা ও সচলের লেখক বন্যা আহমেদের বিবর্তনের পথ ধরে বইটি পড়তে পারেন। এটি বাংলা ভাষায় বিবর্তনের উপর লেখা একটি অসাধারণ বই। খুব সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য বইটি লেখা হয়েছে। আমার নিজের প্রাথমিক জ্ঞানও লাভ করি এই বই থেকে।
আমাদের দেহকে যদি একটি যন্ত্র হিসেবে চিন্তা করেন এবং তাহলে মস্তিষ্ককে চিন্তা করতে পারেন একটি গণনা কেন্দ্র হিসেবে যেটি বিশ্বের আধুনিকতম কম্পিউটারের চেয়েও শক্তিশালী। শুধু এর ভেতর তারের জালের পরিবর্তে রয়েছে অসংখ্য সুক্ষ্ণ নার্ভ। মানুষকে চিন্তা করতে পারেন একটি রোবট হিসেবে, শু্ধু এর পার্টসগুলো তৈরী হচ্ছে মাংস দিয়ে। মস্তিষ্ক হচ্ছে আমাদের দেহের প্রসেসিং ইউনিট। যে কোন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য চলে যায় মস্তিষ্কে এবং মস্তিষ্ক সেটি প্রসেস করে, তার পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে করণীয় নির্ধারণ করে সেটা পাঠিয়ে দেয় যথাযথ প্রত্যঙ্গের কাছে।
মস্তিষ্ক আবার একই সাথে একটি প্রসেসিং যন্ত্র এবং তথ্য সংরক্ষনের স্থান। আমাদের যাবতীয় তথ্য এখানে সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু মস্তিষ্কের আকার যেহেতু সীমাবদ্ধ তাই সকল তথ্যই আমাদের পক্ষে ধারণ করা সম্ভব হয় না। কোন তথ্য সংরক্ষন করা হবে তার জন্য মস্তিষ্ক পূর্ব অভিজ্ঞতা, কতটা মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, তথ্যের প্রয়োজনীয়তা এসবের উপর ভিক্তি করে একটি রেটিং করে এবং সেভাবে সে সংগ্রহ করে। এ জন্য দেখা যায় যে অনেক কিছুই আমরা দেখি/শুনি/পড়ি কিন্তু সকল তথ্য আমাদের স্মরণ থাকে না। আবার সকল তথ্য একই গভীরতায় সংরক্ষিত হয় না। যে সব তথ্য আমরা দৈনন্দিন ব্যবহার করি সেগুলো প্রথম ধাপেই রাখা হয় যেন সহজেই চাইলে পাওয়া যায়। আর যেগুলো সচারচর ব্যবহার করা হয়না সেগুলো একটু গভীরে রাখা হয়। অনেকটা একটি দোকানের জিনিস সংরক্ষনের মত। চালু আইটেমগুলোকে হাতের নাগালেই রাখা হয়, আর একটু কম চালু বা দামী জিনিসগুলোকে গোডাউনে অথবা বিশেষ স্থানে রাখা হয়।
মানুষের নানান আচার/ব্যবহার মস্তিষ্কের গঠন/গড়ন এবং এর কার্যপদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত করা সম্ভব। অবশ্য এই বিষয়গুলো এখনো নুতন, প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে এই বিষয়ের উপর। বিশেষ করে মস্তিষ্কের স্ক্যানিং প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হবার পর বিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছে মস্তিষ্কের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে আরো বিষদভাবে জানার জন্য। আশা করা যায় একদিন মানুষ সেই লক্ষ্যে পৌছতে পারবে। তখন হয়তো মানুষের কছাকাছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরী করা সক্ষম হবে। মস্তিষ্কের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো বেশি জানার জন্য Evolutionary psychology বা শুধু psychology এর উপর যে কোন বই দেখতে পারেন আগ্রহী পাঠকগণ।
আমি এবার একটু লম্ফ দিব আরেকটি বইয়ের গল্পে। এই বইটির লেখক ডেনিয়েল ডেনেট, তিনি বর্তমান কালের একজন দার্শনিক। তিনি Tufts University এর একজন অধ্যাপক। কাজ করেন মূলত মনোবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, দর্শন নিয়ে। সম্প্রতি তার একটি বই পড়লাম- ব্রেকিং দ্যা স্পেলঃ রিলিজিয়ন এজ এ ন্যাচারাল ফেনেমেনন। তিনি বইটিতে মূলত দেখাতে চেষ্টা করেছেন কিভাবে আমাদের মস্তিষ্কের মাঝে বিদ্যমান কোন আইডিয়া/ধারণা আমাদেরকে চালিত করে। এই আইডিয়া মস্তিষ্কের মাঝে অবচেতন ভাবে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। যদি আইডিয়াই একজন মানুষের চালিকা শক্তি হয়ে যায় তবে সেটা অনেকটা ভাইরাসের মত প্রাণঘাতী হতে পারে। যেমনটি হয়ে থাকে Lancet liver fluke নামক পরজীবিতে আক্রান্ত পিঁপড়ে। এই পরজীবিটি তার জৈবিক চক্রের একটি ধাপে গিয়ে শামুকের লালা হতে চলে যায় পিঁপড়ের পাকস্থলীতে। তারপর সেখানে বংশ বৃদ্ধি করে এক পর্যায়ে পিঁপড়ের নার্ভ এর দখল নিয়ে ফেলে। পরজীবিটিকে তার বংশবৃদ্ধির লক্ষ্যে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে কোন গবাদীপশুর পাকস্থলীতে। এই অবস্থায় পরজীবিটি পিঁপড়েটিকে বাধ্য করে কোন লম্বা ঘাসের চুঁড়ায় উঠার জন্য। পিপড়েটি ঘাসের আগায় উঠে বসে থাকে যতক্ষন না সে কোন গবাদীপশুর পেটে যায়। এভাবেই চলতে থাকে। পিঁপড়েটি নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সে কোন প্রতিরোধ করতে পারে না। কথা হল পিঁপড়েটিকে কিভাবে চালিত করে সেই পরজীবিটি। পিঁপড়েটিকে একধরণের সুখানুভুতি প্রদান করে পরজীবিটি যদি সে সেই লম্বা ঘাসের চূড়ায় উঠে। সেই অনুভূতির লোভে পিঁপড়েটি এই কাজে বারংবার প্ররোচিত হয়।
এই বিষয়টিকেই আরেক বিবর্তনীয় বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার সেলফিশ জিন বইয়ে বলেছেন সেলফিশনেস অফ জিন। জিন তার নিজের বংশবৃদ্ধিতে তার হোস্টকে মরে যেতেও উদ্ধুদ্ধ করে। যে কারণেই প্রাণী জগতের মাঝে পরোপোকারীর মত ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। সে কারণেই একজন মা/বাবা তাঁদের নিজের জীবন দিয়ে হলেও নিজের সন্তানকে রক্ষা করে। এই বিষয়গুলোই প্রকাশ করে জিনের স্বার্থপরতার বিষয়টি। সুতরাং বিবর্তনীয় দৃষ্টিতে যদি দেখি তবে আমাদের জীবনের আসলে উদ্দেশ্য একটিই, তা হচ্ছে নিজের জিনকে রক্ষা করা এবং এর বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। প্রচন্ড হতাশার, কি বলেন?
তবে এটা হচ্ছে ম্যাক্রো লক্ষ্য। একজন ইন্ডিভিজুয়ালের কাছে সেই চালিকা শক্তি থাকে না। তাহলে জিন কিভাবে তার নিজের উদ্দেশ্যে পৌঁছে, সেটা একটি প্রশ্ন। এখানেই আসে আমাদের মস্তিষ্কের কাজ। যেহেতু মস্তিষ্ক হচ্ছে আমাদের মূল প্রসেসিং ইউনিট তাই আমাদের অবচেতন মন সেই লক্ষ্যে সেট করা রয়েছে। অন্যভাবে, সেই পিঁপড়েটির সাথে তুলনা করলে দেখবেন যে আমাদের মস্তিষ্কের এই অবচেতন অংশের কাজ হচ্ছে আমাদেরকে সেই সুখানুভুতি প্রদানের মাধ্যমে তার নিজের লক্ষ্য কাজ করা। এখন একজন মা/বাবা নিজের মৃত্যু হলেও যদি জানেন যে তার সন্তান রক্ষা পেয়েছে বা পাবে তিনি কোন কষ্ট অনুভব করেন না। আবার ধরুণ, সেক্স এর মাধ্যমে এক ধরণের সুখানুভুতি লাভ হবে, যার তাড়নায় আপনি সে কর্মে নিমজ্জিত হবেন আর জিন তার বংশবৃদ্ধি করবে। অবশ্য পরিবার পরিকল্পনার কথা জিন ভাবেনি। আপনি/আমি লেখালেখি করে আনন্দ পাই, কেউ আড্ডা মেরে আনন্দ পাই, কিংবা ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ হই, সবই আমাদের মস্তিষ্কের সেই ভাল লাগাকে ম্যাক্সিমাইজ করার জন্য। দিন শেষে একটি কাজ করে যদি দেখেন যে আপনি আসলে কোন সুখ পাচ্ছেন না, তখন পুরো সময়টাই অপচয় হয়েছে বলে ভাবি। তাহলে মাইক্রো লেভেল জীবনের উদ্দেশ্য ধরতে পারি এই ভাল লাগার অনুভুতিকে ম্যক্সিমাইজ করা। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তেই আমরা সব সময় হিসেব করতে থাকি সচেতনে বা অবচেতনে কতটুকু ভাল লাগা বা মন্দ লাগা অর্জন করেছি। আর তার পরিপ্রেক্ষিতেই ভাবি জীবনটি কি অর্থহীন না অর্থহীন নয়। আমার কাছে তাই জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিটি মুহুর্তকে উপভোগের মাধ্যমে ভাল লাগার অনুভুতিকে ম্যক্সিমাইজ করা, খারাপ অনুভুতিকে মিনিমাইজ করা, এবং তার মাধ্যমে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার প্রেরণা লাভ করা।
এখন আসুন আরেকটু জটিল ভাবনায়। মস্তিষ্কের মাঝে এই অবচেতন অংশে আমি/আপনি যদি একটি ধারণা পাই যেটি ধারণাটির জন্য ভাল কিন্তু আমার বা অন্যের জন্য ক্ষতিকর সে ক্ষেত্রে কি হবে? ধরুণ, জিহাদী ধারণা। এরকম একটি ধারণা আপনার নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে আত্মহত্যার মত কাজে, আবার সেই সাথে এটি ক্ষতিকর সমাজের জন্য কারণ এতে অনেক নিরীহ মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে। এবং এরকম একটি ধারণা কিন্তু সহজেই আপনার মাঝে প্রতিস্থাপিত হতে পারে আপনার চারিপাশ হতে, আপনার পরিবার হতে, বা আপনি নিজেও যে কোন ভাবে এই ধারণায় উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। এখানেই চলে আসে ইনসেপশান ছবিটির কথা। ছবিটিতে এই বিষয়টিই দেখানো হয়েছে যে কিভাবে একটি ক্ষুদ্র ধারণা আপনি অন্যজনের মাঝে প্রতিস্থাপন করতে পারেন। ছবিটির বানিজ্যকরণের লক্ষ্যে সেখানে নানান বিষয়, যেমন স্বপ্ন, স্বপ্নের মাঝে স্বপ্ন নিয়ে এসেছে, থ্রিল এসেছে। তবে মূল উদ্দেশ্য ছিল “একটি ক্ষুদ্র ধারণার প্রতিস্থাপন”, যেটা অন্য একজন মানুষের স্বপ্নের মাঝে করা হয়েছে এমন ভাবে যেন সেই ব্যক্তিটি বুঝতে না পারে যে তার মাঝে অন্য কেউ কোন ধারণা প্রতিস্থাপন করেছে।
এখন যদি আমরা আমাদের নিজস্ব জগতের কথা চিন্তা করি তবে এরকম ধারণার ইনসেপশান কিন্তু অহরহই হচ্ছে। এই যেমন আমার আজকের লেখা আপনার মাঝে একটি ক্ষুদ্র ধারণা প্রতিস্থাপিত করতে পারে। এভাবে অবচেতন মনে বিদ্যমান নানান ধারণা ছাড়াও শিশুকাল হতে এটা করা খারাপ/এটা করা যাবে না এরকম নানান ধারণার ইনসেপশান চলতেই থাকে, যেটা অনেক বড় হয়েও অনেকেই কাটাতে পারি না। আর সেই ধারণা যখন বদ্ধমূল হয়ে যায় সেটা পরিণত হয় একটি স্থির বিশ্বাসে এবং তখন বিশ্বাসই হয়ে যায় চালিকা শক্তি। তখন আরেকজনকে বিচার করি নিজের বিশ্বাসের আয়নায়, একজন মানুষ হিসেবে নয়। ডেনেট এই বিশ্বাস ব্যবস্থাকেই বলেছেন ভাইরাসের মত।
এ কারণে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা যে কোন বিশ্বাসকে সংরক্ষনের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে। আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দেই, আমরা দেশের জন্য প্রাণ দেই, আমরা মানবাধিকারের জন্য প্রাণ দেই, আমরা ধর্মের জন্য প্রাণ দেই। আমরা বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়ে বন্ধুর সাথে তর্কে লিপ্ত হই, বন্ধুত্ব ছিন্ন করি। আমরা সেই বিশ্বাসকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে আনন্দ পাই। কারণ বিশ্বাসই তখন চালিকা শক্তি। তাই সতর্ক থাকুন, নিজের বিশ্বাস সম্পর্কে। অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার আগে ভাবুন, আপনার ধারণাটি কি প্রাণঘাতী নাকি মানুষের কল্যাণমূখী। আপনার সন্তানের মাঝে কোন ধারণার ইনসেপশানের আগে একটি বার ভেবে, তারপর সিদ্ধান্ত নিন। কারণ একমাত্র কল্যাণমূখী ধারণাই দিতে পারে একটি সুন্দর ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং একটি সুন্দর পৃথিবী। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার চেষ্টাই, তাই, আমার লক্ষ্য।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
১। বিবর্তনের পথ ধরে লেখক বন্যা আহমেদ
২। Evolutionary psychology: an introduction by Lance Workman and Will Reader
৩। Breaking the spell: Religion as a natural phenomenon by Daniel Dennett
৪। The selfish gene by Richard Dawkins
৫। Inception (a movie released in 2010)
৬। Wikipedia
সকলেই যে এই মতবাদে বিশ্বাসী তা নয়। তারা কোন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী নয় বা মৃত্যুর পরের কোন জগতেও বিশ্বাসী নয়। তাছাড়া, আধুনিক বিজ্ঞানেও মন বা আত্মার আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া/প্রতিক্রিয়ার মাঝেই মনের অবস্থান। মস্তিষ্কের মৃত্যুর মাঝে মনেরও মৃত্যু ঘটে। আত্মা যদি নাও থাকে সমস্যা রয়েই যায়, তা হলো এই জীবনের উদ্দেশ্য কি? কেনই বা এই পৃথিবী আর কেনই বা এত দ্বন্দ্ব।
এই কিছুদিন আগেও মানুষের কাছে এর জবাব ছিলনা। কিন্তু অধুনা জেনেটিক বিজ্ঞান, ণৃ-বিজ্ঞান, এবং জীববিজ্ঞানের ফলে মানুষ আজ তার নিজের বিবর্তন সম্পর্কে অতীতের চেয়েও অনেক বেশি জানে। জীববিজ্ঞানের শাখায় বিবর্তন আজ একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়। এটি শুধু জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ না থেকে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, জেনেটিক্স এর মত শাখাগুলোতেও আজ প্রয়োগ হচ্ছে। AIDS ভাইরাস বা সুপারবাগ ব্যাক্টেরিয়ার মত প্রাণঘাতী জীবগুলোর প্রতিষেধক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিবর্তনের জ্ঞানকে কাজে লাগানো হচ্ছে। মানুষের আচার/ব্যবহার বিশ্লেষণের জন্য, মানুষের বিভিন্ন মানসিক রোগ অথবা অটিজমের মত রোগগুলোকে বিশ্লেষণের জন্য মনোবিদ্যায় বিবর্তনকে কাজ লাগানো হচ্ছে। এ ছাড়া মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ আচরনকে বোঝার জন্য কিংবা জাতিগত দ্বন্দ্ব নিরসনে, বা অর্থনীতির মত বিষয়গুলোকে বোঝার জন্যেও আজ বিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে বিবর্তনীয় সমাজবিজ্ঞান,বিবর্তনীয় অর্থনীতির মত বিষয়গুলোর চালু হয়েছে।
আজকের এই লেখায় বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার আলোকে জীবনের উদ্দেশ্য তুলে ধরার কিছুটা চেষ্টা করবো। বিবর্তনীয় মনোবিদ্যা অনুসারে মানুষের মস্তিষ্ক তার অন্যান্য অঙ্গের মতই দীর্ঘ বিবর্তনের একটি ফসল। অন্যান্য প্রাণীদের থেকে আমরা এগিয়ে গিয়েছি আমাদের এই বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মস্তিষ্কের জন্য। এ জন্য আমাদের মস্তিষ্কের আকার অন্যান্য প্রাণীদের থেকে বড়। বিবর্তনের উপর প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য মুক্তমনা ও সচলের লেখক বন্যা আহমেদের বিবর্তনের পথ ধরে বইটি পড়তে পারেন। এটি বাংলা ভাষায় বিবর্তনের উপর লেখা একটি অসাধারণ বই। খুব সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য বইটি লেখা হয়েছে। আমার নিজের প্রাথমিক জ্ঞানও লাভ করি এই বই থেকে।
আমাদের দেহকে যদি একটি যন্ত্র হিসেবে চিন্তা করেন এবং তাহলে মস্তিষ্ককে চিন্তা করতে পারেন একটি গণনা কেন্দ্র হিসেবে যেটি বিশ্বের আধুনিকতম কম্পিউটারের চেয়েও শক্তিশালী। শুধু এর ভেতর তারের জালের পরিবর্তে রয়েছে অসংখ্য সুক্ষ্ণ নার্ভ। মানুষকে চিন্তা করতে পারেন একটি রোবট হিসেবে, শু্ধু এর পার্টসগুলো তৈরী হচ্ছে মাংস দিয়ে। মস্তিষ্ক হচ্ছে আমাদের দেহের প্রসেসিং ইউনিট। যে কোন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য চলে যায় মস্তিষ্কে এবং মস্তিষ্ক সেটি প্রসেস করে, তার পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে করণীয় নির্ধারণ করে সেটা পাঠিয়ে দেয় যথাযথ প্রত্যঙ্গের কাছে।
মস্তিষ্ক আবার একই সাথে একটি প্রসেসিং যন্ত্র এবং তথ্য সংরক্ষনের স্থান। আমাদের যাবতীয় তথ্য এখানে সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু মস্তিষ্কের আকার যেহেতু সীমাবদ্ধ তাই সকল তথ্যই আমাদের পক্ষে ধারণ করা সম্ভব হয় না। কোন তথ্য সংরক্ষন করা হবে তার জন্য মস্তিষ্ক পূর্ব অভিজ্ঞতা, কতটা মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, তথ্যের প্রয়োজনীয়তা এসবের উপর ভিক্তি করে একটি রেটিং করে এবং সেভাবে সে সংগ্রহ করে। এ জন্য দেখা যায় যে অনেক কিছুই আমরা দেখি/শুনি/পড়ি কিন্তু সকল তথ্য আমাদের স্মরণ থাকে না। আবার সকল তথ্য একই গভীরতায় সংরক্ষিত হয় না। যে সব তথ্য আমরা দৈনন্দিন ব্যবহার করি সেগুলো প্রথম ধাপেই রাখা হয় যেন সহজেই চাইলে পাওয়া যায়। আর যেগুলো সচারচর ব্যবহার করা হয়না সেগুলো একটু গভীরে রাখা হয়। অনেকটা একটি দোকানের জিনিস সংরক্ষনের মত। চালু আইটেমগুলোকে হাতের নাগালেই রাখা হয়, আর একটু কম চালু বা দামী জিনিসগুলোকে গোডাউনে অথবা বিশেষ স্থানে রাখা হয়।
মানুষের নানান আচার/ব্যবহার মস্তিষ্কের গঠন/গড়ন এবং এর কার্যপদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত করা সম্ভব। অবশ্য এই বিষয়গুলো এখনো নুতন, প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে এই বিষয়ের উপর। বিশেষ করে মস্তিষ্কের স্ক্যানিং প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হবার পর বিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছে মস্তিষ্কের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে আরো বিষদভাবে জানার জন্য। আশা করা যায় একদিন মানুষ সেই লক্ষ্যে পৌছতে পারবে। তখন হয়তো মানুষের কছাকাছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরী করা সক্ষম হবে। মস্তিষ্কের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো বেশি জানার জন্য Evolutionary psychology বা শুধু psychology এর উপর যে কোন বই দেখতে পারেন আগ্রহী পাঠকগণ।
আমি এবার একটু লম্ফ দিব আরেকটি বইয়ের গল্পে। এই বইটির লেখক ডেনিয়েল ডেনেট, তিনি বর্তমান কালের একজন দার্শনিক। তিনি Tufts University এর একজন অধ্যাপক। কাজ করেন মূলত মনোবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, দর্শন নিয়ে। সম্প্রতি তার একটি বই পড়লাম- ব্রেকিং দ্যা স্পেলঃ রিলিজিয়ন এজ এ ন্যাচারাল ফেনেমেনন। তিনি বইটিতে মূলত দেখাতে চেষ্টা করেছেন কিভাবে আমাদের মস্তিষ্কের মাঝে বিদ্যমান কোন আইডিয়া/ধারণা আমাদেরকে চালিত করে। এই আইডিয়া মস্তিষ্কের মাঝে অবচেতন ভাবে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। যদি আইডিয়াই একজন মানুষের চালিকা শক্তি হয়ে যায় তবে সেটা অনেকটা ভাইরাসের মত প্রাণঘাতী হতে পারে। যেমনটি হয়ে থাকে Lancet liver fluke নামক পরজীবিতে আক্রান্ত পিঁপড়ে। এই পরজীবিটি তার জৈবিক চক্রের একটি ধাপে গিয়ে শামুকের লালা হতে চলে যায় পিঁপড়ের পাকস্থলীতে। তারপর সেখানে বংশ বৃদ্ধি করে এক পর্যায়ে পিঁপড়ের নার্ভ এর দখল নিয়ে ফেলে। পরজীবিটিকে তার বংশবৃদ্ধির লক্ষ্যে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে কোন গবাদীপশুর পাকস্থলীতে। এই অবস্থায় পরজীবিটি পিঁপড়েটিকে বাধ্য করে কোন লম্বা ঘাসের চুঁড়ায় উঠার জন্য। পিপড়েটি ঘাসের আগায় উঠে বসে থাকে যতক্ষন না সে কোন গবাদীপশুর পেটে যায়। এভাবেই চলতে থাকে। পিঁপড়েটি নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সে কোন প্রতিরোধ করতে পারে না। কথা হল পিঁপড়েটিকে কিভাবে চালিত করে সেই পরজীবিটি। পিঁপড়েটিকে একধরণের সুখানুভুতি প্রদান করে পরজীবিটি যদি সে সেই লম্বা ঘাসের চূড়ায় উঠে। সেই অনুভূতির লোভে পিঁপড়েটি এই কাজে বারংবার প্ররোচিত হয়।
এই বিষয়টিকেই আরেক বিবর্তনীয় বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার সেলফিশ জিন বইয়ে বলেছেন সেলফিশনেস অফ জিন। জিন তার নিজের বংশবৃদ্ধিতে তার হোস্টকে মরে যেতেও উদ্ধুদ্ধ করে। যে কারণেই প্রাণী জগতের মাঝে পরোপোকারীর মত ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। সে কারণেই একজন মা/বাবা তাঁদের নিজের জীবন দিয়ে হলেও নিজের সন্তানকে রক্ষা করে। এই বিষয়গুলোই প্রকাশ করে জিনের স্বার্থপরতার বিষয়টি। সুতরাং বিবর্তনীয় দৃষ্টিতে যদি দেখি তবে আমাদের জীবনের আসলে উদ্দেশ্য একটিই, তা হচ্ছে নিজের জিনকে রক্ষা করা এবং এর বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। প্রচন্ড হতাশার, কি বলেন?
তবে এটা হচ্ছে ম্যাক্রো লক্ষ্য। একজন ইন্ডিভিজুয়ালের কাছে সেই চালিকা শক্তি থাকে না। তাহলে জিন কিভাবে তার নিজের উদ্দেশ্যে পৌঁছে, সেটা একটি প্রশ্ন। এখানেই আসে আমাদের মস্তিষ্কের কাজ। যেহেতু মস্তিষ্ক হচ্ছে আমাদের মূল প্রসেসিং ইউনিট তাই আমাদের অবচেতন মন সেই লক্ষ্যে সেট করা রয়েছে। অন্যভাবে, সেই পিঁপড়েটির সাথে তুলনা করলে দেখবেন যে আমাদের মস্তিষ্কের এই অবচেতন অংশের কাজ হচ্ছে আমাদেরকে সেই সুখানুভুতি প্রদানের মাধ্যমে তার নিজের লক্ষ্য কাজ করা। এখন একজন মা/বাবা নিজের মৃত্যু হলেও যদি জানেন যে তার সন্তান রক্ষা পেয়েছে বা পাবে তিনি কোন কষ্ট অনুভব করেন না। আবার ধরুণ, সেক্স এর মাধ্যমে এক ধরণের সুখানুভুতি লাভ হবে, যার তাড়নায় আপনি সে কর্মে নিমজ্জিত হবেন আর জিন তার বংশবৃদ্ধি করবে। অবশ্য পরিবার পরিকল্পনার কথা জিন ভাবেনি। আপনি/আমি লেখালেখি করে আনন্দ পাই, কেউ আড্ডা মেরে আনন্দ পাই, কিংবা ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ হই, সবই আমাদের মস্তিষ্কের সেই ভাল লাগাকে ম্যাক্সিমাইজ করার জন্য। দিন শেষে একটি কাজ করে যদি দেখেন যে আপনি আসলে কোন সুখ পাচ্ছেন না, তখন পুরো সময়টাই অপচয় হয়েছে বলে ভাবি। তাহলে মাইক্রো লেভেল জীবনের উদ্দেশ্য ধরতে পারি এই ভাল লাগার অনুভুতিকে ম্যক্সিমাইজ করা। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তেই আমরা সব সময় হিসেব করতে থাকি সচেতনে বা অবচেতনে কতটুকু ভাল লাগা বা মন্দ লাগা অর্জন করেছি। আর তার পরিপ্রেক্ষিতেই ভাবি জীবনটি কি অর্থহীন না অর্থহীন নয়। আমার কাছে তাই জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিটি মুহুর্তকে উপভোগের মাধ্যমে ভাল লাগার অনুভুতিকে ম্যক্সিমাইজ করা, খারাপ অনুভুতিকে মিনিমাইজ করা, এবং তার মাধ্যমে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার প্রেরণা লাভ করা।
এখন আসুন আরেকটু জটিল ভাবনায়। মস্তিষ্কের মাঝে এই অবচেতন অংশে আমি/আপনি যদি একটি ধারণা পাই যেটি ধারণাটির জন্য ভাল কিন্তু আমার বা অন্যের জন্য ক্ষতিকর সে ক্ষেত্রে কি হবে? ধরুণ, জিহাদী ধারণা। এরকম একটি ধারণা আপনার নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে আত্মহত্যার মত কাজে, আবার সেই সাথে এটি ক্ষতিকর সমাজের জন্য কারণ এতে অনেক নিরীহ মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে। এবং এরকম একটি ধারণা কিন্তু সহজেই আপনার মাঝে প্রতিস্থাপিত হতে পারে আপনার চারিপাশ হতে, আপনার পরিবার হতে, বা আপনি নিজেও যে কোন ভাবে এই ধারণায় উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। এখানেই চলে আসে ইনসেপশান ছবিটির কথা। ছবিটিতে এই বিষয়টিই দেখানো হয়েছে যে কিভাবে একটি ক্ষুদ্র ধারণা আপনি অন্যজনের মাঝে প্রতিস্থাপন করতে পারেন। ছবিটির বানিজ্যকরণের লক্ষ্যে সেখানে নানান বিষয়, যেমন স্বপ্ন, স্বপ্নের মাঝে স্বপ্ন নিয়ে এসেছে, থ্রিল এসেছে। তবে মূল উদ্দেশ্য ছিল “একটি ক্ষুদ্র ধারণার প্রতিস্থাপন”, যেটা অন্য একজন মানুষের স্বপ্নের মাঝে করা হয়েছে এমন ভাবে যেন সেই ব্যক্তিটি বুঝতে না পারে যে তার মাঝে অন্য কেউ কোন ধারণা প্রতিস্থাপন করেছে।
এখন যদি আমরা আমাদের নিজস্ব জগতের কথা চিন্তা করি তবে এরকম ধারণার ইনসেপশান কিন্তু অহরহই হচ্ছে। এই যেমন আমার আজকের লেখা আপনার মাঝে একটি ক্ষুদ্র ধারণা প্রতিস্থাপিত করতে পারে। এভাবে অবচেতন মনে বিদ্যমান নানান ধারণা ছাড়াও শিশুকাল হতে এটা করা খারাপ/এটা করা যাবে না এরকম নানান ধারণার ইনসেপশান চলতেই থাকে, যেটা অনেক বড় হয়েও অনেকেই কাটাতে পারি না। আর সেই ধারণা যখন বদ্ধমূল হয়ে যায় সেটা পরিণত হয় একটি স্থির বিশ্বাসে এবং তখন বিশ্বাসই হয়ে যায় চালিকা শক্তি। তখন আরেকজনকে বিচার করি নিজের বিশ্বাসের আয়নায়, একজন মানুষ হিসেবে নয়। ডেনেট এই বিশ্বাস ব্যবস্থাকেই বলেছেন ভাইরাসের মত।
এ কারণে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা যে কোন বিশ্বাসকে সংরক্ষনের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে। আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দেই, আমরা দেশের জন্য প্রাণ দেই, আমরা মানবাধিকারের জন্য প্রাণ দেই, আমরা ধর্মের জন্য প্রাণ দেই। আমরা বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়ে বন্ধুর সাথে তর্কে লিপ্ত হই, বন্ধুত্ব ছিন্ন করি। আমরা সেই বিশ্বাসকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে আনন্দ পাই। কারণ বিশ্বাসই তখন চালিকা শক্তি। তাই সতর্ক থাকুন, নিজের বিশ্বাস সম্পর্কে। অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার আগে ভাবুন, আপনার ধারণাটি কি প্রাণঘাতী নাকি মানুষের কল্যাণমূখী। আপনার সন্তানের মাঝে কোন ধারণার ইনসেপশানের আগে একটি বার ভেবে, তারপর সিদ্ধান্ত নিন। কারণ একমাত্র কল্যাণমূখী ধারণাই দিতে পারে একটি সুন্দর ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং একটি সুন্দর পৃথিবী। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার চেষ্টাই, তাই, আমার লক্ষ্য।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
১। বিবর্তনের পথ ধরে লেখক বন্যা আহমেদ
২। Evolutionary psychology: an introduction by Lance Workman and Will Reader
৩। Breaking the spell: Religion as a natural phenomenon by Daniel Dennett
৪। The selfish gene by Richard Dawkins
৫। Inception (a movie released in 2010)
৬। Wikipedia
Friday, September 24, 2010
এলোমেলো চিন্তাঃ অবিশ্বাসের যত গল্প
জবানবন্দী শব্দটি আমার মোটেও পছন্দ নয়। শব্দটি শুনলে নিজেকে মনে হয় একজন আসামী তার জবানবন্দী দিচ্ছে। অবিশ্বাসের জন্য নিজেকে সেরকম আসামী ভাবতে পারি না। পছন্দ হোক বা না হোক, জবানবন্দী হোক বা অবিশ্বাসের গল্পই হোক, সেটা বলার জন্যই আজ কলম ধরেছি। আমাদের সকলের অবিশ্বাসের গল্প বেশ কাছাকাছি। আবার জীবনের গল্পও কম বেশি কাছাকাছি। একই গল্প শুনতে সব সময় ভাল লাগে না, তারপরেও লিখে রাখছি নিজের চিন্তাগুলো, যদি কেউ তাতে অনুপ্রাণিত হয়।
ছোটবেলার গল্প বেশি নেই আমার, তেমন আহামরি/চমকপ্রদ কোন কিছুই নেই। আর নেই বলেই কিনা, তেমন কিছু মনেও নেই। আর দশটা সাধারণ শিশুর মত জন্ম নিয়েছিলাম সাধারণ মুসলিম পরিবারে। বাবা/মা দু’জনেই প্রচন্ড ধার্মিক মানুষ। বাবা প্রায় প্রতিটি নামাজ চেষ্টা করতেন মসজিদে যেয়ে পড়তেন আর মাও প্রতি বেলাতেই নিয়মিত নামাজ পড়তেন। এমন পরিবারে স্বাভাবিক ভাবেই বাসায় সপ্তাহে তিন দিন হুজুর আসতেন আরবী পড়াতে। বেশ বয়ষ্ক একজন হুজুর আমাদের পড়াতেন। হুজুর যতদিন বেঁচে ছিলেন আমাদের বাসায় নিয়মিত আসতেন।
ছোটবেলা হতেই গণিত, বিজ্ঞান খুব টানতো আর ঘৃনা করতাম ইংরেজী/বাংলা ব্যাকারণকে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো সব সময় খুব ভাল লাগতো। সপ্তম বা অষ্টম শ্রেনীতে আমার একটি প্রিয় বিষয় ছিল পৃথিবী যে গোল সেটার প্রমানের বিষয়গুলো। এখনো ভুলতে পারি না, সেই মাস্তুলের ছবিগুলো, যেখানে জাহাজ ধীরে ধীরে ফুটে উঠে যত তীরের কাছাকাছি আসে। আরেকটি প্রিয় বিষয় ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কিভাবে কাজ করে সেই বিষয়টী। এগুলো এখনো চোঁখের সামনেই ভাসে। যে জিনিস বুঝতে পারতাম তা কখনো ভুলতাম না, আর যে জিনিস বুঝতে পারতাম না তা হাজার বার পড়েও মনে রাখতে পারতাম না। পরবর্তীতে যখন বুয়েটে পড়তে আসি এই বুঝার ব্যাপারগুলো খুব ভাল কাজে দিয়েছে। তবে আমি সবচেয়ে ভাল বুঝতাম যখন কাউকে বুঝাতে যেতাম। দেখা যেত বন্ধুদের কোন বিষয় বুঝাতে গিয়েই সবচেয়ে বেশি নিজে বুঝেছি এবং নিজেও উপকৃত হয়েছি। তাই সে কাজটিই করতাম। একা একা পড়ার অভ্যেস করতে পারিনি।
কলেজে থাকাকালিন সময়ে বই পড়ার আগ্রহ ছিল বেশ। তখন শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলো বেশি টানতো। কলেজে আমাদের বেশ ভাল একটি লাইব্রেরী ছিল। প্রায় সব ধরণের বইই পড়তাম। এর মাঝে একটি বই পড়ি ডেল কার্নেগীর “দুঃশ্চিন্তাহীন জীবন”। বইটির প্রায় প্রতিটি কথা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সকল চিন্তা হতে দুঃশ্চিন্তা মুক্ত রাখার জন্য এই বইটির কাছে আমি ভীষণভাবে ঋনী। এর মাঝে একটি পন্থা ছিল সব সময় সবচেয়ে খারাপ কি হতে পারে চিন্তা করা। যে কোন বিপদে যদি সবচেয়ে খারাপটি কল্পনা করেন এবং যদি দেখেন যে তত খারাপ আসলে হচ্ছে না তখন দুঃশ্চিন্তা অনেক কমে যায়। কারণ অধিকাংশ সময়ে সবচেয়ে খারাপটি কিন্ত হবে না, প্রব্যাবিলিটি কিন্তু তাহাই বলে। এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক সমস্যাই মোকাবেলা করেছি, কিন্তু মানসিক ভাবে বিপর্যস্থ হইনি, তার পেছনে ডেল কার্নেগীর এই বইয়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। এর ফলে আরেকটি যেটি লাভ হয়েছে যে কোন কিছুতে ধারাবাহিক যুক্তির ব্যবহার করার অভ্যেস হয়েছে।
অন্যান্য যে কোন কিশোরের মত প্রচুর সেবার বই পড়তাম। সেবার অনুবাদ, তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন সবই মুগ্ধের মত পড়তাম। জীবনে সবচেয়ে বেশি বই পড়েছি ইন্টারমিডিয়ট পরীক্ষার পর। কোথায় ভর্তি হবো এই নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না। কোচিং এ যেতাম আর আসার সময় সিনেমা হলে ঢুঁ মেরে আসতাম। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটিয়েছি তখন। এর মাঝে বুয়েটে সুযোগ পেয়ে যাই কিন্তু ক্লাস শুরু হয় দেড় বছর পর। এই সময়টা টিউশনি করে আর বই পড়েই কাটাই। ততদিনে তিন গোয়েন্দা ছেড়ে ফেলুদা আর শার্লক হোমস গিলছি। শার্লক হোমসের অমনিবাস কিনে একের পর এক পড়ে যাচ্ছি। গোয়েন্দা কাহিনীই আমাকে বেশি টানতো। তবে সমরেশ, সুনীল, বুদ্ধদেব, শঙ্কর, শীর্ষেন্দু, আরো কত যে ওপারবাংলার লেখকের বই পড়েছি সব মনে করতে পারছি না। আশ্চর্যজনক ভাবে বুয়েটে ক্লাস শুরুর পর বই পড়া বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তখন বছরে এক বা দু’টোর বেশি বই পড়িনি। যা পড়ার সব বুয়েটের ক্লাস শুরুর আগেই পড়েছি।
বুয়েটের জীবনটা বেশ চমৎকার কেটেছে। সারাদিন ক্লাস করতাম, বিকেলে ফটুবল খেলতাম, রাতে কার্ড খেলতাম। ক্লাস টেস্টের আগের দিন কিছুটা পড়তাম, বিকেলের সেশানাল ক্লাসের আগের এক ঘন্টায় কারোর ল্যাবের খাতা হতে চোথা মারতাম। প্রিপারেশন লিভের সময় রাতদিন পড়ে সারা টার্মের ফাঁকি পোষাতাম। এরকম সহজ সমীকরণের মাঝেই বুয়েট জীবন পার করে দিলাম। চোখের পলকে যেন পাঁচটি বছর চলে গেল। তারপর মাষ্টার্স করি পরবর্তী তিন বছরে। এই সময়টি আমি মুলত আর দশটা মুসলিমের মতই ছিলাম। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়ে মুসলমানিত্ব বজায় রাখতাম, আর রোজার মাসে উপোস করতাম এবং ঈদের নামাজে যেতাম। বাড়ী গেলে বাবার পীড়াপিড়তে মাঝে মাঝে ফজরের নামাজেও বাবার সাথে শামিল হতাম। একটি বিষয়ে আমি ভাগ্যবান ছিলাম যে বাবা/মা সব সময় আমাকে নামাজের জন্য বলতেন, এখনো বলেন। কিন্তু কট্টর মৌলবাদীদের মত আমাকে বাধ্য করার জন্য চাপ দিতেন না।
বুয়েটের জীবনটা খুব উপভোগ করেছি। আড্ডা, সিনেমা দেখা, কার্ড খেলা, ফুটবল খেলা, ফাঁকে ফাঁকে পড়াশুনা করা, এই ছিল মূলত জীবন। আমার চারজন রুমমেটের মাঝে দু’জন ছিল হিন্দু রুমমেট। এর মাঝে একজন হচ্ছে আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। তাঁদের বাসায় যেয়ে থেকেছি, মাসীর হাতের কবুতরের মাংসের তরকারীর কথা জীবনে ভুলবার নয়। বরাবরই আমি ধর্মের এই বিভেদকে উপেক্ষা করে চলে এসেছি। ধর্মের কারণে বিধর্মীকে ভিন্ন জাত হিসেবে কল্পনা করা এক প্রকার অসম্ভব ছিল আমার কাছে। সেভাবে ধর্ম নিয়ে চিন্তা না করলেও প্র্যাক্টেসিং ভাবে মনে হয় সংশয়বাদের কাছাকাছি ছিলাম। বরং যারা বিধর্মীদেরকে ভিন্ন ভাবে নিতেন তাঁদেরকেই অমানুষ মনে করতাম।
বুয়েট জীবন শেষে চলে আসি বিদেশে উচ্চ-শিক্ষার্থে। বিদেশ জীবনের শুরুর সময়টা বিশেষ সুবিধের ছিল না। ঠান্ডার দেশে আসার পর আমার আর্থ্রাইটিস ধরা পড়ে। এক পর্যায়ে আর্থ্রাটাইসের কারণে নিজের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে, আমার ঘাড়ের মাছে মেরুদন্ডের একটি হাঁড় ক্ষয় হয়ে জয়েন্টটি খুলে যায়। সার্জারী করে সেই জয়েন্টটিকে ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। খুব বেশি জটিল সার্জারী না হলেও সার্জারীটি রিস্কি ছিল। আর বিদেশে বসে একা একা সার্জারীর ধকল সামলানো সব মিলিয়ে একটি কঠিন অবস্থার মাঝ দিয়ে অতিক্রম করি। ডেল কার্নেগীকে আবারো উপলব্ধি করি। জীবনকে নুতন ভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাই। এক প্রকার নুতন এক জীবন হিসেবে নেই এটিকে। জীবনের উদ্দেশ্য কি নিজের মাঝে আবার প্রশ্নটি মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠে। মূলত এই প্রশ্নের খুঁজেই আমার অবিশ্বাসের জীবন শুরু করা।
এর মাঝে ব্লগ নামক বস্তুটির দেখা পাই মাত্র এক বছর আগে। লেখালেখির প্রতি টান ছিল সব সময়, কিন্তু লেখালেখি করার জন্য যে পরিমান জ্ঞান প্রয়োজন তা কখনোই ছিল না। এর মাঝে আমার গ্র্যাজুয়েট কোর্স ওয়ার্ক শেষ, শুধু গবেষণার কাজ করি। গবেষণার কাজ মূলত কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং ভিক্তিক হওয়াতে বাড়তি সময় সব সময় থাকতো, এই মুহুর্তে অফিসে বসেই লিখছি। আমার ব্লগের নব্বইভাগ অফিসেই বসে লেখা। নিজের বই পড়াশুনার আগ্রহ আবার শুরু হয়। প্রথমে মূলত ব্লগ পড়তাম। নানান ব্লগ দেখে সচলায়তন ব্লগটিকে পছন্দ হলো পরিবেশের জন্য। মুক্তমনা ব্লগও দেখতাম। কিন্তু অনেকদিন পড়ে মনে হল সচলে না লিখলে কোন সদস্য পদ দেওয়া হবে না, তাই একটি লেখা লিখেও ফেললাম। সেই শুরু। রাজনৈতিক দর্শনেই মূলত আগ্রহ আমার। এই আগ্রহ কিভাবে এসেছে বলা মুশকিল। প্রকৃতিগত ভাবেই আমি এই চরিত্রের অধিকারী বলে মনে হয়। মূলত মানুষের জন্য কিছু করার প্রেরণা থেকেই মনে হয় রাজনৈতিক দর্শনে আগ্রহ। কারণ আমার মতে একমাত্র রাজনৈতিক শক্তিই পারে মানুষের বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে।
এই রাজনৈতিক দর্শনটি খুঁজতে গিয়ে নানান পথে চলতে হয়েছে। কখনো ইতিহাসের পাতায় ঘুরতে হয়েছে, কখনো বিজ্ঞানের পাতায় ঘুরতে হয়েছে। ছোটবেলায় গোয়েন্দাকাহিনী যেমন টানতো এখন আমাকে ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শনের গল্প সেভাবে টানে। শুরুটা করি ইতিহাস দিয়েই। বই পড়ার নেশা দীর্ঘবিরতীর পর যেন বাঁধ ভেঙ্গে এসেছে। সেই সাথে কিছু লেখার প্রেরণা তো আছেই। নিজের গবেষণা করতে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর কিভাবে ধারাবাহিক ভাবে খুঁজতে হয় সেটাও শিখেছি। সব মিলিয়ে প্রায় ধারাবাহিক ভাবে নিজের নানান প্রশ্নের জবাব খুঁজতে থাকলাম। ধর্ম নিয়ে প্রথম একটি উপলব্ধি ছিল কিভাবে ধর্মের উৎপত্তি হয়। সে নিয়ে লেখাটি ছিল ধর্ম সমাজ ও দর্শন। একদম আদিম সমাজে ধর্ম কেমন ছিল কল্পনা করার চেষ্টা করি। যদি শুধুমাত্র মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকেই তাকাই দেখতে পাই যে ধর্ম এসেছিল আগে নাকি মানুষ এসেছিল আগে। অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম অনেক অনেক অনেক পরে এসেছিল। অবাক করা ব্যাপার হলো যে পুরোপুরি কৃষিকাজ শিখেছে মানুষ এই মাত্র প্রায় আট হাজার বছর আগে। প্রথম লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে মাত্র প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। এখন যদি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর দিকে দেখি তবে দেখনে যে ইহুদী ধর্ম এসেছে মাত্র প্রায় ২৬০০ বছর আগে, ইসলাম এসেছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে। অথচ আমাদের শেষ বরফ যুগ শেষ হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার বছর আগে। তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর আগে কি মানুষের ধর্ম ছিল না? তাঁদের কি ঈশ্বরের ভয় ছিল না, মৃত্যুর ভয় ছিল না। সবই ছিল। সেই সব ধর্ম ছিল লোকজ ধর্ম। তারা পুঁজো করতো সূর্য, বাতাস, সাগর, পাহাড়, অতিকায় প্রাণী এই সবের। তাঁদেরও গোষ্ঠী নেতা ছিলা, সবই ছিল। এ কারণে হঠাৎ করে কিছু মানুষের দাবী করা যে তাদের ধর্মই সত্য, বাকী সবাই মিথ্যে, সেটা মেনে নেওয়া কষ্টকর আমার যুক্তিতে। আমার মতে শুধুমাত্র মানুব সভ্যতার নৃ-তাত্বিক ইতিহাসই সক্ষম প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দাবীকে অসাড় প্রমান করার জন্য।
তারপরেও ধর্মকে বাতিল করে দেওয়াটা এত সহজ নয়। সেখানে বিশ্বাস আছে, সেখানে নানান কু-যুক্তি রয়েছে। বিশ্বাসকে সত্যের মর্যাদা দেওয়ার জন্য আমাদের মনে নানান ধারণা নানান সময়ে পেয়ে এসেছি পরিবার হতে, সমাজ হতে, রাষ্ট্র হতে। সবচেয়ে আধুনিক ধর্ম হচ্ছে ইসলাম এবং নিজেও জন্মগত ভাবে ইসলাম ধর্মই পেয়ে এসেছি। ইসলামের সবচেয়ে বড় শক্তি এবং বিশ্বাস - কোরান হচ্ছে আল্লাহর বাণী। যদি শুধুমাত্র প্রমান করা যায় যে কোরান আল্লাহর বাণী নয় এটি কোন মানুষের রচণা তাহলে ধর্মকে অস্বীকার করা অনেক সহজ হয়ে উঠে। এই বিষয়ে মুক্তমনায় পেলাম আকাশ মালিকের লেখা “যে সত্য বলা হয়নি”, বইটির মাধ্যমে ইসলামের অনেক ইতিহাসই জানতে পারি। অধিকাংশ মুসলমানদের মাঝে একটি বিশ্বাস যে মুহাম্মদ একজন নিরক্ষর ব্যক্তি এবং কোরানে যে সব বর্ণিত রয়েছে একজন নিরক্ষর মানুষের পক্ষে ১৪০০ শত বছর আগে সে গুলো বলা বা লেখা সম্ভব নয়। আবারো যদি শুধু মাত্র ইতিহাসই দেখি তবে দেখবো যে, মুহাম্মদ ছাড়াও তার আগে উনার মত আর কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন কিনা? যদি ইতিহাস পড়ি তবে দেখি মুহাম্মদ এর জন্মের প্রায় ১২০০ শত বছর আগে কনফুসিয়াস, জরাথ্রুষ্ট, গৌতম বুদ্ধ, সক্রেটিসের মত দার্শনিক, ধর্ম অবতারদের জন্ম। নীতির কথা তারাও বলে গিয়েছেন। সভ্যতার ইতিহাস যদি দেখি খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগে মিশরীয়রা মমি বানানোর পদ্ধতি বের করে। সেই সময় ব্যাবলীনিয় সভ্যতা, পারস্য সভ্যতাও অনেক উন্নতর ছিল। তাঁদের নিজস্ব সেঁচ ব্যবস্থা ছিল। এমনকি উপমহাদেশের সভ্যতার ইতিহাস দেখলেও দেখবেন যে মহাঞ্জোদারো, হরোপ্পা সভ্যতাগুলোও অনেক উন্নত ছিল। এই ইতিহাস বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে যে চৌদ্দশত বছর আগে নয়, প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বেও মানব সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল। তাই চোদ্দশত বছর পূর্বের একজন মানুষের পক্ষে উন্নতর দর্শন রচণা অসম্ভব নয়।
বিশেষ করে ২৩০০ শত বছর আগে যদি গ্রীক সভ্যতার দিকে একটু তাকাই, তবে দেখি যে সেখানে থেলিস, ডেমোক্রিটাস এরিস্টটলের মত দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীরা গণিত, জীববিজ্ঞান, রাষ্টবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন। এরিষ্টটলের লেখা পলিটিক্স আজো রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি অবশ্যপাঠ্য পুস্তক। সেই সময় এরিষ্টটল স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এই সব তন্ত্রের যে ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়েছেন সেগুলো আজো পরিবর্তন হয়নি। এরিষ্টটল জীববিজ্ঞানে যে অবদান রেখেছেন তার জন্য আমরা তাকে জীববিজ্ঞানের জনক বলি। একজন মানুষ যদি ২৩০০ বছর আগে রাজনীতি, জীববিজ্ঞানে এই পরিমান অবদান রাখতে পারেন তবে কেন ১৪০০ বছর আগের একজন মানুষ পারবেন না কোরানে বিজ্ঞানের মত বিষয়, রাষ্টনীতির মত বিষয় এবং নীতি কথার মত বিষয় নিয়ে লিখতে। মুহাম্মদ নিরক্ষর হতে পারেন, কিন্তু তিনি ২৫ বছর হতে ৪০ বছর পর্যন্ত ব্যবসার উদ্দেশ্য ভ্রমন করেছেন। তাই তিনি লিখতে না পারেন, কিন্তু তিনি একজন জ্ঞানী নন সেটা বলা যাবে না। উনি নিজে এই সব বিষয়ে চিন্তা করতেন, নিজের মনে কিছু প্রশ্নের জবাব খুঁজতেন। এবং সেভাবে তিনি উনার নিজস্ব দর্শন খুজে পেয়েছেন, যা ছড়িয়ে দিয়েছেন ইসলাম ধর্ম নামে। এখন যদি কোরানের ভেতরে দেখি তবে দেখবেন কোরানে এমন কিছু নেই যা তখনকার মানুষ বা আগেরকার মানুষ জানতো না। মিশরীয় সভ্যতার কাহিনী বলি, বা নূহের বন্যার কাহিনীর বলি, লুত সভ্যতার কাহিনী বলি সবই আমাদের মুখে মুখে রচিত পূঁথিকাহিনীর মত আরবে ছড়িয়ে ছিল। আর সেগুলো ইহুদী এবং খ্রীষ্টান ধর্মগ্রন্থেই লিপিবদ্ধ ছিল। কোরানে যে সব বৈজ্ঞানিক দাবী করে থাকে সেগুলো নুতন কিছু নয়, বরং কিছু ভুলও রয়েছে। সেই সময়কার জ্ঞানে ভুল থাকাটাই স্বাভাবিক বরং না থাকাটাই মিরাকল হতো। তাই কোরান বা বাইবেল বা তাওরাত বা ইঞ্জিলকে আমি কোন ঐশ্বরিক গ্রন্থ বলে মনে করি না। মনে করি না তাঁদের ঈশ্বরই পৃথিবীর সকল কিছুর স্রষ্টা।
বাকি থাকলো ঈশ্বর বলে কি কিছু আছে? এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়ার মত অবস্থায় আমরা এখনো নেই। এর জবাব খুঁজার চেষ্টা চলছে মাত্র। তবে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক গবেষনায় ঈশ্বর অথবা আত্মার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। যতক্ষন বৈজ্ঞানিক ভাবে কোন কিছু প্রমানিত না হচ্ছে ততক্ষন সেটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান থাকবো। এই সেই দিন মাত্র স্টিফেন হকিং তার গ্রান্ড ডিজাইনে অবশেষে বলেছেন যে সৃষ্টিকর্তা ছাড়াও বিগ ব্যাং হওয়া সম্ভব। সুতরাং একদিন বিজ্ঞান সম্পুর্ণভাবে বুঝতে সক্ষম হবে বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য। ধর্মকে বিবর্তনের দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব। কিভাবে মানুষের মস্তিষ্কে বিশ্বাস নামক বস্তুটির সৃষ্টি হয় এবং সেটাকে কিভাবে এবং কেন আমরা ছড়িয়ে দেই প্রজন্ম হতে প্রজন্মে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। কেন মানুষ সামাজিক জীব, কেন মানুষ গ্রুপে চলাচলে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে, কিভাবে গ্রুপ তাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে এই বিষয়গুলো আমাদের বুঝতে হবে যদি আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চরিত্র বুঝতে চাই। ধর্মকে মানুষই রক্ষা করে। ধর্ম বলে আলাদা কিছু নেই- এটা সংঘবদ্ধ একদল মানুষের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। একদল মানুষ সেটাকে লালন করছে। কিন্তু কেন তারা লালল করছে সেটাকে বুঝতে হবে যদি তাঁদেরকে সেই চিন্তা থেকে সরিয়ে আনতে চান। সেটা না বুঝে তাঁদেরকে জোর করে আপনি/আমি সেই বিশ্বাস হতে মুক্ত করতে পারবো না। এই মানুষগুলোর যদি সেই বিশ্বাসের প্রয়োজন না থাকে তবে সেটাকে লালনেরও প্রয়োজ়ন থাকতো না।
যদি আজ বিশ্বের সকল মানুষ ইশ্বরে অবিশ্বাসী হয়েও যায় তাতে কি শোষণ বন্ধ হবে? তাতে কি অন্যায় বন্ধ হয়ে যাবে, মানব হত্যা বন্ধ হয়ে যাবে? যাবে না। কারণ ধর্মই দ্বন্দ্বের মূলে নয়। টিকে থাকার সংগ্রাম দ্বন্দ্বের মূলে। যতদিন চাহিদা এবং সম্পদের মাঝে ব্যবধান থাকবে ততদিন দ্বন্দ্ব থাকবে। ধর্ম একদলকে এই টিকে থাকায় বাড়তি সহায়তা করেছে, তাই তারা ধর্মকে লালন করছে। জাতীয়তাবাদ নামক সংঘবদ্ধতা এই টিকে থাকায় সাহায্য করেছে তাই নানান জাতি গোষ্ঠী দেখি। এ কারণে আজ দেখি বিশ্বে বিশ্বাসীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। নদী এবং সাগরের পানির উচ্চতা যখন সমান হয়ে যাবে তখন পানির আর কোন প্রবাহ হবে না। তেমনি চাহিদা এবং উৎপাদনের বিভেদ যেদিন থাকবে না, দ্বন্দ্বও সেদিন থাকবে না। সমস্যা হল সেই বিভেদ পুরোপুরি কমানো অসম্ভব। এমন কোন সাধারণ গাণিতিক মডেল নেই যেটা দিয়ে বলতে পারবেন যে এভাবে চলিলে বিভেদ থাকবে না। এর পেছনে বড় বাঁধা হচ্ছে মানুষের চরিত্রের বিবর্তনীয় ক্ষমতা। পুরো ব্যবস্থাটি নির্ভর করছে আরেকজন মানুষ কিভাবে স্টেপ নেয় তার উপর। একজন মানুষের নেওয়া একশ্যানের উপর নির্ভর করে অন্যজনের কাজ, এভাবে হাজার কোটি মানুষের চরিত্রকে ডিটারমিনিস্টিক মডেলের আওয়তায় আনা এখনকার জ্ঞানে অসম্ভব। কিন্তু একেবারেই কি অসম্ভব? যদি আমরা মানুষের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে সেটা একদিন পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারি তবে হয়তোবা ক্ষুদ্র একটি সমাজে একটি নুতন আইন করা হলে তার ফলাফল কি হবে সেটা আমরা কম্পিউটারে বসেই বের করতে পারবো। তখন আফ্রিকা বা এশিয়ার কোন দেশে কোন অর্থনীতির মডেল হাতে নিলে, স্বল্প সম্পদ ব্যবহার করে , কিভাবে পুরো বিশ্বের জীবন ধারায় উন্নতি আনবে দিয়ে সেটা মডেল করে জানতে পারি। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে চলমান রাখাই আমাদের কর্তব্য । কম্পিউটার একদিনে আবিষ্কার হয়ে যায়নি। আমেরিকার আদম শুমারীতে ব্যবহৃত হতো এমন একটি সাধারণ গণনা যন্ত্র হতে ধীরে ধীরে কম্পিউটার আসে। এভাবে স্টীম ইঞ্জিন কিংবা এরোপ্লেন বা নিউটনের সুত্র কোন কিছুই হঠাৎ করে আবিষ্কৃত হয়নি। প্রতিটি গবেষণাতেই দেখা যায় পূর্বের গবেষণাকে উন্নত রুপ দিয়েই নুতন সুত্র আসে। থেলিস, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিষ্টটল, কনফুসিয়াস, বৌদ্ধ, যিশু, মুহাম্মদ, হাইপেশিয়া, কোপার্নিকাস, ভলতেয়ার, গ্যালিলিও, রুশো, হেগেল, মার্ক্স, লিবনিজ, নিউটন, শেক্সপিয়ার, ডারউইন, আইন্সটাইন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হকিং, ডকিন্স এরা কেউ হঠাৎ করেই কিছু আবিষ্কার করে ফেলেননি। সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথেই তাঁদের আগমন। সভ্যতা এভাবেই এগিয়ে যাবে। এই মুক্তমনা হতেই হতেই অভিজিত, বন্যা, আকাশ মালিকরা মানব সভ্যতায় নুতন কিছু দিয়ে যাবে। মানব সভ্যতা গুঁটি গুঁটি পায়ে এগিয়ে যাবে। জয় হোক মুক্তমনার।
Wednesday, September 15, 2010
এলোমেলো চিন্তাঃ গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের আচরণ
মানুষ আসলে একটি গ্রুপের মাঝে থাকতে পছন্দ করে। এই যেমন মুক্তমনা বা সচল বা সামহোয়ারইন সবাই একটি গ্রুপ। আরো বড় গ্রুপ যদি চিন্তা করেন তবে ধর্মীয় গ্রুপ গুলো, কিংবা একেকটি জাতি বা রাষ্ট্রকে চিন্তা করতে পারেন। ছোট হোক বা বড় হোক যে গ্রুপে আপনি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন সেই গ্রুপে আপনি চলতে পছন্দ করেন। গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের প্রয়োজন গ্রুপ বড় করার আবার আপনার নিজেরও প্রয়োজন কোন না কোন গ্রুপে থাকার। এভাবে দু’য়ের প্রয়োজনে আপনি আপনার গ্রুপ খুঁজে পান আবার গ্রুপও আপনাকে খুঁজে পায়। গ্রুপের চেষ্টা থাকে নানান সুবিধে দিয়ে তার গ্রুপকে সুসংহত রাখার। অন্য গ্রুপের আক্রমন হতে গ্রুপ আপনাকে রক্ষা করে। নিজের নানান বিপদে গ্রুপের সদস্যদের আপনি পাশে পাবেন যেটা আপনি পেতেন না যদি আপনি এই গ্রুপের সদস্য না হতেন। তাই কোন না কোন গ্রুপে আপনি সচেতনে কিংবা অবচেতনে যুক্ত থাকেন। এর মাঝে অনেক গ্রুপ হয়তো আসলেই সাংগঠনিক ভাবে বিদ্যমান আবার অনেক গ্রুপ শুধু মাত্র আদর্শে বিদ্যমান। যেমন আপনি হয়তো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। পৃথিবীর যে কোন গণতন্ত্রাকামি মানুষের প্রতি আপনার সহানুভুতি থাকবে। আবার গ্রুপের সদস্যদের মাঝে কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে গ্রুপ নানান নীতিমালা প্রণয়ন করে থাকে। গ্রুপ সব সময় নিজের ভাঙ্গন রোধে সচেষ্ট থাকে। তাই অনেক সময় কেউ গ্রুপ হতে বের হয়ে চলে যেতে চাইলে সেটাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। গ্রুপের মাঝে কেউ নিয়ম না মানলে তাকে শাস্তি দেওয়া হয় গ্রুপকে রক্ষার্থে। এই সবই চিন্তা করা যেতে পারে “এজ এ সেলফিশনেস অফ এ গ্রুপ” হিসেবে।
ছোট হোক বড় হোক যে কোন গ্রুপের মাঝে আমরা এই কমন বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে পাবো। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন সত্য মুক্তমনা বা সচলের মত ছোট গ্রুপের জন্য তেমনি সত্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় সংগঠনগুলোর জন্য। এ কারণেই অনেক মানুষ ধর্ম তেমন ভাবে পালন না করলেও শুধু মাত্র তার নিজের বা পরিবারের জন্য গ্রুপে রয়ে যায়। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে ধর্ম পালন না করলেও, এমন কি ধর্মে অবিশ্বাস করলেও শুধু মাত্র সামাজিকতা রক্ষার্থে হয়তো জুম্মার নামাজটি, কিংবা ঈদের নামাজটি করেন, কিংবা রোজার মাসে রোজাও রাখেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, জুম্মার নামাজ পড়া বা রোজা রাখা কি ধর্ম পালন নয়? আমার জবাব হচ্ছে হিন্দুদের অনেকে উপোস করে থাকে, সেটা কি রোজা? না, তেমনি এক ওয়াক্ত নামাজ পালন, কিংবা সারা মাস উপোস করাটা ধর্ম পালন নয়। ধর্মে যদি তার বিশ্বাস থাকতো, তার যদি আল্লাহ্র ভয় থাকতো তবে তিনি পাঁচ ওয়াক্তই নামাজ পড়তেন। কারণ ইসলামে এক ওয়াক্ত নামাজও না পড়ার জন্য কোন অজুহাত রাখা হয়নি। এবার আপনি আপনার আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন শতকরা কতভাগ মানুষ পান, যারা সত্যিকার ভাবে আসলে ধর্ম পালন করে, বা ধর্মকে ধারণ করেন।
আবার যারা সত্যিকার ভাবে ধর্ম পালন করেন তার মাঝে বেশিরভাগই নিরীহ, সাধারণ মানুষ, যারা মূলত পরকালের ভয় থেকেই পুরোপুরি ধর্ম পালন করেন। এদের মধ্য খুব কম মানুষই কোরনের অনুবাদ পড়েছেন। কোরান সম্পর্কে জানেন এক মাত্র হুজুরদের বয়ান থেকে। আর যে সব হুজুরেরা বয়ান করেন তাঁদেরও বেশিরভাগই কম পড়ুয়া। খুতবার জন্য যতটুকু না জানলেই নয়, তাই জানেন। একই খুতবা আমার সারাজীবনে বার বার শুনে এসেছি জুম্মার বা ঈদের নামাজে। তাহলে প্রকৃত জিহাদী চেতনার মানুষ কিছু হিজবুত তাহরীর মত উগ্র সংগঠন থেকেই পাই, যারা মানুষের ধর্মভীরুতার, অজ্ঞতার, দারিদ্রতার সূযোগ নিয়ে ব্যবহার করে।
এখন কথা হল যে আমাদের শত্রু সকল ধার্মিক নয়। শত্রু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, এবং আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে ধর্মের মাঝে বিদ্যমান ক্ষতিকর এলিমেন্টগুলো, এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে সেই সব এলিমেন্ট ব্যবহার করে যে সমস্ত ব্যক্তি তারা। আমি দেশে ফোন করার জন্য একবার একটি টেলিকমের লাইন নিয়েছিলাম, এবং সে জন্য আমাকে ক্রেডিট কার্ডের নম্বর দিতে হয়েছিল ফোনে। যে লোকটি নিয়েছিল তারা ব্যবহার কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। আমি ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিকে ফোন করে বললাম ঘটনা। সে যেটা বললো, এ রকম ফোনে অনেক লেনদেন হয়, সো ডোন্ট ওওরি। আমি জিজ্ঞেস করলাম ওই ব্যক্তি যদি আমার কার্ড ব্যবহার করে নিজে কিছু অনলাইনে কিনে, তাহলে? সে আমাকে যেটা বললো যে, আমার সেই প্রটেকশান আছে। যদি ওরা দেখে যে সেই জিনিসটি আমার নামে বা আমার ঠিকানায় যায় নি, তবে বুঝবে এটা আমি কিনিনি এবং সে ক্ষেত্রে টাকা আমাকে দিতে হবে না। আর তার চেয়েও যেটা বললো যে এটা করবে সেটা তার জন্য একটি ক্রিমিনাল এক্ট হবে। ক্রেডিট কার্ডের মালিক যেহেতু সে নয়, তাই সে সেটা ব্যবহার করলে আইনত সে অপরাধী। এই ঘটনাটি বলার উদ্দেশ্য হল যে সব ব্যক্তি সাধারণ মানুষের ধর্মভীরুতার, দারিদ্রতার সূযোগ নিচ্ছে সেই প্রকৃত অপরাধী। আমি এই কথাটি বারবার বলার চেষ্টা করি, যে কে প্রকৃত শত্রু সেটা আগে জানুন, তার পর না আপনি যুদ্ধে নামবেন।
এখন এই অপরাধী যেন তেন অপরাধী নয়। এই অপরাধী অনেক চালাক, কারণ তার অস্ত্র সেটাই যেটা মানুষের প্রয়োজন। এর সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সেই মানুষগুলো যাঁদের সে ব্যবহার করে। কিন্তু সেই মানুষগুলো কেন এ রকম ব্যবহৃত হচ্ছে? হচ্ছে কারণ এত বড় গ্রুপের শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মত ক্ষমতা তার নেই। এ রকম একটি বড় গ্রুপের বিরুদ্ধে তাকে লড়তে দিতে হলে তাঁর প্রয়োজন অন্য একটি কাছাকাছি শক্তির গ্রুপের অবস্থান যেখানে সে তার প্রয়োজনীয় শক্তিটুকু পাবে। যদি তাঁকে সেই গ্রুপটি না দিতে পারেন তবে তার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করা ভুল। আর যদি তাকেই অপরাধী বানিয়ে বসে থাকেন তবে আপনি নিজেও বড় ভুল করলেন। ভুল শত্রুর পেছনে নিজের শক্তি খরচ করলেন। শত্রুর স্থলে নিজের ট্যাকনিকাল মিত্রকে নিজের শত্রু বানিয়ে দিলেন।
তাই আমার মতে একটি মুক্তমনা সমাজ দেখতে হলে মুক্তমনা গ্রুপকে বড় করতে হবে। মানুষের কাছে গ্রুপের আদর্শকে তুলে ধরে গ্রুপকে সব সময় বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। এবং এই গ্রুপে অন্য যে কারোর বিরুদ্ধেই বিদ্বেষ পূর্ণ কথার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকতে হবে গ্রুপের ভালোর জন্য। প্রায় এ রকম কথাই বিপ্লব’দা বলেছিলেনঃ বিজ্ঞান ভিক্তিক জনসংগঠনের কথা। জীবনটাই একটা যুদ্ধ, বেঁচে থাকার প্রচেষ্টাই একটি যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে আগে তার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পরিষ্কার করতে হবে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে তীর ছোড়াছুড়ি করলে শুধু সময় আর শক্তির অপচয় হবে। আর সেই অপচয় নিশ্চয়ই আমাদেরকে টিকে থাকতে কোন প্রকার সাহয্য করবে না। তাই যারা নিজেদের মুক্তমনা মনে করেন, নিজেদের মাঝে যুদ্ধ না করে, চলুন লক্ষ্য ঠিক করি, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করি। এই সংগঠনটিকেই বড় করি। মানুষের কাছে এর আদর্শ তুলে ধরি।
ছোট হোক বড় হোক যে কোন গ্রুপের মাঝে আমরা এই কমন বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে পাবো। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন সত্য মুক্তমনা বা সচলের মত ছোট গ্রুপের জন্য তেমনি সত্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় সংগঠনগুলোর জন্য। এ কারণেই অনেক মানুষ ধর্ম তেমন ভাবে পালন না করলেও শুধু মাত্র তার নিজের বা পরিবারের জন্য গ্রুপে রয়ে যায়। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে ধর্ম পালন না করলেও, এমন কি ধর্মে অবিশ্বাস করলেও শুধু মাত্র সামাজিকতা রক্ষার্থে হয়তো জুম্মার নামাজটি, কিংবা ঈদের নামাজটি করেন, কিংবা রোজার মাসে রোজাও রাখেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, জুম্মার নামাজ পড়া বা রোজা রাখা কি ধর্ম পালন নয়? আমার জবাব হচ্ছে হিন্দুদের অনেকে উপোস করে থাকে, সেটা কি রোজা? না, তেমনি এক ওয়াক্ত নামাজ পালন, কিংবা সারা মাস উপোস করাটা ধর্ম পালন নয়। ধর্মে যদি তার বিশ্বাস থাকতো, তার যদি আল্লাহ্র ভয় থাকতো তবে তিনি পাঁচ ওয়াক্তই নামাজ পড়তেন। কারণ ইসলামে এক ওয়াক্ত নামাজও না পড়ার জন্য কোন অজুহাত রাখা হয়নি। এবার আপনি আপনার আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন শতকরা কতভাগ মানুষ পান, যারা সত্যিকার ভাবে আসলে ধর্ম পালন করে, বা ধর্মকে ধারণ করেন।
আবার যারা সত্যিকার ভাবে ধর্ম পালন করেন তার মাঝে বেশিরভাগই নিরীহ, সাধারণ মানুষ, যারা মূলত পরকালের ভয় থেকেই পুরোপুরি ধর্ম পালন করেন। এদের মধ্য খুব কম মানুষই কোরনের অনুবাদ পড়েছেন। কোরান সম্পর্কে জানেন এক মাত্র হুজুরদের বয়ান থেকে। আর যে সব হুজুরেরা বয়ান করেন তাঁদেরও বেশিরভাগই কম পড়ুয়া। খুতবার জন্য যতটুকু না জানলেই নয়, তাই জানেন। একই খুতবা আমার সারাজীবনে বার বার শুনে এসেছি জুম্মার বা ঈদের নামাজে। তাহলে প্রকৃত জিহাদী চেতনার মানুষ কিছু হিজবুত তাহরীর মত উগ্র সংগঠন থেকেই পাই, যারা মানুষের ধর্মভীরুতার, অজ্ঞতার, দারিদ্রতার সূযোগ নিয়ে ব্যবহার করে।
এখন কথা হল যে আমাদের শত্রু সকল ধার্মিক নয়। শত্রু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, এবং আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে ধর্মের মাঝে বিদ্যমান ক্ষতিকর এলিমেন্টগুলো, এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে সেই সব এলিমেন্ট ব্যবহার করে যে সমস্ত ব্যক্তি তারা। আমি দেশে ফোন করার জন্য একবার একটি টেলিকমের লাইন নিয়েছিলাম, এবং সে জন্য আমাকে ক্রেডিট কার্ডের নম্বর দিতে হয়েছিল ফোনে। যে লোকটি নিয়েছিল তারা ব্যবহার কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। আমি ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিকে ফোন করে বললাম ঘটনা। সে যেটা বললো, এ রকম ফোনে অনেক লেনদেন হয়, সো ডোন্ট ওওরি। আমি জিজ্ঞেস করলাম ওই ব্যক্তি যদি আমার কার্ড ব্যবহার করে নিজে কিছু অনলাইনে কিনে, তাহলে? সে আমাকে যেটা বললো যে, আমার সেই প্রটেকশান আছে। যদি ওরা দেখে যে সেই জিনিসটি আমার নামে বা আমার ঠিকানায় যায় নি, তবে বুঝবে এটা আমি কিনিনি এবং সে ক্ষেত্রে টাকা আমাকে দিতে হবে না। আর তার চেয়েও যেটা বললো যে এটা করবে সেটা তার জন্য একটি ক্রিমিনাল এক্ট হবে। ক্রেডিট কার্ডের মালিক যেহেতু সে নয়, তাই সে সেটা ব্যবহার করলে আইনত সে অপরাধী। এই ঘটনাটি বলার উদ্দেশ্য হল যে সব ব্যক্তি সাধারণ মানুষের ধর্মভীরুতার, দারিদ্রতার সূযোগ নিচ্ছে সেই প্রকৃত অপরাধী। আমি এই কথাটি বারবার বলার চেষ্টা করি, যে কে প্রকৃত শত্রু সেটা আগে জানুন, তার পর না আপনি যুদ্ধে নামবেন।
এখন এই অপরাধী যেন তেন অপরাধী নয়। এই অপরাধী অনেক চালাক, কারণ তার অস্ত্র সেটাই যেটা মানুষের প্রয়োজন। এর সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সেই মানুষগুলো যাঁদের সে ব্যবহার করে। কিন্তু সেই মানুষগুলো কেন এ রকম ব্যবহৃত হচ্ছে? হচ্ছে কারণ এত বড় গ্রুপের শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মত ক্ষমতা তার নেই। এ রকম একটি বড় গ্রুপের বিরুদ্ধে তাকে লড়তে দিতে হলে তাঁর প্রয়োজন অন্য একটি কাছাকাছি শক্তির গ্রুপের অবস্থান যেখানে সে তার প্রয়োজনীয় শক্তিটুকু পাবে। যদি তাঁকে সেই গ্রুপটি না দিতে পারেন তবে তার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করা ভুল। আর যদি তাকেই অপরাধী বানিয়ে বসে থাকেন তবে আপনি নিজেও বড় ভুল করলেন। ভুল শত্রুর পেছনে নিজের শক্তি খরচ করলেন। শত্রুর স্থলে নিজের ট্যাকনিকাল মিত্রকে নিজের শত্রু বানিয়ে দিলেন।
তাই আমার মতে একটি মুক্তমনা সমাজ দেখতে হলে মুক্তমনা গ্রুপকে বড় করতে হবে। মানুষের কাছে গ্রুপের আদর্শকে তুলে ধরে গ্রুপকে সব সময় বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। এবং এই গ্রুপে অন্য যে কারোর বিরুদ্ধেই বিদ্বেষ পূর্ণ কথার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকতে হবে গ্রুপের ভালোর জন্য। প্রায় এ রকম কথাই বিপ্লব’দা বলেছিলেনঃ বিজ্ঞান ভিক্তিক জনসংগঠনের কথা। জীবনটাই একটা যুদ্ধ, বেঁচে থাকার প্রচেষ্টাই একটি যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে আগে তার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পরিষ্কার করতে হবে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে তীর ছোড়াছুড়ি করলে শুধু সময় আর শক্তির অপচয় হবে। আর সেই অপচয় নিশ্চয়ই আমাদেরকে টিকে থাকতে কোন প্রকার সাহয্য করবে না। তাই যারা নিজেদের মুক্তমনা মনে করেন, নিজেদের মাঝে যুদ্ধ না করে, চলুন লক্ষ্য ঠিক করি, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করি। এই সংগঠনটিকেই বড় করি। মানুষের কাছে এর আদর্শ তুলে ধরি।
Wednesday, August 11, 2010
এলোমেলো চিন্তাঃ বিবর্তনময় জীবন
বন্যা আপাকে আমার আগের লেখায় মন্তব্যে লিখেছিলাম যে আমার জীবন এখন বিবর্তনময় হয়ে গিয়েছে। আমার চারপাশে আমি এখন শুধু বিবর্তনকেই দেখতে পাই। বিবর্তনের আলোকে নিজের অনেক কর্মের ব্যাখ্যা পাই, নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও ঠিক করি। এর জন্য বন্যা আপার “বিবর্তনের পথ ধরে” বইয়ের অবদান অনেক। আজ অফিসিয়ালি কৃতজ্ঞতা জানালাম। বিবর্তনের উপর প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য এই বইটির তুলনা হয় না। তবে আমার মূল আগ্রহ হচ্ছে রাজনৈতিক দর্শনে। প্রাথমিক জ্ঞানটুকু পাবার পর আমি এখন মূলত পড়ি বিবর্তনের আলোকে মানুষ বা সমাজ, বা রাষ্ট্রের চরিত্র বোঝার বিষয়গুলো নিয়ে। আজকের লেখাটি আমার সেই বিবর্তনময় জীবন নিয়ে কিছু আবজাব।
আমি দর্শনকে দু’ভাগে ভাগ করবোঃ বিবর্তন পূর্ব দর্শন এবং বিবর্তন পরবর্তী দর্শন। আজ বিজ্ঞানের অগ্রগতীর ফলে দর্শন এবং বিজ্ঞান এখন প্রায় সমার্থক শব্দ হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক এখন কোন দর্শন সম্ভব নয়। তাই জীব বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ণৃ-বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস সহ সকল ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপস্থিতি লক্ষনীয়। তাই এখন একজন দার্শনিক দর্শন নিয়ে কাজ করেন আবার বিবর্তনের মত বিজ্ঞান নিয়েও কাজ করেন। তাই ডকিন্স, হকিংস এর মত বিজ্ঞানীরা হয়ে উঠেন একই সাথে দার্শনিক আবার ডেনেটের মত দার্শনিকেরা হয়ে উঠেন বিবর্তনীয় বিজ্ঞানী।
আমি যখন ধর্ম সম্পর্কে লেখাকে নিরুৎসাহিত করি তখন সেটা ধর্মকে নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখার কথা বুঝাইনি। ধর্মকে শুধু মাত্র কোরান বা মুহাম্মদের চরিত্রকে খন্ডনের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে দর্শনের আলোকে, ইতিহাসের আলোকে, নৃবিজ্ঞানের আলোকে, বিবর্তনের আলোকেও খন্ডন করার কথা বলি। এই ক্ষেত্রে ডেনেট এর ব্রেকিং দ্যা স্পেল বা ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইগুলোর কথা বলতে পারি। ডেনেট তার এই বইয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শুরু আমাদের লোকজ ধর্মগুলো হতে। তিনি ধর্মকে একটি লোকজ ধারা হিসেবে দেখিয়েছেন যেমনতর আমাদের রয়েছে লোকজ সঙ্গীত, লোকজ সংস্কৃতি বা লোকজ ভাষা। লোকজ সঙ্গীত যেমন বিবর্তিত হয়ে আজ প্রাতিষ্ঠানিক রক, ব্যান্ড, আধুনিক কিংবা জ্যাজ সঙ্গীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনি লোকজ ধর্মগুলো বিবর্তিত হয়ে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আপনি হয়তো রক পছন্দ করেন না, শুধু মেলোডি নির্ভর পছন্দ করেন, তেমনি আরেকজন হয়তো এখনো শুধু লোকজ সঙ্গীতই পছন্দ করেন, কিন্তু তাই বলে নিশ্চয়ই আরেকজনের পছন্দকে পাগল বলে বাতিল করে দেননা।
বিশ্বাস বা ধারণা বা কোন আইডিয়া নামক বস্তুটি আমাদের মস্তিষ্কের মাঝে বিবর্তনের পথে কোন একসময়ে এসেছে। যে কোন বিশ্বাস, বা সঙ্গীত বা চিত্রকলা বা সংস্কৃতি এগুলো আমাদের মস্তিষ্কে একধরনের ভাল লাগার অনুভূতি প্রদান করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সমাজকে সংগঠিত করতে সাহায্য করে, যার ফলে গ্রুপ সিলেকশনে টিকে থাকতে ফিটনেস বাড়ায়। সে কারণে এই সমস্ত বিষয়গুলো আমাদের মস্তিষ্কে বংশপরম্পরায় টিকে থেকে গিয়েছে। এর মধ্যে যেগুলো আবার সমাজের জন্য ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত হবে সেগুলো আবার বিববর্তনের সুত্র মতেই ধীরে ধীরে বংশপরম্পায় বাদ হয়ে যাবে। ধর্ম বিশ্বাসকে আমি সেভাবেই দেখি। এক সময় সেটা সমাজকে সংগঠিত করেছে, কিন্তু আজ সেটাই এখন ক্ষতির কারন হয়ে দাড়াচ্ছে। আমার বাবা/মা যেভাবে ধর্ম পালন করতো, আমি সেভাবে করি না, আর আমার সন্তানরা যে আরো করবে না সেটা বলাই বাহুল্য। তিন/চার হাজার বছরের পুরোন বিশ্বাস চলে যেতে আমাদেরকে প্রায় সেরকম সময় অপেক্ষা করতে হবে। বিবর্তন খুব ধীর গতির যা সহজে আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে পরিবর্তন কিন্তু চোখে পড়বে। টোটাল পরিবর্তনের জন্য আমাদের সময় দিতে হবে। সেটা আমি বা আপনি দেখে যেতে পারবো না।
ডেনেটের একটি বক্তব্য আমার বেশ ভাল লেগেছে তা হল ধারণা বা আইডিয়া কিভাবে একটি মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা কোন একটি ধারণার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে। আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিতে পারি, জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদের জন্য প্রাণ দিতে পারি আবার ধর্মের জন্যেও শহীদ হতে পারি। এ সবই করি কারণ, আমাদের মস্তিষ্কের ধারণা নামক বস্তুটির জন্য। ডকিন্স এটিকেই বলেছেন সেলফিশনেস অফ মিম, অনেকটা সেলফিশনেস অফ জিনের মত। জিন যেমন নিজের বংশবৃদ্ধির জন্য তার হোষ্টকে মরে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম তেমনি মিমও সেটা করতে পারে। একজন মা যেমন তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দিতে পারে তেমনি একজন মানুষ তার বিশ্বাসকে রক্ষার জন্য জীবন দিতে পারে। এই ধারনা বা বিশ্বাস জিনিসটিকে ডেনেট পরজীবী জীবের সাথে তুলনা করেছেন। Lancet liver fluke এর মত পরজীবী যেমন একটি পিঁপড়েকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে আত্মহননে বাধ্য করে তেমনি আমাদের বিশ্বাস একজন মানুষকে বাধ্য করে আত্মহননের মত কাজে। যে কোন মানুষকে আঘাত দেওয়ার আগে তাই কেন মানুষের মাঝে এমন বিশ্বাস নামক বস্তুটির উৎপত্তি হয় সেটা বোঝা জরুরী। তখন আপনি রোগটিকে নিরাময় করতে পারবেন সহজে।
মজার ব্যাপার হল মানুষের মস্তিষ্কে এই ধারণাগুলোর প্রবেশ বা প্রতিস্থাপন করানো কিন্তু খুব সহজ একটি কাজ যেটা আমরা সব সময় করে আসি। ছোটবেলায় বাবা/মার শেখানো নানান বুলিগুলো দিয়ে শুরু হয় ধারণার প্রতিস্থাপন। ধর্মের ধারণাও সবাই পরিবারের কাছ থেকেই পাই প্রথমে। তারপর বন্ধু, আত্মীয় স্বজন, সমাজ সবর্ত্রের মাধ্যমে এই ধারণা আরো পাকাপোক্ত হয়। এর পর থেকে কখন যে বিশ্বাস/ধারণাই চালিকা শক্তি হয়ে যায় সেটা আর টের পাই না। যার ফলে বিদেশে এসে হালাল/হারাম খুঁজি। ধারণা প্রতিস্থাপন নিয়ে সম্প্রতি একটি ছবি হয়েছে, ডিকাপ্রিওর, নাম Inception. দেখতে পারেন। আমার চমৎকার লেগেছে। ছবিটির মাঝে একটি ক্ষুদ্র ধারণা কিভাবে অন্যের মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করা যায় এবং সেটি কিভাবে একজনের দৃষ্টিভঙ্গীকে বদলে দিতে পারে সেটা তুলে ধরা হয়েছে।
মানুষের মনের বা মস্তিষ্কের বিবর্তনের কথা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখবো যে মানুষই এই ধর্মগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে আবার তারাই আজ ধর্মগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা শুরু করেছে। তাই প্রয়োজন নিছক সমালোচনা নয়, প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা। ধর্মকে নিয়ে যত গবেষণা হবে, নৃবিজ্ঞানের আলোকে, ইতিহাসের আলোকে, বিবর্তিনের আলোকে ততই মানুষ ধর্মের বিবর্তন সম্পর্কে আরো বেশি করে জানতে পারবে এবং নিজেই পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে পারবে। ডেনেট তার বইয়ে ধর্ম নিয়ে এই গবেষণার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন প্রয়োজন হলে ধার্মিক/বিশ্বাসী গবেষকদের দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধর্ম নিয়ে গবেষণা করতে। হয় তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার দ্বারা ধর্মকে ব্যাখ্যা করুক, প্রতিষ্ঠিত করুক নয়তো তারা স্বীকার করুক তাঁদের ভুল।
আমরা যারা গবেষক নই তারা কি করতে পারি? তারা ডেনেটের এই বইটি কিংবা ডকিন্স এর সেলফিশ জিন বইয়ের মত বইগুলোকে অনুবাদ করে মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারি। ধর্ম নিয়ে আরেকটি গবেষনা মুলক বইয়ের নাম এখানে দিতে পারি। বইটির নামঃ Where God and science meet : How Brain and Evolutionary Studies Alter Our Understanding of Religion Edited by Patrick McNamara. এর তিনটি খন্ড রয়েছে। প্রথম খন্ডে আপনি পাবেন Evolution, Genes, and the Religious Brain, দ্বিতীয় খন্ডে পাবেনঃ The Neurology of Religious Experience এবং তৃতীয় খন্ডে পাবেনঃ The Psychology of Religious Experience। পুরো ৯০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ে বিবর্তন এবং মনোবিজ্ঞানের আলোকে ধর্মকে নিয়ে গবেষণালব্ধ অনেক কিছুই পাওয়া যাবে যা দিয়ে নিজের যুক্তিগুলোকে শাণিত করতে পারবেন। বইটি কারো লাগলে এখানে ইমেইল ঠিকানা দিলে, আমি পাঠিয়ে দিতে পারবো। শর্ত হল একটি অধ্যায় হলেও পড়ে সারমর্ম পোষ্ট করতে হবে।
বিবর্তন একটি শক্তিশালী শাখা বিজ্ঞানের, এবং এটি আজ শুধু জীববিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ বিবর্তনের বিভিন্ন চিন্তাধারাগুলো এরই মধ্যে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোতে প্রয়োগ করছে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি প্রতিষ্ঠিত শাখা। তেমনি বিবর্তনের দৃষ্টি দিয়ে মানুষের গোষ্ঠিবদ্ধ আচরনকে বোঝার চেষ্টা চলছে যার ফলশ্রুতিতে এখন বিবর্তনীয় সমাজবিজ্ঞান, বিবর্তনীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা বিবর্তনীয় অর্থনীতির মত বিষয়গুলো দেখতে পাই। বলাই বাহুল্য এই বিষয়গুলো সদ্য যাত্রা করেছে এবং এই বিষয়গুলো পরিপূর্ণতা পেতে আরো কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু সেটা যে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা বাংলা ভাষাভাষী যারা রয়েছি তারা এই সম্পর্কের বইগুলো পড়ে সেগুলো সম্পর্কে বেশি বেশি করে লিখতে পারি, যেন তরুন গবেষকরা এই সব বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী হয়। তবেই কিন্তু একটি মুক্তবুদ্ধির সমাজ পাবো।
পরিশেষে ধর্মের উপর লেখাগুলো নিয়ে বিবর্তন আর্কাইভের মত একটি আর্কাইভ খোলার প্রয়োজনীয়তার কথা আবারো বলে যাচ্ছি। আর লেখাটি বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো, তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আগেই।
আমি দর্শনকে দু’ভাগে ভাগ করবোঃ বিবর্তন পূর্ব দর্শন এবং বিবর্তন পরবর্তী দর্শন। আজ বিজ্ঞানের অগ্রগতীর ফলে দর্শন এবং বিজ্ঞান এখন প্রায় সমার্থক শব্দ হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক এখন কোন দর্শন সম্ভব নয়। তাই জীব বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ণৃ-বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস সহ সকল ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপস্থিতি লক্ষনীয়। তাই এখন একজন দার্শনিক দর্শন নিয়ে কাজ করেন আবার বিবর্তনের মত বিজ্ঞান নিয়েও কাজ করেন। তাই ডকিন্স, হকিংস এর মত বিজ্ঞানীরা হয়ে উঠেন একই সাথে দার্শনিক আবার ডেনেটের মত দার্শনিকেরা হয়ে উঠেন বিবর্তনীয় বিজ্ঞানী।
আমি যখন ধর্ম সম্পর্কে লেখাকে নিরুৎসাহিত করি তখন সেটা ধর্মকে নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখার কথা বুঝাইনি। ধর্মকে শুধু মাত্র কোরান বা মুহাম্মদের চরিত্রকে খন্ডনের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে দর্শনের আলোকে, ইতিহাসের আলোকে, নৃবিজ্ঞানের আলোকে, বিবর্তনের আলোকেও খন্ডন করার কথা বলি। এই ক্ষেত্রে ডেনেট এর ব্রেকিং দ্যা স্পেল বা ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইগুলোর কথা বলতে পারি। ডেনেট তার এই বইয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শুরু আমাদের লোকজ ধর্মগুলো হতে। তিনি ধর্মকে একটি লোকজ ধারা হিসেবে দেখিয়েছেন যেমনতর আমাদের রয়েছে লোকজ সঙ্গীত, লোকজ সংস্কৃতি বা লোকজ ভাষা। লোকজ সঙ্গীত যেমন বিবর্তিত হয়ে আজ প্রাতিষ্ঠানিক রক, ব্যান্ড, আধুনিক কিংবা জ্যাজ সঙ্গীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনি লোকজ ধর্মগুলো বিবর্তিত হয়ে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আপনি হয়তো রক পছন্দ করেন না, শুধু মেলোডি নির্ভর পছন্দ করেন, তেমনি আরেকজন হয়তো এখনো শুধু লোকজ সঙ্গীতই পছন্দ করেন, কিন্তু তাই বলে নিশ্চয়ই আরেকজনের পছন্দকে পাগল বলে বাতিল করে দেননা।
বিশ্বাস বা ধারণা বা কোন আইডিয়া নামক বস্তুটি আমাদের মস্তিষ্কের মাঝে বিবর্তনের পথে কোন একসময়ে এসেছে। যে কোন বিশ্বাস, বা সঙ্গীত বা চিত্রকলা বা সংস্কৃতি এগুলো আমাদের মস্তিষ্কে একধরনের ভাল লাগার অনুভূতি প্রদান করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সমাজকে সংগঠিত করতে সাহায্য করে, যার ফলে গ্রুপ সিলেকশনে টিকে থাকতে ফিটনেস বাড়ায়। সে কারণে এই সমস্ত বিষয়গুলো আমাদের মস্তিষ্কে বংশপরম্পরায় টিকে থেকে গিয়েছে। এর মধ্যে যেগুলো আবার সমাজের জন্য ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত হবে সেগুলো আবার বিববর্তনের সুত্র মতেই ধীরে ধীরে বংশপরম্পায় বাদ হয়ে যাবে। ধর্ম বিশ্বাসকে আমি সেভাবেই দেখি। এক সময় সেটা সমাজকে সংগঠিত করেছে, কিন্তু আজ সেটাই এখন ক্ষতির কারন হয়ে দাড়াচ্ছে। আমার বাবা/মা যেভাবে ধর্ম পালন করতো, আমি সেভাবে করি না, আর আমার সন্তানরা যে আরো করবে না সেটা বলাই বাহুল্য। তিন/চার হাজার বছরের পুরোন বিশ্বাস চলে যেতে আমাদেরকে প্রায় সেরকম সময় অপেক্ষা করতে হবে। বিবর্তন খুব ধীর গতির যা সহজে আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে পরিবর্তন কিন্তু চোখে পড়বে। টোটাল পরিবর্তনের জন্য আমাদের সময় দিতে হবে। সেটা আমি বা আপনি দেখে যেতে পারবো না।
ডেনেটের একটি বক্তব্য আমার বেশ ভাল লেগেছে তা হল ধারণা বা আইডিয়া কিভাবে একটি মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা কোন একটি ধারণার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে। আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিতে পারি, জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদের জন্য প্রাণ দিতে পারি আবার ধর্মের জন্যেও শহীদ হতে পারি। এ সবই করি কারণ, আমাদের মস্তিষ্কের ধারণা নামক বস্তুটির জন্য। ডকিন্স এটিকেই বলেছেন সেলফিশনেস অফ মিম, অনেকটা সেলফিশনেস অফ জিনের মত। জিন যেমন নিজের বংশবৃদ্ধির জন্য তার হোষ্টকে মরে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম তেমনি মিমও সেটা করতে পারে। একজন মা যেমন তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দিতে পারে তেমনি একজন মানুষ তার বিশ্বাসকে রক্ষার জন্য জীবন দিতে পারে। এই ধারনা বা বিশ্বাস জিনিসটিকে ডেনেট পরজীবী জীবের সাথে তুলনা করেছেন। Lancet liver fluke এর মত পরজীবী যেমন একটি পিঁপড়েকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে আত্মহননে বাধ্য করে তেমনি আমাদের বিশ্বাস একজন মানুষকে বাধ্য করে আত্মহননের মত কাজে। যে কোন মানুষকে আঘাত দেওয়ার আগে তাই কেন মানুষের মাঝে এমন বিশ্বাস নামক বস্তুটির উৎপত্তি হয় সেটা বোঝা জরুরী। তখন আপনি রোগটিকে নিরাময় করতে পারবেন সহজে।
মজার ব্যাপার হল মানুষের মস্তিষ্কে এই ধারণাগুলোর প্রবেশ বা প্রতিস্থাপন করানো কিন্তু খুব সহজ একটি কাজ যেটা আমরা সব সময় করে আসি। ছোটবেলায় বাবা/মার শেখানো নানান বুলিগুলো দিয়ে শুরু হয় ধারণার প্রতিস্থাপন। ধর্মের ধারণাও সবাই পরিবারের কাছ থেকেই পাই প্রথমে। তারপর বন্ধু, আত্মীয় স্বজন, সমাজ সবর্ত্রের মাধ্যমে এই ধারণা আরো পাকাপোক্ত হয়। এর পর থেকে কখন যে বিশ্বাস/ধারণাই চালিকা শক্তি হয়ে যায় সেটা আর টের পাই না। যার ফলে বিদেশে এসে হালাল/হারাম খুঁজি। ধারণা প্রতিস্থাপন নিয়ে সম্প্রতি একটি ছবি হয়েছে, ডিকাপ্রিওর, নাম Inception. দেখতে পারেন। আমার চমৎকার লেগেছে। ছবিটির মাঝে একটি ক্ষুদ্র ধারণা কিভাবে অন্যের মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করা যায় এবং সেটি কিভাবে একজনের দৃষ্টিভঙ্গীকে বদলে দিতে পারে সেটা তুলে ধরা হয়েছে।
মানুষের মনের বা মস্তিষ্কের বিবর্তনের কথা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখবো যে মানুষই এই ধর্মগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে আবার তারাই আজ ধর্মগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা শুরু করেছে। তাই প্রয়োজন নিছক সমালোচনা নয়, প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা। ধর্মকে নিয়ে যত গবেষণা হবে, নৃবিজ্ঞানের আলোকে, ইতিহাসের আলোকে, বিবর্তিনের আলোকে ততই মানুষ ধর্মের বিবর্তন সম্পর্কে আরো বেশি করে জানতে পারবে এবং নিজেই পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে পারবে। ডেনেট তার বইয়ে ধর্ম নিয়ে এই গবেষণার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন প্রয়োজন হলে ধার্মিক/বিশ্বাসী গবেষকদের দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধর্ম নিয়ে গবেষণা করতে। হয় তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার দ্বারা ধর্মকে ব্যাখ্যা করুক, প্রতিষ্ঠিত করুক নয়তো তারা স্বীকার করুক তাঁদের ভুল।
আমরা যারা গবেষক নই তারা কি করতে পারি? তারা ডেনেটের এই বইটি কিংবা ডকিন্স এর সেলফিশ জিন বইয়ের মত বইগুলোকে অনুবাদ করে মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারি। ধর্ম নিয়ে আরেকটি গবেষনা মুলক বইয়ের নাম এখানে দিতে পারি। বইটির নামঃ Where God and science meet : How Brain and Evolutionary Studies Alter Our Understanding of Religion Edited by Patrick McNamara. এর তিনটি খন্ড রয়েছে। প্রথম খন্ডে আপনি পাবেন Evolution, Genes, and the Religious Brain, দ্বিতীয় খন্ডে পাবেনঃ The Neurology of Religious Experience এবং তৃতীয় খন্ডে পাবেনঃ The Psychology of Religious Experience। পুরো ৯০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ে বিবর্তন এবং মনোবিজ্ঞানের আলোকে ধর্মকে নিয়ে গবেষণালব্ধ অনেক কিছুই পাওয়া যাবে যা দিয়ে নিজের যুক্তিগুলোকে শাণিত করতে পারবেন। বইটি কারো লাগলে এখানে ইমেইল ঠিকানা দিলে, আমি পাঠিয়ে দিতে পারবো। শর্ত হল একটি অধ্যায় হলেও পড়ে সারমর্ম পোষ্ট করতে হবে।
বিবর্তন একটি শক্তিশালী শাখা বিজ্ঞানের, এবং এটি আজ শুধু জীববিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ বিবর্তনের বিভিন্ন চিন্তাধারাগুলো এরই মধ্যে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোতে প্রয়োগ করছে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি প্রতিষ্ঠিত শাখা। তেমনি বিবর্তনের দৃষ্টি দিয়ে মানুষের গোষ্ঠিবদ্ধ আচরনকে বোঝার চেষ্টা চলছে যার ফলশ্রুতিতে এখন বিবর্তনীয় সমাজবিজ্ঞান, বিবর্তনীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা বিবর্তনীয় অর্থনীতির মত বিষয়গুলো দেখতে পাই। বলাই বাহুল্য এই বিষয়গুলো সদ্য যাত্রা করেছে এবং এই বিষয়গুলো পরিপূর্ণতা পেতে আরো কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু সেটা যে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা বাংলা ভাষাভাষী যারা রয়েছি তারা এই সম্পর্কের বইগুলো পড়ে সেগুলো সম্পর্কে বেশি বেশি করে লিখতে পারি, যেন তরুন গবেষকরা এই সব বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী হয়। তবেই কিন্তু একটি মুক্তবুদ্ধির সমাজ পাবো।
পরিশেষে ধর্মের উপর লেখাগুলো নিয়ে বিবর্তন আর্কাইভের মত একটি আর্কাইভ খোলার প্রয়োজনীয়তার কথা আবারো বলে যাচ্ছি। আর লেখাটি বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো, তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আগেই।
Subscribe to:
Posts (Atom)