Saturday, December 4, 2010

বদলে গেল প্রাণের সংজ্ঞা

কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস এবং সালফার এই ছয়টি উপাদান হচ্ছে আমাদের সকল প্রাণের মূলে। ফসফরাস আমাদের ডিএনএ এবং আরএনএ এর রাসায়নিক গঠনের কেন্দ্রীয় উপাদান, যেগুলোকে আমাদের জিনের মূল হিসেবে আমরা চিহ্নিত করে থাকি। আমাদের প্রাণকে আবার কার্বন ভিক্তিক প্রাণও বলা হয়, কারণ কার্বনের রয়েছে নিজের সাথে নিজেকে যুক্ত করে যৌগিক অনু তৈরী করার ধর্ম। হকিং তার গ্রান্ড ডিজাইন বইয়ে কার্বন ভিক্তিক ব্যতীত প্রাণের কথা বলেছেন। কার্বনের মতই ধর্ম দেখা যায় সিলিকনের মাঝে। তাই হকিং তার বইয়ে বলেছেন বহিঃবিশ্বে আমরা হয়তো কার্বন ভিক্তিক প্রাণ পেলাম না, কিন্তু কে বলতে পারে, সিলিকন ভিক্তিক প্রাণ পেতে পারি। তারপরেও এটি কেবল তাঁর একটি অনুমান ছিল। তাই বহিঃবিশ্বে আমরা শুধু আমাদের মত প্রাণের কথাই চিন্তাই করেছি এবং আমাদের পৃথিবীর পরিবেশের মত আরেকটি পরিবেশই খুঁজছি।

কিন্তু আমরা যে আমাদের নিজেদের বাড়ির সীমানাই ভাল করে জানিনি তার একটি প্রমাণ পাওয়া গেল সাম্প্রতিক নাসার এস্ট্রোবায়োলজি গ্রুপের গবেষণায়। এবার নাসার গবেষকেরা গবেষণায় পেয়েছেন এমন একটি প্রাণ যার গঠন আমাদের প্রাণের গঠন থেকে ভিন্ন। এই গবেষণা আমাদের প্রাণের সংজ্ঞাকে আরো বৃহৎ ব্যাপ্তিতে নিয়ে যাবে, এবং পাঠ্য বইয়ের প্রাণের সংজ্ঞাকে বদলে দিবে। এর ফলে মহাবিশ্বে এখন আমরা শুধু আমাদের পৃথিবীর মতই পরিবেশ খুঁজবো না, কিংবা আমাদের মতই প্রাণ খুঁজবো না। আমরা এখন যে কোন বিরূপ পরিবেশেও প্রাণের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিবো না। এই গবেষণা মহাবিশ্বে প্রাণ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাকে আরো অনেক গুণে বাড়িয়ে দিল।

আর্সেনিক আমাদের মত ফসফরাস ভিক্তিক প্রাণের জন্য ক্ষতিকারক। কিন্তু আর্সেনিক এবং ফসফরাসের ধর্ম অনেক কাছাকাছি। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিল যে যদি ফসফরাসকে আর্সেনিক দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা সম্ভবপর হয় তবে ভিন্ন প্রাণ সম্ভব হলেও হতে পারে। তাই গবেষকেরা যেটা করেছিলো ক্যালিফোর্নিয়ার মুনু লেক, যেখানকার পানি প্রচুর আর্সেনিকযুক্ত, লবনাক্ত, সেখানে হতে কিছু মাইক্রোব সংগ্রহ করেছেন। এই মাইক্রোবগুলো অনেক ক্ষুদ্র আকারের ব্যাকটেরিয়া সদৃশ প্রাণী। বিজ্ঞানীরা এরকম মাইক্রোবকে খুব অল্প ফসফরাস কিন্তু বেশি আর্সেনিক এর মত পরিবেশে রেখে দেখতে পেল যে মাইক্রোবগুলো সেই পরিবেশেও টিকে আছে এবং সংখ্যায় বৃদ্ধি করছে নিজেদেরকে। এর পর গবেষকেরা ফসফরাস সম্পূর্ণ সরিয়ে শুধু আর্সেনিক পূর্ণ পরিবেশে এই মাইক্রোবদেরকে পরীক্ষা করে দেখতে পেল যে সেই পরিবেশেও মাইক্রোবগুলো টিকে থাকছে এবং সংখ্যায় বৃদ্ধি করছে।

এটি একটি সম্পূর্ণ নুতন বিষয় বিজ্ঞানীদের জন্য। কারণ ফসফরাস ভিন্ন প্রাণের সম্ভাবনা বিজ্ঞানীরা কখনো ভাবেননি। দেখা যাচ্ছে যে এই মাইক্রোবগুলোর প্রাণের গঠন এখন সম্পূর্ণ আর্সেনিক ভিক্তিক এবং বিজ্ঞানীরা এই আর্সেনিক কোথায় যুক্ত হয়েছেন সেটাও জানতে পারছেন। এই নুতন মাইক্রোবগুলোর ডিএনএ তে ফসফরাসের বদলে এখন আর্সেনিক যুক্ত হয়েছে। আগের প্রাণের সংজ্ঞায় এদেরকে জীবিত বলা সম্ভবপর ছিল না। কিন্তু এই নুতন মাইক্রোবগুলো জীবিত এবং বংশবৃদ্ধি করছে। অর্থাৎ এদেরকেও এখন আমাদের পাশাপাশি নুতন প্রাণ হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে। এখন আমরা আশা করতে পারি যে অন্য কোন গ্রহেও প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে, কিন্তু তারা হতে পারে ভিন্ন রাসায়নিক গঠনের।

বিবর্তন বিদ্যাকেও এখন আবার নুতন ভাবে চিন্তা করতে হবে। শুধু মাত্র একটি ট্রি অফ লাইফ হিসেবে চিন্তা না করে একাধিক ট্রি অফ লাইফকে সম্ভাবনায় রাখতে হবে। কে বলতে পারে হয়তো বিলিয়ন বছর পরে এই আর্সেনিক যুক্ত প্রাণ থেকেও উন্নতর বুদ্ধিমত্তা বিশিষ্ট প্রাণ তৈরী হতে পারে। ততদিন এই মানুষ টিকে থাকবে না কিনা সেটা তারচেয়েও বড় প্রশ্ন। আমরা পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন, ওজোন স্তর নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটলেও, মানুষ বা কার্বন/ফসফরাস ভিক্তিক প্রাণ ধ্বংস হয়ে গেলেও, এই আর্সেনিক ভিক্তিক প্রাণ হয়তো টিকে থাকতে পারে এবং কিংবা নুতন প্রাণের উদ্ভব হতে পারে এবং প্রাণের বিকাশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কে জানে?

নোটঃ মূল খবরটি নাসার ওয়েবসাইট হতে পাবেন। এবং আরো বিস্তারিত জানতে মূল লিঙ্কটি ঘুরে দেখার অনুরোধ রইল। খবরটি দেখার পর থেকে অভিজিৎ ও বন্যা উনাদের কারোর লেখার জন্যে অপেক্ষা করে, এখনো কোন লেখা না দেখে,‌ আমিই দিয়ে দিলাম। এমন চমকপ্রদ খবর মুক্তমনার পাঠকদের সাথে ভাগ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। এই বিষয়ে লেখার জন্য যে পরিমান জ্ঞান থাকা দরকার তার চেয়ে জ্ঞান অনেকটা কম আছে। লেখায় কোন ভুল তথ্য চোখে পড়লে জানাবেন, ঠিক করে দিবো।

Thursday, November 25, 2010

জিন এবং মিম

সতর্কবার্তাঃ লেখাটি নিজ দায়িত্বে পড়ুন। লেখাটি পড়ার পর আপনার মস্তিষ্ক একটি ভাল/খারাপ মিম দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। উক্ত মিম আপনার জীবনের গতিপথ বদলে দিতে পারে যেটা আপনার জন্য ভাল/খারাপ হতে পারে। যদি ভালো হয় তার কৃতিত্ব যেমন আপনার, কারণ মিমটি আপনি গ্রহন করেছেন, তেমনি খারাপ হলেও দায়িত্ব আপনার। লেখকের এখানে কোন দায় নেই।

অমরত্বের ইচ্ছে মানুষের সব সময়। মানুষ কোন না কোন ভাবে চায় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। এই সেদিন আমার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটি হু হু করে কাঁদছিলো মৃত্যু ভয়ে। সে মরতে চায় না। এই বয়সেই তার মাঝে মৃত্যু ভয় চলে এসেছে। আমি জানতে চাইলাম কেন তুমি এতো ভয় পাচ্ছো? ভয়টা কিসের? সে জবাব দিল, মারা গেল তার ঘুম আর ভাঙ্গবে না, সে আর কোন দিন খেলা করতে পারবে না, সে আর কোন বন্ধুর সাথে কথা বলতে পারবে না, এটা সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। একটু ভাল ভাবে খেয়াল করে দেখুন এখানে কিন্তু নরকের কোন ভয় নেই। তাহলে দেখতে পারছেন যে কোন প্রকার নরক নামক বস্তুর ভয় ব্যতীতও একজন স্বাভাবিক মানুষের মনে মৃত্যু ভয় চলে আসতে পারে। তারজন্য ধর্ম পর্যন্ত যেতে হয় না। এরকম মৃত্যু ভয়ই হতে পারে একজন দয়ালু ঈশ্বর নামক চিন্তার শুরু।

যা হোক, দু’ভাবে মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। একঃ তাঁর নিজের জিনের প্রতিলিপি তৈরীর মাধ্যমে, দুইঃ তার নিজের বিশ্বাস/আদর্শ/সংস্কৃতি/ভাষা/ ইত্যাদী মিমের প্রতিলিপ তৈরীর মাধ্যমে। জিনের প্রতিলিপ সম্ভব সেক্সের মাধ্যমে অথবা ক্লোনিং এর মাধ্যমে আর মিমের প্রতিলিপ সম্ভব মস্তিষ্কের মাধ্যমে। জিন এবং মিম এই দু’টোর প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যমেই কেবলমাত্র নিশ্চিত করা যায় যে একজন মানুষের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি তৈরী হয়েছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে কোন ভাবেই একজন মানুষ তার সম্পূর্ণ প্রতিলিপি রেখে যেতে পারে না। ক্লোনিং এর ফলে জিনের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি সম্ভব হলেও যে মিমের প্রতিলিপি একই হবে তার নিশ্চয়তা নেই। যে কারণে টুইন বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জেনেটিক বৈশিষ্ট একই থাকলেও তাঁদের চরিত্র ভিন্ন হতে পারে। আবার সেক্সের ফলে জিনের যে প্রতিলিপ তৈরী হয় সেখানে কখনই বাবা/মার একশত ভাগ প্রতিলিপি আসে না।

আমরা যদি ক্লোনিং এর প্রসঙ্গকে আপাতত বাহিরে রাখি, তবে সেক্সই কেমাত্র উপায় জিনের প্রতিলিপি জন্য। তেমনি মিমও কেবলমাত্র প্রতিলিপি তৈরী করতে পারে যদি সে কোন মস্তিষ্কের সংস্পর্শে আসে। যেমন আপনি যদি নির্দিষ্ট কোন সংস্কৃতি/ভাষা/বিশ্বাস এর কথা কোনদিন নাই শুনেন তবে সেই মিমটি সম্পর্কে কোন ধারনাই আপনার মস্তিষ্কে থাকবে না। একটি মিম মস্তিষ্কে তার প্রতিলিপ তৈরী করতে পারে আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। চোখ, কান, ত্বক, ঘ্রাণ, এগুলোর মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকেই তাহলে আমরা মিম হিসেবে সংঙায়িত করতে পারি। যিনি বর্ণান্ধ তার মস্তিষ্কে রঙের কোন ভিন্নতা নেই। তাই মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট কোন মিমের সংস্পর্শে না আসলে মস্তিষ্কে সেই মিমের প্রতিলিপি তৈরী হয় না। মিমের সংস্পর্শে আমরা প্রতিনিয়তই আসছি। এই যে লেখাটি পড়ছেন, আপনি একটি মিম পাচ্ছেন। একটি বই পড়ছেন, মুভি দেখছেন, টিভি/রেডিও দেখছেন/শুনছেন প্রতিনিয়ত মিমের সংস্পর্শে আসছেন। বাবা-মা সন্তাদের সব সময় কোন না কোন মিম দিচ্ছেন। আপনার বন্ধু/বান্ধব, স্কুল/কলেজ, অফিস/আদালত সব কিছু হতে আপনি মিম পাচ্ছেন।

এখন কে বেশি শক্তিশালী তাহলে? জিন নাকি মিম? প্রশ্নটির জবাব পেতে হলে আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে কার প্রতিলিপি তাহলে বেশি তৈরি হচ্ছে? কে বেশি ছড়িয়ে দিতে পারছে নিজেকে? সেক্সের দ্বারা আপনি আপনার নিজের জিনের কতগুলো প্রতিলিপি তৈরি করতে পারছেন? চেঙ্গিস খানের মত হলেও এক জীবন বেশি হলে একশত সন্তান রেখে যেতে পারলেন একাধিক স্ত্রীর ঘরে। তারপরেও কথা থাকে - জিনের প্রতিলিপি কখনই নিজের একশত ভাগ হয় না এবং জিনের প্রতিলিপি হলেই মিমের প্রতিলিপি তৈরি হয় না। অন্যদিকে মিমের প্রতিলিপি আপনি যে কারোর মাঝেই ছড়িয়ে দিতে পারেন, তার জন্য নিজের জেনেটিক প্রতিলিপির দরকার নেই। যে কারণে খুব সহজেই একটি মিম কোটি কোটি মানুষের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যেতে পারে।

তাহলে বুঝতেই পারছেন কেন মানুষ আজ এগিয়ে গিয়েছে অন্য জীবের তুলনায়। অন্যান্য প্রাণী গোষ্ঠী যেখানে কেবলমাত্র জিনের প্রতিলিপি তৈরি করে সেখানে মানুষ জিনের প্রতিলিপির সাথে মিমেরও প্রতিলিপি তৈরি করে। জিনের মিউটেশান যেখানে খুব ধীর গতির, মিমের মিউটেশান সেখানে দ্রুত গতির। যে কারণেই বিবর্তনের এক দম শেষ দিবসে এসে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হলেও খুব সহজেই মানুষ অন্যান্য জীব গোষ্ঠি্কে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে হুর হুর করে, এবং এ সম্ভব হয়েছে মস্তিষ্কের এই মিমের প্রতিলিপির ফলেই। মানুষ তার পূর্ব-অভিজ্ঞতায় অর্জিত জ্ঞান তার পরবর্তী জেনেরাশানে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, এবং ছড়িয়ে দিতে পেরেছে অন্যান্য মানুষের মাঝেও।

মিমের বিবর্তন দ্রুত গতির হলেও, সেটিও প্রাকৃতিক নির্বাচনের বাহিরে নয় মোটেই। যে মিমগুলো সময়ের প্রেক্ষিতে টিকে থাকায় সহায়তা করেছে তারাই নির্বাচিত হয়েছে এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছে। ধর্ম, নৈতিকতা, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ সহ যে কোন মিমকেই এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব। প্রতিটি মিমের কাজ হচ্ছে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া, নিজের প্রতিলিপি তৈরি করা। মানুষের মস্তিষ্কই এই মিমগুলো ধারণ করে আবার বর্জন করে। সময়ের প্রয়োজনেই ধর্মগুলো এসেছিলো, আবার তাঁদের কার্যকারিতা না থাকলে সময়ের প্রয়োজনেই সেগুলো বিবর্তিত হবে অথবা হারিয়ে যাবে।

জিনপুলে যেমন পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে যাওয়ার আগে ড়্যান্ডম মিউটেশান ঘটে তেমনি মিমের ক্ষেত্রেও ঘটে। এক বাংলা ভাষাই যদি দেখেন তবে দেখবেন যে আজকে আমরা যে ভাষায় কথা বলি সে ভাষাতেই কি আমাদের কয়েক পূর্বপুরুষ আগের মানুষেরা কথা বলতো। সামনের দিকে ভাষার মাঝে আরো পরিবর্তন আসবে, এবং সেটাই স্বাভাবিক। এখন যখন কোন মিম নিজেকে অবিকৃত রেখে ছড়াতে চায় তখনই কনফ্লিক্ট শুরু হয়। ধর্ম যদি নিজেকে বিবর্তিত করতে পারতো তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু ধর্ম যখন নিজেকে ঈশ্বরের বাণী বলে অবিকৃত থাকতে যায়, তখনই সে অন্যান্য মিউটেডেট মিমের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।

মিউটেশন অবশ্যই নন-মিউটেশানের তুলনায় উন্নত হবে। মিউটেশানের ফলে জিনপুলে, মিমপুলে অনেক বৈচিত্র থাকে। যার ফলে যে কোন প্রতিকূল পরিবেশে এই বৈচিত্রের মধ্য হতে কারোর না কারোর টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকবে এবং তারাই পরবর্তীতে বংশবৃদ্ধি করবে। কিন্তু সবাই একই রকমের হলে পুরো মানবকূল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে কারণে আমার ব্যক্তিগত অভিমত মানব ক্লোনিং যদি কোন দিন বৈধ হয়ও, সেক্সের ফলে সৃষ্ট মানব জাতিই টিকে থাকবে, ক্লোনিং মানব জাতি নয়। এ কারণেই আমি মনে করি ঐশ্বরিক ধর্মের মিমগুলো যদি সময়ের সাথে নিজেদেরকে বিবর্তিত না করে তবে তারা অন্যান্য প্রগতিশীল মিমগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এবং হারিয়ে যাবে মানুষের মস্তিষ্কে থেকে যেভাবে হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী হতে বহু ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি। ধর্মে বিশ্বাসীরা এই বাস্তবতা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততই সভ্যতার জন্য মঙ্গল হবে।

নোটঃ উপরের সতর্কবার্তাটির ধারণাটি “Virus of the mind : the new science of the meme / Richard Brodie ” বইয়ের সূচনা থেকে ধার করা। মিম নিয়ে নিজেও মাত্রই জানছি। তাই স্বতস্ফুর্ত আলোচনা হোক এটাই কামনা করি। আর আমি ঠিক করেছি এখন থেকে কোন বিষয় নিয়ে লিখলে লেখার সাথে চেষ্টা করবো একটি হলেও মূল বই সংযুক্ত করে দিতে যেন আগ্রহী পাঠকেরা চাইলে মূল বই থেকে আরো বেশি জানতে পারে। শুধু লেখার উদ্দেশ্য এবং নিজের আনন্দের জন্যই আমার কোন লেখা নয়। লিখি যেন নিজের চিন্তাগুলো অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি। তাই অনুরোধ থাকবে মূল বইগুলো পড়ুন। নিজেও জানুন এবং অন্যের মাঝেও ছড়িয়ে দিন। এভাবেই একমাত্র সম্ভব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর মিমগুলোকে আউট নাম্বার করা।

আজ মিম নিয়ে একটি বই দিচ্ছি যেটি আমার ইস্নিপ্স ফোল্ডার থেকে ডাউনলোড করতে পারবেন Darwinizing culture : the status of memetics as a science / edited by Robert Aunger ; with a foreword by Daniel Dennett. । বইটি্র সফট কপি জোগাড় করে দেওয়ার জন্য সচলায়তন সদস্য শুভাশীষকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।

Wednesday, November 17, 2010

এলোমেলো চিন্তাঃ “ডোপামিন” তার নাম

ডেনিয়েল ডেনেটের Breaking the spell বইটা পড়ে Lancet liver fluke পরজীবির কথা জানতে পারি যেটার কথা আমার এলোমেলো চিন্তাঃ বিবর্তনময় জীবন এই লেখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম। এই পরজীবি তার জৈবিক চক্রের একটি ধাপে যখন পিঁপড়ের মাঝে বংশবৃদ্ধি করে তখন এক পর্যায়ে পিঁপড়ের মস্তিষ্কের দখল নিয়ে ফেলে এবং পিঁপড়েটিকে এক প্রকার সুখানুভুতি প্রদানের মাধ্যমে বাধ্য করে পরজীবিটির নিজ উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করার জন্য। ডেনেট মানুষের বিশ্বাস ব্যবস্থাকে সেরকম কিছু পরজীবির সাথে তুলনা করেছেন। মানুষ নিজের বিশ্বাসকে রক্ষার্থে নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে পারে, টুইন টাওয়ারে বিমান নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পারে।

কিন্তু বিশ্বাস একটি এবস্ট্রাক্ট কিছু। তাহলে বিশ্বাস কিভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে আত্মহননের মত কাজে। নিশ্চয়ই মানুষের মস্তিষ্কেও সেরকম কোন একটি পোকার অবস্থান রয়েছে যেটি উক্ত কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। হয়তো সেই পোকাও আমাদেরকে এক প্রকার সুখানুভুতি প্রদান করে। যে কারণে কোন কাজ করলে ভাল লাগে, অথবা কোন কাজ করতে ইচ্ছে করে না। নিজের মাঝে এই পোকার অবস্থান সব সময় টের পাই। এই পোকাই বাধ্য করে নিজের আসল গবেষণা ফেলে বনের মোষ তাড়ানোর গবেষণা করতে, ব্লগে লেখা দিতে। এই পোকাই বাধ্য করে সমাজ, বিশ্ব জগৎ ইত্যাদী নিয়ে চিন্তা করতে। আমার বিশ্বাস এ রকম পোকার অস্তিত্ব কম বেশি সবার মাঝেই রয়েছে।

বহুদিন পোকাটির অস্তিত্বটি টের পেলেও, তার পরিচয় জানার সুযোগ হয়নি। সম্প্রতি পোকাটির নাম জানতে পারলাম। এর নাম নাকি ডোপামিন (উচ্চারণটি কি ডোপামাইন হবে?) মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে এই ডোপামিনের তারতম্যের ফলেই নাকি মানুষের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, চেতনা, অনুভূতি, কার্মদক্ষতা , কর্মস্পৃহা ইত্যাদীর তারতম্য দেখা যায়। এই ডোপামিনের অভাবেই পারকিনসসের মত রোগ হয় যার এক মাত্র চিকিৎসা হচ্ছে ডোপামিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া। আবার এর অত্যাধিকতার জন্য অটিজম, সিজ্রোফেনিয়া, হাইপার একটিভিটি, ম্যানিয়া এর মত মানসিক রোগগুলো দেখা যায়। এর প্রভাবেই নাকি মানুষের মাঝে অত্যাধিক বুদ্ধিমত্তা কিংবা ধর্ম/বিশ্ব নিয়ে বেশি চিন্তা করার প্রবনতা, তীব্র প্রতিযোগিতা মনোভাবাপন্নতা দেখা যায়। এর আধিক্যের ফলে অতিপ্রাকৃতিক অনুভূতি লাভ হয়, যার ফলে স্বর্গ/নরক কিংবা ঈশ্বরের দেখা পাওয়ার মত অনুভূতি হতে পারে। এরই ফলে মানুষের মাঝে দূর ভবিষ্যৎ কিংবা মহা বিশ্বের মত বৃহৎ আকার নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হয়। আজ পর্যন্ত যত সমর নায়ক, ধর্ম অবতার, কিংবা দার্শনিক, বিজ্ঞানী এসেছেন তাঁদের মাঝে এই ডোপামিনের আধিক্য ছিল বলে ধারনা করা হয়।

এটি মানুষের সকল কর্মস্পৃহার মূলে। এটি কাজ করে পূরষ্কারের ভিক্তিতে। অর্থাৎ কোন কাজ ভাল লাগলে পুরষ্কার হিসেবে মস্তিষ্কে এই বস্তু কিছুটা নিঃসৃত হলে আপনার মনে এক ধরণের ভাল লাগা অনুভুত হবে যার ফলে আপনি আবার সেই কাজটি করার জন্য উদ্বুদ্ধ হবেন। কোন ভাল খাবার খেলে বা সেক্সের ফলে, বা কোন ভাল কাজের ফলে এই বস্তুর নিঃসরণ ঘটে যার কারণে আমরা তৃপ্তিলাভ করি। একই রকমের অনুভুতি কোকেন বা উদ্দিপক নানান ড্রাগের মাধ্যমেও পাওয়া যায়। শুধু ভাল কাজেই যে তা নয়, আক্রমনাত্মক কাজেও এই বস্তুর নিঃসরণ যুক্ত। মোটকথা এই বস্তুই আমাদের মাথার সেই পোকা যে কিনা আমাদেরকে তার পথে চালায়।

মানুষের আজকের এই আধুনিক বুদ্ধিমত্তার মানুষ হয়ে উঠার পেছনেও নাকি মস্তিষ্কের আকারের তুলনায় এই ডোপামিনের প্রভাবই বেশি বলে এক পক্ষের ধারনা। আমি নিশ্চিত এই লেখাটি আমাদের সেই “নেচার ভার্সেস নেচার” বিতর্ককে আবার উসকে দিবে। এই পক্ষের ধারনা যে মানুষের মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি হলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তা সেভাবে বাড়েনি বরং ২ লক্ষ বছর আগে আধুনিক মানুষের উৎপত্তি হলেও তখনকার তুলনায় মানুষের মস্তিষ্কের আকার বেশি পরিবর্তন হয়নি, বরং কিছুটা কমেছে। কিন্তু আমরা দেখি যে জেনেটিকালি খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তার বেশ উন্নতি হয় এবং সেই উন্নতির পেছনে এই ডোপামিনের অবদানকেই ধরা হচ্ছে। আধুনিক মানুষের আগেও আমাদের যে পূর্বপুরুষেরা ছিল তাঁদের মাঝেও এই ডোপামিন ছিল কিন্তু তার পরিমান আজকের মানুষদের তুলনায় প্রায় অর্ধেক ছিল। এই পক্ষের ধারনা মানুষের আদি পূর্বপুরষদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের যাত্রা শুরু হয় মূলত মাংসাশী প্রাণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে এবং গায়ের লোম কমা শুরুর পর থেকে। ডোপামিন মানুষের দেহ হতে তাপ দ্রুত কমাতে সাহায্য করে। তাই গায়ের লোম কমার পাশাপাশি সে সময় ডোপামিনের পরিমানও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শুধু মাংসাশী প্রাণী এবং তাপ ঝরানোর কারণেই ডোপামিনের পরিমান অনেক বেশি হয়ে যায় না। তাই পরবর্তী ১০০,০০০ বছরে মানুষের বুদ্ধিমত্তায় তেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। সেই সময়কার তাঁদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সেই ধারনাই দেয়।

প্রায় ১৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ হাজার বছরের দিকে কিছু আধুনিক মানুষ পূর্ব আফ্রিকা হতে দক্ষিণের দিকে মাইগ্রেট করে এবং এই সময় সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি থাকার কারণে এবং বড় বড় মাংসাশী প্রাণীর অভাবের কারণে তাঁদের খাদ্যাভাসে সামুদ্রিক প্রাণী/মাছ নিয়ে আসে। সামুদ্রিক মাছ খাদ্য তালিকায় প্রবেশের কারণে তাঁদের শরীরে আয়োডিনের পরিমান বৃদ্ধি পায়। এই আয়োডিনের ফলে, থাইরয়েড প্রন্থির প্রভাবে সেই মানুষের মাঝে ডোপামিনের মাত্রা আরেক দফা বৃদ্ধি পায়। যার কারণে এই সময়কার মানুষের পাথরের যন্ত্রপাতিগুলো উন্নত হয়। যন্ত্রপাতিগুলো আগের চেয়ে ধারালো, এবং কার্যকর হয়। এই সময় মানুষের মাঝে বিভিন্ন সংস্কৃতি, আর্ট এগুলোও দেখা যায়। কিন্তু শুধু্মাত্র মাংসভোজ কিংবা আয়োডিনের প্রভাবেই আজকের এই ডোপামিনের সভ্যতা নয়।

এই সময়টাতেও মানুষ মূলত শিকারী এবং সংগ্রাহক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতো। মানুষ তখনো পুরোপুরি কৃষিনির্ভর হয়ে উঠেনি, যে কারণে তখনো জনসংখ্যার পরিমান বেশি হয়নি এবং এর ঘনত্ব অনেক কম ছিল। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সেভাবে প্রবল হয়ে দেখা দেয়নি। কিন্তু প্রায় ৮০০০ বছর আগে এই শিকারী গোত্রের বেশির ভাগ মানুষই পাকাপাকি ভাবে কৃষিকাজ শুরু করে এবং যার ফলে সমাজের চরিত্র দ্রুত বদলাতে থাকে। জনসংখ্যার বিষ্ফোরণ ঘটে, জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়, বৃহৎ আকারে সমাজ, রাষ্ট্রের মত সংস্থা তৈরী হয়। মানুষের মাঝে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এই চরম প্রতিযোগিতাই মানুষের মাঝে ডোপামিনের পরিমান বৃদ্ধি করে এবং যার ফলে আমরা আজকের এই ডোপামিনিক সভ্যতা দেখতে পাচ্ছি।

ডোপামিনের বৃদ্ধির ফলে মানুষের মাঝে চরম প্রতিযোগিতা মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। লেখকের মতে আমরা এখন হাইপার ডোপামিনিক সময়ের মাঝে আছি। এর শুরু হয়েছে ইন্ড্রাসটিয়াল রেভুলেশানর পর থেকে বা আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরুর পর থেকে। মানুষ এখন আগেরকার যে কোন সময়ের তুলনায় বেঁচে থাকার জন্য সর্বোচ্চ প্রতিযোগীতার মধ্যে দিয়ে যায়। লেখক এই পর্যায়ে এসে অনেকটা দার্শনিক হয়ে যান। তিনি কামনা করেন এই হাইপার ডোপামিনিক সভ্যতা হতে রিভার্স প্রক্রিয়ায় আমরা আরেকটু কম ডোপামিন মাত্রার সভ্যতায় যেতে পারি কিনা সেই প্রশ্ন রেখে। ডোপামিন নিয়ে গবেষণা এখনো শুরুর দিকে। আশা করা যায় ভবিষ্যতে এই বস্তুর প্রভাব আরো ভাল করে বুঝা যাবে। বুঝা যাচ্ছে এর মাধ্যমেই মস্তিষ্কের আচরণকে আরো ভাল করে জানা সম্ভব হবে।

নোটঃ এই লেখাটি Fred H. Previc এর The Dopaminergic Mind in Human Evolution and History বই অবলম্বনে লেখা হয়েছে। আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আগ্রহীদেরকে উক্ত বইটি পড়ে দেখতে বলবো। সময়ের অভাবে পুরো বইটি অনুবাদ করা অসম্ভব আমার পক্ষে। এই লেখাটিকে সারমর্ম হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। তারপরেও মনে করি লেখাটি আরো ভাল হতে পারতো। আরো কিছু বিষয়ে বিস্তারিত লেখা যেতে পারতো। কিছু ছবি যুক্ত করা যেতে পারতো। কিন্তু সেগুলো সব করতে গেলে হয়তো লেখাটিই আর আত্মপ্রকাশ করতো না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে অন্তত কিছু হলেও লেখা উচিৎ মুক্তমনার পাঠক/লেখকদের জন্য। আমি মনে করি মানব মস্তিষ্কের আচরণ সুনির্দিষ্ট ভাবে বুঝার মাঝেই নীহিত রয়েছে মানব সভ্যতার ভবিষ্যত। সবশেষে মুক্তমনা ও সচলায়তনের সদস্য সিরাতকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই বইটির খোঁজ দেওয়ার জন্য। সিরাতের এই লেখাটির মাধ্যমেই প্রথম বইটির কথা জানতে পারি।

Monday, November 1, 2010

এলোমেলো চিন্তাঃ জীবনের উদ্দেশ্য এবং Inception

জীবনের উদ্দেশ্য কি? - এই প্রশ্ন মানুষের মনে প্রথম কবে আসে বলা মুশকিল। মানুষ যখন মূলত শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো তখন, নাকি যখন প্রথম কৃষিজীবি হয়ে উঠে তখন থেকেই এই প্রশ্নের উৎপত্তি। প্রশ্নের শুরু যখন থেকেই হোক সেই প্রশ্ন যে বংশপরম্পরায় আজো আমরাও বহন করে চলছি তার প্রমান পাই আজো সবার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজা দেখে। এই প্রশ্নের পেছনে কোন একক নির্দিষ্ট জাতি শুধু সময় ব্যয় করেনি- বলা যায় ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সকলেই কোন না কোন জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এর সবচেয়ে সহজ যে জবাবটি আমরা দেখি তা হল দু’স্বত্বা, দু’জগত এবং এক বা বহু সৃষ্টিকর্তার চিন্তাতে। এই বিশ্বাস মূলত নির্ভর করছে দেহ এবং আত্মা এই দুটি বিষয়ের উপর। দেহের মৃত্যুর পর আত্মার অমরণশীলতা এবং সে সাথে নুতন একটি জগতে প্রবেশ করা, এই ধারণার উপর ভিক্তি করে এই জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা।

সকলেই যে এই মতবাদে বিশ্বাসী তা নয়। তারা কোন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী নয় বা মৃত্যুর পরের কোন জগতেও বিশ্বাসী নয়। তাছাড়া, আধুনিক বিজ্ঞানেও মন বা আত্মার আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া/প্রতিক্রিয়ার মাঝেই মনের অবস্থান। মস্তিষ্কের মৃত্যুর মাঝে মনেরও মৃত্যু ঘটে। আত্মা যদি নাও থাকে সমস্যা রয়েই যায়, তা হলো এই জীবনের উদ্দেশ্য কি? কেনই বা এই পৃথিবী আর কেনই বা এত দ্বন্দ্ব।

এই কিছুদিন আগেও মানুষের কাছে এর জবাব ছিলনা। কিন্তু অধুনা জেনেটিক বিজ্ঞান, ণৃ-বিজ্ঞান, এবং জীববিজ্ঞানের ফলে মানুষ আজ তার নিজের বিবর্তন সম্পর্কে অতীতের চেয়েও অনেক বেশি জানে। জীববিজ্ঞানের শাখায় বিবর্তন আজ একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়। এটি শুধু জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ না থেকে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, জেনেটিক্স এর মত শাখাগুলোতেও আজ প্রয়োগ হচ্ছে। AIDS ভাইরাস বা সুপারবাগ ব্যাক্টেরিয়ার মত প্রাণঘাতী জীবগুলোর প্রতিষেধক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিবর্তনের জ্ঞানকে কাজে লাগানো হচ্ছে। মানুষের আচার/ব্যবহার বিশ্লেষণের জন্য, মানুষের বিভিন্ন মানসিক রোগ অথবা অটিজমের মত রোগগুলোকে বিশ্লেষণের জন্য মনোবিদ্যায় বিবর্তনকে কাজ লাগানো হচ্ছে। এ ছাড়া মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ আচরনকে বোঝার জন্য কিংবা জাতিগত দ্বন্দ্ব নিরসনে, বা অর্থনীতির মত বিষয়গুলোকে বোঝার জন্যেও আজ বিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে বিবর্তনীয় সমাজবিজ্ঞান,বিবর্তনীয় অর্থনীতির মত বিষয়গুলোর চালু হয়েছে।

আজকের এই লেখায় বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার আলোকে জীবনের উদ্দেশ্য তুলে ধরার কিছুটা চেষ্টা করবো। বিবর্তনীয় মনোবিদ্যা অনুসারে মানুষের মস্তিষ্ক তার অন্যান্য অঙ্গের মতই দীর্ঘ বিবর্তনের একটি ফসল। অন্যান্য প্রাণীদের থেকে আমরা এগিয়ে গিয়েছি আমাদের এই বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মস্তিষ্কের জন্য। এ জন্য আমাদের মস্তিষ্কের আকার অন্যান্য প্রাণীদের থেকে বড়। বিবর্তনের উপর প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য মুক্তমনা ও সচলের লেখক বন্যা আহমেদের বিবর্তনের পথ ধরে বইটি পড়তে পারেন। এটি বাংলা ভাষায় বিবর্তনের উপর লেখা একটি অসাধারণ বই। খুব সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য বইটি লেখা হয়েছে। আমার নিজের প্রাথমিক জ্ঞানও লাভ করি এই বই থেকে।

আমাদের দেহকে যদি একটি যন্ত্র হিসেবে চিন্তা করেন এবং তাহলে মস্তিষ্ককে চিন্তা করতে পারেন একটি গণনা কেন্দ্র হিসেবে যেটি বিশ্বের আধুনিকতম কম্পিউটারের চেয়েও শক্তিশালী। শুধু এর ভেতর তারের জালের পরিবর্তে রয়েছে অসংখ্য সুক্ষ্ণ নার্ভ। মানুষকে চিন্তা করতে পারেন একটি রোবট হিসেবে, শু্ধু এর পার্টসগুলো তৈরী হচ্ছে মাংস দিয়ে। মস্তিষ্ক হচ্ছে আমাদের দেহের প্রসেসিং ইউনিট। যে কোন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য চলে যায় মস্তিষ্কে এবং মস্তিষ্ক সেটি প্রসেস করে, তার পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে করণীয় নির্ধারণ করে সেটা পাঠিয়ে দেয় যথাযথ প্রত্যঙ্গের কাছে।

মস্তিষ্ক আবার একই সাথে একটি প্রসেসিং যন্ত্র এবং তথ্য সংরক্ষনের স্থান। আমাদের যাবতীয় তথ্য এখানে সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু মস্তিষ্কের আকার যেহেতু সীমাবদ্ধ তাই সকল তথ্যই আমাদের পক্ষে ধারণ করা সম্ভব হয় না। কোন তথ্য সংরক্ষন করা হবে তার জন্য মস্তিষ্ক পূর্ব অভিজ্ঞতা, কতটা মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, তথ্যের প্রয়োজনীয়তা এসবের উপর ভিক্তি করে একটি রেটিং করে এবং সেভাবে সে সংগ্রহ করে। এ জন্য দেখা যায় যে অনেক কিছুই আমরা দেখি/শুনি/পড়ি কিন্তু সকল তথ্য আমাদের স্মরণ থাকে না। আবার সকল তথ্য একই গভীরতায় সংরক্ষিত হয় না। যে সব তথ্য আমরা দৈনন্দিন ব্যবহার করি সেগুলো প্রথম ধাপেই রাখা হয় যেন সহজেই চাইলে পাওয়া যায়। আর যেগুলো সচারচর ব্যবহার করা হয়না সেগুলো একটু গভীরে রাখা হয়। অনেকটা একটি দোকানের জিনিস সংরক্ষনের মত। চালু আইটেমগুলোকে হাতের নাগালেই রাখা হয়, আর একটু কম চালু বা দামী জিনিসগুলোকে গোডাউনে অথবা বিশেষ স্থানে রাখা হয়।

মানুষের নানান আচার/ব্যবহার মস্তিষ্কের গঠন/গড়ন এবং এর কার্যপদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত করা সম্ভব। অবশ্য এই বিষয়গুলো এখনো নুতন, প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে এই বিষয়ের উপর। বিশেষ করে মস্তিষ্কের স্ক্যানিং প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হবার পর বিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছে মস্তিষ্কের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে আরো বিষদভাবে জানার জন্য। আশা করা যায় একদিন মানুষ সেই লক্ষ্যে পৌছতে পারবে। তখন হয়তো মানুষের কছাকাছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরী করা সক্ষম হবে। মস্তিষ্কের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো বেশি জানার জন্য Evolutionary psychology বা শুধু psychology এর উপর যে কোন বই দেখতে পারেন আগ্রহী পাঠকগণ।

আমি এবার একটু লম্ফ দিব আরেকটি বইয়ের গল্পে। এই বইটির লেখক ডেনিয়েল ডেনেট, তিনি বর্তমান কালের একজন দার্শনিক। তিনি Tufts University এর একজন অধ্যাপক। কাজ করেন মূলত মনোবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, দর্শন নিয়ে। সম্প্রতি তার একটি বই পড়লাম- ব্রেকিং দ্যা স্পেলঃ রিলিজিয়ন এজ এ ন্যাচারাল ফেনেমেনন। তিনি বইটিতে মূলত দেখাতে চেষ্টা করেছেন কিভাবে আমাদের মস্তিষ্কের মাঝে বিদ্যমান কোন আইডিয়া/ধারণা আমাদেরকে চালিত করে। এই আইডিয়া মস্তিষ্কের মাঝে অবচেতন ভাবে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। যদি আইডিয়াই একজন মানুষের চালিকা শক্তি হয়ে যায় তবে সেটা অনেকটা ভাইরাসের মত প্রাণঘাতী হতে পারে। যেমনটি হয়ে থাকে Lancet liver fluke নামক পরজীবিতে আক্রান্ত পিঁপড়ে। এই পরজীবিটি তার জৈবিক চক্রের একটি ধাপে গিয়ে শামুকের লালা হতে চলে যায় পিঁপড়ের পাকস্থলীতে। তারপর সেখানে বংশ বৃদ্ধি করে এক পর্যায়ে পিঁপড়ের নার্ভ এর দখল নিয়ে ফেলে। পরজীবিটিকে তার বংশবৃদ্ধির লক্ষ্যে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে কোন গবাদীপশুর পাকস্থলীতে। এই অবস্থায় পরজীবিটি পিঁপড়েটিকে বাধ্য করে কোন লম্বা ঘাসের চুঁড়ায় উঠার জন্য। পিপড়েটি ঘাসের আগায় উঠে বসে থাকে যতক্ষন না সে কোন গবাদীপশুর পেটে যায়। এভাবেই চলতে থাকে। পিঁপড়েটি নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সে কোন প্রতিরোধ করতে পারে না। কথা হল পিঁপড়েটিকে কিভাবে চালিত করে সেই পরজীবিটি। পিঁপড়েটিকে একধরণের সুখানুভুতি প্রদান করে পরজীবিটি যদি সে সেই লম্বা ঘাসের চূড়ায় উঠে। সেই অনুভূতির লোভে পিঁপড়েটি এই কাজে বারংবার প্ররোচিত হয়।

এই বিষয়টিকেই আরেক বিবর্তনীয় বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার সেলফিশ জিন বইয়ে বলেছেন সেলফিশনেস অফ জিন। জিন তার নিজের বংশবৃদ্ধিতে তার হোস্টকে মরে যেতেও উদ্ধুদ্ধ করে। যে কারণেই প্রাণী জগতের মাঝে পরোপোকারীর মত ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। সে কারণেই একজন মা/বাবা তাঁদের নিজের জীবন দিয়ে হলেও নিজের সন্তানকে রক্ষা করে। এই বিষয়গুলোই প্রকাশ করে জিনের স্বার্থপরতার বিষয়টি। সুতরাং বিবর্তনীয় দৃষ্টিতে যদি দেখি তবে আমাদের জীবনের আসলে উদ্দেশ্য একটিই, তা হচ্ছে নিজের জিনকে রক্ষা করা এবং এর বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। প্রচন্ড হতাশার, কি বলেন?


তবে এটা হচ্ছে ম্যাক্রো লক্ষ্য। একজন ইন্ডিভিজুয়ালের কাছে সেই চালিকা শক্তি থাকে না। তাহলে জিন কিভাবে তার নিজের উদ্দেশ্যে পৌঁছে, সেটা একটি প্রশ্ন। এখানেই আসে আমাদের মস্তিষ্কের কাজ। যেহেতু মস্তিষ্ক হচ্ছে আমাদের মূল প্রসেসিং ইউনিট তাই আমাদের অবচেতন মন সেই লক্ষ্যে সেট করা রয়েছে। অন্যভাবে, সেই পিঁপড়েটির সাথে তুলনা করলে দেখবেন যে আমাদের মস্তিষ্কের এই অবচেতন অংশের কাজ হচ্ছে আমাদেরকে সেই সুখানুভুতি প্রদানের মাধ্যমে তার নিজের লক্ষ্য কাজ করা। এখন একজন মা/বাবা নিজের মৃত্যু হলেও যদি জানেন যে তার সন্তান রক্ষা পেয়েছে বা পাবে তিনি কোন কষ্ট অনুভব করেন না। আবার ধরুণ, সেক্স এর মাধ্যমে এক ধরণের সুখানুভুতি লাভ হবে, যার তাড়নায় আপনি সে কর্মে নিমজ্জিত হবেন আর জিন তার বংশবৃদ্ধি করবে। অবশ্য পরিবার পরিকল্পনার কথা জিন ভাবেনি। আপনি/আমি লেখালেখি করে আনন্দ পাই, কেউ আড্ডা মেরে আনন্দ পাই, কিংবা ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ হই, সবই আমাদের মস্তিষ্কের সেই ভাল লাগাকে ম্যাক্সিমাইজ করার জন্য। দিন শেষে একটি কাজ করে যদি দেখেন যে আপনি আসলে কোন সুখ পাচ্ছেন না, তখন পুরো সময়টাই অপচয় হয়েছে বলে ভাবি। তাহলে মাইক্রো লেভেল জীবনের উদ্দেশ্য ধরতে পারি এই ভাল লাগার অনুভুতিকে ম্যক্সিমাইজ করা। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তেই আমরা সব সময় হিসেব করতে থাকি সচেতনে বা অবচেতনে কতটুকু ভাল লাগা বা মন্দ লাগা অর্জন করেছি। আর তার পরিপ্রেক্ষিতেই ভাবি জীবনটি কি অর্থহীন না অর্থহীন নয়। আমার কাছে তাই জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিটি মুহুর্তকে উপভোগের মাধ্যমে ভাল লাগার অনুভুতিকে ম্যক্সিমাইজ করা, খারাপ অনুভুতিকে মিনিমাইজ করা, এবং তার মাধ্যমে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার প্রেরণা লাভ করা।

এখন আসুন আরেকটু জটিল ভাবনায়। মস্তিষ্কের মাঝে এই অবচেতন অংশে আমি/আপনি যদি একটি ধারণা পাই যেটি ধারণাটির জন্য ভাল কিন্তু আমার বা অন্যের জন্য ক্ষতিকর সে ক্ষেত্রে কি হবে? ধরুণ, জিহাদী ধারণা। এরকম একটি ধারণা আপনার নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে আত্মহত্যার মত কাজে, আবার সেই সাথে এটি ক্ষতিকর সমাজের জন্য কারণ এতে অনেক নিরীহ মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে। এবং এরকম একটি ধারণা কিন্তু সহজেই আপনার মাঝে প্রতিস্থাপিত হতে পারে আপনার চারিপাশ হতে, আপনার পরিবার হতে, বা আপনি নিজেও যে কোন ভাবে এই ধারণায় উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। এখানেই চলে আসে ইনসেপশান ছবিটির কথা। ছবিটিতে এই বিষয়টিই দেখানো হয়েছে যে কিভাবে একটি ক্ষুদ্র ধারণা আপনি অন্যজনের মাঝে প্রতিস্থাপন করতে পারেন। ছবিটির বানিজ্যকরণের লক্ষ্যে সেখানে নানান বিষয়, যেমন স্বপ্ন, স্বপ্নের মাঝে স্বপ্ন নিয়ে এসেছে, থ্রিল এসেছে। তবে মূল উদ্দেশ্য ছিল “একটি ক্ষুদ্র ধারণার প্রতিস্থাপন”, যেটা অন্য একজন মানুষের স্বপ্নের মাঝে করা হয়েছে এমন ভাবে যেন সেই ব্যক্তিটি বুঝতে না পারে যে তার মাঝে অন্য কেউ কোন ধারণা প্রতিস্থাপন করেছে।

এখন যদি আমরা আমাদের নিজস্ব জগতের কথা চিন্তা করি তবে এরকম ধারণার ইনসেপশান কিন্তু অহরহই হচ্ছে। এই যেমন আমার আজকের লেখা আপনার মাঝে একটি ক্ষুদ্র ধারণা প্রতিস্থাপিত করতে পারে। এভাবে অবচেতন মনে বিদ্যমান নানান ধারণা ছাড়াও শিশুকাল হতে এটা করা খারাপ/এটা করা যাবে না এরকম নানান ধারণার ইনসেপশান চলতেই থাকে, যেটা অনেক বড় হয়েও অনেকেই কাটাতে পারি না। আর সেই ধারণা যখন বদ্ধমূল হয়ে যায় সেটা পরিণত হয় একটি স্থির বিশ্বাসে এবং তখন বিশ্বাসই হয়ে যায় চালিকা শক্তি। তখন আরেকজনকে বিচার করি নিজের বিশ্বাসের আয়নায়, একজন মানুষ হিসেবে নয়। ডেনেট এই বিশ্বাস ব্যবস্থাকেই বলেছেন ভাইরাসের মত।

এ কারণে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা যে কোন বিশ্বাসকে সংরক্ষনের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে। আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দেই, আমরা দেশের জন্য প্রাণ দেই, আমরা মানবাধিকারের জন্য প্রাণ দেই, আমরা ধর্মের জন্য প্রাণ দেই। আমরা বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়ে বন্ধুর সাথে তর্কে লিপ্ত হই, বন্ধুত্ব ছিন্ন করি। আমরা সেই বিশ্বাসকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে আনন্দ পাই। কারণ বিশ্বাসই তখন চালিকা শক্তি। তাই সতর্ক থাকুন, নিজের বিশ্বাস সম্পর্কে। অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার আগে ভাবুন, আপনার ধারণাটি কি প্রাণঘাতী নাকি মানুষের কল্যাণমূখী। আপনার সন্তানের মাঝে কোন ধারণার ইনসেপশানের আগে একটি বার ভেবে, তারপর সিদ্ধান্ত নিন। কারণ একমাত্র কল্যাণমূখী ধারণাই দিতে পারে একটি সুন্দর ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং একটি সুন্দর পৃথিবী। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার চেষ্টাই, তাই, আমার লক্ষ্য।


কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

১। বিবর্তনের পথ ধরে লেখক বন্যা আহমেদ
২। Evolutionary psychology: an introduction by Lance Workman and Will Reader
৩। Breaking the spell: Religion as a natural phenomenon by Daniel Dennett
৪। The selfish gene by Richard Dawkins
৫। Inception (a movie released in 2010)
৬। Wikipedia

Friday, September 24, 2010

এলোমেলো চিন্তাঃ অবিশ্বাসের যত গল্প

জবানবন্দী শব্দটি আমার মোটেও পছন্দ নয়। শব্দটি শুনলে নিজেকে মনে হয় একজন আসামী তার জবানবন্দী দিচ্ছে। অবিশ্বাসের জন্য নিজেকে সেরকম আসামী ভাবতে পারি না। পছন্দ হোক বা না হোক, জবানবন্দী হোক বা অবিশ্বাসের গল্পই হোক, সেটা বলার জন্যই আজ কলম ধরেছি। আমাদের সকলের অবিশ্বাসের গল্প বেশ কাছাকাছি। আবার জীবনের গল্পও কম বেশি কাছাকাছি। একই গল্প শুনতে সব সময় ভাল লাগে না, তারপরেও লিখে রাখছি নিজের চিন্তাগুলো, যদি কেউ তাতে অনুপ্রাণিত হয়।

ছোটবেলার গল্প বেশি নেই আমার, তেমন আহামরি/চমকপ্রদ কোন কিছুই নেই। আর নেই বলেই কিনা, তেমন কিছু মনেও নেই। আর দশটা সাধারণ শিশুর মত জন্ম নিয়েছিলাম সাধারণ মুসলিম পরিবারে। বাবা/মা দু’জনেই প্রচন্ড ধার্মিক মানুষ। বাবা প্রায় প্রতিটি নামাজ চেষ্টা করতেন মসজিদে যেয়ে পড়তেন আর মাও প্রতি বেলাতেই নিয়মিত নামাজ পড়তেন। এমন পরিবারে স্বাভাবিক ভাবেই বাসায় সপ্তাহে তিন দিন হুজুর আসতেন আরবী পড়াতে। বেশ বয়ষ্ক একজন হুজুর আমাদের পড়াতেন। হুজুর যতদিন বেঁচে ছিলেন আমাদের বাসায় নিয়মিত আসতেন।

ছোটবেলা হতেই গণিত, বিজ্ঞান খুব টানতো আর ঘৃনা করতাম ইংরেজী/বাংলা ব্যাকারণকে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো সব সময় খুব ভাল লাগতো। সপ্তম বা অষ্টম শ্রেনীতে আমার একটি প্রিয় বিষয় ছিল পৃথিবী যে গোল সেটার প্রমানের বিষয়গুলো। এখনো ভুলতে পারি না, সেই মাস্তুলের ছবিগুলো, যেখানে জাহাজ ধীরে ধীরে ফুটে উঠে যত তীরের কাছাকাছি আসে। আরেকটি প্রিয় বিষয় ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কিভাবে কাজ করে সেই বিষয়টী। এগুলো এখনো চোঁখের সামনেই ভাসে। যে জিনিস বুঝতে পারতাম তা কখনো ভুলতাম না, আর যে জিনিস বুঝতে পারতাম না তা হাজার বার পড়েও মনে রাখতে পারতাম না। পরবর্তীতে যখন বুয়েটে পড়তে আসি এই বুঝার ব্যাপারগুলো খুব ভাল কাজে দিয়েছে। তবে আমি সবচেয়ে ভাল বুঝতাম যখন কাউকে বুঝাতে যেতাম। দেখা যেত বন্ধুদের কোন বিষয় বুঝাতে গিয়েই সবচেয়ে বেশি নিজে বুঝেছি এবং নিজেও উপকৃত হয়েছি। তাই সে কাজটিই করতাম। একা একা পড়ার অভ্যেস করতে পারিনি।

কলেজে থাকাকালিন সময়ে বই পড়ার আগ্রহ ছিল বেশ। তখন শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলো বেশি টানতো। কলেজে আমাদের বেশ ভাল একটি লাইব্রেরী ছিল। প্রায় সব ধরণের বইই পড়তাম। এর মাঝে একটি বই পড়ি ডেল কার্নেগীর “দুঃশ্চিন্তাহীন জীবন”। বইটির প্রায় প্রতিটি কথা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সকল চিন্তা হতে দুঃশ্চিন্তা মুক্ত রাখার জন্য এই বইটির কাছে আমি ভীষণভাবে ঋনী। এর মাঝে একটি পন্থা ছিল সব সময় সবচেয়ে খারাপ কি হতে পারে চিন্তা করা। যে কোন বিপদে যদি সবচেয়ে খারাপটি কল্পনা করেন এবং যদি দেখেন যে তত খারাপ আসলে হচ্ছে না তখন দুঃশ্চিন্তা অনেক কমে যায়। কারণ অধিকাংশ সময়ে সবচেয়ে খারাপটি কিন্ত হবে না, প্রব্যাবিলিটি কিন্তু তাহাই বলে। এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক সমস্যাই মোকাবেলা করেছি, কিন্তু মানসিক ভাবে বিপর্যস্থ হইনি, তার পেছনে ডেল কার্নেগীর এই বইয়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। এর ফলে আরেকটি যেটি লাভ হয়েছে যে কোন কিছুতে ধারাবাহিক যুক্তির ব্যবহার করার অভ্যেস হয়েছে।

অন্যান্য যে কোন কিশোরের মত প্রচুর সেবার বই পড়তাম। সেবার অনুবাদ, তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন সবই মুগ্ধের মত পড়তাম। জীবনে সবচেয়ে বেশি বই পড়েছি ইন্টারমিডিয়ট পরীক্ষার পর। কোথায় ভর্তি হবো এই নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না। কোচিং এ যেতাম আর আসার সময় সিনেমা হলে ঢুঁ মেরে আসতাম। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটিয়েছি তখন। এর মাঝে বুয়েটে সুযোগ পেয়ে যাই কিন্তু ক্লাস শুরু হয় দেড় বছর পর। এই সময়টা টিউশনি করে আর বই পড়েই কাটাই। ততদিনে তিন গোয়েন্দা ছেড়ে ফেলুদা আর শার্লক হোমস গিলছি। শার্লক হোমসের অমনিবাস কিনে একের পর এক পড়ে যাচ্ছি। গোয়েন্দা কাহিনীই আমাকে বেশি টানতো। তবে সমরেশ, সুনীল, বুদ্ধদেব, শঙ্কর, শীর্ষেন্দু, আরো কত যে ওপারবাংলার লেখকের বই পড়েছি সব মনে করতে পারছি না। আশ্চর্যজনক ভাবে বুয়েটে ক্লাস শুরুর পর বই পড়া বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তখন বছরে এক বা দু’টোর বেশি বই পড়িনি। যা পড়ার সব বুয়েটের ক্লাস শুরুর আগেই পড়েছি।

বুয়েটের জীবনটা বেশ চমৎকার কেটেছে। সারাদিন ক্লাস করতাম, বিকেলে ফটুবল খেলতাম, রাতে কার্ড খেলতাম। ক্লাস টেস্টের আগের দিন কিছুটা পড়তাম, বিকেলের সেশানাল ক্লাসের আগের এক ঘন্টায় কারোর ল্যাবের খাতা হতে চোথা মারতাম। প্রিপারেশন লিভের সময় রাতদিন পড়ে সারা টার্মের ফাঁকি পোষাতাম। এরকম সহজ সমীকরণের মাঝেই বুয়েট জীবন পার করে দিলাম। চোখের পলকে যেন পাঁচটি বছর চলে গেল। তারপর মাষ্টার্স করি পরবর্তী তিন বছরে। এই সময়টি আমি মুলত আর দশটা মুসলিমের মতই ছিলাম। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়ে মুসলমানিত্ব বজায় রাখতাম, আর রোজার মাসে উপোস করতাম এবং ঈদের নামাজে যেতাম। বাড়ী গেলে বাবার পীড়াপিড়তে মাঝে মাঝে ফজরের নামাজেও বাবার সাথে শামিল হতাম। একটি বিষয়ে আমি ভাগ্যবান ছিলাম যে বাবা/মা সব সময় আমাকে নামাজের জন্য বলতেন, এখনো বলেন। কিন্তু কট্টর মৌলবাদীদের মত আমাকে বাধ্য করার জন্য চাপ দিতেন না।

বুয়েটের জীবনটা খুব উপভোগ করেছি। আড্ডা, সিনেমা দেখা, কার্ড খেলা, ফুটবল খেলা, ফাঁকে ফাঁকে পড়াশুনা করা, এই ছিল মূলত জীবন। আমার চারজন রুমমেটের মাঝে দু’জন ছিল হিন্দু রুমমেট। এর মাঝে একজন হচ্ছে আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। তাঁদের বাসায় যেয়ে থেকেছি, মাসীর হাতের কবুতরের মাংসের তরকারীর কথা জীবনে ভুলবার নয়। বরাবরই আমি ধর্মের এই বিভেদকে উপেক্ষা করে চলে এসেছি। ধর্মের কারণে বিধর্মীকে ভিন্ন জাত হিসেবে কল্পনা করা এক প্রকার অসম্ভব ছিল আমার কাছে। সেভাবে ধর্ম নিয়ে চিন্তা না করলেও প্র্যাক্টেসিং ভাবে মনে হয় সংশয়বাদের কাছাকাছি ছিলাম। বরং যারা বিধর্মীদেরকে ভিন্ন ভাবে নিতেন তাঁদেরকেই অমানুষ মনে করতাম।

বুয়েট জীবন শেষে চলে আসি বিদেশে উচ্চ-শিক্ষার্থে। বিদেশ জীবনের শুরুর সময়টা বিশেষ সুবিধের ছিল না। ঠান্ডার দেশে আসার পর আমার আর্থ্রাইটিস ধরা পড়ে। এক পর্যায়ে আর্থ্রাটাইসের কারণে নিজের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে, আমার ঘাড়ের মাছে মেরুদন্ডের একটি হাঁড় ক্ষয় হয়ে জয়েন্টটি খুলে যায়। সার্জারী করে সেই জয়েন্টটিকে ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। খুব বেশি জটিল সার্জারী না হলেও সার্জারীটি রিস্কি ছিল। আর বিদেশে বসে একা একা সার্জারীর ধকল সামলানো সব মিলিয়ে একটি কঠিন অবস্থার মাঝ দিয়ে অতিক্রম করি। ডেল কার্নেগীকে আবারো উপলব্ধি করি। জীবনকে নুতন ভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাই। এক প্রকার নুতন এক জীবন হিসেবে নেই এটিকে। জীবনের উদ্দেশ্য কি নিজের মাঝে আবার প্রশ্নটি মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠে। মূলত এই প্রশ্নের খুঁজেই আমার অবিশ্বাসের জীবন শুরু করা।

এর মাঝে ব্লগ নামক বস্তুটির দেখা পাই মাত্র এক বছর আগে। লেখালেখির প্রতি টান ছিল সব সময়, কিন্তু লেখালেখি করার জন্য যে পরিমান জ্ঞান প্রয়োজন তা কখনোই ছিল না। এর মাঝে আমার গ্র্যাজুয়েট কোর্স ওয়ার্ক শেষ, শুধু গবেষণার কাজ করি। গবেষণার কাজ মূলত কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং ভিক্তিক হওয়াতে বাড়তি সময় সব সময় থাকতো, এই মুহুর্তে অফিসে বসেই লিখছি। আমার ব্লগের নব্বইভাগ অফিসেই বসে লেখা। নিজের বই পড়াশুনার আগ্রহ আবার শুরু হয়। প্রথমে মূলত ব্লগ পড়তাম। নানান ব্লগ দেখে সচলায়তন ব্লগটিকে পছন্দ হলো পরিবেশের জন্য। মুক্তমনা ব্লগও দেখতাম। কিন্তু অনেকদিন পড়ে মনে হল সচলে না লিখলে কোন সদস্য পদ দেওয়া হবে না, তাই একটি লেখা লিখেও ফেললাম। সেই শুরু। রাজনৈতিক দর্শনেই মূলত আগ্রহ আমার। এই আগ্রহ কিভাবে এসেছে বলা মুশকিল। প্রকৃতিগত ভাবেই আমি এই চরিত্রের অধিকারী বলে মনে হয়। মূলত মানুষের জন্য কিছু করার প্রেরণা থেকেই মনে হয় রাজনৈতিক দর্শনে আগ্রহ। কারণ আমার মতে একমাত্র রাজনৈতিক শক্তিই পারে মানুষের বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে।

এই রাজনৈতিক দর্শনটি খুঁজতে গিয়ে নানান পথে চলতে হয়েছে। কখনো ইতিহাসের পাতায় ঘুরতে হয়েছে, কখনো বিজ্ঞানের পাতায় ঘুরতে হয়েছে। ছোটবেলায় গোয়েন্দাকাহিনী যেমন টানতো এখন আমাকে ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শনের গল্প সেভাবে টানে। শুরুটা করি ইতিহাস দিয়েই। বই পড়ার নেশা দীর্ঘবিরতীর পর যেন বাঁধ ভেঙ্গে এসেছে। সেই সাথে কিছু লেখার প্রেরণা তো আছেই। নিজের গবেষণা করতে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর কিভাবে ধারাবাহিক ভাবে খুঁজতে হয় সেটাও শিখেছি। সব মিলিয়ে প্রায় ধারাবাহিক ভাবে নিজের নানান প্রশ্নের জবাব খুঁজতে থাকলাম। ধর্ম নিয়ে প্রথম একটি উপলব্ধি ছিল কিভাবে ধর্মের উৎপত্তি হয়। সে নিয়ে লেখাটি ছিল ধর্ম সমাজ ও দর্শন। একদম আদিম সমাজে ধর্ম কেমন ছিল কল্পনা করার চেষ্টা করি। যদি শুধুমাত্র মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকেই তাকাই দেখতে পাই যে ধর্ম এসেছিল আগে নাকি মানুষ এসেছিল আগে। অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম অনেক অনেক অনেক পরে এসেছিল। অবাক করা ব্যাপার হলো যে পুরোপুরি কৃষিকাজ শিখেছে মানুষ এই মাত্র প্রায় আট হাজার বছর আগে। প্রথম লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে মাত্র প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। এখন যদি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর দিকে দেখি তবে দেখনে যে ইহুদী ধর্ম এসেছে মাত্র প্রায় ২৬০০ বছর আগে, ইসলাম এসেছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে। অথচ আমাদের শেষ বরফ যুগ শেষ হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার বছর আগে। তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর আগে কি মানুষের ধর্ম ছিল না? তাঁদের কি ঈশ্বরের ভয় ছিল না, মৃত্যুর ভয় ছিল না। সবই ছিল। সেই সব ধর্ম ছিল লোকজ ধর্ম। তারা পুঁজো করতো সূর্য, বাতাস, সাগর, পাহাড়, অতিকায় প্রাণী এই সবের। তাঁদেরও গোষ্ঠী নেতা ছিলা, সবই ছিল। এ কারণে হঠাৎ করে কিছু মানুষের দাবী করা যে তাদের ধর্মই সত্য, বাকী সবাই মিথ্যে, সেটা মেনে নেওয়া কষ্টকর আমার যুক্তিতে। আমার মতে শুধুমাত্র মানুব সভ্যতার নৃ-তাত্বিক ইতিহাসই সক্ষম প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দাবীকে অসাড় প্রমান করার জন্য।

তারপরেও ধর্মকে বাতিল করে দেওয়াটা এত সহজ নয়। সেখানে বিশ্বাস আছে, সেখানে নানান কু-যুক্তি রয়েছে। বিশ্বাসকে সত্যের মর্যাদা দেওয়ার জন্য আমাদের মনে নানান ধারণা নানান সময়ে পেয়ে এসেছি পরিবার হতে, সমাজ হতে, রাষ্ট্র হতে। সবচেয়ে আধুনিক ধর্ম হচ্ছে ইসলাম এবং নিজেও জন্মগত ভাবে ইসলাম ধর্মই পেয়ে এসেছি। ইসলামের সবচেয়ে বড় শক্তি এবং বিশ্বাস - কোরান হচ্ছে আল্লাহর বাণী। যদি শুধুমাত্র প্রমান করা যায় যে কোরান আল্লাহর বাণী নয় এটি কোন মানুষের রচণা তাহলে ধর্মকে অস্বীকার করা অনেক সহজ হয়ে উঠে। এই বিষয়ে মুক্তমনায় পেলাম আকাশ মালিকের লেখা “যে সত্য বলা হয়নি”, বইটির মাধ্যমে ইসলামের অনেক ইতিহাসই জানতে পারি। অধিকাংশ মুসলমানদের মাঝে একটি বিশ্বাস যে মুহাম্মদ একজন নিরক্ষর ব্যক্তি এবং কোরানে যে সব বর্ণিত রয়েছে একজন নিরক্ষর মানুষের পক্ষে ১৪০০ শত বছর আগে সে গুলো বলা বা লেখা সম্ভব নয়। আবারো যদি শুধু মাত্র ইতিহাসই দেখি তবে দেখবো যে, মুহাম্মদ ছাড়াও তার আগে উনার মত আর কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন কিনা? যদি ইতিহাস পড়ি তবে দেখি মুহাম্মদ এর জন্মের প্রায় ১২০০ শত বছর আগে কনফুসিয়াস, জরাথ্রুষ্ট, গৌতম বুদ্ধ, সক্রেটিসের মত দার্শনিক, ধর্ম অবতারদের জন্ম। নীতির কথা তারাও বলে গিয়েছেন। সভ্যতার ইতিহাস যদি দেখি খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগে মিশরীয়রা মমি বানানোর পদ্ধতি বের করে। সেই সময় ব্যাবলীনিয় সভ্যতা, পারস্য সভ্যতাও অনেক উন্নতর ছিল। তাঁদের নিজস্ব সেঁচ ব্যবস্থা ছিল। এমনকি উপমহাদেশের সভ্যতার ইতিহাস দেখলেও দেখবেন যে মহাঞ্জোদারো, হরোপ্পা সভ্যতাগুলোও অনেক উন্নত ছিল। এই ইতিহাস বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে যে চৌদ্দশত বছর আগে নয়, প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বেও মানব সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল। তাই চোদ্দশত বছর পূর্বের একজন মানুষের পক্ষে উন্নতর দর্শন রচণা অসম্ভব নয়।

বিশেষ করে ২৩০০ শত বছর আগে যদি গ্রীক সভ্যতার দিকে একটু তাকাই, তবে দেখি যে সেখানে থেলিস, ডেমোক্রিটাস এরিস্টটলের মত দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীরা গণিত, জীববিজ্ঞান, রাষ্টবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন। এরিষ্টটলের লেখা পলিটিক্স আজো রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি অবশ্যপাঠ্য পুস্তক। সেই সময় এরিষ্টটল স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এই সব তন্ত্রের যে ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়েছেন সেগুলো আজো পরিবর্তন হয়নি। এরিষ্টটল জীববিজ্ঞানে যে অবদান রেখেছেন তার জন্য আমরা তাকে জীববিজ্ঞানের জনক বলি। একজন মানুষ যদি ২৩০০ বছর আগে রাজনীতি, জীববিজ্ঞানে এই পরিমান অবদান রাখতে পারেন তবে কেন ১৪০০ বছর আগের একজন মানুষ পারবেন না কোরানে বিজ্ঞানের মত বিষয়, রাষ্টনীতির মত বিষয় এবং নীতি কথার মত বিষয় নিয়ে লিখতে। মুহাম্মদ নিরক্ষর হতে পারেন, কিন্তু তিনি ২৫ বছর হতে ৪০ বছর পর্যন্ত ব্যবসার উদ্দেশ্য ভ্রমন করেছেন। তাই তিনি লিখতে না পারেন, কিন্তু তিনি একজন জ্ঞানী নন সেটা বলা যাবে না। উনি নিজে এই সব বিষয়ে চিন্তা করতেন, নিজের মনে কিছু প্রশ্নের জবাব খুঁজতেন। এবং সেভাবে তিনি উনার নিজস্ব দর্শন খুজে পেয়েছেন, যা ছড়িয়ে দিয়েছেন ইসলাম ধর্ম নামে। এখন যদি কোরানের ভেতরে দেখি তবে দেখবেন কোরানে এমন কিছু নেই যা তখনকার মানুষ বা আগেরকার মানুষ জানতো না। মিশরীয় সভ্যতার কাহিনী বলি, বা নূহের বন্যার কাহিনীর বলি, লুত সভ্যতার কাহিনী বলি সবই আমাদের মুখে মুখে রচিত পূঁথিকাহিনীর মত আরবে ছড়িয়ে ছিল। আর সেগুলো ইহুদী এবং খ্রীষ্টান ধর্মগ্রন্থেই লিপিবদ্ধ ছিল। কোরানে যে সব বৈজ্ঞানিক দাবী করে থাকে সেগুলো নুতন কিছু নয়, বরং কিছু ভুলও রয়েছে। সেই সময়কার জ্ঞানে ভুল থাকাটাই স্বাভাবিক বরং না থাকাটাই মিরাকল হতো। তাই কোরান বা বাইবেল বা তাওরাত বা ইঞ্জিলকে আমি কোন ঐশ্বরিক গ্রন্থ বলে মনে করি না। মনে করি না তাঁদের ঈশ্বরই পৃথিবীর সকল কিছুর স্রষ্টা।

বাকি থাকলো ঈশ্বর বলে কি কিছু আছে? এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়ার মত অবস্থায় আমরা এখনো নেই। এর জবাব খুঁজার চেষ্টা চলছে মাত্র। তবে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক গবেষনায় ঈশ্বর অথবা আত্মার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। যতক্ষন বৈজ্ঞানিক ভাবে কোন কিছু প্রমানিত না হচ্ছে ততক্ষন সেটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান থাকবো। এই সেই দিন মাত্র স্টিফেন হকিং তার গ্রান্ড ডিজাইনে অবশেষে বলেছেন যে সৃষ্টিকর্তা ছাড়াও বিগ ব্যাং হওয়া সম্ভব। সুতরাং একদিন বিজ্ঞান সম্পুর্ণভাবে বুঝতে সক্ষম হবে বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য। ধর্মকে বিবর্তনের দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব। কিভাবে মানুষের মস্তিষ্কে বিশ্বাস নামক বস্তুটির সৃষ্টি হয় এবং সেটাকে কিভাবে এবং কেন আমরা ছড়িয়ে দেই প্রজন্ম হতে প্রজন্মে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। কেন মানুষ সামাজিক জীব, কেন মানুষ গ্রুপে চলাচলে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে, কিভাবে গ্রুপ তাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে এই বিষয়গুলো আমাদের বুঝতে হবে যদি আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চরিত্র বুঝতে চাই। ধর্মকে মানুষই রক্ষা করে। ধর্ম বলে আলাদা কিছু নেই- এটা সংঘবদ্ধ একদল মানুষের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। একদল মানুষ সেটাকে লালন করছে। কিন্তু কেন তারা লালল করছে সেটাকে বুঝতে হবে যদি তাঁদেরকে সেই চিন্তা থেকে সরিয়ে আনতে চান। সেটা না বুঝে তাঁদেরকে জোর করে আপনি/আমি সেই বিশ্বাস হতে মুক্ত করতে পারবো না। এই মানুষগুলোর যদি সেই বিশ্বাসের প্রয়োজন না থাকে তবে সেটাকে লালনেরও প্রয়োজ়ন থাকতো না।

যদি আজ বিশ্বের সকল মানুষ ইশ্বরে অবিশ্বাসী হয়েও যায় তাতে কি শোষণ বন্ধ হবে? তাতে কি অন্যায় বন্ধ হয়ে যাবে, মানব হত্যা বন্ধ হয়ে যাবে? যাবে না। কারণ ধর্মই দ্বন্দ্বের মূলে নয়। টিকে থাকার সংগ্রাম দ্বন্দ্বের মূলে। যতদিন চাহিদা এবং সম্পদের মাঝে ব্যবধান থাকবে ততদিন দ্বন্দ্ব থাকবে। ধর্ম একদলকে এই টিকে থাকায় বাড়তি সহায়তা করেছে, তাই তারা ধর্মকে লালন করছে। জাতীয়তাবাদ নামক সংঘবদ্ধতা এই টিকে থাকায় সাহায্য করেছে তাই নানান জাতি গোষ্ঠী দেখি। এ কারণে আজ দেখি বিশ্বে বিশ্বাসীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। নদী এবং সাগরের পানির উচ্চতা যখন সমান হয়ে যাবে তখন পানির আর কোন প্রবাহ হবে না। তেমনি চাহিদা এবং উৎপাদনের বিভেদ যেদিন থাকবে না, দ্বন্দ্বও সেদিন থাকবে না। সমস্যা হল সেই বিভেদ পুরোপুরি কমানো অসম্ভব। এমন কোন সাধারণ গাণিতিক মডেল নেই যেটা দিয়ে বলতে পারবেন যে এভাবে চলিলে বিভেদ থাকবে না। এর পেছনে বড় বাঁধা হচ্ছে মানুষের চরিত্রের বিবর্তনীয় ক্ষমতা। পুরো ব্যবস্থাটি নির্ভর করছে আরেকজন মানুষ কিভাবে স্টেপ নেয় তার উপর। একজন মানুষের নেওয়া একশ্যানের উপর নির্ভর করে অন্যজনের কাজ, এভাবে হাজার কোটি মানুষের চরিত্রকে ডিটারমিনিস্টিক মডেলের আওয়তায় আনা এখনকার জ্ঞানে অসম্ভব। কিন্তু একেবারেই কি অসম্ভব? যদি আমরা মানুষের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে সেটা একদিন পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারি তবে হয়তোবা ক্ষুদ্র একটি সমাজে একটি নুতন আইন করা হলে তার ফলাফল কি হবে সেটা আমরা কম্পিউটারে বসেই বের করতে পারবো। তখন আফ্রিকা বা এশিয়ার কোন দেশে কোন অর্থনীতির মডেল হাতে নিলে, স্বল্প সম্পদ ব্যবহার করে , কিভাবে পুরো বিশ্বের জীবন ধারায় উন্নতি আনবে দিয়ে সেটা মডেল করে জানতে পারি। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে চলমান রাখাই আমাদের কর্তব্য । কম্পিউটার একদিনে আবিষ্কার হয়ে যায়নি। আমেরিকার আদম শুমারীতে ব্যবহৃত হতো এমন একটি সাধারণ গণনা যন্ত্র হতে ধীরে ধীরে কম্পিউটার আসে। এভাবে স্টীম ইঞ্জিন কিংবা এরোপ্লেন বা নিউটনের সুত্র কোন কিছুই হঠাৎ করে আবিষ্কৃত হয়নি। প্রতিটি গবেষণাতেই দেখা যায় পূর্বের গবেষণাকে উন্নত রুপ দিয়েই নুতন সুত্র আসে। থেলিস, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিষ্টটল, কনফুসিয়াস, বৌদ্ধ, যিশু, মুহাম্মদ, হাইপেশিয়া, কোপার্নিকাস, ভলতেয়ার, গ্যালিলিও, রুশো, হেগেল, মার্ক্স, লিবনিজ, নিউটন, শেক্সপিয়ার, ডারউইন, আইন্সটাইন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হকিং, ডকিন্স এরা কেউ হঠাৎ করেই কিছু আবিষ্কার করে ফেলেননি। সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথেই তাঁদের আগমন। সভ্যতা এভাবেই এগিয়ে যাবে। এই মুক্তমনা হতেই হতেই অভিজিত, বন্যা, আকাশ মালিকরা মানব সভ্যতায় নুতন কিছু দিয়ে যাবে। মানব সভ্যতা গুঁটি গুঁটি পায়ে এগিয়ে যাবে। জয় হোক মুক্তমনার।


Wednesday, September 15, 2010

এলোমেলো চিন্তাঃ গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের আচরণ

মানুষ আসলে একটি গ্রুপের মাঝে থাকতে পছন্দ করে। এই যেমন মুক্তমনা বা সচল বা সামহোয়ারইন সবাই একটি গ্রুপ। আরো বড় গ্রুপ যদি চিন্তা করেন তবে ধর্মীয় গ্রুপ গুলো, কিংবা একেকটি জাতি বা রাষ্ট্রকে চিন্তা করতে পারেন। ছোট হোক বা বড় হোক যে গ্রুপে আপনি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন সেই গ্রুপে আপনি চলতে পছন্দ করেন। গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের প্রয়োজন গ্রুপ বড় করার আবার আপনার নিজেরও প্রয়োজন কোন না কোন গ্রুপে থাকার। এভাবে দু’য়ের প্রয়োজনে আপনি আপনার গ্রুপ খুঁজে পান আবার গ্রুপও আপনাকে খুঁজে পায়। গ্রুপের চেষ্টা থাকে নানান সুবিধে দিয়ে তার গ্রুপকে সুসংহত রাখার। অন্য গ্রুপের আক্রমন হতে গ্রুপ আপনাকে রক্ষা করে। নিজের নানান বিপদে গ্রুপের সদস্যদের আপনি পাশে পাবেন যেটা আপনি পেতেন না যদি আপনি এই গ্রুপের সদস্য না হতেন। তাই কোন না কোন গ্রুপে আপনি সচেতনে কিংবা অবচেতনে যুক্ত থাকেন। এর মাঝে অনেক গ্রুপ হয়তো আসলেই সাংগঠনিক ভাবে বিদ্যমান আবার অনেক গ্রুপ শুধু মাত্র আদর্শে বিদ্যমান। যেমন আপনি হয়তো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। পৃথিবীর যে কোন গণতন্ত্রাকামি মানুষের প্রতি আপনার সহানুভুতি থাকবে। আবার গ্রুপের সদস্যদের মাঝে কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে গ্রুপ নানান নীতিমালা প্রণয়ন করে থাকে। গ্রুপ সব সময় নিজের ভাঙ্গন রোধে সচেষ্ট থাকে। তাই অনেক সময় কেউ গ্রুপ হতে বের হয়ে চলে যেতে চাইলে সেটাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। গ্রুপের মাঝে কেউ নিয়ম না মানলে তাকে শাস্তি দেওয়া হয় গ্রুপকে রক্ষার্থে। এই সবই চিন্তা করা যেতে পারে “এজ এ সেলফিশনেস অফ এ গ্রুপ” হিসেবে।

ছোট হোক বড় হোক যে কোন গ্রুপের মাঝে আমরা এই কমন বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে পাবো। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন সত্য মুক্তমনা বা সচলের মত ছোট গ্রুপের জন্য তেমনি সত্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় সংগঠনগুলোর জন্য। এ কারণেই অনেক মানুষ ধর্ম তেমন ভাবে পালন না করলেও শুধু মাত্র তার নিজের বা পরিবারের জন্য গ্রুপে রয়ে যায়। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে ধর্ম পালন না করলেও, এমন কি ধর্মে অবিশ্বাস করলেও শুধু মাত্র সামাজিকতা রক্ষার্থে হয়তো জুম্মার নামাজটি, কিংবা ঈদের নামাজটি করেন, কিংবা রোজার মাসে রোজাও রাখেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, জুম্মার নামাজ পড়া বা রোজা রাখা কি ধর্ম পালন নয়? আমার জবাব হচ্ছে হিন্দুদের অনেকে উপোস করে থাকে, সেটা কি রোজা? না, তেমনি এক ওয়াক্ত নামাজ পালন, কিংবা সারা মাস উপোস করাটা ধর্ম পালন নয়। ধর্মে যদি তার বিশ্বাস থাকতো, তার যদি আল্লাহ্‌র ভয় থাকতো তবে তিনি পাঁচ ওয়াক্তই নামাজ পড়তেন। কারণ ইসলামে এক ওয়াক্ত নামাজও না পড়ার জন্য কোন অজুহাত রাখা হয়নি। এবার আপনি আপনার আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন শতকরা কতভাগ মানুষ পান, যারা সত্যিকার ভাবে আসলে ধর্ম পালন করে, বা ধর্মকে ধারণ করেন।

আবার যারা সত্যিকার ভাবে ধর্ম পালন করেন তার মাঝে বেশিরভাগই নিরীহ, সাধারণ মানুষ, যারা মূলত পরকালের ভয় থেকেই পুরোপুরি ধর্ম পালন করেন। এদের মধ্য খুব কম মানুষই কোরনের অনুবাদ পড়েছেন। কোরান সম্পর্কে জানেন এক মাত্র হুজুরদের বয়ান থেকে। আর যে সব হুজুরেরা বয়ান করেন তাঁদেরও বেশিরভাগই কম পড়ুয়া। খুতবার জন্য যতটুকু না জানলেই নয়, তাই জানেন। একই খুতবা আমার সারাজীবনে বার বার শুনে এসেছি জুম্মার বা ঈদের নামাজে। তাহলে প্রকৃত জিহাদী চেতনার মানুষ কিছু হিজবুত তাহরীর মত উগ্র সংগঠন থেকেই পাই, যারা মানুষের ধর্মভীরুতার, অজ্ঞতার, দারিদ্রতার সূযোগ নিয়ে ব্যবহার করে।

এখন কথা হল যে আমাদের শত্রু সকল ধার্মিক নয়। শত্রু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, এবং আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে ধর্মের মাঝে বিদ্যমান ক্ষতিকর এলিমেন্টগুলো, এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে সেই সব এলিমেন্ট ব্যবহার করে যে সমস্ত ব্যক্তি তারা। আমি দেশে ফোন করার জন্য একবার একটি টেলিকমের লাইন নিয়েছিলাম, এবং সে জন্য আমাকে ক্রেডিট কার্ডের নম্বর দিতে হয়েছিল ফোনে। যে লোকটি নিয়েছিল তারা ব্যবহার কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। আমি ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিকে ফোন করে বললাম ঘটনা। সে যেটা বললো, এ রকম ফোনে অনেক লেনদেন হয়, সো ডোন্ট ওওরি। আমি জিজ্ঞেস করলাম ওই ব্যক্তি যদি আমার কার্ড ব্যবহার করে নিজে কিছু অনলাইনে কিনে, তাহলে? সে আমাকে যেটা বললো যে, আমার সেই প্রটেকশান আছে। যদি ওরা দেখে যে সেই জিনিসটি আমার নামে বা আমার ঠিকানায় যায় নি, তবে বুঝবে এটা আমি কিনিনি এবং সে ক্ষেত্রে টাকা আমাকে দিতে হবে না। আর তার চেয়েও যেটা বললো যে এটা করবে সেটা তার জন্য একটি ক্রিমিনাল এক্ট হবে। ক্রেডিট কার্ডের মালিক যেহেতু সে নয়, তাই সে সেটা ব্যবহার করলে আইনত সে অপরাধী। এই ঘটনাটি বলার উদ্দেশ্য হল যে সব ব্যক্তি সাধারণ মানুষের ধর্মভীরুতার, দারিদ্রতার সূযোগ নিচ্ছে সেই প্রকৃত অপরাধী। আমি এই কথাটি বারবার বলার চেষ্টা করি, যে কে প্রকৃত শত্রু সেটা আগে জানুন, তার পর না আপনি যুদ্ধে নামবেন।

এখন এই অপরাধী যেন তেন অপরাধী নয়। এই অপরাধী অনেক চালাক, কারণ তার অস্ত্র সেটাই যেটা মানুষের প্রয়োজন। এর সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সেই মানুষগুলো যাঁদের সে ব্যবহার করে। কিন্তু সেই মানুষগুলো কেন এ রকম ব্যবহৃত হচ্ছে? হচ্ছে কারণ এত বড় গ্রুপের শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মত ক্ষমতা তার নেই। এ রকম একটি বড় গ্রুপের বিরুদ্ধে তাকে লড়তে দিতে হলে তাঁর প্রয়োজন অন্য একটি কাছাকাছি শক্তির গ্রুপের অবস্থান যেখানে সে তার প্রয়োজনীয় শক্তিটুকু পাবে। যদি তাঁকে সেই গ্রুপটি না দিতে পারেন তবে তার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করা ভুল। আর যদি তাকেই অপরাধী বানিয়ে বসে থাকেন তবে আপনি নিজেও বড় ভুল করলেন। ভুল শত্রুর পেছনে নিজের শক্তি খরচ করলেন। শত্রুর স্থলে নিজের ট্যাকনিকাল মিত্রকে নিজের শত্রু বানিয়ে দিলেন।

তাই আমার মতে একটি মুক্তমনা সমাজ দেখতে হলে মুক্তমনা গ্রুপকে বড় করতে হবে। মানুষের কাছে গ্রুপের আদর্শকে তুলে ধরে গ্রুপকে সব সময় বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। এবং এই গ্রুপে অন্য যে কারোর বিরুদ্ধেই বিদ্বেষ পূর্ণ কথার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকতে হবে গ্রুপের ভালোর জন্য। প্রায় এ রকম কথাই বিপ্লব’দা বলেছিলেনঃ বিজ্ঞান ভিক্তিক জনসংগঠনের কথা। জীবনটাই একটা যুদ্ধ, বেঁচে থাকার প্রচেষ্টাই একটি যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে আগে তার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পরিষ্কার করতে হবে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে তীর ছোড়াছুড়ি করলে শুধু সময় আর শক্তির অপচয় হবে। আর সেই অপচয় নিশ্চয়ই আমাদেরকে টিকে থাকতে কোন প্রকার সাহয্য করবে না। তাই যারা নিজেদের মুক্তমনা মনে করেন, নিজেদের মাঝে যুদ্ধ না করে, চলুন লক্ষ্য ঠিক করি, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করি। এই সংগঠনটিকেই বড় করি। মানুষের কাছে এর আদর্শ তুলে ধরি।

Wednesday, August 11, 2010

এলোমেলো চিন্তাঃ বিবর্তনময় জীবন

বন্যা আপাকে আমার আগের লেখায় মন্তব্যে লিখেছিলাম যে আমার জীবন এখন বিবর্তনময় হয়ে গিয়েছে। আমার চারপাশে আমি এখন শুধু বিবর্তনকেই দেখতে পাই। বিবর্তনের আলোকে নিজের অনেক কর্মের ব্যাখ্যা পাই, নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও ঠিক করি। এর জন্য বন্যা আপার “বিবর্তনের পথ ধরে” বইয়ের অবদান অনেক। আজ অফিসিয়ালি কৃতজ্ঞতা জানালাম। বিবর্তনের উপর প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য এই বইটির তুলনা হয় না। তবে আমার মূল আগ্রহ হচ্ছে রাজনৈতিক দর্শনে। প্রাথমিক জ্ঞানটুকু পাবার পর আমি এখন মূলত পড়ি বিবর্তনের আলোকে মানুষ বা সমাজ, বা রাষ্ট্রের চরিত্র বোঝার বিষয়গুলো নিয়ে। আজকের লেখাটি আমার সেই বিবর্তনময় জীবন নিয়ে কিছু আবজাব।

আমি দর্শনকে দু’ভাগে ভাগ করবোঃ বিবর্তন পূর্ব দর্শন এবং বিবর্তন পরবর্তী দর্শন। আজ বিজ্ঞানের অগ্রগতীর ফলে দর্শন এবং বিজ্ঞান এখন প্রায় সমার্থক শব্দ হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক এখন কোন দর্শন সম্ভব নয়। তাই জীব বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ণৃ-বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস সহ সকল ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপস্থিতি লক্ষনীয়। তাই এখন একজন দার্শনিক দর্শন নিয়ে কাজ করেন আবার বিবর্তনের মত বিজ্ঞান নিয়েও কাজ করেন। তাই ডকিন্স, হকিংস এর মত বিজ্ঞানীরা হয়ে উঠেন একই সাথে দার্শনিক আবার ডেনেটের মত দার্শনিকেরা হয়ে উঠেন বিবর্তনীয় বিজ্ঞানী।

আমি যখন ধর্ম সম্পর্কে লেখাকে নিরুৎসাহিত করি তখন সেটা ধর্মকে নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখার কথা বুঝাইনি। ধর্মকে শুধু মাত্র কোরান বা মুহাম্মদের চরিত্রকে খন্ডনের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে দর্শনের আলোকে, ইতিহাসের আলোকে, নৃবিজ্ঞানের আলোকে, বিবর্তনের আলোকেও খন্ডন করার কথা বলি। এই ক্ষেত্রে ডেনেট এর ব্রেকিং দ্যা স্পেল বা ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইগুলোর কথা বলতে পারি। ডেনেট তার এই বইয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শুরু আমাদের লোকজ ধর্মগুলো হতে। তিনি ধর্মকে একটি লোকজ ধারা হিসেবে দেখিয়েছেন যেমনতর আমাদের রয়েছে লোকজ সঙ্গীত, লোকজ সংস্কৃতি বা লোকজ ভাষা। লোকজ সঙ্গীত যেমন বিবর্তিত হয়ে আজ প্রাতিষ্ঠানিক রক, ব্যান্ড, আধুনিক কিংবা জ্যাজ সঙ্গীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনি লোকজ ধর্মগুলো বিবর্তিত হয়ে আজকের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আপনি হয়তো রক পছন্দ করেন না, শুধু মেলোডি নির্ভর পছন্দ করেন, তেমনি আরেকজন হয়তো এখনো শুধু লোকজ সঙ্গীতই পছন্দ করেন, কিন্তু তাই বলে নিশ্চয়ই আরেকজনের পছন্দকে পাগল বলে বাতিল করে দেননা।

বিশ্বাস বা ধারণা বা কোন আইডিয়া নামক বস্তুটি আমাদের মস্তিষ্কের মাঝে বিবর্তনের পথে কোন একসময়ে এসেছে। যে কোন বিশ্বাস, বা সঙ্গীত বা চিত্রকলা বা সংস্কৃতি এগুলো আমাদের মস্তিষ্কে একধরনের ভাল লাগার অনুভূতি প্রদান করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সমাজকে সংগঠিত করতে সাহায্য করে, যার ফলে গ্রুপ সিলেকশনে টিকে থাকতে ফিটনেস বাড়ায়। সে কারণে এই সমস্ত বিষয়গুলো আমাদের মস্তিষ্কে বংশপরম্পরায় টিকে থেকে গিয়েছে। এর মধ্যে যেগুলো আবার সমাজের জন্য ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত হবে সেগুলো আবার বিববর্তনের সুত্র মতেই ধীরে ধীরে বংশপরম্পায় বাদ হয়ে যাবে। ধর্ম বিশ্বাসকে আমি সেভাবেই দেখি। এক সময় সেটা সমাজকে সংগঠিত করেছে, কিন্তু আজ সেটাই এখন ক্ষতির কারন হয়ে দাড়াচ্ছে। আমার বাবা/মা যেভাবে ধর্ম পালন করতো, আমি সেভাবে করি না, আর আমার সন্তানরা যে আরো করবে না সেটা বলাই বাহুল্য। তিন/চার হাজার বছরের পুরোন বিশ্বাস চলে যেতে আমাদেরকে প্রায় সেরকম সময় অপেক্ষা করতে হবে। বিবর্তন খুব ধীর গতির যা সহজে আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে পরিবর্তন কিন্তু চোখে পড়বে। টোটাল পরিবর্তনের জন্য আমাদের সময় দিতে হবে। সেটা আমি বা আপনি দেখে যেতে পারবো না।

ডেনেটের একটি বক্তব্য আমার বেশ ভাল লেগেছে তা হল ধারণা বা আইডিয়া কিভাবে একটি মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা কোন একটি ধারণার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারে। আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিতে পারি, জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদের জন্য প্রাণ দিতে পারি আবার ধর্মের জন্যেও শহীদ হতে পারি। এ সবই করি কারণ, আমাদের মস্তিষ্কের ধারণা নামক বস্তুটির জন্য। ডকিন্স এটিকেই বলেছেন সেলফিশনেস অফ মিম, অনেকটা সেলফিশনেস অফ জিনের মত। জিন যেমন নিজের বংশবৃদ্ধির জন্য তার হোষ্টকে মরে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম তেমনি মিমও সেটা করতে পারে। একজন মা যেমন তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দিতে পারে তেমনি একজন মানুষ তার বিশ্বাসকে রক্ষার জন্য জীবন দিতে পারে। এই ধারনা বা বিশ্বাস জিনিসটিকে ডেনেট পরজীবী জীবের সাথে তুলনা করেছেন। Lancet liver fluke এর মত পরজীবী যেমন একটি পিঁপড়েকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে আত্মহননে বাধ্য করে তেমনি আমাদের বিশ্বাস একজন মানুষকে বাধ্য করে আত্মহননের মত কাজে। যে কোন মানুষকে আঘাত দেওয়ার আগে তাই কেন মানুষের মাঝে এমন বিশ্বাস নামক বস্তুটির উৎপত্তি হয় সেটা বোঝা জরুরী। তখন আপনি রোগটিকে নিরাময় করতে পারবেন সহজে।

মজার ব্যাপার হল মানুষের মস্তিষ্কে এই ধারণাগুলোর প্রবেশ বা প্রতিস্থাপন করানো কিন্তু খুব সহজ একটি কাজ যেটা আমরা সব সময় করে আসি। ছোটবেলায় বাবা/মার শেখানো নানান বুলিগুলো দিয়ে শুরু হয় ধারণার প্রতিস্থাপন। ধর্মের ধারণাও সবাই পরিবারের কাছ থেকেই পাই প্রথমে। তারপর বন্ধু, আত্মীয় স্বজন, সমাজ সবর্ত্রের মাধ্যমে এই ধারণা আরো পাকাপোক্ত হয়। এর পর থেকে কখন যে বিশ্বাস/ধারণাই চালিকা শক্তি হয়ে যায় সেটা আর টের পাই না। যার ফলে বিদেশে এসে হালাল/হারাম খুঁজি। ধারণা প্রতিস্থাপন নিয়ে সম্প্রতি একটি ছবি হয়েছে, ডিকাপ্রিওর, নাম Inception. দেখতে পারেন। আমার চমৎকার লেগেছে। ছবিটির মাঝে একটি ক্ষুদ্র ধারণা কিভাবে অন্যের মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করা যায় এবং সেটি কিভাবে একজনের দৃষ্টিভঙ্গীকে বদলে দিতে পারে সেটা তুলে ধরা হয়েছে।

মানুষের মনের বা মস্তিষ্কের বিবর্তনের কথা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখবো যে মানুষই এই ধর্মগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে আবার তারাই আজ ধর্মগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা শুরু করেছে। তাই প্রয়োজন নিছক সমালোচনা নয়, প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা। ধর্মকে নিয়ে যত গবেষণা হবে, নৃবিজ্ঞানের আলোকে, ইতিহাসের আলোকে, বিবর্তিনের আলোকে ততই মানুষ ধর্মের বিবর্তন সম্পর্কে আরো বেশি করে জানতে পারবে এবং নিজেই পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে পারবে। ডেনেট তার বইয়ে ধর্ম নিয়ে এই গবেষণার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন প্রয়োজন হলে ধার্মিক/বিশ্বাসী গবেষকদের দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধর্ম নিয়ে গবেষণা করতে। হয় তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার দ্বারা ধর্মকে ব্যাখ্যা করুক, প্রতিষ্ঠিত করুক নয়তো তারা স্বীকার করুক তাঁদের ভুল।

আমরা যারা গবেষক নই তারা কি করতে পারি? তারা ডেনেটের এই বইটি কিংবা ডকিন্স এর সেলফিশ জিন বইয়ের মত বইগুলোকে অনুবাদ করে মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারি। ধর্ম নিয়ে আরেকটি গবেষনা মুলক বইয়ের নাম এখানে দিতে পারি। বইটির নামঃ Where God and science meet : How Brain and Evolutionary Studies Alter Our Understanding of Religion Edited by Patrick McNamara. এর তিনটি খন্ড রয়েছে। প্রথম খন্ডে আপনি পাবেন Evolution, Genes, and the Religious Brain, দ্বিতীয় খন্ডে পাবেনঃ The Neurology of Religious Experience এবং তৃতীয় খন্ডে পাবেনঃ The Psychology of Religious Experience। পুরো ৯০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ে বিবর্তন এবং মনোবিজ্ঞানের আলোকে ধর্মকে নিয়ে গবেষণালব্ধ অনেক কিছুই পাওয়া যাবে যা দিয়ে নিজের যুক্তিগুলোকে শাণিত করতে পারবেন। বইটি কারো লাগলে এখানে ইমেইল ঠিকানা দিলে, আমি পাঠিয়ে দিতে পারবো। শর্ত হল একটি অধ্যায় হলেও পড়ে সারমর্ম পোষ্ট করতে হবে।

বিবর্তন একটি শক্তিশালী শাখা বিজ্ঞানের, এবং এটি আজ শুধু জীববিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ বিবর্তনের বিভিন্ন চিন্তাধারাগুলো এরই মধ্যে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোতে প্রয়োগ করছে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি প্রতিষ্ঠিত শাখা। তেমনি বিবর্তনের দৃষ্টি দিয়ে মানুষের গোষ্ঠিবদ্ধ আচরনকে বোঝার চেষ্টা চলছে যার ফলশ্রুতিতে এখন বিবর্তনীয় সমাজবিজ্ঞান, বিবর্তনীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা বিবর্তনীয় অর্থনীতির মত বিষয়গুলো দেখতে পাই। বলাই বাহুল্য এই বিষয়গুলো সদ্য যাত্রা করেছে এবং এই বিষয়গুলো পরিপূর্ণতা পেতে আরো কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু সেটা যে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা বাংলা ভাষাভাষী যারা রয়েছি তারা এই সম্পর্কের বইগুলো পড়ে সেগুলো সম্পর্কে বেশি বেশি করে লিখতে পারি, যেন তরুন গবেষকরা এই সব বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী হয়। তবেই কিন্তু একটি মুক্তবুদ্ধির সমাজ পাবো।

পরিশেষে ধর্মের উপর লেখাগুলো নিয়ে বিবর্তন আর্কাইভের মত একটি আর্কাইভ খোলার প্রয়োজনীয়তার কথা আবারো বলে যাচ্ছি। আর লেখাটি বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো, তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আগেই।

Saturday, June 26, 2010

গণতন্ত্র ও তার সমালোচনা

ভুমিকাঃ

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমভাগ হতে (508 BC) গণতন্ত্রের সূচনা হলেও আধুনিক গণতন্ত্রের যে রূপ আমরা আজ দেখি সেটির ধারণা আমরা পাই আঠারো শতাব্দীর শুরুতে এসে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক অবস্থা হতে আজকের আধুনিকতম রূপে আসতে গিয়ে গণতন্ত্রকে নানা রূপান্তরের মাঝে দিয়ে যেতে হয়েছে। গণতন্ত্রের ভবিষ্যত স্বরূপটি কল্পনা করতে হলে এবং এর সুফল পেতে হলে আমাদেরকে এই রূপান্তরগুলো এবং রূপান্তরের কারণগুলোকে জানতে হবে এবং বুঝতে হবে। এই লেখাটিতে আমরা গণতন্ত্রের সেই ক্রমবিকাশকেই দেখবো। প্রথমে আমরা দেখবো গণতন্ত্রের একদম শুরুর কথা যেটাকে আমরা বলবো গণতন্ত্রের প্রাথমিক রূপান্তর। তারপর দেখবো গণতন্ত্রের দ্বিতীয় পরিবর্তনটি। এর পর গণতন্ত্রের বিপক্ষদলের কাছ থেকে আমরা গণতন্ত্রের কিছু সমালোচনা শুনবো এবং সেগুলোকে খন্ডন করে যুক্তিগুলো শুনবো । সবশেষে গণতন্রের কিছু তত্বীয় বিষয় আলোচনা করে এর ভবিষ্যৎ রূপ কেমন হতে পারে সেটি নিয়ে লেখা থাকবে।

গণতন্ত্রের প্রাথমিক রূপঃ সরাসরি গণতন্ত্র বা নগরকেন্দ্রিক গণতন্ত্র

খুব সহজ ভাষায় যদি বলা হয় - কিছু মানুষ সব সময়ই এমন ধারণা পোষণ করতো যে সকল মানুষ রাজনৈতিকভাবে সমান এবং সমষ্টিগত ভাবে নিজেরাই নিজেদের শাসন করার ক্ষমতা রাখে এবং শাসন যন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা অথবা শাসনযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই থাকবে। এই ধারণার উৎপত্তি মূলত গ্রীক দেশে, এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে এথেনিয়ানদের। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরুর দিকে গ্রীসের কিছু ছোট ছোট নগর, যারা মূলত শাসিত হতো বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক শাসক, যেমন রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, স্বৈরশাসক কিংবা কতিপয়তন্ত্রের মাধ্যমে, তারা এমন একটি ব্যবস্থা গ্রহন করলো যেখানে নাগরিকগণ নিজেরাই নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় শাসনযন্ত্রও তারাই পরিচালনা করবে। সে জন্য তাঁদের নির্ধারিত সংসদ ছিল যেখানে নাগরিকগণ তাঁদের মতামত তুলে ধরবে এবং নিজের ভোট প্রদান করবে। এই ছিল গ্রীক সময়কার সহজ এবং সাধারন গণতন্ত্রের ধারণা যা আজকের আধুনিক গণতন্ত্রের মূলেও রয়েছে। এবার তাহলে দেখি গ্রীক গণতন্ত্রের রূপটি কেমন ছিল।

প্রাচীন গ্রীসের গণতান্ত্রিক ধারণার ছয়টি মূল উপাদান ছিলঃ

১। নাগরিকগণেরর মাঝে একরকম ঐক্য থাকবে যেন তারা নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এড়িয়ে সার্বিক ভালোর জন্য কাজ করতে পারে।
২। নাগরিকগণ হবে মানসিকগত, অর্থনৈতিকগত ভাবে বৈষম্যহীন।
৩। গণের আকার ছোট থাকবে অর্থাৎ গণতন্ত্র হবে নগরকেন্দ্রিক।
৪। গণতন্ত্রের ধরণ হবে সরাসরি (Direct democracy), অর্থাৎ প্রতিনিধিমূলক (Representative) নয়।
৫। প্রতিটি নাগরিককেই স্বল্প সময়ের জন্য হলেও শাসনযন্ত্রে অংশ গ্রহন করতে হবে।
৬। নগরটি হতে হবে স্বায়িত্বশাসিত।

গ্রীসের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতাঃ

যদিও আজকের মতো কোন প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব তখন ছিল না, কিন্ত পারিবারিক কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্কের জোরে তখনো ক্ষমতার অপব্যবহার লক্ষ্য করা গিয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যা ছিল যে উক্ত সময়ে গ্রীসের গণতন্ত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণ ছিল না। নারী, দাস, শিশু এদেরকে এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বাহিরে রাখা হয়েছিল যার ফলে সকল নাগরিক রাজনৈতিক ভাবে সমান এই তত্বটি এখানে সত্যিকারভাবে পালিত হয়নি। তাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হলেও ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র একশ্রেণীর নাগরিকদের মাঝে। দ্বিতীয় সমস্য ছিল যে সরাসরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ছোট ছোট নগরকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় কার্যকর, কিন্তু বেশ বড় নগর কিংবা পুরো দেশের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ততটা কার্যকর নয়। অনেক নাগরিকের সে ক্ষেত্রে সংসদে এসে নিজের মতামত তুলে ধরা সম্ভবপর হয় না।

গণতন্ত্রের দ্বিতীয় রূপান্তরঃ প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র বা দেশকেন্দ্রিক গণতন্ত্র

প্রজাতন্ত্রের ধারণাঃ

গণতন্ত্রের কাছাকাছি আরেকটি ধারণা একই সময়ে গড়ে উঠেছিল তা হল প্রজাতান্ত্রিক ধারণা। এই ধারণায় মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রাণী। একজন ভাল মানুষ একজন ভাল নাগরিক এবং একটি গণ হল কিছু ভাল নাগরিকের সমন্বয়ে করা সংস্থা। একজন ভাল নাগরিক হচ্ছে নাগরিকচেতনা গূণাবলি সম্পন্ন একজন মানুষ। প্রজাতান্ত্রিকদের মতে একটি সমাজে সকল মানুষ পুরোপুরিভাবে সমান নয়। তাঁদের মতে সমাজ বিভক্ত কতিপয়তান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক অংশে। সব সময় সমাজে লঘু এবং গরিষ্ঠের অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়। তার সাথে যুক্ত করা যেতে পারে এরিষ্টটলের মতে তৃতীয় অংশেরঃ একের শাসন বা রাজতন্ত্রের। প্রজাতন্ত্রের ধারণার মূলে হচ্ছে শাসন যন্ত্রের মাঝে এক, কতিপয় এবং বহু এই তিন অংশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একধরনের ভারসাম্য রক্ষা করা।

আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমরা এই চিন্তারই প্রতিফলন দেখতে পাই। যেমনঃ আমেরিকা কিংবা ইংলেন্ডে দেখি প্রেসিডেন্ট বা রানী যিনি একের প্রতিনিধিত্ব করে, উচ্চ-কক্ষ সংসদ যাঁদেরকে তুলনা করা যায় অভিজাতশ্রেণী বা কতিপয়শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে এবং সব শেষে নিম্ন-কক্ষ সংসদকে কল্পনা করা যায় গরিষ্ঠের প্রতিনিধি হিসেবে। প্রজাতান্ত্রিক ধারণা পৃথকভাবে আসলেও এটি আধুনিক গণতন্ত্রের দ্বিতীয় পরিবর্তনে বেশ বড় ভুমিকা রাখে। প্রজাতান্ত্রিক ধারণা আসে রোমের শাসন যন্ত্র হতে। কিন্তু তাঁদের শাসন যন্ত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ছিল না। সংসদের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত ছিল না। মূলত বংশগতভাবেই তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করতো। তাই ইতিহাসের এই সময়েও নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের ধারণাটি আসেনি। গ্রীকের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সাথে রোমানদের প্রজাতান্ত্রিক পদ্ধতির বড় পার্থক্য হল যে গ্রীকের ধারণায় সকল নাগরিক শাসন যন্ত্রে অংশগ্রহন করে আর রোমানদের ধারণায় বিভিন্ন প্রতিনিধিরা শাসন যন্ত্র নিয়ন্ত্রন করে।

প্রতিনিধিমূলক ধারণাঃ

গ্রীকদের ধারণা থেকে আমরা দেখি যে বড় আকারের গণের দিকে তাঁদের অনীহা ছিল, এবং তারা কখনোই প্রতিনিধিমূলক শাসনযন্ত্র তৈরী করেনি। ঠিক তেমনি রোমানরাও। এমনকি রোমান সাম্রাজ্যের আকার দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও সংসদই ছিল নিজের মতামত তুলে ধরার একমাত্র স্থান। যে কারণে যখন কেউ সংসদে যোগদান করতে অক্ষম হতো কোন কারণে, সে তার নিজের মতামত পাঠাতো কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে। তারপরেও সেটা বর্তমানের মত প্রতিনিধিমূলক শাসনব্যবস্থা ছিল না। প্রতিনিধিত্ব শুধু মাত্র সীমাবদ্ধ ছিল নিজের মতামত প্রদানের মাধ্যম হিসেবে।

বর্তমান প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থা বাস্তবে আসে প্রথম আঠারো শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের প্রথম গৃহযুদ্ধের পরে। এই প্রথম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, যাঁদের সেই সময় বলা হয় লেভেলার (Leveller) সমস্যায় পড়লো কিভাবে একটি দেশের মত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা যায়। তারা খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছিল যে সরাসরি গণতন্ত্র এই ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর হবে না। তখনই তারা নিয়ে আসে প্রতিনিধিমূলক পদ্ধতি, আরো পরিষ্কার ভাবে বললে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি মূলক গণতন্ত্র, যেখানে জনগণের পক্ষে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদের মতামত দিবেন, সিদ্ধান্ত গ্রহন করবেন। এর ফলে গণতন্ত্রের আকারের (size) যে সীমাবদ্ধতা ছিল সেটা দূর হয়ে গেল।

তবে প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিকরাই প্রথম উদ্ভব করে নি। প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা তারও আগে থেকে মধ্যযুগের রাজতন্ত্র এবং অভিজাততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিদ্যমান ছিল যেখানে বিভিন্ন দূর রাষ্ট্রে রাজার পক্ষে বিভিন্ন প্রতিনিধিরা শাসন পরিচালনা করতো এবং রাজ্যের সংকটকালীন (যুদ্ধ) অবস্থায় রাজাকে পরামর্শ প্রদান করতো। এই ধারণাটিই পরবর্তীতে গণতান্ত্রিকরা ধারণ করেন প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এর কয়েক যুগের মাঝে প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক এবং প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে সকলেই স্বাচ্ছন্দে গ্রহণ করেন।

গণতন্ত্রের সমালোচনাঃ

এই পর্বে থাকছে নৈরাজ্যবাদ* (Anarchism) ও অভিভাবকতন্ত্র (Guardianship) এই দু’য়ের পক্ষ হতে গণতন্ত্রের সমালোচনা এবং সেগুলোকে খন্ডন করে লেখকের দেওয়া যুক্তি। এই দু’টি মতবাদ থেকে গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী সমালোচনাগুলো এসেছে।

নৈরাজ্যবাদীদের পক্ষ থেকেঃ

নৈরাজ্যবাদীদের চিন্তার মূলে হচ্ছে - যেহেতু রাষ্ট্র মাত্রেই বলপ্রয়োগকারী এবং যেকোন ধরনেরর বলপ্রয়োগ যেহেতু কাম্য নহে তাই রাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপন করা উচিত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দিয়ে। রাষ্ট্রবিহীন সমাজ হচ্ছে সহজ দৃষ্টিতে নৈরাজ্যবাদীদের মূলমন্ত্র। নৈরাজ্যবাদীদের মাঝেও আবার নানান ভাগ রয়েছে। যেমন অনেকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রহীন অবস্থায় না গিয়ে সর্বনিম্ন পর্যায়ের রাষ্ট্রের কথা বলে, যেখানে রাষ্ট্রের কাজ হবে খুবই সীমাবদ্ধ। যেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও বল প্রয়োগ থাকবে তাই নৈরাজ্যবাদীদের মতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও কাম্য নয়। নৈরাজ্যবাদীদের আপত্তি মুলত বলপ্রয়োগের সম্ভাবনা থেকে। যেহেতু গণতন্ত্র মানে হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন তাই গণতন্ত্রের আরেক মানে হচ্ছে সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর বলপ্রয়োগ। বলপ্রয়োগ সরাসরি না হলেও আইন এবং শাসন যন্ত্রে সংখ্যাগুরুর মতামতের মাধ্যমে সেটা হয়ে থাকবে।

লেখক এখানে নৈরাজ্যবাদীদের যুক্তির জবাব দিয়েছেন এভাবে যে বল প্রয়োগ কোথায় থাকবে না? এমনকি যে রাষ্ট্রবিহীন সমাজ সেখানেও কি বল প্রয়োগ থাকবে না? ধরুন কোন রাষ্ট্র নেই, কিন্তু সমাজের কিছু লোক অন্যের ক্রমাগত ক্ষতি করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান সেই সব লোককে জোরপূর্বক আইনের ভীতি দেখানো অথবা জেলে দেওয়া। তার মানে এই দাঁড়ায় যে একদম রাষ্ট্রবিহীন সমাজেও বল প্রয়োগ থাকবে। এখন যদি বল প্রয়োগ অবধারিতই হয় তবে সেটা সংখ্যালঘুর শাসন না হয়ে সংখ্যাগুরুর শাসন হলেই বল প্রয়োগ সর্বনিম্ন হবে এবং তাই শাসন হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হওয়াই যুক্তিযুক্ত। যদিও নৈরাজ্যবাদীদের বলপ্রয়োগের যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয় তারপরেও গণতন্ত্রের ফলে যে সংখ্যালঘুদের উপর বল প্রয়োগের সম্ভাবনা রয়ে যায় সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যেন সংখ্যালঘুদের অধিকারও নিশ্চিত থাকে। পরবর্তীতে আমরা এটাই দেখবো যে প্রতিনিধিমূলক পদ্ধতি এবং সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থার দ্বারা সংখ্যালঘুদের উপর বলপ্রয়োগের সম্ভাবনাকে অনেকাংশে কমিয়ে দেওয়া হয়।

অভিভাবকতন্ত্রের পক্ষ থেকেঃ

গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি আসে অভিভাবকতন্ত্রের দিক হতে যে সাধারণ মানুষ নিজেরা নিজেদেরকে শাসনের জন্য পুরোপুরি যোগ্য নয় । এই দাবীর সর্বপ্রথম যে রূপকার তিনি হলে প্লেটো। তিনি তার “রিপাব্লিক” গ্রন্থে বলেছিলেন দার্শনিক রাজার কথা। পরবর্তীতে এরিষ্টটল থেকে শুরু করে বহুজনই ঘুরেফিরে এর কাছাকাছি বক্তব্য প্রদান করেন। সেই দিক দিয়ে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে অভিভাবকতন্ত্র। এর মূল কথা হল যে শাসন যন্ত্র এমন একটি জটিল যন্ত্র যেটা পরিচালনার জন্য যোগ্য মানুষের প্রয়োজন। কেউ বলেন একমাত্র দার্শনিকদেরই হওয়া উচিত রাষ্ট্রের শাসক, কারো মতে প্রতিভাবানদের, কেউ বলেন প্রকৌশলীবিদ, চিকিৎসাবিদ বা পেশাজীবিদের, কেউ বা বলেন মনোবিজ্ঞানীদের। আসল বক্তব্য হল যে সাধারণ মানুষেরা নিজেদের চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে সব সময়। যে কারণে তারা কখনোই সার্বিক বা সকলের ভালোর জন্যে কাজ করবে না। অন্য কথায় গণতন্ত্রের দ্বারা সঠিক পথে রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালিত হবে না। তাই শাসন যন্ত্র পরিচালনার ভার থাকা উচিৎ যোগ্য অভিভাবকদের হাতে। বহুজনের (Democracy) শাসন নাকি কতিপয় যোগ্যজনের শাসন এই বিতর্ক বহু পুরনো বিতর্ক। আসুন দেখি লেখক কী বলেন এই বিষয়ে।

লেখক এখানেও তাঁর যুক্তি তুলে ধরেছেন, উদাহরণ দিয়েছেন, কেন গণতন্ত্র অভিভাবকতন্ত্র হতে উত্তম সব সময়। মূল যুক্তিটি হল যে যোগ্য ব্যক্তিরা অবশ্যই সাধারণ মানুষের তুলনায় উন্নত (বা অধিকতর) জ্ঞান রাখেন কিন্তু কখনই উন্নতর নৈতিকতা ধারণ করেন না। এখন পরবর্তীতে লেখক দেখাচ্ছেন যে শাসন যন্ত্রের ক্ষেত্রে উন্নত জ্ঞানের যেমন প্রয়োজন আছে তেমনি রয়েছে উন্নত নৈতিকতারও প্রয়োজন। এবং একমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এই উন্নত নৈতিকতার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব। কিভাবে, একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

ধরুনঃ আমেরিকার পারমাণবিক বোমার ব্যবহার সম্পর্কে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। এখন অবশ্যই পারমাণবিক বোমার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিষদ জ্ঞান একজন সাধারন মানুষের তুলনায় একজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী বেশি রাখবেন। কিন্তু যখনই প্রশ্ন আসবে বোমার ব্যবহার সম্পর্কে, কোন কোন অবস্থায় বোমা ব্যবহার করা হবে অথবা কোন কোন স্থানে বোমাটি ব্যবহার করা হবে, কিংবা আদৌ মানুষের উপর ব্যবহার করা হবে কি না, এই ধরণের সিদ্ধান্তগুলো যখন আসবে সেগুলো কোন কারিগরী বিষয় নয়, সম্পূর্ণ নীতিগত বিষয়। এবং এই ক্ষেত্রে একজন সাধারণ মানুষের সাথে একজন দার্শনিক, কিংবা প্রতিভাবান কিংবা ট্যাকনোক্র্যাটদের তেমন কোন পার্থক্য নেই। তাই লেখকের প্রথম যুক্তি হচ্ছে যেহেতু নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সকল মানুষের নৈতিকতা কাছাকাছি, কারোরটা খুব বেশি উন্নত নয়, তাই তাঁদের (অভিভাবকদের অথবা যোগ্যদের) এমন কোন অধিকার নেই যে জনগণের পক্ষ হয়ে তারা তাঁদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারেন জনগণের উপর, যদি না তাঁরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়। অর্থাৎ একমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নীতিগত সিদ্ধান্তে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব, কতিপয় যোগ্য লোকের দ্বারা নয়।

এবার দ্বিতীয় যুক্তিটি হল, অভিভাবকতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে। যোগ্য লোকের শাসন, যদি সেটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির আওতায় না থাকে, তার প্রধান সমস্যা হচ্ছে যদি কোন কারণে সাধারণ মানুষের সাথে অভিভাবকদের মতের মিল না হয় তখন তাঁরা বল প্রয়োগের মাধ্যমে সেটাকে সাধারণের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। অভিভাবকগণ সেক্ষেত্রে জনগণের অনুভূতিকে বুঝতে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হন এবং তখন সেটা সংঘাতের সৃষ্টি করে। কিন্তু যদি অভিভাবকগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হতেন তবে এই সংঘাত এড়ানো সম্ভব হতো। কারণ হয় অভিভাবকগণ জনগণের অনুভূতিকে মূল্যায়ন করতো অথবা জনগণ তাঁদেরকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অপসারণ করতো। উদাহরণ হিসেবে আমরা ইতিহাসের দিকে যদি দেখি, লেনিনের ভ্যানগার্ড কিংবা চার্চের শাসন কিংবা মুসলিম খলিফাদের শাসন এক প্রকার অভিভাবকতন্ত্রই ছিল, কিন্তু তাতে সাধারণ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে সামান্যই। পরিশেষে, এই আলোচনা থেকে এটি আমরা পাই যে, হ্যাঁ যদি জনগণ শাসন যন্ত্রের যোগ্য না হয়ে থাকে তবে যোগ্য লোকদেরই শাসনে আসা উচিত, কিন্তু তাদেরকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে, অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নয়।

তাহলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির যৌক্তিকতা কী?

আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থা অথবা আদর্শ রাষ্ট্র কখনোই ছিল না এবং আশা করা যায় কখনো হবেও না। সুতরাং বাস্তব রাষ্ট্রে, বাস্তব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের মাঝে মতভেদ থাকবেই এবং একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই সম্ভব সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে সন্তুষ্ট করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল মানুষ রাজনৈতিক ভাবে সমান হিসেবে বিবেচিত হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল মানুষ সর্বোচ্চ ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারী হয়, যেমনঃ বাক স্বাধীনতার, যাকে খুশি ভোট দেওয়ার, যে কোন রাজনৈতিক দল সমর্থন করার ইত্যাদি। এই ব্যবস্থায় একজন মানুষ সর্বোচ্চ নৈতিক স্বাধীনতাও ভোগ করে। তাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির একটি বড় যুক্তি হচ্ছে যে - কোন একটি গোষ্ঠীতে বা সমাজে বা রাষ্ট্রে কোন একক ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তি অন্যান্য সকল সদস্যের তুলনায় এমনতর উন্নত নয় যে তাঁরা সকলকে শাসন করার অধিকার রাখে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এটা ধারণা রাখা হয় যে গোষ্ঠীর সকল সদস্য সমানভাবে যোগ্য এবং সিদ্ধান্ত প্রণয়নে সমান অধিকার রক্ষা করে। এটাকে লেখক বলেছেন রাজনৈতিক সমতার যুক্তি।

এবার আমরা দেখি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল উপাদান কী কী যা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল উপাদান পাচঁটি এবং এই পাচঁটি উপাদান আবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সমস্যাগুলোও তুলে ধরে।

১। কার্যকরী অংশগ্রহণঃ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকল সদস্যের কার্যকরী অংশগ্রহণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল কথা যেটা আমরা প্রাচীন গ্রীসের মডেলেও দেখতে পাই। যদি বিপুল সংখক মানুষ মতামত প্রদানে বিরত থাকে তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হবে না। একই সাথে চলে আসে তথ্যের অবাধ প্রবাহের বিষয়টি। যদি মতামত প্রদানের পূর্বে সমস্যা সম্পর্কে যথাযত ভাবে সকল সদস্য অবহিত না হয় তবে সে ক্ষেত্রেও প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত সার্বিক লক্ষ্যের জন্য কাজ করবে না। তাই সকলের কার্যকর্রী অংশগ্রহণ এবং মতামত প্রদানের পূর্বে সমস্যা সম্পর্কে যথাযত জ্ঞান রাখা গণতন্ত্রের প্রাথমিক মন্ত্র।

২। সমান ভোটাধিকারঃ রাজনৈতিক ভাবে সকল পূর্ণবয়স্ক নাগরিকেরই সমান ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। ধনী/গরীব, মেধবী/মিডিওকার, নারী/পুরুষ, সাদা/কালো, শ্রমজীবি/পেশাজীবি সকলের সমান ভোটাধিকার হচ্ছে গণতন্ত্রের আরেকটি মৌলিক উপাদান।

৩। ব্যক্তির বিচারবুদ্ধিতাঃ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সমস্যা সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বোঝার ক্ষমতা। যদি অধিকাংশ জনগণের সেই ক্ষমতায় ঘাটতি থাকে তবে সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থ হবে কাক্ষিত ফলাফল অর্জনে। এই সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করে আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে।

৪। এজেন্ডার পরিচালনাঃ কোন্‌ কোন্‌ সমস্যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে এটা যারা পরিচালনা করে, যেমন নির্বাচন কমিশন, তাঁদের কথা বোঝানো হচ্ছে এখানে। নির্বাচন কমিশন যদি যথেষ্ট স্বাধীন ও নিরপেক্ষ না হয় তবে জনগণের প্রকৃত মতামত না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৫। ইনক্লুসিভনেসঃ ভোটের অধিকার কারা কারা সংরক্ষন করবে সেটা নিশ্চিত করা। কিছু গোত্র বা শ্রেণীকে শাসনযন্ত্র হতে বাদ দেওয়ার চেষ্টা নানান সময়েই দেখা গিয়েছে । যেমনঃ বহুদিন নারীদের, কালোদের ভোটাধিকার ছিল না। এখন অবশ্য এই সমস্যাটি আর নেই। এখন যেকোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শিশু, সিদ্ধান্ত নিতে মানসিকভাবে অক্ষম এমন ব্যক্তি, এবং সাজাপ্রাপ্ত ব্যাক্তি ব্যতীত সকলেরই ভোটাধিকার রয়েছে।

উপোরক্ত পাচঁটি উপাদানের পরেও কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যা রয়ে যায়ঃ

সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বনাম সংখ্যালঘুর শাসনঃ

এটি একটি আদি সমস্যা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির। গনতন্ত্র মানে কি সংখ্যালঘুর উপর সব সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন? সহজ উত্তর - সরাসরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হ্যাঁ। প্রতিনিধিমূলক পদ্ধতিতেও হ্যাঁ, তবে কিছুটা কম। এটি কি কোনভাবে এড়ানো সম্ভব? এ ক্ষেত্রেও সরাসরি জবাব না। যে কোন বাস্তব রাষ্ট্রেই মতভেদ থাকবে এবং কারোর মতামত গ্রহণ করা হবে এবং কারোর মতামত উপেক্ষিত হবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মতামত গৃহীত হবে এবং এর দ্বারা সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের সন্তুষ্টি অর্জিত হবে।

তবে প্রশ্ন আসে কোন বিকল্প পদ্ধতি কি সম্ভব? যেমনঃ সকলের মতামতের ভিক্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কিংবা দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন-চতুর্থাংশের ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। সকলের মতামতের (১০০শত ভাগ) ব্যাপারে বলা হয় যে এটি একটি অসম্ভব ব্যবস্থা যে সকলেই কোন কিছুতে একমত হবে। সে ক্ষেত্রে যে কারোর হাতে ক্ষমতা রয়ে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের উপর তার নিজের সিদ্ধান্তকে চাপিয়ে দেওয়ার এবং সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর অবিচার হবে। একই যুক্তি খাটে দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন-চতুর্থাংশ ভোটের ব্যাপারে। তারপরেও বর্তমানে আমরা দেখি যে সংবিধান পরিবর্তনের মত মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে অনেক দেশেই দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন-চতুর্থাংশ ভোটের ব্যবস্থা রয়েছে।

তাহলে প্রশ্ন আসে, কিভাবে সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করা যায়। এর একটি জবাব হতে পারে জনপ্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র, যা সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করে না। এছাড়া অন্যান্য সংস্থা, যেমনঃ বিচার বিভাগ, সংবিধান এর দ্বারাও সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কার্যকরী হতো যদি সকল নাগরিকের মাঝে সামাজিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমতা থাকতো। কিন্তু বাস্তব রাষ্ট্রে যেহেতু সকলের মাঝে নানান ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান, তাই সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হলে সংখ্যালঘুরা সবসময় বঞ্চিত থাকতো। এ কারণেই আজ বেশিরভাগ দেশেই প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা দেখা যায়।

ব্যক্তিগত লক্ষ্য বনাম সার্বিক লক্ষ্যঃ

তাহলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির লক্ষ্য কী? গণতান্ত্রিক পদ্ধতির লক্ষ্য হল সকলের মতামতের ভিক্তিতে সার্বিক ভালোর জন্য কাজ করা। এখানে তাহলে প্রশ্ন জাগে সার্বিক ভালো বলতে আমরা কি বুঝি। সার্বিক ভালো হচ্ছে সেটাই যেটাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সন্তুষ্টি লাভ করা যায় এবং যেহেতু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত পাওয়া সম্ভব তাই এর মাধ্যমেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব। এখানে আরো প্রশ্ন জাগে কীভাবে এই সার্বিক ভালো অর্জন করা সম্ভব। লেখকের যুক্তি হচ্ছে একটি গণ হচ্ছে কতিপয় সদস্যের সমন্বয়ে গড়া একটি সংস্থা যেখানে সকল সদস্য বুদ্ধিগতভাবে, অর্থনৈতিক ভাবে, সামাজিক ভাবে সমান বা প্রায় কাছাকাছি (Homogenous)। অর্থাৎ সদস্যদের মাঝে মতভেদ প্রকট নয়। এমন একটি গণের ক্ষেত্রে যখন প্রতিটি সদস্য যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করবে সে চিন্তা করবে নিজের লাভের কথা এবং সেই ভিক্তিতেই নিজের মতামত প্রদান করবে। এখন প্রতিটি নাগরিক যদি এভাবে নিজের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য মতামত দেয় এবং তাঁদের মাঝে যদি বৈষম্য কম থাকে তবে সেই মতামতের ভিক্তিতে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে তাতে সার্বিক সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে এবং এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের দ্বারা সার্বিক ভালোর লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে। তাহলে এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হচ্ছে যে যদি সদস্যদের মাঝে বৈষম্য (বুদ্ধিগত, অর্থনৈতিকগত, সাংস্কৃতিকগত, জাতিগত ইত্যাদি) প্রকট হয় তবে সবাই নিজ নিজ উদ্দেশ্যে মতামত প্রদান করলে সার্বিক লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভবপর হবে না, যা আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য।

সরাসরি গণতন্ত্র বনাম প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র বনাম সাংবিধানিক গণতন্ত্র বনাম বহুসংস্থার শাসনঃ

আমরা দেখি যে সরাসরি গণতন্ত্রের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরাসরি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যার ফলে সংখ্যালঘু সব সময় নিগৃহীত থাকার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এছাড়া সরাসরি গণতন্ত্র বড় আকারের গণের পক্ষে ততটা কার্যকরী নয়। গণের আকার বড় হয়ে গেলে সকলের কার্যকরী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভবপর হয়ে উঠে না, সে ক্ষেত্রে জনগণের প্রকৃত মতামত না পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। এ কারণে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় পরিবর্তনে আমরা দেখি প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা। প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থার ফলে গণের আকারের সীমাবদ্ধতা আর থাকে না। কিন্তু প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থাও সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করে না। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক ব্যবস্থা অধিকতর কার্যকরী। কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থাকে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিক্তিতেই সংবিধান রচিত হয় তবে সেটা কীভাবে সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করবে? এই ক্ষেত্রে আসে বহুসংস্থার শাসন** (Polyarchy) যেখানে ক্ষমতা শুধু জনপ্রতিনিধি কিংবা সংসদেই সীমাবদ্ধ থাকে না, ক্ষমতার বেকেন্দ্রীকরণ ঘটে নানান স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার হাতে। এমনই কিছু সংস্থা হচ্ছেঃ বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন মিডিয়া ইত্যাদি। এটিকে বলা হয় গণতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর যা আমরা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করবো।

গণতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর বা বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র ঃ

আমরা এটি আগেই আলোচনা করেছি যে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় রূপান্তরের একটি মূল প্রাপ্তি হলো প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা। এর ফলে সরাসরি গণতন্ত্রের যে আকারগত সীমাবদ্ধতা ছিল সেটি নিমিষেই দূর হয়ে গিয়েছে। নগরকেন্দ্রিক গণতন্ত্র থেকে আমরা চলে যাই এখন দেশকেন্দ্রিক গণতন্ত্রে। কিন্তু এর ফলে এখন কিছু নুতন সীমাবদ্ধতার উদ্ভব হয়েছে। প্রথমতঃ প্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতি কী হবে কিংবা ক্ষেত্র কী হবে? নির্বাচন কি পপুলারিস্টিক ভোটের মাধ্যমে হবে নাকি ভোটের হার অনুপাতে হবে? দ্বিতীয়তঃ নাগরিকদের সরাসরি শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ যা গ্রীক গণতন্ত্রের মূলে ছিল সেটা এখন আর সম্ভব নয়। তৃতীয়তঃ রাষ্ট্রের আকার বৃদ্ধির ফলে নাগরিকদের মাঝে বৈচিত্র আরো বেড়ে যায় এবং যার ফলে মতভেদ আরো তীব্র হয়, শাসন ব্যবস্থা আরো জটিলতর হয়।

বৃহৎ আকারের গণতন্ত্রে শাসনযন্ত্রকে সঠিক ভাবে পরিচালিত করার লক্ষ্যে গণতন্ত্রের মাঝে আরো এক ধরনেরর রূপান্তর ঘটে। তৈরী হয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, জন্ম নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের। এর ফলে শাসন যন্ত্র শুধু প্রতিনিধিদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না, ক্ষমতার বন্টন ঘটে নানান প্রতিষ্ঠানের হাতে যারা নিজেরা হয়ে উঠে স্বায়ত্বশাসিত। এভাবে সৃষ্টি হয় বহুসংস্থার শাসন। এমনই কিছু সংস্থা হচ্ছেঃ বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন মিডিয়া ইত্যাদি। বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রকে লেখক বলেছেন গণতন্ত্রের সর্বোচ্চরূপ, যা আমরা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির মাঝে দেখতে পাই।

বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের মৌলিক সাতটি উপাদান লক্ষ্য করা যায়ঃ

১। নির্বাচিত প্রতিনিধি ২। প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ৩। ইনক্লুসিভ সাফরেজ (Inclusive Suffrage) ৪। নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার
৫। বাক স্বাধীনতা ৬। বিকল্প তথ্যের অধিকার ৭। স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা

তাহলে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের উদ্ভব কীভাবে হয়ে থাকে?

যদিও বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র বড় আকারের জনগোষ্ঠীর জন্য গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রুপ তথাপি সকল দেশে এই শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। তাহলে কীভাবে এই শাসনতন্ত্র গড়ে উঠে? তার আগে আমরা ধারণা করি যে এক বা একাধিক অনুকূল পরিস্থিতিতে আমরা নিম্নোক্ত তিন ধরনের শাসন ব্যবস্থা পেতে পারি।

যদি পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে অনুকূল হয় তবে
১। NPR (Non Polyarchy Region) -> PR (Polyarchy Region)
যদি পরিস্থিতি অনুকূল না হয় তবে
২। NPR -> NPR
যদি পরিস্থিতি মাঝামাঝি হয় তবে
৩।(ক) NPR ->PR -> NPR
(খ) NPR -> PR -> NPR -> PR
(গ) NPR->PR->NPR->PR->NPR->PR-> ………(দোদুল্যমান)

তাহলে কি সেই অনুকূল পরিস্থিতিঃ

১। বল প্রয়োগের যন্ত্রগুলোর ক্ষমতার কেন্দ্রঃ রাষ্ট্র সাধারণত বল প্রয়োগ করে থাকে পুলিশ এবং সামরিকবাহিনী দ্বারা। তাই এটি দেখার বিষয় যে এই দু’টি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কাঁদের হাতে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বড় শর্ত হচ্ছে এই দু’বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত বেসামরিক ব্যাক্তির হাতে যিনি গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত। সাম্প্রতিক আফগানিস্তানে আমেরিকার সেনকমান্ডারের আপসারনের চিত্রটি এখানে দ্রষ্টব্য হতে পারে। তবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও বিপক্ষ মতের দমনে বল প্রয়োগ করতে পারে। তাই গণতান্ত্রিক ভাবে তাঁদের অপসারণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

২। আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজঃ ঐতিহাসিক ভাবে দেখা যায় যে, যে সব সমাজে জনগণের আয়ক্ষমতা অধিক, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক, উন্নতর জীবন ব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্রে অবাধ বৈচিত্র, উন্নত শিক্ষার হার, ক্ষুদ্র কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠী, উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন বৃহৎ জনগোষ্ঠী, অধিকতর সংখ্যক স্বায়ত্বশাসিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অধিকতর সংখ্যক পেশাজীবি, ইত্যাদির হার বেশি সেই সব সমাজে বহুসংস্থার শাসন তন্ত্রের দেখা পাওয়া যায় বেশি। এ ধরণের সমাজকেই লেখক আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী (MDP: Modern, Dynamic and Pluralism) সমাজ হিসেবে বলেছেন। কেন এই ধরণের সমাজ বহুজনের শাসনতন্ত্রের জন্য সহায়ক? প্রথমতঃ নানান শিক্ষিত ও স্বনির্ভর জনগোষ্ঠীর কারণে ক্ষমতার পেছনের শক্তিগুলো নানান ক্ষেত্রে ছড়িয়ে যায়। যার ফলে কোন একক ব্যক্তি বা কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে সকল ক্ষমতা থাকা সম্ভবপর হয় না। দ্বিতীয়তঃ স্বনির্ভরতা ও শিক্ষা মানুষকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দিকে পরিচালিত করে।
তারপরেও প্রশ্ন থাকে যে অনেক দেশই পুরোপুরি আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজ না হওয়া সত্বেও বহুসংস্থার শাসন এসেছে। উদাহরণ হিসেবে ভারত, বাংলাদেশের কথা বলা যেতে পারে। ভারত, বাংলাদেশ সে রকম আধুনিক, উন্নত দেশ না হওয়া সত্বেও সেখানে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র বিদ্যমান। এই সব দেশে বহুসংস্থার শাসন এসেছে তাদের উপনেবেশিক শাসকগোষ্ঠী (বৃটিশ শাসন) হতে। তাই বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের জন্য আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজই একমাত্র উপায় এ কথাও জোর করে বলা যায় না।
আবার আধুনিক, গতিসম্পন্ন ও বহুত্ববাদী সমাজ হলেও যে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র টিকে থাকবে তাও নয়। বলপ্রয়োগের যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ কাঁদের হাতে সেটি একটি মূল বিষয় যা আগের অংশে বলা হয়েছে। সামরিকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ যদি গণতান্ত্রিক প্রতিনিধির হাতে না হয় তবে যেকোন সময় সেই সমাজে অগণতান্ত্রিক সরকার চলে আসতে পারে। এ ছাড়া, একটি দেশে যদি বিভিন্ন জাতিগত দ্বন্দ্ব থাকে তবে সে ক্ষেত্রেও গণতন্ত্র বাধাগ্রস্থ হয়ে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা গৃহযুদ্ধের আকার ধারণ করে। বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের সম্ভাবনা অনেক কমে যায় যদি জাতিগত বিভেদ প্রকট হয়। এই সব ক্ষেত্রে সকল জাতিকে নিয়ে একধরণের ঐক্যমতের সরকার গঠণ কার্যকরী হয়ে থাকে । অথবা প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীকে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন দিতে হয়। ভারতের ক্ষেত্রে এই কারণেই এত জাতিগত বৈচিত্র থাকা সত্বেও গণতন্ত্রের ভিত ওদের শক্ত। জাতিগত বিভেদ টিকিয়ে রেখে কোনভাবেই বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। জাতিগত বিভেদ ছাড়াও বহিঃশক্তি গণতন্ত্রের একটি নিয়ামক। যদি বহিঃশক্তি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে সমর্থন জুগিয়ে চলে তবে একটি দেশে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্থ হয়।

পরিশেষে, একটি রাষ্ট্রে যদি সামরিক ও পুলিশ বাহিনী নিরপেক্ষ থাকে, যদি আধুনিক ও উন্নত সমাজ ব্যবস্থা থাকে, যদি জাতিগত বিভেদ বা জনগণের মাঝে মতভেদ প্রকট না থাকে, যদি বহিঃশক্তির প্রভাব না থাকে এবং রাজনৈতিক সংস্থাগুলো বহুসংস্থার শাসনে বিশ্বাস ও চর্চা করে তবে সেই রাষ্ট্রে বহুসংস্থার শাসনের উদ্ভব হবে এবং সেটি টিকে থাকবে।

আগামী দিনের গণতন্ত্রঃ

প্রায় দু’সহস্র বছরের অধিক পূর্বে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার চালু হয়েছিল যেখানে সকল সদস্য একে অন্যের তুলনায় রাজনৈতিক ভাবে সমান এবং সমষ্টিগত ভাবে নিজেরাই নিজেদের শাসন যন্ত্রের নিয়ন্ত্রক ছিল। এই ব্যবস্থা অন্যান্য যে কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনায় উৎকৃষ্ট ছিল কারণ- প্রথমতঃ এই ব্যবস্থা সর্বোচ্চ ব্যাক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে, দ্বিতীয়তঃ এই ব্যবস্থা মানব সভ্যতার উন্নয়ন করে, তৃতীয়তঃ মানুষের সার্বজনিন ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করার এটাই সবচেয়ে উন্নত পন্থা ।
গণতন্ত্রের প্রথম রূপান্তরটি ঘটে গণতন্ত্র অথবা প্রজাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্রকে দূর করে ক্ষমতার কেন্দ্রে জনগণকে নিয়ে আসার মাধ্যমে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা ছিল মূলত ক্ষুদ্র নগর কেন্দ্রিক এবং সরাসরি গণতন্ত্র। দ্বিতীয় রুপান্তরটি ঘটে যেখানে প্রতিনিধিমূলক গনতন্ত্রের মাধ্যমে নগর কেন্দ্রিক গণতন্ত্র হতে দেশ কেন্দ্রিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। বৃহৎ আকারের শাসন যন্ত্রের কাজ যথাযত ভাবে সম্পন্ন করার জন্য উদ্ভব হয় শাসন যন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগ, যেমনঃ সংসদ, আদালত, নির্বাচন কমিশন। একে আমরা বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের (polyarchy) প্রথম রূপ বলতে পারি।

শাসন যন্ত্রের ধরন আরো জটিলতর আকার ধারণ করলে নির্বাচিত প্রতিনিধির পক্ষে সকল সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে অনির্বাচিত প্রতিনিধি যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ। তৈরী হয় বিভিন্ন অভিজ্ঞ কমিটি। এটি একধরণের ছদ্ম অভিভাবকত্ব যেখানে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিজেদের ইচ্ছা জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে না কিন্তু জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের উদ্দেশ্য জনপ্রতিনিধিদের সাথে কাজ করছে। বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসিত মিডিয়া কিংবা জনগোষ্ঠী নানান ভাবে জনপ্রতিনিধিগণকে উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে থাকে। এই ধরণের ব্যবস্থাকে আমরা বলতে পারি বহুসংস্থার শাসন যন্ত্রের দ্বিতীয় রূপ। এটিই এই পর্যন্ত গণতন্ত্রের আধুনিকতম রূপ যা আমরা সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেখে থাকি।

এখন বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের তৃতীয় রূপান্তর কি অবশ্যাম্ভাবী? লেখকের মতে এটি হতে পারে সাধারণ জনগণের সাথে রাজনৈতিক এলিটদের যে জ্ঞানের ব্যবধান রয়েছে সেটিকে কমিয়ে। ক্ষমতায় আরোহীরা সাধারণ জনগণের চেয়ে অধিকতর বোঝদার সেটা নয় বরং তাঁরা সাধারণ জনগণের চেয়ে বেশি তথ্য পেয়ে থাকেন। যদি জনগণের কাছে সকল তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করা যায় তবে জনগণও সঠিক ভাবে যে কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারতো। তাই তথ্যের বিকল্প ব্যবস্থার উপর লেখক জোর দিচ্ছেন এবং অভিবাবকদের উপর নির্ভিরতা কমিয়ে জনগণের উপর নির্ভরতা বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছেন। লেখকের মতে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের শেষ ধাপ হবে যখন জনগণের সরাসরি অংশ গ্রহণেরর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রতিফলিত হবে, অনেকটা প্রাচীন গ্রীসের সরাসরি গণতন্ত্রের মত।

এই অংশের মাঝে দিয়ে বইটির মূল অংশের অনুবাদ শেষ হলো।

আমার নিজস্ব কিছু বিশ্লেষণঃ

এই বইটির মূল অংশ যে কারণে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি তা হল লেখকের যুক্তিবোধ। গণতন্ত্রের প্রতিটি সীমাবদ্ধতাকে লেখক এখানে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন এবং সেগুলোকে সমাধানের চেষ্টা করেছেন। প্রথমত যেটা করেছেন ইতিহাসের আলোকে গণতন্ত্রকে দেখেছেন এবং গণতন্ত্রের প্রধান পরিবর্তনগুলোকে চিহ্নিত করেছেন। অতঃপর গণতন্ত্রের প্রধান সমালোচক, প্রতিদ্বন্দ্বী নৈরাজ্যবাদ এবং অভিবাবকতন্ত্রের চোখ দিয়ে এর সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করেছেন এবং যুক্তি দিয়ে স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন কেন গণতন্ত্র অন্যান্য যে কোন শাসন ব্যবস্থা হতে সর্বোৎকৃষ্ট। যোগ্য লোকের শাসন নাকি সাধারণ জনগণের শাসন – বহুল আলোচিত এই প্রশ্নের কিছু জবাব আমরা এখানে পাই। লেখক শুধু এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল উপাদান, এর নিয়ামকগুলোকে তুলে ধরেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কেন যৌক্তিক, এবং কীভাবে প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা হতে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের উদ্ভব হল সেটি দেখিয়েছেন। সাথে দেখিয়েছেন বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রের সহায়ক শক্তিগুলো কী কী এবং কেনই বা কোন কোন দেশে এই শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে কিন্তু অন্য কোন দেশে নয়। বহুসংস্থার শাসন ব্যবস্থাকে তিনি চিহ্নিত করেছেন আধুনিক গণতন্ত্রের সর্বোচ্চরূপে। তারপরে লেখক দেখিয়েছেন যে এই ব্যবস্থাকেও আরো উন্নত করা সম্ভব যদি সাধারণ মানুষকে শাসনযন্ত্রে আরো জড়িত করা যায়, জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ আরো বাড়ানো যায়। সে কারণে জনগণের কাছে তথ্যের সহজগম্যতার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি মূলত জনগণকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে প্রাচীন গ্রীসের মূল গণতান্ত্রিক মডেলেই ফিরে যাবার একটি স্বপ্ন দেখেছেন।

এটি একটি বড় প্রশ্ন, আমরা কি আসলেই প্রাচীন গ্রীসের সেই সরাসরি গণতন্ত্রে ফিরে যেতে পারি। এর তাত্ত্বিক জবাব হতে পারে আজকের এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে একটি দেশের এর মত বৃহৎ আকারের গণের ক্ষেত্রেও এখন সরাসরি গণতন্ত্র সম্ভব। কিছুদিন আগেও আমাদের হাতে উন্নত প্রযুক্তি ছিল না যার মাধ্যমে নিমিষে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মতামত গ্রহন করা সম্ভবপর হতো। কিন্তু আজকের এই মিডিয়া, মোবাইল, ফোন, ইন্টারনেট এর যুগে কয়েক ঘন্টার মাঝেই যেকোন আকারের জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত জানা সম্ভব। তাই তাত্ত্বিক জবাব হল, হ্যাঁ, সরাসরি গণতন্ত্র এখন সম্ভব। তার উপর বিভিন্ন কারণেই আজ প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র মানুষের সার্বজনিন ইচ্ছার প্রতিফলেন ব্যর্থ হচ্ছে। মানুষের মাঝে আজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি এক ধরণের হতাশা দেখা যাচ্ছে। তবে কি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে সরাসরি গণতন্ত্রই হবে আমাদের পরবর্তী রূপান্তর?

কিন্তু সরাসরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কথা আমরা জানি। রাষ্ট্রের প্রতিটি কাজে যদি জনগণের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তবে সেটা বাস্তবসম্মত ও কার্যকরী হবে কি? আবার সরাসরি গণতন্ত্রের জন্য নাগরিকদের মাঝে বৈষম্য প্রকট না হওয়া উচিত। কিন্তু যে কোন বৃহৎ আকারের জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকবেই। তাই সরাসরি গণতন্ত্র এখনো বাস্তব সম্মত নয়। তাই এর একটি সমাধান হতে পারে প্রতিনিধিমূলক ও সরাসরি গণতন্ত্রের এক মিশ্র ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজ জনগণের পক্ষ হতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা করে যাবেন জনগণের দ্বারা রচিত বিধিমালা (সংবিধান) মোতাবেক। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা কখনই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে না। কেন্দ্রে থাকবে জনগণ। যে কোন মুহুর্তে, যে কোন জনপ্রতিনিধিকে জনগণ অপসারণ করতে পারবে, তাদের ভোটের মাধ্যমে। যেকোন ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে জনগণ, সরাসরি ভোটের মাধ্যমে। এই ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও বিভিন্ন স্বাধীন সংস্থাগুলো জনগণকে সহায়তা প্রদান করবে। বর্তমান পদ্ধতির সাথে এই নুতন পদ্ধতির একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে যে কোন জনপ্রতিনিধিকেই দীর্ঘমেয়াদের জন্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। অনেকটা চাকুরীর ক্ষেত্রে যেমন বছর বছর কাজের মূল্যায়নের উপর নির্ভর করে চাকুরীর নবায়ন করা হয় সেরকম। এ রকম প্রতি ছয় মাস বা প্রতি এক বছর বা যে কোন সময়েই যে কোন জনপ্রতিনিধির কাজের মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকবে। কেউ ভাল কাজ করলে তিনি আজীবন থাকবেন, না হয় নুতন প্রতিনিধি আসবে। এভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব এবং জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল তথ্যের বিকল্প ব্যবস্থার পথ নিশ্চিত করা। জনগণকে ক্ষমতার কেন্দ্রে রাখতে হলে, জনগণের কাছ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত পেতে হলে তথ্যের অবাধ প্রবাহের বিকল্প নেই। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি এই ক্ষেত্রেও সহায়ক হতে পারে। প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠনের তথ্য যদি অন্তর্জাল, পত্রিকা, মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌছানো সম্ভব হয় তবে জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদানে ভুল করবে না এবং এর দ্বারা জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতাও নিশ্চিত করা সম্ভব।

গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ভিন্ন অন্য কোন উন্নতর শাসন ব্যবস্থা সম্ভবপর নয়। তাই শুধু প্রয়োজন এর সীমাবদ্ধতাগুলোকে দূর করে ব্যবস্থাটিকে আরো উন্নত করা। জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতার মাধ্যমে, জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধের মাধ্যমে, জনগণের হাতে মূল ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে আমরা গণতন্ত্রকে আরো সুসংহত করতে পারি। বহুসংস্থার শাসন, ই-গভর্নমেন্ট, ই-ভোটিং, আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচন, ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ আরো বৃদ্ধি করা উচিত যেন জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে না থেকে জনগণই ক্ষমতার প্রকৃত কেন্দ্রে থাকে। গণতন্ত্র আরো সুসংহত হোক এই আশা ব্যক্ত করে লেখাটি এখানেই শেষ করছি।

* Anarchism এর বাংলা অনুবাদ সবখানেই লেখা হয় নৈরাজ্যবাদ, তাই আমিও এটাই ব্যবহার করছি, যদিও আমার কাছে এই অনুবাদটি যথার্থ মনে হয় না। আমার মতে এর যথার্থ হতে পারে রাষ্ট্রহীনতাবাদ বা রাষ্ট্রহীনতন্ত্র, এই জাতীয় কিছু। কারণ Anarchy এর মানে আসলে হচ্ছে শাসকবিহীন (no ruler or absence of government)। নৈরাজ্য কেমন যেন নেগেটিভ অর্থ বহন করে।

** Polyarchy এর অনুবাদ গুগুল ডিকশনারি দেখায় বহুজন কর্তৃক শাসনব্যবস্থা বা বহুশাসনতন্ত্র। কিন্তু আমার কাছে বহুসংস্থার শাসনতন্ত্রকেই সঠিক বলে মনে হয়েছে এর চরিত্র দেখে। বহুজন শাসনতন্ত্র এক প্রকার গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্য। তাই আমি Ployarchy এর অনুবাদ বহুসংস্থার শাসনতন্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করেছি।

নোটঃ এই লেখাটি “গণতন্ত্র ও এর সমালোচনা” (Democracy and its critics (Dahl R. A., 1989)) এই বইটির কিছু মূল অংশ নিজের মত করে লেখা।

Wednesday, March 17, 2010

গণতন্ত্র নাকি অভিজাততন্ত্র?

আজ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই গণতন্ত্র বিদ্যমান এবং গণতন্ত্রকে আজ শাসন ব্যবস্থার মধ্য সর্বোৎকৃষ্ট মডেল বলে ধরা হয়। জনগণও খুশি এ কারণে যে অন্তত অন্ধকার যুগের দাসত্ব আজ তাঁদের সামনে নেই, নেই মধ্যযুগীয় কোন জমিদারী প্রথা কিংবা নেই কোন উপণিবেশিক শাসন অথবা কোন স্বৈরশাসন। জনগণ মুক্ত এবং স্বাধীন। আসলে কি তাই? বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষ আসলে কতটা মুক্ত এবং স্বাধীন নিজের ভাগ্য উন্নয়নে? রাষ্ট্র কতটা মনযোগী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে? কিংবা জনগনই কতটা সক্ষম নিজদের ভাগ্যের রচনায়? এই সব কিছুর প্রশ্নের উত্তর আজ এই লেখায় খুঁজে পাবার চেষ্টা করবো।

ডিরেক্ট বা সরাসরি গণতন্ত্র রাষ্ট্রের মত বৃহৎ পরিসরে তেমন কার্যকরী না হওয়ায়, রিপ্রেজেন্ট্যাটিভ বা প্রতিনিধিমুলক সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার আবিষ্কার গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই পদ্ধতিতে একদল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি জনগণের পক্ষ হয়ে জনগণের জন্য কাজ করবে। তবে এই পদ্ধতির সাফল্য নির্ভর করছে সঠিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থার উপর।

পরিসংখ্যানের নিয়ম অনুসারে যখন কোন বৈজ্ঞানিক গবেষনার জন্য কোন নমুনা (Sample) সংগ্রহ করা হয় তখন চেষ্টা থাকে যেন নমুনা উপস্থিত সকল বৈচিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। আবার দেখা যায় নমুনার সংখ্যা যত বেশি হয় প্রতিনিধিত্বের সম্ভাবনাও তত বেশি হয়। তবে নমুনা সংগ্রহের খরচ এর সংখ্যার সাথে সমানুপাতিক হওয়ায়, গবেষনার খরচ এবং প্রতিনিধিত্বের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে নমুনার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এখানে যে উদাহরণ দিয়েছি সেটা আমরা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই বুঝে বা না বুঝেই প্রয়োগ করে যাই। চাওয়া বা পাওয়া, হাসি বা কান্না, আয় বা ব্যায়ের মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখেই জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাই। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও আমাদের নির্ধারণ করতে হয় জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ঠিক কত হলে তা জনগনের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করবে কিন্তু তা আবার রাষ্ট্রের জন্য বোঝা স্বরূপ হয়ে উঠবে না।

যত সহজে উদাহরণ দিয়েছি প্রকৃত ক্ষেত্রে তা খুব সহজ নয়। তেমন কোন নির্দিষ্ট সুত্র নেই যা দিয়ে সরাসরি বলে দেওয়া সম্ভব ঠিক কত জন জনপ্রতিনিধি একটি রাষ্ট্রে প্রয়োজন। এ ছাড়াও রয়েছে প্রতিনিধি নির্বাচনের নানান ক্ষেত্রগুলো। বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় জনসংখ্যার অনুপাতে কিংবা অঞ্চল ভেদে। অঞ্চলগুলো মুলত ভাগ করা হয় জনসংখ্যার ভিক্তিতেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মুলত এভাবেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়।

গণতন্ত্রের যাত্রাকাল প্রায় ২৫০০ বছর আগে হলেও গনতন্ত্রের আধুনিক রুপের বয়স কয়েকশত বছরের বেশি নয়। তাই বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি নির্ভুল সেটা বলা সম্ভব নয়। গণত্নত্রের নির্দিষ্ট কোন ছাঁচ নেই যা স্থান/কাল/দেশ ভেদে একই রকম থাকবে। উন্নত বিশ্বে যে গণতান্ত্রিক মডেল কার্যকর, একই মডেল যে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশেও কার্যকর হবে তা নয়। বর্তমান জনপ্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থা পাশ্চাত্য দেশগুলোতে কার্যকরী বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হলেও আমার মতে তা সঠিক নয়। যে কারণেই দেখি মানুষ আশাহত হয়ে বারংবার জনপ্রতিনিধি পরিবর্তন করে কিন্তু মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত মানুষের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না।

দেশে বসে হয়তো মনে হয় বৈদেশে সবাই বেশ ভাল থাকে, কিন্তু বাস্তবতা দেশের থেকে ভিন্ন কিছু নয়। এখানেও মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তকে সারা জীবন কঠিন পরিশ্রমের মাঝে দিয়ে যেতে হয় শুধু মাত্র ভাল ভাবে বেঁচে থাকাটুকু নিশ্চিত করার জন্য, একটি বাড়ির জন্য, বুড়ো বয়সে একটু বিশ্রামের জন্য। কিন্তু যদি কোন কারণে আপনার উপার্জনের ব্যবস্থা চলে যায় কিংবা অসুস্থ হয়ে উপার্জনে অক্ষম হয়ে পড়েন তবে তার অবস্থা দেশের যে কোন মধ্যবিত্তের চেয়ে কন অংশেই ভাল নয়। এটা সত্য যে কিছু দেশে সরকারী ব্যবস্থা রয়েছে সেই সব মানুষের জন্য কিন্তু সে রকম দেশের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

পাশ্চাত্যের আসল চিত্রটি তুলে ধরার উদ্দেশ্য এটা বুঝানো যে বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করে না, করে মুষ্টিমেয় লোকের ভাগ্য উন্নয়ন। গ্রীক দার্শনিক এরিষ্টটলের মতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যস্থা হচ্ছে সকল শাসন ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ব্যবস্থা। যুক্তি ছিল যে গনতন্ত্র হল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কিন্তু একই সাথে তা হল গরীব লোকের শাসন, কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেনী হচ্ছে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত শ্রেনী। এরিষ্টটলের পছন্দ ছিল অভিজাত শ্রেনীর শাসন।

এবার তাহলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনপ্রতিনিধিদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। যে কোন দেশেই আজ কারা হচ্ছে জনপ্রতিনিধি? যে কোন দেশের জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি যদি গড় করা হয় তবে তাঁদের সেই গড় আয় সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের গড় আয়ের মাঝে কি পরে? আমি নিশ্চিত এর উত্তর এক কথায় নেতিবাচক। আর এই চিত্র আরো করুণ আকার ধারণ করে অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশেগুলোতে। সেসব দেশের জনপ্রতিনিধিদের গড় আয় সাধারণ জনগণের চেয়ে কয়েকশত গুণ বেশি হবে নিশ্চিত। তাহলে এই জনপ্রতিনিধিরা যে আইন প্রণয়ন করবে বা যে নীতি প্রণয়ন করবে তাতে যে নিজদের মত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করবে সেটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? এই জনপ্রতিনিধিরাই যে মুখে মানবতার কথা বলে, অন্য দেশে মরণাস্ত্র খোঁজার ছলে নিরীহ মানুষের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিবে সেটা কি বুঝতে খুব বেশি কষ্ট হয়? এরাই যে জনগণের সেবার নামে ক্ষমতার জন্য লাশের রাজনীতি করে তা কি আর বুঝার বাকি রাখে। বলে শেষ করার নয়। এই চিত্র যে শুধু বাংলাদেশে, সেটা ভেবে নিলে কিন্তু ভুল হবে। তাকিয়ে দেখুন বিশ্বের কোন দেশে ক্ষমতার জন্য এ রকম নির্লজ্জতা নেই। জনপ্রতিনিধি আজ একটি ভিন্ন শ্রেনী, এবং জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া আজ একটি লাভজনক পেশা হিসেবে দাড়িয়েছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উলটো। জনপ্রতিনিধি হওয়ার কথা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পক্ষে কাজ করার জন্য।

বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়া এমন যে নির্দিষ্ট একটি গোত্রের বাহিরে যে কেউ নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে না। যদিও আইনগত ভাবে যে কারোরই নির্বাচনে অংশগ্রহনে বাধা নেই, কিন্তু মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে আমরা এমন একটি ব্যবস্থা করে রেখেছি যে সকল ক্ষেত্রে অর্থের কাছে বন্দী মানুষ। এই অর্থের সিংহ ভাগ নিয়ন্ত্রিত হয় ব্যবসায়ী শ্রেনীর দ্বারা। এর ফলে নির্বাচন ব্যবস্থাকে এক প্রকার এই ব্যবসায়ীরাই নির্ধারণ করে। রাজনীতিবিদদের এই দুরাবস্থার চিত্রটি কিছুটা তুলে ধরেছেন বারাক ওবামা তার “The Audacity of Hope” বইটিতে।

আমাদের দেশের অবস্থা আরো করূণ। আপনি যদি সরকারী চাকুরীজীবি হোন তবে আপনাকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে হলে আপনার পেশা ছেড়ে চলে আসতে হবে। আবার এমন না যে আপনার মেয়াদ শেষে আপনি আবার আপনার চাকুরীতে ফেরত চলে গেলেন। অর্থাৎ ব্যবস্থা এমনই যে যারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে জন্মগ্রহন করেছে কিংবা জনপ্রতিনিধিদের ঘরে জন্মগ্রহন করেছে তারাই জনপ্রতিনিধি হবার ক্ষমতা রাখে। সাধারণ একজন কৃষক, শ্রমিক, কিংবা ছাত্র, শিক্ষক এর পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহন করে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়া সম্ভব নয়, অর্থের সমস্যা তো আছেই। বড়জোর তারা কোন দলীয় সংগঠনের লেজুরবৃত্তি করতে পারবে। এ কারণে নির্দিষ্ট কিছু পেশাজীবি (আইন কিংব ডাক্তার) শ্রেনীর বাহিরে অন্যান্য পেশাজীবিদের প্রতিনিধি হিসেবে সচারচর দেখা যায় না। আর এ সুযোগে সেই জায়গা গুলো নিচ্ছে ব্যবসায়ী শ্রেনী এবং রাজনীতিকে একটি পেশা হিসেবে নেওয়া এক শ্রেনীর, যাদের অধিকাংশই আবার মুলত ব্যবসায়ী।

তাহলে এ পর্যন্ত মুল যে বিষয়টি বলার চেষ্টা করেছি তা হল বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের প্রতিনিধিত্ব কোনভাবেই করে না। প্রতিনিধিত্ব করে সংখ্যালঘু অভিজাত এক শ্রেনীর যাদের গড় আয় মধ্যবিত্তের আয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এরাই অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক, আবার এরাই এখন আইন প্রণয়নকারী। তাই এ রকম শাসন ব্যবস্থা আসলে গণতন্ত্রের নামের আড়ালে অভিজাত শ্রেনীর শাসন। প্রকৃত গণতন্ত্র আমরা তখনই বলতে পারি যখন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেনীর প্রতিনিধি থাকবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, অভিজাত শ্রেনীর নয়।

Thursday, February 25, 2010

ছাত্র রাজনীতিঃ পক্ষ-বিপক্ষ

বিগত কিছুদিনের ছাত্র সংঘর্ষে সবার সামনে আবারো ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা/অপ্রয়োজনীয়তার প্রশ্নটি চলে এসেছে।মানুষ পক্ষ এবং বিপক্ষ এই দু’দলে বিভক্ত, কিন্তু আপাত সহজ কোন সমাধান কারোর কাছেই নেই। দু’পক্ষরই উদ্দেশ্য বর্তমান ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত মুক্ত করা, শুধু তাঁদের পন্থা ভিন্ন। যারা ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে তাঁদের যুক্তি হল বর্তমান ছাত্র রাজনীতির দৈন্যদশাঃ দলীয় কোন্দল, চাঁদাবাজি, হল দখল, সংঘর্ষ, মৃত্যু। তাই তাঁরা এই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে। অন্য পক্ষ যারা ছাত্র রাজনীতি বলবৎ রাখার পক্ষে তাঁরাও এই দৈন্যদশার অবসান যে চান না তা নয়, কিন্তু এ জন্য তাঁরা সরাসরি ছাত্র রাজনীতিকে দায়ী করতে রাজী নন। বরং ছাত্র রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সত্যিকার ভাবে দায়ি যে কারণ গুলো তা খুঁজে বের করার পক্ষপাতি, যদিও সমস্যার মূলে খুব কম মানুষই যায়। একটি কথা বারংবার আলোচনায় উঠে আসে তা হল দলীয় লেজুড়ভিক্তিক ছাত্র রাজনীতির কারণেই আজ এই দশা, কিন্তু এর সহজ কোন সমাধান কেউ বলতে পারেন না। কিভাবে বর্তমান অবস্থায় ছাত্র রাজীতিকে দলীয় প্রভাব মুক্ত রাখা সম্ভব সেটা নিয়ে কেউ আলোচনা করেন না। এ কারণে সহজ সমাধান হিসেবে আমরা পাই ছাত্র রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করাকে।

মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে একটি বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরী বলে মনে করি। প্রশ্ন হল রাজনীতি বলতে আমরা কি বুঝি? রাষ্ট্রের বা সরকারের বা জনগণের বিভিন্ন সমস্যা, সুযোগ সুবিধে, ভাল মন্দ নিয়ে কথা বলা বা সমালোচনা করা কি রাজনীতি? বর্তমানে পাহাড়ের অস্থিতিশীলতা নিয়ে কথা বলা বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা বলা কি রাজনীতি? নাকি এই সব বিষয়ে ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসাবিদ, প্রকৌশলীবিদ, সামরিকবিদ বা সরকারী চাকুরীজীবি বা খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলা অনুচিত? ছাত্রদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলা বা শিক্ষকদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে বা শ্রমজীবি মানুষের নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলা কি রাজনীতি? তাহলে রাজনীতি কি শুধু নির্বাচনে প্রতিদন্দ্বীতা করা আর না করার মাঝেই সীমাবদ্ধ? নাকি চাঁদাবাজি, হল-দখল, জমি-দখল, খাল-দখল, সন্ত্রাস এই সব হল রাজনীতি।

আমার মনে হয় না রাজনীতির মাঝে এই সব সন্ত্রাস কেউ চাইবে বা এগুলোকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে কেউ থাকবে। তাহলে বাকি রইল দেশ ও দেশের মানুষের বা নিজেদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এর কি প্রয়োজন আছে বা ছাত্রদের, শিক্ষকদের, বিভিন্ন পেশাজীবিদের বা শ্রমজীবি মানুষের কি দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে? আপনার কি মনে হয়? আর দেশের কথা যদি এই সকল শ্রেনীর মানুষেরা চিন্তা না করে তবে কারা তাঁদের পক্ষে চিন্তা করবেঃ কর্পোরেট ব্যবসায়ীবৃন্দ আর বিদেশী কূটনীতিকবৃন্দ?

যদিও লেখাটির মূল আলোচনা ছাত্র রাজনীতি নিয়ে কিন্তু আমার মতে ছাত্র রাজনীতি পৃথক কোন বিষয় নয়। এর সাথে শিক্ষক রাজনীতি , বিভিন্ন পেশাজীবিদের রাজনীতি বা শ্রমজীবি সংগঠনের বিষয়গুলো সম্পৃক্ত। কোনটিকে অন্যটির থেকে পৃথক করে দেখার অবকাশ নেই। দলীয় লেজুরভিক্তিক ছাত্র সংগঠন বা শিক্ষক সংগঠন বা পেশাজীবি বা শ্রমজীবি সংগঠনের বিরোধিতা আমিও করি কিন্তু সেই সঙ্গে এও বলতে চাই যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই সব সংগঠনের প্রয়োজনীয়তাও অপরিসীম। প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্কের অধিকার রয়েছে এবং উচিতও প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সজাগ থাকা এবং সে আলোকে নিজের মতামত প্রদান করা। কোন আইন করে নির্দিষ্ট কোন গোষ্ঠী বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয় যদি না সে গোষ্ঠী বা সংগঠন আদর্শগত ভাবে হিংসাত্বক বা ধ্বংসাত্বক কাজে যুক্ত থাকে। তাই আইন করে ছাত্র বা শিক্ষক বা কোন পেশাজীবি বা শ্রমজীবি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা সম্ভবপর নয় বা করাও উচিত নয় বলে আমার মনে হয় । তাহলে এই গোলক ধাঁধার কি কোন সমাধান নেই? দলীয় লেজুড়বৃত্তি ব্যতীত সংগঠন কি সম্ভবপর নয়? সবাই দলীয় লেজুড়বৃত্তি মুক্ত সংগঠন কামনা করেন কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব সেটা নিয়ে কেউ আলোকপাত করেন না। আমি এখানে একটি সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করতে চাই।

আমার মতে এর একটি মূল কারণ হচ্ছে আমাদের বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতির একটি বড় দুর্বলতা এবং তা হল সঠিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অক্ষমতা। আঞ্চলিক ভেদে জনসংখ্যার অনুপাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠির প্রকৃত চিত্র চিত্রিত করে না। বর্তমান জনপ্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি পুরোপুরি দলীয় নির্ভর নির্বাচন পদ্ধতি। এখানে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত না হয়ে দলীয় প্রতিনিধি নির্বাচন হয়। বাস্তবতায় জনগণও ব্যক্তিকে ভোট না দিয়ে একটি দলকেই ভোট দেয়। এই চিত্রটি যে শুধু আমাদের দেশেই তা নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অগ্রসর দেশেগুলোতেও জনগণ দলকেই নির্বাচন করে। এ কারণে সে সব দেশেও ঘুরে ফিরে একেক বার একেক দল সরকার গঠণ করে। দলীয় ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি খুব কমই দলীয় আনুগত্যের বাহিরে যেতে পারেন। তাই এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কখনই জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে গমণ করেন না। এই চিত্রটি করুণ আকার ধারণ করে উন্নয়শীল বা অনুন্নত দেশগুলোতে যেখানে শিক্ষার হার অনেক কম এবং দারিদ্রের হার অনেক বেশি। দলীয় আনুগত্য তখন সকল প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে এবং সেটারই বহিঃপ্রকাশ দেখি দলীয় লেজুরভিক্তিক সংগঠন গুলোতে।

তবে আনুগত্য শুধু দলের প্রতি সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়। বর্তমান পদ্ধতিতে যেহেতু ছাত্র বা শিক্ষক বা শ্রমিক বা পেশাজীবিদের সরাসরি আইন প্রণয়নে কোন ভুমিকা থাকে না তাই তাঁদের যে কোন কিছুর জন্য আঞ্চলিক জনপ্রতিনিধির পেছনেই অবস্থান নিতে হয়। এভাবেই জনপ্রতিনিধিরা হয়ে উঠেন ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে, এবং এভাবেই তাঁরা বিভিন্ন পেশাজীবিদের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠে আর এভাবেই শুরু হয় দলের ভেতরেও উপদল। দলীয় লেজুরভিক্তিকতার পাশাপাশি এই ব্যক্তিনির্ভরতাও দায়ী পেশাজীবি ও শ্রমজীবি সংগঠন গুলোর মাঝে সন্ত্রাসের বিষ ছড়াতে। তাই আমাদের প্রয়োজন এই পেশাজীবিদের সরাসরি সরকার ব্যবস্থায় প্রবেশ করানো যেন তাঁদের অন্যদের উপর নির্ভর না করতে হয়।

এ কারণে আমি মনে করি প্রকৃত রিপ্রজেন্টেটিভ বা জনপ্রতিনিধি শুধু অঞ্চলভেদে নির্বাচন না করে জনগণের মাঝে যত প্রকার বৈচিত্র রয়েছে সব ক্ষেত্র হতেই স্যাম্পল আসা উচিত। তাই অঞ্চলভেদে প্রতিনিধির পাশাপাশি প্রতিনিধি আসা উচিত বয়স অনুপাতে, ধর্মীয় বিশ্বাস অনুপাতে, বিভিন্ন পেশাজীবিঃ ছাত্র, শিক্ষক, চিকিতসা, প্রকৌশলী অনুপাতে,, বিভিন্ন শ্রমজীবি পেশা অনুপাতে, লিঙ্গ অনুপাতে। অর্থাৎ প্রতিটি বিভাগ হতেই প্রতিনিধি নির্বাচন করে যে সরকার ব্যবস্থা গঠিত হবে সেখানে সকল মানুষের মনোভাব উঠে আসবে। অন্যথায় জনগণ এর চিন্তার সাথে সরকারের চিন্তার মাঝে পার্থক্য রয়ে যাবে।

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে এভাবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা কতটা বাস্তব সম্মত। যদি শুধু মাত্র ছাত্র প্রতিনিধির কথাই উদাহরণ হিসেবে বলি তবে প্রতিটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল একটি মাত্র ছাত্র সংসদ থাকবে যারা নির্বাচিত হবে সরাসরি ছাত্রদের ভোটের মাধ্যমে। এভাবে প্রতিটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত সংসদ নির্বাচন করবে তাঁদের কেন্দ্রিয় কার্যনির্বাহী পরিষদ ও সভাপতি। নির্বাচিত সভপতি একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য (দু’বছর) সংসদে উক্ত সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন। এভাবে প্রতিটি পেশাজীবি বা ধর্মীয় গোত্র বা আদিবাসী সহ সকল শ্রেনীর মানুষ তাঁদের নিজ নিজ সংগঠনের মাধ্যমে তাঁদের প্রতিনিধি পাঠাবেন সংসদে। এই প্রক্রিয়া আরো সহজতর করা সম্ভম তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে। প্রতিটি প্রাপ্তবয়ষ্ক নাগরিক যখন ভোটার হবেন তখন তিনি তাঁর বয়স, ধর্ম, পেশা, অঞ্চল এগুলো উল্লেখ করবেন। পরবর্তীতে নির্বাচনের সময় তিনি তাঁর ক্যাটাগরি অনুসারে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে একই ব্যক্তি একই সংসদে নিজ নিজ বয়স, ধর্ম, পেশা ও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমের সংসদকে আরো প্রতিনিধিমুলক করবেন।

এই ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় চলে আসে। এক কক্ষ বিশিষ্ট বনাম দু’কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ। আমি ব্যক্তিগত ভাবে দু’কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পক্ষপাতি। বিভিন্ন পেশা, ধর্ম, বয়স এবং অঞ্চল অনুপাতে যে সংসদ গঠিত হবে সেটাকে আমি যেহেতু প্রকৃত প্রতিনিধিমুলক বলে মনে করি তাই এই সংসদকে আমি রাখতে চাই উচ্চ কক্ষে যাঁদের কাজ হবে কেবল আইন প্রণয়ন বা বিভিন্ন জাতীয় নীতি প্রণয়ন বা সংবিধান পর্যালোচনা করা। শুধু মাত্র অঞ্চলভেদে একটি সংসদ (বর্তমান সংসদ) হতে পারে যাঁদের কাজ হবে দেশ পরিচালনা করা এবং জনগণের করের অর্থের যথার্থ ব্যবহার করা সংবিধান অনুসারে। নিম্ন কক্ষ হবে দেশের নির্বাহী বিভাগ এবং উচ্চ কক্ষ হবে আইন প্রণয়নকারী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ হবে আইন প্রয়োগকারী বিভাগ। আবার শুধু মাত্র একটি সংসদ দিয়েও দেশ পরিচালনা সম্ভবপর হবে যদি সেই সংসদে সকল শ্রেনীর জনগণের প্রতিনিধির উপস্থিতি থাকে। সে ক্ষেত্রে সংসদ হবে সকল ক্ষমতার উৎস এবং সরকার হবে সংসদের একটি ক্ষুদ্র অংশ। কিন্তু বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ এবং সরকার একই প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সরকারের বা সংসদের জবাবদীহিতার কোন উপায় নেই। ভোটাধিকার প্রয়োগ হচ্ছে জনগণের ক্ষমতার উৎস এবং সেই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন জনগণের চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে বারংবার ব্যর্থ হয় তখনই জনগণ অসিহুষ্ণ হয়ে ধ্বংসাত্বক পথ অবলম্বন করে। তাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে জনগণের অবস্থান নিশ্চিত করার জন্যই প্রয়োজন সংসদে সকল শ্রেনীর প্রতিনিধি প্রেরণ।

রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমার দেশের সমস্যা এবং সরকারের ভাল মন্দ নিয়ে কথা বলার অধিকার রয়েছে। তেমনি অধিকার রয়েছে যে কোন সংগঠনে জড়িত হবার হোক না তা বিজ্ঞান ভিক্তিক কিংবা সাংস্কৃতিক ভিক্তিক বা ধর্ম ভিক্তিক বা রাজনীতি ভিক্তিক। নিজে ছাত্র বা শিক্ষক হয়েও যদি নিজের শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যহত না করে দেশ গঠনে বা সমাজ গঠনে কোন ভুমিকা রাখতে পারি তবে তা কেন করবো না। কিন্তু আজ কোন আইন করে যদি বলা হয় যে ছাত্রত্ব/শিক্ষকতা অথবা দেশ গঠনের মাঝে কেবল একটিকেই বেছে নিতে হবে তাহলে তা কতটা যুক্তিযুক্ত? কিছু ছাত্র বা শিক্ষক ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে রাজনীতিতে যুক্ত হয় যাঁদের মাঝে নৈতিকতার কোন চিহ্ন নেই। তাঁদেরকে শাস্তি প্রদানের জন্য যদি সকল ছাত্র বা শিক্ষক সমাজের উপর আঘাত আনি সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত? শিক্ষক সমাজকে আমি মনে করি একটি জাতির চক্ষু স্বরুপ এবং একজন শিক্ষককের হওয়া উচিত একজন দার্শনিকের মত। তিনি শুধু পাঠ্যবই থেকেই শিক্ষা দিবেন না তিনি সেই শিক্ষাকে নিজের মাঝে ধারণ করবেন যা থেকে ছাত্ররা বা সমাজের অন্য ব্যক্তিরা শিক্ষা লাভ করতে পারে। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে আজ সেই শিক্ষক সমাজ নেই। সমাজের অবক্ষয়ের এটাও একটি কারণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা প্রবেশ করেছি এটা সত্য , কিন্তু সেই সাথে উপেক্ষা করেছি শিক্ষক সমাজকে আর মাথায় তুলে নিয়েছি জনপ্রতিনিধিদের। একজন জনপ্রতিনিধি কেবল দেশকে শাসন করতে পারে, কিন্তু একজন শিক্ষক দেশকে বা সমাজকে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তাই প্রয়োজন উন্নত চরিত্রের মানুষদের শিক্ষকতার পেশায় আসা এবং সাথে সাথে রাজনীতিতেও আসা।